এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  উপন্যাস

  • দেখা না দেখায় মেশাঃ পর্ব ৫

    Ranjan Roy লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | উপন্যাস | ০৫ আগস্ট ২০২৫ | ২২ বার পঠিত
  • দেখা না দেখায় মেশাঃ পর্ব ৫

    জয় জয় দেবি চরাচরসারে

    নাহ্‌ এর পরে আর কোন অসুবিধে হয় নি।
     মোহিনী আমার বাড়িতে এল ‘টুকরো টুকরো গ্যাং’ হয়ে প্যাকিং বাক্সে বন্দী অবস্থায়। 
    অর্থাৎ যাকে কোম্পানির অফিসে দেখেছিলাম তাকে ডিসম্যান্টল করে প্যাক করে পাঠিয়েছে। 
    তবে তার আগে কিছু পরিবর্তন করতে হোল।
     যেমন, আমার কথায় লিপস্টিকের গাঢ় রঙ মুছে প্রায় স্কিন কালারের কাছাকাছি করা, আর ওদের হেড অফিসের দাক্ষিণ্যে স্পেশাল ফীচার --
    মানে সেফটি মেজারের ব্যাপারটা ওর মধ্যে ইনস্টল করা।

     ‘আশ্চর্য প্রদীপ’ কোম্পানির ডেলিভারি ভ্যান যখন এল কৌতূহলী পড়শিরা ভাবল আমি বোধহয় নতুন ফ্রীজ বা ওয়াশিং মেশিন কিনেছি।
     
    সঙ্গে এল সার্ভিস ইঞ্জিনিয়র ও দু’জন মেকানিক। ওরা এসে প্যাকিংগুলো আমার দেখিয়ে দেয়া কামরায়, মানে রীমার কামরায়, নিয়ে গিয়ে চটপট খুলতে শুরু করল।
     প্রথমে কিছু বক্স, কেবল ও প্লাগ এবং সকেট বেরোল। একজন মেকানিক রীমার প্লাগের সকেটগুলো টেস্টার দিয়ে চেক করে দেখল। 
    তারপর কেবলগুলো ফিট করে সাপ্লাই লাইন টেস্ট করে একটা বাক্সমত বের করে তাতে জুড়ে দিল। বাক্সের গায়ে চারটে ডায়াল ও কয়েকটি সুইচ। 
    সাপ্লাই অন করতেই ডায়ালের কাঁটাগুলো কেঁপে উঠে নড়তে শুরু করল।  

    এখন অনেকগুলো প্যাকিংবাক্স খোলা হচ্ছে। এগুলোর সাইজ একটু বড়।
     এবার মোহিনীর দেখা পাবো। আমার মোহিনী!
    আমার? কথাটা কেমন বেসুরো লাগছে না? লোকে যেমন বলে—আমার ছেলেমেয়ে, আমার বৌ, আমার বাড়ি, আমার গাড়ি।
    কিন্তু মোহিনী কি তাই? আমার সম্পত্তি?
     শেষে তুমিও অবিনাশ! নারীর অবজেক্টিফিকেশন? এত্‌ তু !

    --বাজে বোকো না। মোহিনী  কোন নারী নয়, আমার একলা সময়ের সাহচর্য দেবার মেশিন।
    --মেশিন? ঠিক বলছ?
    --তাছাড়া আর কী? আমি পছন্দমত অর্ডার করে একগাদা পয়সা দিয়ে ঘরে এনেছি।
    --ঠিক ঠিক। যেমন গাঁয়ের গরীব ঘরের মেয়েকে পাইক পাঠিয়ে তুলে আনে? 
    আর বাপের মুখ বন্ধ করতে একগাদা টাকা দেয়? 
     
    --ওহে অবিনাশ- নম্বর টু! ওসব সিনেমায় হয়, সিরিয়ালে হয়। আজকাল কোথাও হয় না।
    --হয় না মানে? চোখ বুঁজে থাকো নাকি? আচ্ছা, তার আগে বল এই নাম্বার টু কী ?

    --ছোটবেলায় হোস্টেলে দিয়েছিল। দেখি একজন রোগাপটকা সিনিয়র দাদাকে সবাই ডাকে পালোয়ান বলে। আর একজন কম সিনিয়রকে পাল্টু । আমি ভেবেছিলাম পল্টু হবে।
     পরে বুঝলাম আসলে দুজনের একই নাম—তপন পাল। তাতে বিপত্তি। ফলে সিনিয়রকে ডাকনাম দেয়া হোল তপন পাল- ওয়ান, অন্যজন পাল- টু।
     মুখে মুখে ওগুলো সন্ধি হয়ে পালোয়ান আর পাল্টু হয়ে গেল।
     
    --তার সঙ্গে আমাদের কী সম্পর্ক? আমি অবিনাশ টু? নাম্বার টু! তার মানে তুমি নাম্বার ওয়ান! বলি কোন গুণে?
    --দেখ, আমরা দু’জন অবিনাশ, একজন ভেতরে মানে তুমি। আর বাইরে আমি।
     তাই নম্বর ট্যাগ লাগিয়ে দেয়া, নইলে কনফিউশন হতে পারে।
     
    --কার কনফিউশন?
    --ভগবানের, মানে যে জন্ম দিয়েছে।
    --জন্মদাতারও সন্তানকে চিনতে ভুল হয়?

    --হয় তো! সেই যে রাজস্থানের বিখ্যাত লোকগাথা – গাঁয়ের বাইরে এক চালাঘরে থাকত আধবুড়ো স্বামী স্ত্রী। 
    ওরা টাকার লোভে রাতে কোন অতিথি আশ্রয় চাইলে তাকে খাইয়ে দাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে কেটে ফেলত।
     সেবার বহুদিন বাদে তার নিরুদ্দেশ হওয়া ছেলে এল অতিথি সেজে। সঙ্গে মালকড়ি ভালই। ইচ্ছে করে পরিচয় দেয় নি। 
    ভেবেছিল—দেখি, সকাল নাগাদ বাবা মা আমায় চিনতে পারে কিনা।
     অন্ততঃ দশমাস দশদিন পেটে ধরেছিল যে সে কি আর চিনবে না?  সকাল হোক, সুর্য উঠুক।

    সেটাই কাল হল। সূর্য আর উঠল না। 
    ওর বাবা মা রাত্তিরে কুড়ুল দিয়ে ছেলেকে কুপিয়ে মেরে ফেলল। 
    সকাল বেলা ছেলেটার ঝোলায় কাগজপত্তর দেখে চিনতে পেরে কী কান্না। কিন্তু যা হবার তা হয়ে গিয়েছে।  

    --যত্ত বাজে গল্প! সে যা হোক, ভগবানের ভুল হয় কী করে?  
    -- ধর দুই যমজ সন্তান, মাথার চুল থেকে পা’য়ের নখ অব্দি একরকম। 
    আর এরকম হলে নিজের বৌ চিনতে পারে না তো অন্যে পরে কা কথা! সেক্ষপীর এই নিয়েই তো কমেডি অফ এরর্স লিখেছিলেন।
     তাতে একজোড়া যমজের হাঙ্গামা। আমাদের বিদ্যাসাগর মশাইও কম নন। 
    ‘ভ্রান্তিবিলাস’ নামে ওর একটা মারকাটারি বাংলা অনুবাদ নামিয়েছিলেন।
     
    --গোলপোস্ট সরাবে না। আমি তোমার ভেতরে আছি, যাত্রাদলের বিবেক। তাই আমি একনম্বরী।
     আর তুমি শালা আমাকে চোখ মেরে রাজ্যের দু’নম্বরী করে বেড়াও। অতএব, তুমিই দুনম্বরী অবিনাশ।  

    --একটু বাড়াবাড়ি হচ্ছে না কি? তুমি হলে পিঞ্জরে বসিয়া শুক। ভেতরে মৌরসীপাট্টা গেড়ে বসে আছ, কোন কাজ নেই, তাই লেকচার ঝাড়ছ।
     আমাকে করে খেতে হয়। রিয়েল ওয়ার্ল্ডে।ে
     এই দুনিয়ায় লক্ষ্যপ্রাপ্তির জন্য কিছু সমঝোতা, কিছু কম্প্রোমাইজ  করতে হয়। নইলে চাকা ঘোরে না।
    এমন সমঝোতা কে করেন নি? ইতিহাসের পাতা উলটে দেখ। যত নামকরা, সবার প্রণম্য, সবাইকে করতে হয়েছে।
     আমাদের দেশে গান্ধীজি, নেতাজি, শ্যামাপ্রসাদজী—সবাই করেছেন।  

    --ঢপ দিচ্ছ?
    --কাকে? তোমাকে মানে নিজেকে?  দেখ, ঝাঁপির ঢাকনা খুললাম। হিসেব মিলিয়ে নিও।

    গান্ধীজি মধ্যপ্রাচ্যের আধুনিক তুর্কী নেতা কামাল পাশার বদলে সমর্থন দিলেন খিলাফত আন্দোলনকারীদের। 
    ওদের দাবি কী—না, অটোমান সাম্রাজ্যের গদিতে আগের মতই ওদের ধর্মগুরু ক্যালিফ বা খলিফা আসীন হবেন। 
    আশা ছিল, এর ফলে দেশের মুসলিম সমাজ স্বাধীনতা আন্দোলনে হিন্দুদের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে—ইত্যাদি। 
    তাতে কী লাভ হয়েছিল সবাই জানে।
     
    নেতাজি সুভাষ যখন জার্মানীতে গেছেন তখন হিটলার ইহুদীদের দলে দলে গ্যাস চেম্বারে পাঠাচ্ছেন। নেতাজি সেবারে ১৯৪১ থেকে ১৯৪৩ অবধি বার্লিনে ছিলেন। 
     কিন্তু বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণহত্যা নিয়ে নেতাজি রা কাড়েন নি। লাভ কিছু হয় নি। 
    হিটলার দু’বছর বসিয়ে রেখে নেতাজিকে জাপান যেতে বললেন।  আত্মজীবনী মেইন ক্যাম্পফে ভারতীয়দের সম্বন্ধে যা তা বলেছেন।
     শেষে এত বছর পরে তাঁর দাদা শরৎ বসুর নাতনি শর্মিলা বসু নেতাজির এই সমঝোতা নিয়ে বিশ্বের ইহুদী সম্প্রদায়ের কাছে চিঠি লিখে ক্ষমা চাইলেন।
     
    শ্যামাপ্রসাদ হিন্দু মহাসভার নেতা হয়ে ইংরেজ শাসনের অধীন ফজলুল হক মন্ত্রীসভায় যোগ দিলেন। ‘’ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন দমনের জন্য কী করা উচিত –তা নিয়ে ইংরেজ সরকারকে পরামর্শ দিলেন।
     
    বামপন্থীরা আরও সরেস। যেই হিটলার চুক্তি ভেঙে রাশিয়া আক্রমণ করল, অমনই ব্রিটেন আর শত্রু রইল না, জনযুদ্ধে পার্টনার হয়ে গেল।
     কমিউনিস্টরা সরকারের হয়ে র‍্যাশন বিলির কাজে লেগে পড়লেন।

    --যাকগে, ওসব পুরনো কথা। তুমি যে কথাটা বললে সেটা নিজে বিশ্বাস কর? টাকার জোরে গরীবের মেয়েকে তুলে আনা, জাতপাতের প্রশ্নে দলিতদের ঠ্যাঙানো—এসব বাস্তবে বন্ধ হয়ে গেছে, শুধু সিরিয়ালে দেখা যায়? 
    গ্রামের ব্যাংকে কাজ করেছ। এসব কিছুই দেখ নি ? 
    কোন ঘটনা মনে পড়ছে না? অন্ততঃ একটা ঘটনা বল, তাহলে বুঝব তুমি চোখ বুঁজে ছিলে না।  
    --না, এমন কিছুই মনে পড়ছে না।  

    -- বেশ, মনে করিয়ে দিচ্ছি। ছোট্ট রেল স্টেশনের পাশে কয়লার গুদাম। সেখানে তুমি লাইনের ওপারে নতুন ব্র্যাঞ্চ খুলিয়েছিলে। 
    ওখানকার সবচেয়ে বড় ধান-চাল-মশলার ব্যাপারীর দুই ছেলের সঙ্গে ভাল পরিচয় হোল। 
    ওদের ক্রেডিট লিমিট দিলে। ওদের বাড়িতে গেলে।
    যাবার পথে দলিত বস্তি। তোমার চোখে পড়ল চারপাশের ঝুপড়ির মধ্যে একটি ছোট পাকাবাড়ি, জানলায় এসি মেশিন।
     তুমি অবাক। দুইভাইকে জিজ্ঞেস করায় ওরা কেঠো জবাব দিল—আমরা কী জানি! এসব দলিত পাড়ার ব্যাপার।
     
    পরের দিন ব্যাংকের চাপরাশির থেকে জানতে পারলে ব্যবসায়ীর বড় সুপুত্তুর দলিত বাড়ির মেয়েকে রেপ করে হাতেনাতে ধরা পড়ে। 
    কেস তৈরি হয়। দশ বছরের জেল পাক্কা। 
    তখন থানেদার, উকিল এবং ছেলেটার বাবা মিলে আদালতের বাইরে সমঝোতা করে মেয়ের বাবাকে অনেক টাকা দিয়ে মুখ বন্ধ করায়।
     সেই টাকায় বাবা তার ঝোপড়া ভেঙে পাকাবাড়ি বানায়, তাতে এসি।
    এই হোল তোমার প্রাক্টিক্যাল কম্প্রোমাইজ! 
    এবার মেনে নাও যে তুমিই অবিনাশ নম্বর টু। আমি নম্বর ওয়ান।
     
    --আরে অমন কত কি চারপাশে ঘটছে, তার জন্য কি আমি দায়ী? তোমার বলা ওই ঘটনা? 
    সেটা আমি জানতে পারার কয়েক বছর আগে ঘটেছিল। তাতে আমার কি দায়?

    --না; তুমি ওখানে থাকলেও ঠেকাতে পারতে না। কিন্তু ঘটনাটা জানার পরে তুমি ব্যাংকের গ্রাহক দিবসে ওদের “বিশেষ সম্মানিত গ্রাহক” সার্টিফিকেট দিয়েছ, ওই হতচ্ছাড়া বাপ-ব্যাটার সঙ্গে ছবি তুলেছ; কোন আক্কেলে?

    বাথরুম থেকে চোখমুখে জল ছিটিয়ে রীমার ঘরে, থুড়ি, মোহিনীর ঘরে ঢুকি।
     
     
    একী! মোহিনী বেরোচ্ছে খণ্ড খন্ড হয়ে। হাত পা সব যেন ইলেক্ট্রিক করাতে নিপুণ হাতে কাটা।
     কাটা শরীরটাকে সাজিয়ে রাখা হচ্ছে টেবিলের উপর। যেন মর্গে শুইয়ে একটা মৃত শরীর।
     
    এবার টরসো, চোখ ফেরাতে গিয়েও পারি না। কোন গ্রীক দেবীর ভাস্কর্যের মত নিখুঁত অবয়ব। 
    কিন্তু তারপরে একটা প্যাকিং থেকে বেরিয়ে এল মাথাটা। কোঁকড়ানো চুল, কিন্তু চোখের কোটর খালি। মুখের ভেতর দাঁত ও জিভ গায়েব!
     
    আমার মুখ থেকে একটা অস্পষ্ট গালাগাল বেরিয়ে আসে। 
    ওদের ইঞ্জিনিয়ার অবাঙালী উচ্চারণে ভাঙা বাংলায়  বলে—ঘাবড়াইবেন না শ্রীমানজী , অক্ষিগোলক ও দন্তরুচিকৌমুদী সব আলাদা প্যাকিং করে আনা হয়েছে।
     
    আমার অবস্থা দেখে ওর মায়া হোল।
     
    --দুসরা ঘরে যাকে আরাম করুন। ফিটিং কমপ্লিট হলে আমি নিজে হাতে অক্ষিগোলক কোটরে বসিয়ে মোহিনী দেবীর প্রাণপ্রতিষ্ঠা করব। তখন আপনাকে ডেকে নিব। দেখে মিলিয়ে নিবেন –চোখের মণির রঙ  দাঁতের পাটি, চুলের স্টাইল সবকুছ অর্ডার মাফিক।  
     
    আমি বাথরুমে যাই। বমি পাচ্ছে।
     
    কয়েক দশক আগে আমার দেখা একটা ঘটনা।

    বিলাসপুর স্টেশনে ছত্তিশগড় এক্সপ্রেস ছাড়বে ছাড়বে করছে। এমন সময় কুলির মাথায় একটা ট্রাঙ্ক চাপিয়ে এক মহিলা এসে এস-৯ স্লীপার কোচে উঠলেন। 
    কুলি ট্রাঙ্কটি লোয়ার বার্থের নীচে ঢুকিয়ে দিয়ে মহিলার থেকে টাকা নিয়ে নেমে গেল। একটু পরে মহিলাও নেমে গেলেন। 
    বোধহয় খাবার দাবার কিছু কিনে নেবেন। কিন্তু গাড়ি ছেড়ে দিল।
     মহিলাটি আর ওঠেন নি। হয়ত পরের কোচে উঠেছেন। একটু পরে আসবেন।   

     টিকেট কালেক্টর এসে চেক করার সময় দেখা গেল কামরায় সমস্ত সীট ভর্তি। লোয়ার বার্থে আমি। অর্থাৎ এই কামরায় ভদ্রমহিলার বার্থ নেই। 
    সে না হয় হোল, তাড়াহুড়োয় অনেক সময় মানুষে কোচ ভুল করে। কিন্তু ট্রাঙ্ক তো নিয়ে যাবেন!
     
    পরের দিন সকালে ট্রেন ইটার্সি জংশনে থামলো। ভদ্রমহিলার পাত্তা নেই। 
    আমি গিয়ে কনডাক্টর ও গার্ডের কাছে কমপ্লেন লিখে দিলাম। পুলিশ এল। ট্রাঙ্ক ভাঙা হোল। 
    ভেতরে একটি কিশোরীর নগ্ন শরীর খন্ড খন্ড করে কেটে প্যাক করা।
     
    বাচ্চাটি বিলাসপুরের এক ব্যবসায়ী সমাজের প্রতিষ্ঠিত পরিবারের। দু’দিন পরে স্থানীয় খবরের কাগজে একটা বিজ্ঞাপন বেরোল। 
     
    ---এই ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ডের অপরাধীর ব্যাপারে সঠিক খোঁজ দিতে পারলে সমাজের কমিটির তরফ থেকে পঁচিশ হাজার ইনাম দেয়া হবে। 
     
    একটা দুটো গ্রেফতার।  সারা শহর ওই মহিলার আইডেনটিটি নিয়ে তোলপাড়।
    কিছুদিন পরে আরেকটি বিজ্ঞাপন—ইনাম দেয়ার ঘোষণাটি উইথড্র করে নেয়া হোল।  

    পরে কানাঘুষোয় শুনেছিলাম—হত্যা করেছেন ওই পরিবারেরই কোন মহিলা, বাচ্চাটির ঘনিষ্ঠ আত্মীয়া। পারিবারিক ঝগড়ার বদলা নিতে। 
    কেলেংকারি চাপা দিতে মোটা টাকা খরচ হোল। অপরাধী শাস্তি পেল না।  

    আজ মোহিনী নামের কৃত্রিম বুদ্ধিতে তৈরি এক নারী-রোবোর খণ্ড খন্ড টুকরো দেখে সেই দুঃস্বপ্ন আবার ফিরে এল।
     
    চোখমুখে ভাল করে জল দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। শুয়ে শুয়ে টিভি দেখতে দেখতে চোখ লেগে গেছল। 
    হঠাৎ মনে হোল কেউ আমার নাম ধরে ডাকছে—অবিনাশবাবু, এ বাবুমোশায়! জরা ইধার আইয়ে।
    সেই অবাঙালী ইঞ্জিনিয়ার ভদ্রলোক।  

    --আরে আপনার ঘরে একজন সুন্দরী মহিলা এসেছেন, লেকিন আপ তো ঘোড়া বেচকে সো রহে। চলিয়ে, উনকা স্বাগত করনা হ্যায়।

     ঘরের মেজেতে একগাদা ভাঙা প্যাকিং বাক্স, ইলেক্ট্রিক তারের টুকরো, নানা মাপের প্লাগের কভার, টুলকিট, টেপ, স্ক্রু –সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। 
    কিন্তু দেয়াল ঘেঁষে একটা সকেটের কাছে গা ঘেঁষে ইনি কে? 
    এক অল্পবয়েসি মেয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে, একেবারে “তন্বী-শ্যামা-শিখরিদশনা-পক্কবিম্বাধরষ্ঠী”—আমি কি ঠিক এইরকমই অর্ডার দিয়েছিলাম? 
    নাকি ওরা খানিকটা ‘মনের মাধুরী মিশায়ে’?
     
    ওর হাত দু’টি বুকের কাছে খানিকটা ‘নমস্তে’ মুদ্রায় জোড়া। মুখে কোন অভিব্যক্তি নেই। 
    যেন কাপড়ের দোকানে ম্যানেকুইন।  

    ইঞ্জিনিয়ার ভদ্রলোকটি আমার হাতে একটা অপারেটিং ম্যানুয়াল ধরিয়ে দিয়ে বলেন—আর দশ মিনিট। চার্জিং চলছে।  
    তারপর এই ছোট্ট বক্সে গ্রীন লাইট জ্বলে উঠবে। আর এই আপনার রিমোট। এই অ্যাক্টিভিটি বাটন টিপে আপনাকে তার কোড বলতে হবে।
     
    আপনি বলবেন—মাই ফেয়ার লেডি। ইয়োর নেম প্লীজ। ও জবাব দেবে—মোহিনী। অবিনাশ স্যার, কেমন আছেন? আপনি বলবেন –ভাল।
     
    ব্যস্‌ এরপর যে কাজ বলবেন। সারাদিন আর এই ড্রিল লাগবে না। কাজ করতে ডাকলে শুধু বলতে হবে—শুনছ মোহিনী? তাহলেই হবে। 
    রাত দুটো থেকে চারটে ওর ডিউটি অফ, রেস্ট নেবে। সেলফ চার্জিং হবে। দেখে নিন, এই প্লাগ থেকে ওর পেছনে একটা সকেটে গিয়ে চার্জ হচ্ছে। 
    ছোট্ট সকেট ওর কোমরের পেছনে ফিট করা আছে।

    ওই সময় ওকে কোন অর্ডার দেবেন না। আপনি শোয়ার সময় জলের বোতল ওষুধ সব মাথার কাছে একটা টিপয়ের উপরে রেখে দেবেন। 
    আর কোন ম্যালফাংশনিং দেখলে ব্রোশারের পেছনের পাতায় এই এমার্জেন্সি সার্ভিস নম্বরে ফোন করবেন।
     সাধারণ ইস্যুতে হেল্পলাইন নম্বরে করলেই হবে।
     
    আর হ্যাঁ, চার্জিং চলতে থাকলে ওর গায়ে বা কোমরে হাত দেবেন না। শক্‌ লাগতে পারে।

    আমার মাথায় রাগ চড়ে গেল।
     
    --চার্জিং অর নো চার্জিং, গায়ে বা কোমরে হাত দেবার কথা আসছে কোত্থেকে?
    --ভুল বুঝেছেন। ধরুন, কোন কারণে ওর হেল্প চাই, ঘরের মধ্যে পা পিছলে গেল, হোঁচট খেল—তখন আপনি কী করবেন?
    -- আমি কেন কিছু করব? ও রোবট, নিজে সামলে নেবে।
     
    লোকটি দাবড়ানি খেয়ে চুপ করে গেল। কিন্তু খিঁচিয়ে উঠল আমার নাম্বার ওয়ান।
    --এসব থিওরিতে ভাল শোনায়। কিন্তু সবচেয়ে ভদ্রপুরুষের চোখেও নারী মানেই ডিস্ট্রেসড্‌ ড্যামজেল। আর সে নিজে শিভালরাস নাইট।
     বাস্তবে নাইট হওয়ার মুরোদ নেই। তবু মনের মধ্যে ইচ্ছেটা আঁকুপাঁকু করে।
    --চোপ্‌!

    দশ মিনিট কেটে গেছে। সিনিয়র মেকানিক বুড়ো আঙুল তুলেছে। ইঞ্জিনিয়ারের ইশারায় আমি গিয়ে দাঁড়াই মোহিনী মুরতির মুখোমুখি।
    --নিন, রিমোট তুলে বাটন টিপে দিন। ফের দেখবেন ‘খুল্লা খেল ফারুকাবাদী’! 

    আমার হাত কাঁপছে। আমি মোহিনীর প্রাণপ্রতিষ্ঠা করছি। 
    কে? ঋত্বিক? হোতা? অধর্যু? নাকি দুর্গাপুজোর বোধনে ষষ্ঠীপুজোর পুরুত মশাই?

    --আরে কী হোল? তাড়াতাড়ি করুন। আমাদের অন্য জায়গায় যেতে হবে। ফোন আসছে।

    টিপে দিতেই মোহিনী নারী নড়ে উঠল। তার চোখ এখনও বন্ধ। আমি লিখে রাখা কোডের কাগজ হাতড়াই। তারপর কাঁপা কাঁপা ফ্যাঁসফেসে গলায় মন্ত্রোচ্চারণের মত থেমে থেমে বলিঃ
    --মাই ফেয়ার লেডি। ইয়োর নেম প্লীজ।

    মোহিনী মূর্তির কোন প্রতিক্রিয়া নেই। চোখের পাতা আগের মতই বোঁজা।

    --আরে ই কা? ইতনা নার্ভাস কিঁউ? আপনার ভয়েস ভাইব্রেশন অ্যানালিসিস করে আইডেন্টিফিকেশন কোড দেয়া আছে। নর্মাল আওয়াজে বলুন। এক গিলাস পানী পী লিজিয়ে। ফির বোলিয়ে। নর্মাল পিচ।

    এবার বলার সঙ্গে সঙ্গে মোহিনীর শরীর কেঁপে উঠল। ধীরে ধীরে চোখের পাতা খুলে গেল। 
    ও আমার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “মোহিনী। অবিনাশ স্যার, কেমন আছেন”?

    সবার চেহারায় উত্তেজনা। আমার মনে ছোটবেলায় পড়া সহজ পাঠের একটা লাইন খেলে যাচ্ছেঃ
    ‘মুখের চাদর সরিয়ে ফেলে বন্ধ চোখের পাতা মেলে
    আকাশ ওঠে জেগে’।
     
    মোহিনী জেগে উঠেছে। ওর শরীর জেগে উঠছে।
    --ছিঃ। তোমার মনের ময়লা কবে দূর হবে অবিনাশ টু?

    ইঞ্জিনিয়ার ভদ্রলোকের নামটা জানা হয় নি। উনি আমার কাঁধ খিমচে ধরেছেন।

    --আরে কী হোল বাবুমশায়? ভেরিফিকেশন কোড! ভেরিফিকেশন কোড! দু’মিনিট টাইম। এক মিনিট হোয়ে গিয়েছে।

    আমার কিস্যু মনে নেই। ব্ল্যাকবোর্ড সাফ। মোহিনী আমায় অপলকে দেখছে।

    --বলুন ‘ভালো’। ‘ভালো’ বলুন। ভেরিফিকেশন কোড। দশ সেকেন্ড টাইম।
    আমি যান্ত্রিক ভাবে বলি—‘ভালো’।
     
    মোহিনীর চোখের পাতা ফরফর করে। তারপর মাথা ঝুঁকিয়ে বলে—বলুন, আপনার কী চাই স্যার।
    আমার কী চাই? কিছু না। যা পেয়েছি তাতেই খুশির সীমা নেই।  

    কিন্তু মোহিনী যে অপেক্ষায় আছে।

    হাততালি! হাততালি!
    “আশ্চর্য প্রদীপ” কোম্পানির স্টাফ তালি বাজাচ্ছে। ওরা পারফরম্যান্স বোনাস পাবে।
    --মোহিনী, তুমি এক কাজ কর। আমাদের পাঁচজনের জন্য  কফি আর ক্রিমক্র্যাকার বিস্কিট নিয়ে এস। কিচেনের প্ল্যাটফর্মে সব পাবে।

    --পাঁচজন স্যার? চারজন দেখছি, আরেকজন?
    --কেন, তুমিও আমাদের সঙ্গে খেয়ে নাও। নিজেকে আমার পরিবারের একজন ভাব।
    --সরি স্যার, আমি কিছু খাই না।
                                                                                   (চলবে)

     

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ০৫ আগস্ট ২০২৫ | ২২ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। সুচিন্তিত প্রতিক্রিয়া দিন