১৪
সেই সময় গড়িয়ার কামডহরির কাছে একটি ঝিলের পাশে বিশাল নির্জন বাগানবাড়িতে এক টাকমাথা ধবধবে গায়ের রং ষাট পেরিয়ে যাওয়া ভদ্রলোক
স্টাডি রুমে একা একা দাবা খেলছিলেন। ওঁর পরনে সাদা ফতুয়া ও বার্মিজ ধরণের লুঙ্গি।
পায়ের কাছে একটি দেশি কুকুর অলস ভঙ্গিতে গা ছেড়ে দিয়ে থাবা চাটছে।
বই দেখে বটভিনিক ও টালের একটি বিখ্যাত গেমের ওপেনিং চালগুলোকে বদলে বদলে নতুন ভাবে খেলছিলেন। কিন্তু আজ খেলায় মন নেই।
মাঝে মাঝে কান খাড়া করে কিছু শোনার চেষ্টা। ঘন্টা দুই কেটে গেল।
এমন সময় হঠাৎ পোষা কুকুরটা গরর্ করে উঠল।
উনি প্রায় লাফিয়ে উঠে জানলা দিয়ে দেখলেন যে দারোয়ান গেট খুলে দিচ্ছে আর বাগান পেরিয়ে এদিকে হেঁটে আসছে সোনালি চুল
।উনি নিজেকে সংযত করলেন।
গম্ভীর মুখে বললেন--রিপোর্ট!
--- সাকসেসফুল। এভরিথিং ওকে।
-- ভেহিকল্স্?
-- ওকে, ইন দ্য হাভেন। নেমপ্লেট কালার চেঞ্জড্।
-- এনি ক্যাজুয়ালটি?
-- টু গার্ড্স ইন্জিওর্ড, নট ফ্যাটাল; নান অ্যাট আওয়ার সাইড।
লম্বা মানুষটি বেঁটে সোনালিচুলোকে জড়িয়ে ধরে মাথায় চুমো খেলেন।
পিদিমের সলতে পাকানোর আগে
-এঃ বর্ণনাটা এক্কেবারে হুইলারের দোকানের শস্তা থ্রিলারের মত হয়েছে। বিজনদার কপালের কিছু রেখা গভীর হল।
শংকর গম্ভীর হয়ে জানতে চায় ভুল কী বলেছে, বিশেষ করে ও যখন কোন সাহিত্যিক নয়। স্কুল কলেজের ম্যাগাজিনেও কখনো খাপ খোলে নি।
-- এ হল বাজারি পত্রিকার ক্রাইম রিপোর্টের মত। বাইরের থেকে দেখা একটি ডাকাতির বর্ণনা;-- এতে ধরা পড়েনি ছেলেগুলোর আবেগ।
ওরা জানত যে ওরা যে কাজটি করতে যাচ্ছে তাতে মরে যাওয়ার বা ধরা পরার বা টর্চার হয়ে জেলে পচার সম্ভাবনা খুব বেশি।
তবু ওরা এই কাজে নেমে পড়ল। অভিজ্ঞতা নেই, তবু। ওরা বিশ্বাস করেছিল যে যা করছে সেটা নিজের বা নিজের পরিবারের জন্যে নয়, বৃহত্তর আদর্শের জন্যে।
জানত ওরা কেউ ডাকাতির ভাগ পাবে না। কারণ ওরা পেশাদার ডাকাত ছিল না, বরং অনেকটা অগ্নিযুগের স্বদেশী বিপ্লবীদের মত।
তাই পই পই করে বলা ছিল যে যেন কোন মানুষের প্রাণ না যায়।
--- তাই নাকি? কে বারণ করেছিল? ওল্ড গার্ড? অবিনাশ? তবু ১৯৬৯ এর রাসেল স্ট্রিট স্টেট ব্যাংক ডাকাতির সময় নিরীহ চৌকিদার তোরণ বাহাদুরের প্রাণ গেল।
বিজনদা চুপ মেরে যায়। বোঝে, কথা আর এগোবে না। কিন্তু কী করে এদের বোঝাবে পঞ্চাশ বছর আগের সেই দামাল ছেলেগুলোর আবেগ।
বীরু আবৃত্তি করত-- 'জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য,
চিত্ত ভাবনাহীন।'
হ্যাঁ, সেই অপারেশনের আগের দিন রাত্তিরে বেহালার একটি বাড়িতে খাওয়া দাওয়া হয়েছিল। তারপর সবাই মিলে গান গেয়েছিল। বীরু আবৃত্তি করেছিল 'বন্দীবীর'।
ও কি একটাই কবিতা জানত? শেষে ঘুমুতে যাওয়ার আগে সবাই একসঙ্গে এবং আলাদা আলাদা করে একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরেছিল।
অনেকটা আজকের দিনে ক্রিকেটের মাঠে ফিল্ডিং করতে নামা দলের মত।
তফাৎ একটাই,-- ওরা বুঝেছিল অনেকের সঙ্গেই হয়ত এই শেষ দেখা।এ
কবার এ রাস্তায় পা বাড়ালে এভারেস্টের চুড়োয় পতাকা তোলার দিন হয়ত থাকবে হাতে গোণা কয়েকজন।
চিফ কম্যান্ডারের মনে এ নিয়ে কোন সন্দেহ ছিল না।
হাসতে হাসতে সহজ ভঙ্গীতে বলেছিল-- লং মার্চের দু'হাজার লী পথ পেরিয়ে মাও যখন ইয়েনানের গুহায় পৌঁছুলেন ,
তখন ওঁর বাহিনীর সৈনিকের সংখ্যা কয়েকহাজার থেকে কমতে কমতে মাত্র ছ'শো।
তবু সেটা চিয়াংয়ের বিরুদ্ধে রণনীতিগত জয় ছিল। সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়াল লালফৌজ। হারিয়ে দিল আগে জাপানকে, তারপর বিশাল কুয়োমিন্টাং ফৌজকে।
যখন ১৯৪৯ সালে তিয়েন আন মেন স্কোয়ারে বিজয় উৎসব হচ্ছে তখন গণমুক্তি ফৌজের সদস্য কয়েক লাখ।
কাজেই ইতিহাসের উপরে ভরসা রাখো।
পরের দিনের পোস্টাফিস অপারেশনের কম্যান্ডার সোনালী চুলো হ্যান্ডসাম ছেলেটি একটু গলা তুলে বলল-- কমরেড্স্! আমাদের নাম আগামী দিনে ইতিহাসে লেখা থাকবে।
আমরা হয়ত সেদিন দেখব না, কিন্তু আমাদের দেশ, পাড়া, পরিবারের লোকজন আমাদের নিয়ে গর্ব করবে।
কেন?
কারণ, আমরাই সেই হাতে গোণা লেনিনের প্রফেশনাল রেভোলুশনারি।আমরা চাকরি খুঁজি নি, ক্যারিয়ারিজমের রাস্তায় হাঁটি নি।
বা ওই একগাদা বাক্যবাগীশ নকশালদের মত দেয়ালে দেয়ালে রং দিয়ে ' বন্দুকের নলই রাজনৈতিক শক্তির উৎস--মাও' লিখে নিজেদের কী -হনু-রে ভাবি নি।
আমরা সোজা বন্দুকের নলকেই হাতে তুলে নিয়েছি। কালকের অভিযান রাষ্ট্রশক্তির ভিৎ কাঁপিয়ে দেবে।
আর আমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিৎ ওল্ড গার্ড এর কাছে -- উনি আমাদের এই সুযোগ দিয়েছেন বলে।
কৃতজ্ঞতা ? তা তো বটেই। ওরা সবাই কৃতজ্ঞ অবিনাশের কাছে।
বিশেষ করে বীরু। গত কয়েক মাস ওর যেন একটা ঘোরের মত কেটেছে।
ওঁর একটা গাছপালায় ঘেরা পুকুরওলা বাগানবাড়িতে তিনমাস ধরে ওরা অপারেশনের অভ্যাস করেছে। ওঁর কন্ডাক্ট করা মেন্টাল কন্ডিশনিং এর ক্লাস করেছে।
বাড়িতে ছোট করে সদর স্ট্রিট পোস্টাফিসের ডামি মডেল বানিয়ে ডামি কার ও আর্মস ইউজ করে শ্যাডো প্র্যাকটিস করা হয়েছে।
তার আগে সিনিয়র চারজন রেকি করেছে দু'মাস ধরে। পায়ে হেঁটে মেপে নিয়েছে থানা থেকে পোস্ট অফিসের দুরত্ব।
গাড়ি চালিয়ে স্টপ ওয়াচ ধরে দেখেছে থানায় খবর গেলে গাড়ি নিয়ে পুলিশের দল কতক্ষণে পোস্ট অফিসে পৌঁছতে পারে।
বারবার মিলিয়ে দেখা হয়েছে মাসে কতদিন এবং সপ্তাহে কোন কোন দিন ক্যাশ নিয়ে সরকারি ভ্যান পোস্ট অফিসে আসে।
তারপর তৈরি করা হয়েছে অপারেশনের ব্লু-প্রিন্ট, অল্টারনেটিভ প্রিন্ট। কোর টিমের চারজন এতে হাত লাগিয়েছিল।
কিন্তু অবিনাশ ছ'বার লালকালিতে দেগে দিলেন প্ল্যানের কোথায় কোথায় খামতি আছে।
এর পর শুরু হল রিহার্সাল। প্রথমবার গোটা অপারেশনটায় লাগল পঁয়তাল্লিশ মিনিট, ওরা বুঝতে পারে নি। কিন্তু অবিনাশ স্টপ ওয়াচ ধরেছিলেন।
বললেন যে এই সময়টাকে অভ্যাসের মধ্য দিয়ে চার মিনিটে নামিয়ে আনতে হবে।
ওরা হতাশ হয়ে বসে পড়েছিল। বুঝে গেছল এ অসম্ভব। কিন্তু অনন্ত সিং অন্য ধাতুতে তৈরি। ধরে ধরে পাখিপড়া করে বোঝালেন যে কোথায় কোথায় সময় বাঁচানো যায়।
পুরো ব্যাপারটা নির্ভর করছে টিমএর কোঅর্ডিনেশন ও টাইমিং এর উপর। ওদের দেখতে বললেন -- দ্য গ্রেট ট্রেন রবারি সিনেমা ও বাউম্যানের জীবনী।
দেখালেন বাউম্যান কতবার কী কী ভুলের জন্যে ধরা পড়েছিলেন আর কীভাবে মারা গেলেন।
হ্যাঁ, একমাসের পরে সময় কমে পনের মিনিটে দাঁড়াল, কিন্তু আর কমছিল না। তখন উনি টিম বদলে দিলেন।
যারা সাপ্লাই ও সিগন্যালিংর এর দায়িত্বে ছিল তাদের থেকে কয়েকজনকে আনা হল মূল অপারেশনে এবং কয়েকজনকে ফেরত পাঠানো হল সিগন্যালিংয়ে।
হাতে হাতে ফল। তিনমাসের মাথায় সময় কমে দাঁড়াল সাড়ে চারমিনিটে। উনি বললেন--যথেষ্ট, এতেই হবে।
ইতিমধ্যে বীরু ছেড়ে দিয়েছিল ওর কাকার বাড়ি। কাকাকে বলল--তোমরা বুঝবে না। আওয়ার প্রোগ্রাম ইজ ডেথ, আওয়ার ট্রিস্ট ইজ উইথ ডেথ। ফর ইয়োর টুমরো, উই আর গোয়িং টু গিভ আওয়ার টু-ডে!
কাকা আর একটাও কথা বলেন নি।
আর কী আশ্চর্য, ‘ওল্ড গার্ড’ এর পরিকল্পনা ফলে গেল। সমস্ত অপারেশনটাই নিখুঁত; আমাদের একজনও আহত হয় নি ।
অবশ্য সিকিউরিটির দু’জন গুলি খেয়েছে, কিন্তু সেটা গুরুতর নয়, হাসপাতালে সেরে উঠছে।
টাকাপয়সা ঠিক জায়গায় রাখা আছে, তার খুঁটিনাটি আমাদের মত চুনোপুঁটিদের জানার কথা নয়—তাই জানি না । তবে প্রতিমাসের এক তারিখে সেল কম্যান্ডারদের হাত দিয়ে সবাই পেয়ে যায় একটি সাদা খামের ভেতরে কিছু কড়কড়ে নোট। আমিও পাই – খামের উপর সুন্দর হাতের লেখায় কালি দিয়ে ইংরেজিতে লেখা—‘রমেন, ওয়েজ ১৩০/-‘।
আমাদের মাসিক খরচা। আমরা ঘর-পরিবার ছেড়ে বিপ্লব করতে এসেছি, আমরা পেশাদার বিপ্লবী, যেমনটি লেনিনের ‘হোয়াট ইজ টু বি ডান’ বইয়ে বলা আছে।
আমরা সৈনিক, তাই মাইনে পাই । কিন্তু স্যালারি নয়, ওয়েজ—অর্থাৎ মজুরি।
আমরা তো ভাড়াটে সৈনিক বা মার্সেনারি নই , আমরা ভবিষতের গণমুক্তি ফৌজের সৈনিক । আমরা শ্রমিক-কৃষকের স্বার্থের প্রতিনিধি।
নিজেদের জামাকাপড় নিজেরা কাচি, কিন্তু রান্নাবান্না করি না । শস্তায় ভাত-ডাল-মাছের টুকরো লেবু চটকে মেখে খাই—পাইস হোটেলে।
একজোড়া ভাল জামাকাপড় রাখি –টেরিলিনের শস্তা শার্ট ও টেরিকটের প্যান্ট। ঠিক দশটা নাগাদ নিজেদের শেল্টার থেকে বেরিয়ে যাই।
আর বেশ রাত্তির করে ফিরি। লোকজন ভাবে কোথাও সেলসম্যানের কাজ করি—‘বেচুবাবু’ শব্দটি অর্ধশতাব্দী আগে কোলকাতার মুখের ভাষায় চালু হয় নি ।
তা বেশ, সারাদিন কী করি?
অনেক কিছু। প্রধান কাজ হচ্ছে নতুন সৈনিক রিক্রুট করা। নিজেদের চেনাপরিচয়, বন্ধু-বান্ধব বা আত্মীয়দের ভেতর থেকে।
একদিন নয়, দু’দিন নয়; দিনের পর দিন । খরচা হয় নানান ভাবে। নতুন হলেও- হতে -পারে রিক্রুটদের চা আর চার্মিনার সিগ্রেট খাওয়ানো; বাসের ভাড়া নিজের খাইখরচা ইত্যাদি।
ভাল রেস্পন্স পেলে পরের স্টেজে সেলের ইনচার্জের সঙ্গে বৈঠক। প্রসেসটি আরও এগিয়ে গেলে ওর স্বতন্ত্র থাকার ব্যবস্থা করা, ওর গ্রুপ, মেন্টর এবং কাজের এলাকা ঠিক করা।
আমি রমেন কখন যেন নিজের স্মৃতির অ্যালবাম হাতড়াতে শুরু করেছি।
রমেনের স্মৃতির কোলাজঃ
ছ'মাস পর স্টেটস্ম্যান পত্রিকায় একটি রিপোর্ট বেরুল।
-সদর স্ট্রীট ব্যাংক ডাকাতি চিন্তায় ফেলেছে। লালবাজারের তাবড় তাবড় গোয়েন্দারা হতভম্ব। পার্ক স্ট্রীট থানা এত কাছে , তবু এত দু:সাহস!
আর হলিউড ফিল্মের মত এমন প্রিসিশন, কয় মিনিটে অপারেশন শেষ!
এতো পাকা প্রফেশনালদের কাজ, এরা কারা?
পুলিশের ইনফর্মাররা সমস্ত ক্রাইম ডেন চষে ফেলেছে। পুরনো দাগীদের ধরে এনে আড়ং ধোলাই দিচ্ছে, কিন্তু কেউ জানে না এটা কার কাজ।
এই প্রক্রিয়ায় অনেক পুরনো ফেরারের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে, অনেক পুরনো বন্ধ ফাইল খুলছে, কিন্তু আসলীদের কোন পাত্তা নেই।
হাওয়ায় গন্ধ নেই, চার লাখ টাকা নিয়ে কর্পূরের মত উবে গেল ছোঁড়াগুলো।
ভবানীপুরের নন্দন রোডের কাছে একটি টেবিলে তিনটি ছেলে খাচ্ছে,-- তন্দুরী রোটি আর তড়কা ডাল। একজন হাত ধুয়ে কাউন্টারে টাকা দিতে গেল। কিন্তু ছোটটি শেষ রুটির টুকরোয় কামড় দিয়ে কচকচিয়ে পেঁয়াজকুচি আর লংকার ছুঁচলো মুখ চিবিয়ে জড়ানো আওয়াজে বললো-- উঁহু, উই গো ডাচ!
বাইরে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ওরা গাঁজা পার্কে ঢুকে ঘাসের ওপর বসলো।
সিনিয়র যুবক রোগা ক্যাংলা কেলটে ছেলেটাকে বল্লেন-- রমেন, এ' মাসের ওয়েজ নাও।
ব্যাগ থেকে একটি সাদা কাগজের খাম বের করে দিলেন ওর হাতে।
ওতে লেখা Ramen- wage Rs.130/-.
ও খাম খুলে দেখে নিল তাতে আছে তেরোটি দশ টাকার নোট।
সিনিয়র বল্লেন-- শোন, তুমি তো পরিবারের সঙ্গে থাক। বিছানা আর খ্যাঁটনের চিন্তা নেই তাই তোমার ওয়েজ কম। এদিয়ে গোটা মাস চালাতে হবে।
বিভিন্ন মিটিংয়ে যাওয়ার খরচ, চা জলখাবারের খরচ, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকার খরচ, আর তুমি কাউকে রিক্রুট করলে তাকে এন্টারটেন করার খরচ- এতে হয়ে যাবে।
রমেন মাথা নাড়ে।
হ্যাঁ, গড়িয়াহাটে নির্মলা বলে একটা নতুন রেস্তোরাঁ খুলেছে।
তাতে মশলা দোসা, ওনিয়ন দোসা ৬৫ পয়সা, কফি ৩০ পয়সা আর দুটো পানামা সিগ্রেট । শালা, রোজ একটাকায় স্বর্গসুখ। এতে তিরিশ টাকা গেল। ট্রাম-বাস আর হন্টনে সারা মাসে যাবে ৫০ টাকা-- এখনো ৫০ টাকা বাকি।
কতদিন যে কফিহাউসের আড্ডায় যাওয়া হয় নি। এবার একদিন যাবে।
মৌলানা আর প্রেসিডেন্সির বন্ধুদের সবাইকে ডেকে, সব্বাইকে কফি-কোল্ড কফি পাকোড়া খাওয়াবে।
কবি তুষার রায়কে ডেকে কফি খাইয়ে ওনার মজাদার সব গল্প, ফট-সন্দেশের গল্প শুনবে।
আর নাকতলার বন্ধুরা কি দোষ করল!
গড়িয়া কলেজের পাশে কাঠের বেঞ্চিওলা পোঁদে-গরম ঠেক, আর বাস স্ট্যান্ডের পাশে পাখার নীচে গদিওলা পোঁদে -আরাম ঠেক!
আর গীতশ্রী! কোন দিন কি সাহস করে ওকে বলতে পারবে কাফে-ডি- অনিল এ চল?
ও তো একদিন কলেজে সবার সামনে জিগ্যেস করেছিল--- তুমি কি মনে কর নক্সালবাড়ির লাল আগুন একদিন সারাদেশে ছড়িয়ে যাবে?
-- হ্যাঁ, যাবে। একদিন নিশ্চয়ই যাবে।
-- সেই আগুনে পুড়বে কারা? মাও সে তুং এর বাচ্চা যারা।
-- তোমার কাকা কংগ্রেসের নেতা, তুমি তো এসব বলবেই। একটু ভাবো, পড়াশুনো কর, তাহলে বুঝবে।
-- হ্যাঁ, তোমরা তো খুব পড়াশুনো করছ, লজ্জা করে না!
এই তোরা শোন! এই ছেলেটা না মৌলানা আজাদে ইকনমিক্সে ভর্তি হয়েছিল। এ'বছর ড্রপ নিয়ে গড়িয়া কলেজে আমার এক ইয়ার নীচে ম্যাথস্ নিয়ে ভর্তি হয়েছে।
আজেবাজে রাজনীতি করলে এইরকমই হয়।
রমেন বলতে চাইল-- না, গীতশ্রী! রাজনীতি নয়, ওটা অজুহাত। সত্যি কথাটা আমার কমরেডরাও জানেনা।
আমি শুধু তোমার জন্যে কলেজ বদলেছি, শুধু তোমাকে রোজ দেখতে পাব বলে।
কিন্তু বলতে পারলো না। ভালবাসার চেয়ে রাজনীতি বড়। কংগ্রেসী বাড়ির মেয়েকে বিপ্লবী রাজনীতিতে কনভিন্সড্ না করে তার সঙ্গে প্রেম করা যায় না।
-- রমেন, কি ভাবছ? শোন, রোববার দিন বিকেল তিনটেয়, চিড়িয়াখানায়, বাঁদরের খাঁচার সামনে।
ভবানীপুরে হাজরা মোড়ের কাছে বড় রাস্তার ওপর কটা দোকান ঘর, পাশ দিয়ে সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়। দোতলায় একটি সওদাগরি অফিস। তাতে তাক ভর্তি নানারকম ফাইল। গোটা কয় টেবিল-চেয়ার।দুটো রেমিংটন টাইপরাইটার। রোববারের সকাল দশটা।
টেবিল ঘিরে ওরা জনা ছয়, একজন সদ্য কলেজ পেরোনো মেয়ে। মেয়েটি বড় গম্ভীর, কখনো হাসে না।
রমেন জেনে গেছে ওকে ডাকতে হবে রীনাদি বলে।
ফলে বাকি ছেলেগুলোর একটু ইল্লি হয়। ওরা চায় মেয়েটি একটু হাসুক, সহজ হোক।
রমেনের কানে ফিসফিস করে সুকান্ত বলে-- ভাবটা দেখ, যেন বিপ্লবের জন্যে উৎসর্গীকৃত প্রাণ। শালা, বিপ্লবীরা ডাউন-টু-আর্থ হয় না?
পরশু চিড়িয়াখানার মিটিংয়ে আসেনি। জিগ্যেস কর , ভারি গম্ভীর সব কারণ বলবে।
আসলে ওর একজন লাভার আছে। সে অন্য গ্রুপে। তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল।
-- তো কি হয়েছে? প্রেম করা কি প্রতিবিপ্লবী কাজ?
-- ধ্যেৎ, তাই বলেছি? কিন্তু ভড়ং না করে সত্যি কথাটা বললেই পারে।
ওরা সবাই অপেক্ষা করছে ওদের গ্রুপ লীডার মিথিলেশের জন্যে। উনি সদ্য জন্ডিস থেকে সেরে উঠেছেন। আজ ডাক্তার দেখিয়ে আসবেন।
রমেনের মনে ব্যাপক কৌতূহল। আজই প্রথম দেখবে ও মিথিলেশকে। ও জানে পোস্ট অফিস ডাকাতিতে মিথিলেশের বিশেষ ভূমিকা ছিল।
যদিও এই নিয়ে কেউ কোন কথা বলে না, তবু, যদি একটু গল্পটা জানা যায়! ব্যাপারটা কিরকম করে ঘটেছিল।
রমেন ছটফট করে উঠে জানালার কাছে যায়, নীচে ট্রাম-বাস-ট্যাক্সির চলাচল দেখতে থাকে।
পেছন থেকে সুকান্ত বলে -- ছটফট করছিস কেন? জানলা দিয়ে মেয়ে দেখছিস?
ওদিকের ফুটপাথে কাঁধে শান্তিনিকেতনী ব্যাগ কাঁধে মেয়েটিকে দ্যাখ, ঠিক যেন ""গৃহদাহ'' ফিল্মের সুচিত্রা সেন।
-- তাহলে এদিকের ফুটপাথে সদা স্কার্ট পরা মহিলাটি হলেন "দীপ জ্বেলে যাই''।
ওরা হেসে ওঠে। রীনা এইসব অপোগন্ডসুলভ হরকতে একটু বিরক্ত ভাব দেখান।
--- আরে, ঐযে ট্রাম থেকে নেমেছে ওকে চিনি। আমাদের পাড়ায় চারু মার্কেটের গলিতে থাকে।
-- কোনজন?
-- ধ্যুৎ, ওই যে ভাগলপুরি গাই!
-- মানে?
-- উ: এটাও জানিস না?
সুকান্ত মানে বোঝায়। রমেনের দন্তবিকশিত হয়।
--জানো সুকান্তদা, আমারও না একটা ভাগলপুরি গাই জুটেছিলো, এখন কেটে গেছে।
পাড়ার ডাক্তার আমার শরীর ভেঙে যাচ্ছে দেখে বলছে নিয়মিত এক পো' করে দুধ খেতে, পয়সা কোথায়? ইস্, তখন যদি বলতো!
ওদের ফ্যাকফ্যাক হাসিতে রীনা ভারি বিরক্ত হয়ে বলেন-- বেটার লাফ উইথ আস, নট অন আস্। হাসির গল্পটা আমরাও একটু শুনি।
আতংকিত রমেন চোখের ইশারায় না-না করে ওঠে। কিন্তু সুকান্ত যেন দেখেও দেখলো না।
--- রীনাদি, জানেন রমেন কী বলছে? আর ভাগলপুরি গাই ছেলেরা কাকে বলে জানেন?
রীনার চেহারা রাগে বেগুনি হয়।
রমেন দুহাত জোড়ে।
--বিশ্বাস করুন, আমি ঠিক ওভাবে বলিনি। এটা সুকান্তদা বাড়িয়ে বলছে। আর এসবের সঙ্গে আপনার কোন সম্পর্ক নেই।
-- আমি একটুও বাড়িয়ে বলছি না রীণাদি। এই রমেন বয়সে সবচেয়ে ছোট, কিন্তু মহাবিচ্ছু, একেবারে ধানীলংকা।
-- না রমেন, এসব সহ্য করা যায় না। আমরা কি বখামি ইতরামি করতে ঘরদোর ছেড়ে এখানে এসেছি?
রমেনের চেহারা কাঁদো-কাঁদো। মুখদোষে মার গলে! কেন যে এত কথা বলে ও, একটু চুপ করে বসতে পারে না।
ওকে আজ দল থেকে বের করে দেবে? তাহলে ওর যে বিপ্লব করা হবে না। ঠিক আছে, এরাই সব নাকি?
প্রেসিডেন্সি কো-অর্ডিনেশন আছে, লোকায়ন আছে।
দরজা খুলে যায়। মিথিলেশ এসেছে। ফর্সা একহারা চেহারা, গালে হাল্কা চাপ দাড়ি। আরে, একে তো রমেন চেনে।
বছর দুই আগের সিপিএম এর ছাত্র ফ্রন্টের ডাকসাইটে নেতা, বেহালায় বাড়ি।
মিথিলেশ ব্যাগ নামিয়ে চেয়ার টেনে বসে পড়ে। সিগ্রেট ধরায়।
--এ’জায়গাটা আমরা টিউটোরিয়ালের জন্যে ভাড়া নিয়েছি, তা তোমাদের বইখাতা কোথায়? সবাইকে একটা অংক-সিভিক্সের বই আর একটা পুরনো খাতা আনতে বলেছিলাম না?
সবাই বাধ্যছেলের মত কাজ করে।
কিন্তু, দরজাটা এবার বেশ জোরে খুলে যায়।
দরজা আটকে দাঁড়িয়ে একজন চল্লিশ পার রাশভারী ভদ্রলোক, হাতে একটি গ্ল্যাডস্টোন ব্যাগ। অবাক বিস্ময়ে বলেন-- হু আর ইউ? এখানে আমার অফিসে ছুটির দিনে কি করছ? চাবি কোথায় পেলে?
মিথিলেশের স্মার্টনেস গায়েব। থতমত খেয়ে বলে --আমরা আপনার কোম্পানির অমিতকুমারের থেকে অনুমতি নিয়েছি।
রোববার-রোববার এখানে সিলেক্টেড স্টুডেন্টদের জন্যে স্পেশাল টিউটোরিয়াল চালাই।
-- তুমি কি মাস্টার!
-- হ্যাঁ।
--তাহলে সিগ্রেট খাচ্ছ কেন? আর তোমার এই সব ছাত্র? মাস্টারের সামনে সিগ্রেট খাচ্ছে! আমি অমিতের সঙ্গে কথা বলবো।
গজগজ করতে করতে উনি বেরিয়ে যান। আমরা ভাবি- যাক, শালা পুলিশের খোচর তো নয়।
রীনা চৌধুরির রমেনের ব্যাপারে অভিযোগটাকে মিথিলেশ বিশেষ গুরুত্ব দিলেন না।
রমেনকে বেশি চ্যাংড়ামি করার জন্যে বকলেন বটে, কিন্তু ও দেখলো ওনার চোখ দুটো হাসছে।
-- আমরা এবার বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে পড়বো লেনিনের "হোয়াট ইজ টু বি ডান্''--- কী করিতে হইবে।
বিশেষ চ্যাপ্টারগুলো মার্ক কর, সবাই। তাতে বলা হয়েছে " পেশাদার বিপ্লবী'' বা প্রফেশনাল রেভল্যুশনারিদের কথা। আমরা সংক্ষেপে বলি PR ।
আমাদের সংগঠনের লক্ষ্য এই পি আর তৈরি করা, ওদের নিয়ে কাজ করা।
হতভম্ব রমেন হাত তোলে।
--এক মিনিট; আমি জানতে চাই গণসংগঠনের ব্যাপারে আমাদের দল কী ভাবছে?
মিথিলেশের চোখের পাতা পড়ে না।
আমরা গণসংগঠনে বিশ্বাস করি না। আমাদের অভিজ্ঞতা বলে গণসংগঠনে সহজেই পুলিসের Mole সহজে ঢুকতে পারে।
তাই আমরা বিশ্বাস করি গুপ্ত বিপ্লবী সংগঠনে, এবং তা হবে অবশ্যই পেশাদার বিপ্লবীদের।
-- কিন্তু, কিন্তু-- আজ অবদি যা শুনে দেখে এসেছি, মানে যেমন ধরুন কমিউনিস্ট বিপ্লবীরা মেহনতী জনতার বিভিন্ন ফ্রন্ট আগে বানায়-- যেমন ছাত্র, ট্রেড ইউনিয়ন, কৃষকসভা, মহিলা সংগঠন।
--এগুলো লেনিনের বক্তব্যের গৌণ দিক। শুধু এইদিকটাকেই হাইলাইট করে সংশোধনবাদীরা জনগণকে বিভ্রান্ত করছে।
আমরা লেনিনের শিক্ষার বিপ্লবীদিকের ওপর জোর দিচ্ছি।
এবার সুকান্ত বলে
লেনিন যে বলেছিলেন গিভ মি টুয়েলভ প্রফেশনাল রেভলুশনারি , অ্যান্ড আই উইল আপটার্ন দ্য হোল ওয়ার্ল্ড, সেটা কখনো এইসব সিপিআই-সিপিএম বলে? না। ওরা ভয় পায়।
কী জানি বাবা, লেনিন কবে এইসব অলুক্ষুণে কথা বলে গেছেন।
-- রমেনকে আজ ওই দুটো বই পড়তে দাও--‘কী করিতে হইবে’ আর দুই ভল্যুমে এম মন্টিস্লাভস্কীর লেখা "বসন্তের দূত রুক'', অনুবাদ অশোক গুহ।
-- রুক কে?
--- রুক ছিলেন লেনিনের বলশেভিক কোরের সিক্রেট পার্টি সংগঠনের প্রাণপুরুষ, এন বাউম্যান। ১৯০৫ এর ব্যর্থ বিপ্লবে মারা যান। উনি বহুবার ধরা পড়েছেন, আবার পালিয়েছেন। জারের পুলিশ ওনাকে তন্ন তন্ন করে গোটা রাশিয়া খুঁজে বেড়াত।
--- এমনি কারো নাম তো শুনিনি!
-- কোত্থেকে শুনবে? এগুলো তো ওরা প্রচার করে না, করলে ওদের বিপদ। তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না? এই দেখ, "হোয়াট ইজ টু বি ডান'' এর উৎসর্গপত্রে এন বাউম্যানের নাম। ইসক্রা পত্রিকার গুপ্তপ্রেস উনি চালাতেন।
-- আচ্ছা? আমাদের বিপ্লব নিয়ে ধ্যানধারণা খানিকটা ওই অনুশীলন-যুগান্তর দলের চিন্তার মত নয়?
দু'জন হেসে ফেলে।-- বেড়ে বলেছিস, লাগসই।
মিথিলেশ গম্ভীর হয়ে বলে-- অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের সম্বন্ধে হালকা ভাবে কথা বলবে না। মানছি, ইতিহাস শুধু বিজয়ীদের মনে রাখে।
কিন্তু সাময়িক ভাবে পরাজিত হয়েছিলেন মানেই তাঁদের চিন্তা ভুল, এমন তো নয়! আসলে আমরাই তাঁদের যোগ্য উত্তরসূরী--- সরকারি কমিউনিস্টেরা নয়।
অফিসটিতে তালা লাগাবার সময় ঠিক হল এখানে আর বৈঠক করা ঠিক হবে না।
(চলবে)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।