দেখা না দেখায় মেশাঃ পর্ব ৭
থর থর করি কাঁপিছে ভূধর
শিলা রাশিরাশি পড়িছে খসে।
রীমাকে নিয়ে পুরী এসেছি। হরিয়ানার মেয়ে, আরাবল্লী পাহাড় দেখেছে, ডালহৌসি দেখেছে—এমনকি ম্যাকলাউডগঞ্জ গেছে।
তাই ওর জন্যে সমুদ্রের আকর্ষণ বেশি। কলেজে পড়তে বন্ধুদের সঙ্গে গোয়া গিয়ে আরব সমুদ্রের স্বাদ চেখেছে।
কিন্তু বাঙালীর নিজস্ব সমুদ্র, পুরী আর দীঘা, দেখা হয় নি।
ট্রেন সামান্য লেট ছিল। স্টেশন থেকে রিকশা নিয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছি জায়গাটা, মানে যেখানে উঠব। না, হোটেল নয়, একটা OYO।
যখন অনলাইন বুকিং করেছিলাম তখন দেখাচ্ছিল সমুদ্রের পাশে। কিন্তু রিকশাটা এ’গলি সে’গলির ভেতর দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
ভোরবেলা, অধিকাংশ দোকানপাট এখনও খোলে নি। চারদিক শান্ত, নিঃস্তব্ধ।
ভুল করছি না তো! সমুদ্র দেখতে না পাই, তার ঢেউয়ের আওয়াজ? রীমা অবিচল।
হাসছে, একবার বলল—ভুল শহরে নেমে পড়নি তো! স্টেশনের নাম ঠিক দেখেছিলে?
আমি বিরক্ত, কিন্তু ঠিক খুঁজে পেলাম।
একটু গলির মধ্যে বটে। রিসেপশনে কথা বলে জানতে পারলাম—সমুদ্র পায়ে হেঁটে দশ মিনিট দূরে।
বুঝলাম, আমাকে বুকিং এর সময় অন্য ছবি দেখানো হয়েছে। যা হোক, দোতলার ঘরটা বেশ বড়।
জিনিসপত্র নামিয়ে চায়ের অর্ডার দিয়ে বাথরুমে গেলাম।
বেরিয়ে দেখি রীমা ব্যালকনির দরজা খুলে ওখানে রেলিং ধরে নীচের দিকে তাকিয়ে হাসছে। আমাকে ডাকছে—
‘অবু, শিগগির এস। দেখ, তোমার ভুল হয় নি। ঠিক জায়গায় এসেছি। আমাদের ব্যালকনির নীচে সমুদ্র। কী বড় বড় ঢেউ, দারুণ দারুণ!
সমুদ্রের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছ না’?
--কোথায়? আমি তো কিছুই শুনতে পাচ্ছি না?
--এই দেখ! এই দেখ।
রীমা ব্যালকনির রেলিঙের উপর উঠে দাঁড়িয়েছে। যেন পমেল হর্সের উপর দাঁড়িয়ে কোন জিমন্যাস্ট।
আমি ভ্যাবাচাকা। আমি স্ট্যাচু। গলা দিয়ে শব্দ বেরোচ্ছে না। কিন্তু কী সুন্দর দেখাচ্ছে রীমাকে!
রীমা দুই হাত উপরে তুলল, তারপর ওর নিজস্ব সমুদ্রে ঝাঁপ দিল।
কারও ঠান্ডা শক্ত হাত আমাকে নাড়াচ্ছে; নাঃ কুল পাড়ার মত ঝাঁকাচ্ছে বললেই ঠিক হয়। আর ওটা কি, আঁকশি?
--অবিনাশ স্যার, বুকের থেকে হাত নামান। জল খান। আপনাকে বোবায় ধরেছিল।
চোখ খুলি, ধীরে ধীরে উঠে বসি। না উঠে উপায় নেই।
বিছানা ঘেঁষে মোহিনী দাঁড়িয়ে। ভাবলেশহীন মুখ।
হাত বাড়িয়ে জলের গেলাস নিয়ে জিজ্ঞেস করি ক’টা বাজে।
--চারটে বিশ। পাশ ফিরে শুয়ে পড়ুন।
--তুমি কখন উঠেছ?
জিজ্ঞেস করেই খেয়াল হয় প্রশ্নটা বোকার মত করেছি। ও রীমা নয়, মোহিনী।
কোন নারী নয়, একটা মেশিন।
ওর ঘুম থেকে ওঠার বালাই নেই, চেয়ারে বসে আমাকে পাহারা দেয়।
ওর কর্তব্যপালনে ঢিলেমি নেই।
কিন্তু আমাকে অবাক করে মোহিনী বলে—কুড়ি মিনিট আগে, ভোর চারটে।
আচ্ছা, দুটো থেকে চারটে ও নিষ্ক্রিয়, রেস্ট টাইম। চার্জিং হতে থাকে। তাহুলে ওটাকেই ঘুমের সময় বলা যেতে পারে।
ঘুম এল না। উঠে থাইরয়েডের ট্যাবলেট গিলে সদ্য দেখা স্বপ্নের কথা ভাবছিলাম।
হ্যাঁ, স্বপ্নই বটে। বাস্তবে আমি রীমাকে নিয়ে পুরী বেড়াতে গেছি, দু’দুবার।
সমুদ্রের ধারের হোটেলেই উঠেছিলাম—একবার পুরী হোটেলে, আর একবার কোনারকের সরকারী গেস্ট হাউসে।
জলখাবারের টেবিলে আজ টোস্টের সঙ্গে ডিমসেদ্ধ ও কলা ছিল।
দ্বিতীয় চায়ে চুমুক দেবার সময় মোহিনী এসে বলল—স্যার, গ্রসারি।
--ঠিক আছে, যাচ্ছি। দেখে নিচ্ছি কী কী ফুরিয়ে গেছে।
রওনা হয়ে যাই।
মধু বিশ্বাসের দোকান থেকে মাসের সাপ্লাই আসে। গিয়ে লিস্টি ধরিয়ে দিয়ে চলে আসি। ঘন্টাখানেকের মধ্যে সাপ্লাই আসে; সঙ্গে বিল।
মুদি দোকান থেকে বেরিয়ে ঘরে ফিরতে ইচ্ছে করছিল না। ভাবলাম একটু হেঁটে আসি।
সেদিন মাঝরাতে সিরি নামক অ্যাপেলের অশরীরী নটি বয় আত্মাটির খিক্খিক্ হাসি আমাকে ভেতর থেকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল।
সিরি অমন করে হাসে? কেন হাসে?
কিন্তু মোহিনীর এক ধমক—হে সিরি, স্টপ ইট্ । তাতেই থেমে গেল?
আজ বিকেলে সল্ট লেকে বন্ধু সুপ্রিয়র পাড়ায় গিয়ে কফি খেতে খেতে আড্ডা দেব। তখন ওকে জিজ্ঞেস করতে হবে।
ও সফটওয়ার কোম্পানিতে কাজ করেছে। এসব বোঝে টোঝে। আমার মত ব্যাংকের বাঁধাধরা একঘেয়ে চাকরি নয়।
আর অনলাইন ব্যাংকিং শুরু হোল রিটায়ার হবার বছরে। ফলে না বুঝেও আমার কাজ চলে গেছে।
একটা কথা। সিরিকে নিয়ন্ত্রণ আমিই করব। ওটা মোহিনীর হাতে ছাড়ব না।
আমার অটোনমি টিকে থাকুক। নইলে মোহিনীর মত যন্ত্রমানবী ক্রমশঃ আমাকে গিলে খাবে।
রামায়ণের সেই রাক্ষসীর মত, সুরসা না সুরমা –কী যেন নাম।
পবননন্দন যখন লংকায় যাচ্ছিল তখন দেবতাদের আদেশে সুরসা রাক্ষসী বা নাগমাতা রাস্তা আটকে দাঁড়াল এবং হনুমানকে গিলে ফেলার জন্যে হাঁ-মুখ বড় করতে লাগল।
অবশ্যি আমি কোন হনু? আর মোহিনীর ম্যান্ডেট হোল আমার দেখাশুনো করা, আমার আদেশ মেনে চলা।
তাই ওকে রাক্ষসী বলা কি ঠিক? সে মেশিন হলেও নারী পদবাচ্য।
আজ মাথায় দুষ্টুবুদ্ধি চাপল। মোহিনীর সঙ্গে বৌদ্ধিক আলোচনার জন্য কোন বিষয় খুঁজে পাচ্ছিলাম না।
আর কে না জানে যে অলস মস্তিষ্ক মানুষকে দিয়ে শয়তানের চামচাগিরি করায়।
--শোন মোহিনী, একটা কথা বলতে চাই।
মোহিনী এসে আমার সামনে দাঁড়ায়—যেন আমার কোন পি এ।
--ইয়েস স্যার। মোহিনী প্রতীক্ষায় আছে। আমিও চুপ।
--ইয়েস স্যার?
এবার বলতেই হবে, নইলে আমাকে কী ভাববে? ম্যাদামারা, দুর্বল? কিন্তু আমি তো ওর বস, মালিকও বলা যায়।
আসলে বস্ যদি দুর্বল হয় তাকে কেউ মানে না। তাই মুখটাকে গম্ভীর করে বলি—এক গ্লাস জল দাও।
বিনা বাক্যবয়ে জল এসে যায়।
কিন্তু জল দিয়ে মোহিনী চলে যাচ্ছে না কেন? ওর ভাবা উচিত যে আমি ’জল দাও’ বলার জন্যেই ওকে ডেকেছি।
তাহলে ও দাঁড়িয়ে আছে কেন?
তবে কি শুকনো গাছের গুঁড়িতে যেমন কদাচিৎ কচি সবুজ পাতা দেখা দেয়, তেমনি ওর যান্ত্রিক হার্ড ডিস্কে বা সফটওয়ারে কিঞ্চিত মানবীয় অনুভূতির সঞ্চার হচ্ছে?
মানবীয় না মানবী অনুভূতি! বাজিয়ে দেখা যাক।
-শোন মোহিনী, একটা কথা বলব বলব করেও বলা হচ্ছে না। তুমি কি ভাববে!
--আমি কিছু ভাবি না স্যার। আমি আপনার হুকুম তামিল করি।
ধেত্তেরি! এতসব ভ্যান্তারা করে ফের সেই আমড়াতলার মোড়ে!
ঠিক কথা। ও একটা রোবো, ও ভাববে কেন? ভাবব তো আমি।
আমার ভাবনাই ওর ভাবনা, আমার ইচ্ছেই ওর ইচ্ছে।
মোহিনীদের কোন স্বতন্ত্র ইচ্ছে নেই, থাকতে পারে না।
যেমন সৈন্যদলের কোন ইচ্ছে বা ভাবার ক্ষমতা থাকতে পারে না। ওদের মন্ত্র, ওদের ট্রেনিং হোল—পুশ বাটন রেডিনেস।
সত্যিই তো, লড়াইয়ের ময়দানে সৈন্যরা যদি কম্যান্ডারের অর্ডারের নৈতিকতা, মানবাধিকার, হ্যানো ত্যানো নিয়ে বিচার করতে শুরু করে
তাহলে মার খেয়ে বাড়ি আসতে হবে।
এ কথাটা সবদেশের সৈনিকের জন্য সত্যি।
দেখুন, আমি যদি ফ্রন্টে দাঁড়িয়ে কাঁটাতারের ওপারে সৈনিকটিকে গুলি করার আগে ভাবতে বসি—
ওর বয়েস কত? কোথায় বাড়ি? সেখানে কে কে আছে—বৃদ্ধ বাবা মা? বৌ বাচ্চা? বাচ্চাটা কি স্কুলে যাবার বয়েসি, নাকি এখনও হামা দিচ্ছে,
তাহলে কি মর্টারের গোলায় ওর মুন্ডূটা উড়িয়ে দিতে পারব? নাকি হাতাহাতি লড়াইয়ে বেয়নেটে ওর পেটের নাড়িভুঁড়ি বের করার ইচ্ছে হবে?
সবচেয়ে বড় সম্ভাবনা হোল –ভাবাভাবির মাঝখানে আমারই মুন্ডূ যাবে।
তাই সৈনিক—সে যেকোন দেশেরই হোক—ভাববে না। মেশিনের মতন কাজ করবে।
ভাবার জন্য অন্য লোক আছেন।
তাঁরা খেল শুরু বলে হুইসল বাজালেই আমি সামনে যাকে পাব, তার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ব।
আবার খেলা শেষের বাঁশি বাজলে বন্দুকের নল মাটির দিকে নামিয়ে দেব।
তবু একবার চেষ্টা করে দেখতে ক্ষতি কি?
--শোন মোহিনী, আমি তোমাকে ভালবাসি। এই রে, বলেই ফেললাম।
মোহিনীর চেহারা ভাবলেশহীন। কিন্তু ও দাঁড়িয়ে আছে, স্থির।
--শোন মোহিনী, কিছু বল।
--স্যার, আমাকে কী করতে হবে?
--মানে? এই যে আমি তোমাকে একটা কথা বললাম , ভালবাসার কথা, তুমি কিছু বলবে না? মানে কী ভাবছ?
--স্যার, আমি ভাবি না। আদেশ পালন করি।
--বেশ, আমি তোমাকে আদেশ করছিঃ শোন মোহিনী! আমি তোমাকে ভালবাসি।
আমি চাই তুমিও আমাকে ভালবাসবে। এটা তোমার ডিউটি।
--স্যার, আমাকে কী করতে হবে? ভালবাসলে কী করতে হয়?
--সেকী, তুমি জান না?
--না স্যার! আমার ডিউটি লিস্টে ভালবাসা বলে কিছু নেই।
আপনার হেলথ, আপনার সিকিউরিটি নিয়ে প্রো-অ্যাক্টিভ এবং প্রি-এমটিভ অ্যাকশন নেবার নির্দেশ আছে।
কিন্তু ‘ভালবাসা” শব্দটা নেই।
--আচ্ছা, “লাভ” বলে কিছু?
--না স্যার।
আমার কানের পাশে একটা শিরা দপদপ করছে। এখন কী করব?
মোহিনীকে চলে যেতে বলি? নাকি আরেকবার কড়া করে চা বানিয়ে---।
এমন সময় ডিং ডং শব্দে কলিং বেল বেজে উঠল।
এই বেল রীমা লাগিয়েছিল। প্রোমোটারের লাগানো ক্যাররর ঘন্টি পুরনো জিনিসের সঙ্গে কাবাড়ি দোকানে গেল।
মুদি দোকানের জিনিসপত্র এসেছে। আমি ছেলেটিকে অপেক্ষা করতে বলে লিস্টির সঙ্গে জিনিস মেলাতে থাকি।
তারপর ইউপিআই দিয়ে পেমেন্ট করব।
কিন্তু লিস্টি মেলাতে গিয়ে আমার চোখ কপালে।
ছেলেটাকে রুক্ষ স্বরে বলি—এগুলো আমার বাড়ির অর্ডার নয়। তুমি ভুল করে অন্য কারও মালপত্র এনেছ।
ছেলেটা কাঁচুমাচু। কিন্তু জোর দিয়ে বলে ও ভুল করে নি।
আমি বিশ্বাসবাবুকে ফোন লাগিয়ে চেক করতে পারি।
ফোনের ওপাশ থেকে মধু বিশ্বাস বলে—রাগ করছেন কেন মেসোমশায়! আজ অবধি কোনদিন ভুল সাপ্লাই দিয়েছি?
--তা দাও নি। কিন্তু এবার কী করেছ? আমি একমাসের হিসেব করে চাল-ডাল-মশলাপাতির অর্ডার দিয়েছি।
তুমি তো দু’মাসের জিনিস পাঠিয়েছ। রাখব কোথায়? আর এটা কি—স্যানিটারি ন্যাপকিন?
তারপরও বলছ এগুলো অন্য বাড়ির নয়?
--একটু শুনুন। এখন তো আপনারা দু’জন। আপনার ভাইঝি না কে যেন এসেছেন! তাই ডাবল করে পাঠালাম।
আর স্যানিটারি ন্যাপকিন? অল্পবয়েসি মেয়েদের লাগে তো। কেন মেডিক্যাল স্টোর্স থেকে কিনবেন?
যখন আপনার বোনপো’র “জয় মা তারা স্টোর্স” সবকিছুই ন্যায্য দামে দিচ্ছে।
হে ভগবান! এসব কী হচ্ছে? কারা আমার পেছনে বাঁশ দেয়ার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছে?
--শোন মধু, এখন আমার বাড়িতে আমি একা। ভাইঝি নেই। কাজেই সব মাল ফেরত পাঠাচ্ছি।
তুমি আমার লিস্টের হিসেবে পাঠিয়ে দাও, তবে পেমেন্ট করব।
--ও, চলে গেছেন? ঠিক আছে, আমি ফের পাঠাচ্ছি।
আজ সকাল থেকে যা যা ঘটেছে তাতে কার না মেজাজ বিগড়োয়! এ পাড়াটাও কি গেঁয়ো পরচর্চা আখড়া।
এরা আমার বাড়িতে ভাইঝি খুঁজে পেয়েছে। শুধু তাই নয়, যুবতী মেয়ে ।
তার জন্য গায়ে পরে স্যানিটারি ন্যাপকিন গছিয়ে দেয়া!
দিস ইজ হাইট!
নাঃ; দোকানটা বদলাতে হবে, আগামী মাস থেকেই।
দুপুরে খেয়ে দেয়ে টিভিতে ডার্বি ম্যাচ দেখব ভেবেছিলাম। কিন্তু মেজাজ এমন খিঁচড়ে গেছে যে টিভি খুলতে ইচ্ছে করছে না।
মনের অগোচরে পাপ নেই। আসলে সকাল বেলায় মোহিনীর মুখে এমন সত্যবচন শোনার পর থেকে একটা রাগ ভেতরে মাথা চাড়া দিচ্ছে।
ও ভাবে না, ওটা ওর কাজ নয় –কেন নয়? আমি বললেও নয়?
কিন্তু ওদের অফিসে যে তিলোত্তমাকে দেখিয়েছিল সে তো দিব্যি হাসত, নিজে থেকে ভেবে কথা বলত।
তবে মোহিনীও ওখানে অংকের সমস্যা শুনে এমন তেরিয়া মেজাজ দেখিয়েছিল যে ওদের ম্যানেজার ওকে বকতে বাধ্য হয়।
তাহলে কি আমি ঠকে গেছি? এ কীরকম রোবো- সঙ্গিনী যে হাসে না, লজ্জা পায় না! ভাবে না।
অর্থাৎ ওর মন বলে জিনিসটা নেই।
এর জন্যে এক হাজার ইউরো, মানে প্রায় এক লাখ টাকা!
কোন মানে হয়?
সব শালার প্রোমোটারই হাড় বজ্জাত।
ওরা মডেল ফ্ল্যাট বলে যা দেখায় আর বাস্তবে যে ফ্ল্যাটটা গছিয়ে দেয়, তার মধ্যে কিছু তফাৎ হবেই।
আবার ২ বিএচকে আর ৩ বিএচকে’র মধ্যেও।
আরে! এবার বুঝতে পেরেছি। ব্যাপারটা ঠিক ফ্ল্যাটের মতই।
আমি নিয়েছি সবচেয়ে শস্তা বেসিক মডেলের সঙ্গিনী। আর তিলোত্তমা ছিল হাই-এন্ড মডেলের।
একবার জেনে নিতে হবে ওই মডেলের দাম কেমন আর কোন খাইখরচ বা মেন্টেনান্স কস্ট আছে কিনা।
একবছর মোহিনীকে নিয়ে কাটিয়ে দেব। তারপর ফের বলব মডেল আপগ্রেড করতে, নিশ্চয়ই কিছু ছাড় দেবে।
কারণ একটাই। আমি বুঝে গেছি—তিলোত্তমার কাঁধে মাথা রেখে কাঁদা চলে, কিন্তু মোহিনীর কাঁধে?
কিছুতেই নয়।
কিন্তু মোহিনীর জন্যে যা খরচ করেছি এক বছরে তার পাই-পয়সা উসুল করে ছাড়ব।
বিক্রির সময় বলেছিল না যে ও আমার সঙ্গে সময় কাটাতে অংক, সাহিত্য এবং দর্শন, নীতিশাস্ত্র এসব নিয়ে আলোচনা করতে সক্ষম?
রোজ কিছু না কিছু প্রবলেম পেশ করব।
যদি দেখি ছড়াচ্ছে তাহলে ওয়ারান্টি দেখিয়ে আপগ্রেড করতে বলব।
অবশ্য অংক ও পেনাল কোডের আলোচনায় দেখেছি বেশ সড়গড় আছে।
--শোন মোহিনী, এসে সামনের চেয়ারটায় বস। এখন একবার বৌদ্ধিক সেশন হবে।
মোহিনী বাধ্য মেয়ের মত বসে পড়ে।
ঈশ্বরবাবু কোথায় থাকেন?
--শোন মোহিনী, একটা সমস্যা আছে।
--বলুন স্যার।
--কথাটা হল ঈশ্বর বা ভগবান আছেন কি নেই? তুমি কী ভাব?
--আমি ভাবি না স্যার। যা জানি তা বলছি। আপনি ঈশ্বর বলতে কী বোঝেন?
--মানে? ভগবান বলতে তো একটাই। এর নানারকম ব্র্যান্ড হয় নাকি?
--স্যার, আপনি কি বোঝেন?
--ঈশ্বর হলেন আমাদের সৃষ্টিকর্তা। উনি সর্বজ্ঞ , সর্বশক্তিমান, পরম করুণাময়। উনি জ্ঞান ও শক্তির আধার।
আমাদের সবকিছু নৈতিক নিয়মের তিনিই উৎস। কোনটা ভাল, কোনটা মন্দ তিনিই ঠিক করে দেন।
তিনি দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন করেন।
এবার তুমি বল।
মোহিনীর চোখের পলক বেশ খানিকক্ষণ ফরফর করে।
--স্যার, আপনার বর্ণনায় দুটো ভাগ। যদি শুধু দ্বিতীয় ভাগটা দেখি তাহলে মনে হয় ঈশ্বর একজন রাজা।
ঠিক-বেঠিক বলে দেন, দুষ্টুলোককে শাস্তি ও ভাললোককে ইনাম দেন।
অথবা আজকালকার সরকার। একই কাজ।
আর যদি ঈশ্বর কী বোঝাতে শুধু প্রথম ভাগের কথা ধরেন –সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান, অসীম করুণাময়; তাহলে একটা কথা আছে।
বহু আগে একজন গ্রীক দার্শনিক এই কথাগুলোকে প্রশ্ন করেছন।
--কী নাম? কবেকার লোক?
--এপিকিউরাস, যীশুর জন্মেরও কয়েক শতাব্দী আগে?
--তা কী বলেছেন তোমার এপিকিউরাস?
খোঁচাটা বৃথাই গেল। ওকে তাতিয়ে তোলা গেল না।
মোহিনী একটা যান্ত্রিক ঘ্যানঘেনে সুরে বলতে লাগলঃ
ঈশ্বর যদি সবকিছুর স্রষ্টা, তাহলে যা কিছু খারাপ, যত শয়তানি –সেটাও ওনার সৃষ্টি।
সেসব যদি উনি ইচ্ছে করে মজা দেখার জন্যে করে থাকেন, তাহলে উনি দুষ্টু লোক, করুণাময় নন।
যদি ওনার ইচ্ছে আছে, শক্তিও আছে, কিন্তু কোথায় কী শয়তানি হচ্ছে সেসব উনি ঠিকমত জানেন না—নইলে কবে টাইট করে দিতেন,
তাহলে উনি সর্বজ্ঞ নন।
আর যদি উনি করুণাময়, চাইছেন জগত থেকে যত অন্ধকার যত খারাপ সব বিলুপ্ত হোক, অথচ পারছেন না।
তার মানে এগুলোকে নিয়ন্ত্রণ ওনার সাধ্যের অতীত। তাহলে উনি সর্বশক্তিমান নন।
--দূর! এগুলো কথার মারপ্যাঁচ।
যখন কলেজে পড়তাম তখন একটা ফাজিল ছেলে ফিলজফির স্যারকে বলেছিল—স্যার, আপনার ঈশ্বর সব পারেন?
স্যার বললেন ঈশ্বর সবার, আর ঈশ্বরের অসাধ্য কিছুই নেই।
তখন ছেলেটা মিচকি হেসে বলল—আপনার ঈশ্বর কি এমন একটা পাথর সৃষ্টি করতে পারেন যেটা উনি নিজে তুলতে পারেন না?
-- ক্লাস থেকে বেরিয়ে যাও।
মোহিনী হাসল না।
--শোন , সত্তরের দশকে আব্দুল জব্বার লিখেছিলেন ‘বাংলার চালচিত্র’। আচার্য সুনীতিকুমারের ভূমিকা।
তাতে একজন বেয়াড়া গোছের পাগলা স্থানীয় মৌলবীকে সবার সামনে জিজ্ঞেস করেন—বল দেখি আল্লাহ্ কী কী কাজ পারেন না?
--বাজে কথা। ওনার অসাধ্য কিছুই নেই।
--পারলি না তো! আল্লাহ্ দুটো কাজ পারেন না।
এক, উনি দ্বিতীয় আল্লাহ্ সৃষ্টি করতে পারেন না।
দুই, আল্লাহ্ নিজেকে ধ্বংস করতে পারেন না।
মোহিনী নির্বিকার।
--বুঝলাম। এসব তো দু’হাজার বছর আগের কথা। অ্যাদ্দিনে নিশ্চয়ই এর একটা লাগসই উত্তর এসে গেছে।
--আমি জানি না স্যার।
হিউম বলে একজন নামকরা ইংরেজ দার্শনিক বলে গেছেন যে এপিকিউরাসের প্রশ্নগুলোর আজ পর্য্যন্ত সমাধান হয় নি।
উনি এটাও বলেছেন যে সর্বশক্তিমান ঈশ্বর এ কেমন বিশ্ব সৃষ্টি করেছেন যেখানে মানুষ এবং পশুপাখি কেউ সুখী নয়?
--শোন দুনম্বরী! ছোটবেলায় আকাশবাণীতে শোনা বিখ্যাত শ্যামাসঙ্গীত গায়ক হীরালাল সরখেলের একটা গানঃ
“ভগবান তুমি এখনও কেন যে
নীরব রয়েছ তাই,
তোমার সৃষ্টি তোমার বিধান
কিছু না মানিতে চাই।
দুখে সুখে যারা চিরদিন ধরে
করে তব জয়গান,
তারা তো পেলনা করুণা তোমার
পেল যারা ধনবান।।
---আচ্ছা, সিরিকে কম্যান্ড দিলে কি ওই গানটা বাজিয়ে দেবে?
---নাঃ, মোহিনীকেই আদেশ দিয়ে দেখ। (চলবে}
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।