১২
“শুয়োরের বাচ্চা জনগণ,
বছর বছর নির্বাচন?”
--সব তো হল। বোমা বাঁধা, কামানের গোলা, এক ঘুসিতে একটা ছেলের ঠোঁট ফাটিয়ে দেওয়া, বই পোড়ানো, স্যারের হাত থেকে বেত কেড়ে নেওয়া; আর কিছু বলার নেই?
--- কিচ্ছু না। খালি ঘুমুতে চাই।
-- ও বাবা! হঠাৎ এ বৈরাগ্য? সন্ন্যাস নেবে নাকি? নাকি জনগণকে তোমাদের বালখিল্য বিপ্লবের ব্যথর্তার জন্যে দোষ দিচ্ছ?
--- না, না! আমরাই জনগণকে মোবিলাইজ করতে ব্যর্থ হয়েছি।
-- যাক্, বুদ্ধিশুদ্ধি একেবারে লোপ পায় নি! তোমাদের সেই নেতার মত জনগণকে শুয়োরের বাচ্ছা বল নি তাই রক্ষে!
-- সে আবার কি?
--- সত্যি মিথ্যে জানি না। তোমাদের ভাঙাহাটের এক নেতা ছিলেন মহাদেব মুখার্জি।
সত্তরের দশকের শেষে উনি নিজেকে চারু মজুমদারের ও লিন পিয়াওয়ের ভাবশিষ্য বলে প্রচার করতেন শুনেছি।
কুলোকে বলে-- শেষজীবনের হতাশায় উনি বিপ্লব থেকে সন্ন্যাস নেওয়ার আগে নাকি বলেছিলেনঃ
শুয়োরের বাচ্চা জনগণ,
বছর বছর নির্বাচন?
রইল তোদের নির্বাচন,
আমি চল্লেম বৃন্দাবন।
-- অত খ্যা-খ্যা করে হাসার কিছু হয় নি। বেড়ালে অমন করে হাসে না। লাইনে এস। আজ কী কেস?
--- বলছিলাম যে তোমার দাদা বৌদি যাই ভাবুন গে, তুমি তো বুঝতে পারছ?
--হ্যাঁ হ্যাঁ, অত ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলার দরকার নেই। প্রদীপের তেল ফুরিয়ে আসছে, এই তো?
-- তুমি বুদ্ধিমান!
-- তা জানি না; তবে গান্ডু নই,অন্ততঃ জনগণকে মানুষ ভাবি, জানোয়ার নয়।
--- ধ্যাৎ, সব্সময় এত লড়াইক্ষ্যাপা হয়ে থাক কেন?
--- চুপ বে! কোন্ শালা শখ করে মরতে চায়? যে বলে সে মিথ্যে কথা বলে।
--- শখ নেই? তো গেছলে কেন মরতে বিপ্লব মারাতে?
--- মরতে নয়, বাঁচতে। আরও ভাল করে।
-- তো বেশ। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আরেকটা সত্যি কথা বলে যাও। যেটা বলতে তোমার অহংকারে লাগে।
--- কী?
--নারী।
--- নারী? মানে মহিলা? মেয়েমানুষ? এটা কী গাঁড় মাজাখি হচ্ছে!
-- লাইনে আসছ। তোমাদের আরেক খিস্তিবাজ কবি লিখে গেছেন না? বের্টল্ট ব্রেখট!
--- শালা! বেড়ালে আজ ব্রেখটের কোবতে শোনাবে? এই দিনও দেখতে হল?
--- আঃ, চুপ করে শোন দিকি!
" এই তো দেখুন ফাঁসির আসামী দাঁড়িয়ে,
লোকটা তো যাবে জীবনের মায়া ছাড়িয়ে,
সামনে মরণ বাড়িয়ে চরণ থমকে,
তবুও তাহার বুকের রক্ত গমকে।
কারণ কী তার?-মেয়েমানুষ।"
এবার ন্যাকামি না করে মুখ খোল।
--- শোন। এই মুহুর্তে আমার জীবনে একজনই নারী বা মহিলা। মেয়েমানুষ বলতে আমার বাঁধে। উনি হচ্ছেন শ্রীমা। পন্ডিচেরীর।
উনি রোজ রাতে আমার বিছানার কাছে এসে টুল টেনে নিয়ে বসেন। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। আমার সব ব্যথা চলে যায়।
দেখছ না, আমার কষ্ট কত কমে গেছে। আমি আবার কথা বলতে পারছি। আমার সব অবিশ্বাস চলে গেছে।
জানি আমার দিন ঘনিয়ে এসেছে। কিন্তু আমার কোন ভয় নেই।
শেষ চৌকাঠটা পেরোনোর সময় উনি নিজে এসে হাত ধরে আমাকে ওনার বাড়ি মানে ভবনে নিয়ে যাবেন।
-- তোমার কি ভর টর হচ্ছে নাকি? রোজ রাত্তিরে তো একজন মহিলা নার্স রেখে দেওয়া হয়েছে।বয়স্ক অভিজ্ঞ মহিলা।
উনিই তো এসে টুলে বসেন। ওষুধ খাওয়ান, ড্রিপ চালিয়ে দেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দেন।
-- ছাই বুঝেছ। বেড়ালের আর কত বুদ্ধি হবে! তখন শ্রীমা ওঁর রূপ ধরে আসেন।
উনি যা করেন তা কোন সাধারণ নার্স করতে পারে না।
গত শনিবারের রাত। আমার সারাদিন পেচ্ছাপ হয় নি। লিকুইড খেয়ে খেয়ে তলপেটে প্রচন্ড চাপ। কত চেষ্টা করা হল, কিছুই হল না।
ব্লাডার ফেটে যাচ্ছে। রাত সাড়ে দশটা। অসহ্য ব্যথায় চিৎকার করছিলাম। দাদাবৌদি দৌড়ে এলেন। ভাবছিলেন হাসপাতালে নিয়ে যাবেন।
কিন্তু উনি বল্লেন-- আপনারা শুতে যান।কিচ্ছু ভাববেন না। আমি আইস ব্যাগ আর হটব্যাগ দিয়ে পালা করে তলপেটে সেঁক দিয়ে দিচ্ছি, পেচ্ছাপ হয়ে যাবে।
তাই হল। মা যেমন করে ছোট বাচ্চাকে ঘুম থেকে তুলে পেচ্ছাপ করায়, উনি তেমনি যত্ন করে--।
খানিকক্ষণ পরে আমি ওঁর কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লাম।
শরীর ! শরীর !তোমার মন নাই?
আজ চিত্রা এসেছিল। কতদিন পরে। সম্ভবতঃ ও বৌদির সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে এবং আমার সব খবরাখবর নিচ্ছে।
খুব খুশি খুশি মুখে ঢুকল।
-- খুব ভালো দেখাচ্ছে অলক। দিব্যি সেরে উঠছ।
-- মায়ের দয়া!
মুহুর্তে ওর মুখের ভূগোল বদলে গেল।
--এখনও এত অহংকার অলক? শ্রীমার লকেট ও প্রার্থনার শক্তি তো দেখলে। তারপরেও এত ব্যঙ্গবিদ্রূপ!
--না, না সত্যি বলছি। কোন ইয়ার্কি না। শ্রীমা রোজ রাত্রে আমার কাছে আসেন, গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেন; ব্যথা চলে যায়।
ওর মুখ উজ্বল হয়ে ওঠে।
-- লক্ষ্মীছেলে!
বলে আমার গালে আলতো করে চুমু খায়।
আমি চমকে উঠি। ওর শরীর থেকে চেনা সাবান ও বডি লোশনের গন্ধ আমার মন খারাপ করে দেয়। আমি হাত চেপে ধরি। ও ছাড়িয়ে নেয় না।
শরীরের ছোঁয়ায় কি যে আনন্দ! বেঁচে থাকা কত সম্ভাবনাময়। কিন্তু আমি কি সেরে উঠবো?
-- একটা কথা বলছি, একটু স্বার্থপরের মত।
--বল।
-- তুমি আজ অনেকক্ষণ থাকবে? মানে অনেক অনেকক্ষণ? অনেক কথা বলার আছে যে!
ওর চেহারায় কি একটা মেঘের ছায়া? আমাকে এক দৃষ্টিতে খানিকক্ষণ দেখে বলল--ঠিক আছে।
এই সময় বৌদি ওর জন্যে চা নিয়ে ঢুকল। বলল- চিত্রা, ইচ্ছে করলে আজ রাত্তিরে থেকে যাও; কোন অসুবিধে নেই।
-- আমার যে অন্য কাজ আছে বৌদি। ঠিক আছে সন্ধ্যে নাগাদ যাব'খন। অলক, বেশি কথা বল না। আমি বলি, তুমি খালি শোন।
--- আবার বিয়ে করলে না কেন?
-- সব কিছু সবার জন্যে নয়। এটা যেই বুঝতে পারলাম, ইচ্ছেটা চলে গেল। আমার নিজের প্রফেশনাল কাজ ছাড়াও অরবিন্দ আশ্রমের কাজে সময় দিই; মনটা ভাল থাকে।
--- খালি মন আর মন! তোমার শরীর নাই চিত্রা?
ও হেসে ওঠে। এই তো সেই পুরনো আগমার্কা অলক যে শরীর বাদ দিয়ে কোন মন বা আত্মার অস্তিত্ব স্বীকার করে না।
তাহলে তুমি সত্যি সত্যি সেরে উঠছ।
--হ্যাঁ, তোমার ছোঁয়ায় আমার শরীর জেগে উঠছে, মানে সেরে যাচ্ছে।
ও কপট রাগ দেখিয়ে বিছানা থেকে উঠে একটা টুলে গিয়ে বসে।
-- শোন চিত্রা; রোজ একটা বেড়াল এসে বড্ড জ্বালায়। ওকে আর সহ্য করতে পারছি না। নানান হ্যানত্যান প্রশ্ন করে।
তারচেয়ে তুমি এই রেকর্ডিং মেশিনটা অন করে কাছে বস। আমার কিছু স্বীকারোক্তি আছে। ওগুলো যত্ন করে ধরে রাখতে হবে।
-- কী দরকার! ওসব ভুলে গেলেই ভাল নয়?
-- না, না! আমার এই ফালতু জীবনেরও কিছু গল্প আছে।
যেমন চাঁদের পাহাড়ের গল্পে পথ হারিয়ে মৃত্যুপথযাত্রী গুহার দেওয়ালে কিছু খুদে লিখে যায়--খানিকটা সেরকম।
বৌদিরা এসব থেকে লিখে একটা ডায়েরিতে তুলবে। তুমি কথা দাও আমি চলে গেলে সেটা তুমি একজনের কাছে পৌঁছিয়ে দেবে?
এই দায়িত্বটা আমি শুধু তোমাকে দিতে চাই, তুমি আমার এককালের কমরেড। বল?
-- কী সব অলুক্ষুণে কথা! তুমি সেরে উঠছ, সেটা বিশ্বাস কর।
--শোন চিত্রা। মায়ের দয়ায় আমি শান্তি পেয়েছি; ব্যথা চলে গেছে। কিন্তু দুদিন ধরে রোজ রাত্তিরে জ্বর আসছে। প্যারাসিটামলেও নামছে না।
বৌদি জানে না। আমি বুঝতে পারছি, মা ডাকছেন, কোলে তুলে নেবেন বলে।
চিত্রা ফুঁপিয়ে ওঠে।
কাছে এসে আমার কব্জি ধরে নাড়ি দেখতে থাকে। তারপর একটি গ্লাসে ডেটল জলে ডোবানো থার্মোমিটার তুলে নিয়ে আমার মুখে গুঁজে দেয়।
অলকের অসমাপ্ত ডায়েরির শেষ কয়েক পাতা
চিত্রা,
আমি আমার শেষ দেখতে পাচ্ছি। তাই কয়েকটা কথা বলতে চাই।
ওই কালো বেড়ালটা আর আসছে না। বাঁচা গেছে।
তোমার আমার কোন আইন মেনে ডিভোর্স হয় নি--আজও তুমি আমার বৈধ স্ত্রী। আমার শরীরের উপর সবচেয়ে বেশি অধিকার তোমার।
তাই বলছি কোন শ্মশান ক্রিয়া করতে হবে না। শ্রাদ্ধের দরকার নেই।
কোলকাতা মেডিক্যাল কলেজে আমি জন্মেছিলাম। বডি সেখানেই দিয়ে দিও।
আমি উপর থেকে কিছুই দেখতে পাব না, কিন্তু কাউকে ফাঁকি দেওয়া তোমার স্বভাবে নেই-- এটুকু ভাল করে জানি।
কিছু আফশোস রয়ে গেছে। আমি ভাল স্বামী বা ভাল বাবা কোনটাই হতে পারি নি। পারলে ক্ষমা করে দিও।
এই সময়ে আমার অকিঞ্চিৎকর গোটা জীবনটা বেশ দেখতে পাচ্ছি, অনেকটা যেন পুরনো সিনেমার মত।
তোমাকে কষ্ট দিতে চাই না, অত স্যাডিস্টিক নই। কিন্তু দুজনের কথা না বললেই নয়। আচ্ছা, চুপ করে থাকলে কি কিছু এসে যেত? কিচ্ছু না।
আসলে এই সময় মাথায় কনফেশনের ভূত চাগিয়ে ওঠে।
এই দুজন হল গৌরী বোস ও কোন এক মেজদি। দুটো গল্প? না, না; দুজনে মিলে একটাই গল্প। কেন তোমাকে বলতে চাইছি?
শুনলে বুঝবে যে আমার মনে বরাবর মেয়েদের নিয়ে একটা অপরাধ বোধ কাজ করেছে।
তাই বোধ হয় ভাল হাজব্যান্ড হতে পারি নি। হয়ত আমাকে মাফ করা একটু সহজ হবে।
গৌরী বোস নাকতলার মেয়ে, ওর বাবা একজন এল এম এফ ডাক্তার। গৌরী ওদের বেশি বয়সের আদুরে মেয়ে। আমি যখন ইলেভেনে উঠলাম তখন এ'পাড়ায় প্রথম টিউটোরিয়ল শুরু হল, আজকের ভাষায় কোচিং ক্লাস। সেখানেই ওর সাথে আলাপ।
সেই যে আমি স্কুলে স্যারের হাত থেকে বেত কেড়ে নিয়ে দু'টুকরো হয়ে জানলা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলাম, জানতাম না যে গল্পটা কাছাকাছি সবগুলো স্কুলে ছড়িয়ে গিয়েছিল,
মায় নাকতলা আর বাঁশদ্রোণীর মেয়েদের স্কুলেও।
যা হয় আর কি, অনেকেই আমাকে অন্য নজরে দেখত, শুধু আমি জানতাম না। আমার আদর্শ তখন প্রায় আনন্দমঠের সন্তানদলের মত।
ভাবতাম মেয়েরা বিপ্লবীদের দুর্বল করে দেয়। অনেক বিপ্লবী শুধু তাদের মা বা প্রেমিকার সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে পুলিশের ফাঁদে পড়েছেন।
কাজেই মেয়েদের সঙ্গে আমার প্রাথমিক ব্যবহার বেশ রূঢ়, প্রায় অভদ্র গোছের হত।
খেয়াল কর, তোমার আমার পরিচয়ও ছত্তিশগড়ের কলেজে গুন্ডাগর্দির বিরুদ্ধে প্রতিরোধের আন্দোলন থেকেই হয়েছিল। আমরা কমরেড হলাম।
কোথায় যেন নারী ও আন্দোলন আমার জীবনে একসঙ্গে জড়িয়ে গেছে।
যাকগে, শ্যামলা রঙের ছোটখাট দীঘল চোখের মেয়েটির সঙ্গে আমার দোস্তি হয়ে গেল।
সেসব দিনে নাকতলার কিছুটা গ্রামীণ পরিবেশে দুজন ছেলেমেয়ের মধ্যে খোলাখুলি মেলামেশা কথাবার্তা খুব সহজ ছিল না।
আমরা দেখা করতাম নাকতলা স্কুলের মাঠে। আমরা জনা চারেক। কথা হত, আড্ডা হত।
একদিন ও বলল-- আচ্ছা, তোমার কি আন্দোলন, বিপ্লব, ভিয়েতেনাম, কালচারাল রেভোলুশন ছাড়া অন্য কোন কথা নেই?
অন্যেরা হেসে উঠল। আমি খুব রেগে গেলাম।
-- আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখতে হলে এগুলো বাদ দিলে চলবে না।
ও মেনে নিল। ওকে বই পড়তে দিতাম। নানা ধরণের বই, সত্যি কতদূর পড়েছিল জানতাম না। তবে আমার চারমিনার ফোঁকার পয়সা ওই যোগাত।
ছোট্ট পার্স বা রুমালের খুঁট থেকে দুটো দশ পয়সা। একবার বলেছিলাম-- খালি পয়সা দিয়ে যাবি নাকি? তুই ও টান মেরে দ্যাখ!
ও ধ্যাৎ বলেও আমার কথা মেনে দুটো টান দিয়ে কাশতে কাশতে ফিরিয়ে দিয়ে বলল-- ভালো লাগে নি।
--- সত্যি বলছিস? তাহলে আমাকে চুমু খাস কী করে?
উত্তরে গুমগুম করে ক'টা কিল মেরে বলেছিল-- ধোঁয়া টানতে ভাল লাগেনি। তবে ছেলেদের গায়ে নিকোটিনের গন্ধ বেশ ভাল লাগে।
একটা সময়ের পর আমি সে সময়ের হিসেবে বেয়াড়া সাহসে ওর বাড়ি যেতে লাগলাম। ওর বাবা গোবেচারা গোছের ভদ্রলোক।
খবরের কাগজ হাতে আমার সঙ্গে তর্ক জুড়তেন। বোঝাতে চাইতেন যে স্বাধীন দেশে বিপ্লব-টিপ্লবের কোন দরকার নেই।
চেষ্টা করলে এই ব্যব্স্থার মধ্যেও মানুষের জন্যে কিছু ভাল কাজ করা সম্ভব।
ওর মা আমার সঙ্গে একটা কথাও বলতেন না, শুধু ভেতর থেকে নিয়মিত চা পাঠিয়ে দিতেন।
আমি উঠি উঠি করে শেষে উঠে পড়লে গৌরী বারান্দা অবদি এসে আমাকে কায়দা করে আঙুল দিয়ে চার বা পাঁচ দেখাত।
ওটা আমাদের কোড, মানে ক'টায় স্কুলের মাঠে মিট করতে হবে।
অন্ধকার নামলে বন্ধুরা মুখ টিপে হেসে চলে যেত। মাঠ খালি হত।
অন্ধকার আরও গাঢ় হলে মাঠের মাঝখানে বা স্কুলের বারান্দায় চাঁদের হাট বসত--- জোড়ায় জোড়ায় উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েরা।
ধীরে ধীরে কথা বন্ধ হয়ে যেত, শরীর বেজে উঠত।
একদিন ও এসে বলল-- পড়তে পড়তে কানে এল বাবা মাকে বলছে ' অলক ছেলেটা ভালই, স্বভাব চরিত্র বা যাই বল।
কিন্তু পড়াশুনো করে কই? খালি রাজনীতির খই ফুটছে। এর কি কোন ভবিষ্যৎ আছে?
তখন দুটো ঘটনা ঘটেছিল।
খবর এল বিজয়গড়ের কংগ্রেসি গুন্ডাদের ঠেক ডেমোক্র্যাসি ক্লাবের সঙ্গে হিন্টু লিন্টু বলে দুভাইয়ের ভালো ঝাড়পিট হয়ে গেছে। মজার ব্যাপার হল একজন নকশাল তো অন্য জন সিপিএম।
লোক্যাল ইউনিটে কথা হয়ে গেল যে চারদিকের বাম এলাকার মধ্যে ওই মোড়ে কংগ্রেসিদের মুক্তাঞ্চল অনেকদিন ধরে টিকে আছে, ইদানীং এরিয়া বাড়াচ্ছে। এবার ঘুঘুর বাসা না ভাঙলেই নয়। আর ওখানে একা ঢোকা কঠিন। সিপিএম ও নকশাল গ্রুপ দুদিক থেকে সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে ওই এলাকা দখল করবে, ক্লাবঘর ভেঙে দেওয়া হবে।
আমার ছোট্ট ইউনিটের উপর দায়িত্ব বর্তাল চারদিনে গোটা কুড়ি লালসাদা পেটো সাপ্লাই দেওয়া।
মশলা এসে গেল। আজকে চারটে স্যাম্পল বানিয়ে টেস্ট করতে হবে।
সন্ধ্যে ছ'টার আধো অন্ধকার। আমরা চারজন হাজির অরবিন্দনগরের পেছনের বাঁশঝাড়ের কোণায়।
এদিকটায় লোকজনের যাতায়াত নেই। কখনও কিছু ভাম খটাশ জাতীয় জন্তু চোখে পড়ে আর দু একটা সাপখোপ।
প্রথম মালটা আমিই চার্জ করলাম। প্রচন্ড শব্দে ফাটল; বাঁশের ঝাড়ের আশপাশ থেকে কিছু কাক বা অন্য কোন পাখির ঝাঁক শব্দ করে উড়ে গেল।
ন্যাপলা হাততালি দিয়ে উঠল।
পরেরটা তাপস চার্জ করল আর কড়কড়াৎ শব্দের প্রতিধ্বনি মিলিয়ে যাবার আগেই শোনা গেল একটা আর্ত চিৎকার, কোন মেয়ের গলায়।
ভয়ে আমার হাত-পা ঠান্ডা ! কেউ আহত হয়েছে? কোন মেয়ে? কেন মরতে এই সময়ে এই অস্থানে কুস্থানে কেউ আসে?
কিছু না ভেবেই দৌড়ে গেছি আর সামনের বটগাছের পেছনেই চোখে পড়ল একটা বডি, সাদা খোলের শাড়ি--নিঃস্পন্দ; নড়ছে না।
স্প্লিন্টার কোথায় লেগেছে? কিন্তু এই টেস্টিং এর মালগুলোতে পাথরকুচি গোছের সামান্য কিছু নিরীহ স্প্লিন্টারই দেওয়া হয়।
বেজায়গায় না বিঁধলে তেমন ভয়ের কারণ নেই।
কাছে গিয়ে বডিটার পাশে হাঁটু গেড়ে বসি আর ওকে ধরে উল্টে দেই। আরে, এ তো গৌরী! এ আমি কী করলাম?
দুহাতে তুলে নিই ওর শরীর; বুকে জড়িয়ে ঝাঁকাতে থাকি।
সোনামণি! তোর কী হয়েছে? কেন মরতে এখানে এসেছিলি? চোখ খোল, কোথায় লেগেছে বল। এক্ষুণি হাসপাতালে নিয়ে যাব।
গৌরী আস্তে আস্তে চোখ খোলে।
না; স্প্লিন্টার লাগে নি। শুধু ভয়ে সাময়িক অজ্ঞান হয়ে গেছ্ল।
গোটা ব্যাপারটার জন্যে আমিই দায়ী। ওকে বলেছিলাম যে আজকে ওই বাঁশবাগানে মাল টেস্ট করব।
তাই আজ বিকেলে ওর সঙ্গে দেখা করতে পারব না। ও চুপ করেছিল।
মনে মনে জেদ চেপে গেছল যে মেয়েদের কেন বাদ দেওয়া হবে! আর মাল চার্জের টেস্টিং? নিজের চোখে দেখার ইচ্ছে।
-- হল তো? শখ মিটেছে? এবার বাড়ি চল। তোর পা কাঁপছে। হাত ধর।
বাকি তিনবন্ধুদের বলি ঠেকে গিয়ে রিপোর্ট করতে --টেস্টিং সাকসেসফুল। তিনদিন পরে কুড়িটা পেটো ডেলিভারি দেওয়া যাবে।
শুধু বিজয়গড় ইউনিটের লোক এসে নিয়ে যাক, এয়ারব্যাগ নিয়ে আসুক। আমরা ডেলিভারি দিতে ওপাড়ায় যাব না।
আমরা দুজন অন্ধকারে হাতধরে হাঁটতে থাকি। একটু পরে ও হাত ছাড়িয়ে নেয়--বাড়ি এসে গেছে।
বাগানের ছোট আগলটা খোলার আগে ও আমাকে বলে--একটু দাঁড়া। তুই কি জানিস যে তুই আজকে আমাকে একটা সুইট নাম দিয়েছিস?
-- কখন আবার নাম দিলাম?
-- সেই যে মাটিতে পড়া অবস্থায় ঝাঁকাচ্ছিলি? সোনামণি! এস এম!
এবার ও ফিক করে হেসে ভেতরে চলে যায়।
‘মরালিস্ট’ কি গালি?
আচ্ছা, মরালিস্ট শব্দটা গালি কেন হবে?
বিপ্লবীরা কেন এসেন্শিয়ালি মরালিস্ট হবে না? আরে মানুষের মনে বিপ্লবের আবেদন ঠিক কোন জায়গায়?
একটা নৈতিক ভিত্তিতে নাড়া দেওয়া--তাই নয় কি?
তাপস বলল--আসল ব্যাপারটা হল ক্ষমতা দখল করা।
ধ্যেৎ, তাহলে আর চম্বলের ডাকাত আর আমাদের মধ্যে তফাৎ রইল কোথায়?
বংকিম আনন্দমঠে ঠিক জায়গাটা ধরেছিলেন, তাই ভবানন্দকে মরতে হল।
নাকতলার মোড়ে নড়ার দোকানে নিরোধ নামে একটি পনের পয়সায় তিনটে বিক্রির বিরুদ্ধে অ্যাকশন করব ঠিক করেছিলাম।
আমরা ইয়াং ছেলেমেয়েদের একটা গ্রুপ গিয়ে ওর দোকানের যে কয়টা বিক্রির জন্যে আছে সেগুলো নষ্ট করে দেব।
টাঙানো বিজ্ঞাপনগুলো ছিঁড়ে ফেলব। তারপর সেখানে একটা স্ট্রিট কর্নার মিটিং করে লোকজনকে বোঝাব ঃ
---এইসব নতুন নতুন খেলনা প্রতিক্রিয়াশীল সরকার আমেরিকার ইশারায় বাজারে ছেড়েছে একটিই উদ্দেশ্য নিয়ে সেটা হল?
-- যুবছাত্রদের বেড়ে চলা বিপ্লবী চেতনাকে পঙ্গু করে দেওয়া।
সবাই কিন্তু কিন্তু করে সমর্থন জানাল। গৌরী হাত তুলল-- একটা কথা, নড়া আমাদের পরিচিত ছোট দোকানদার। ওর কী দোষ? ও তো শ্রেণীশত্রু নয়।
তাই ওর কেন লোকসান হবে? আমরা ওর দোকানে যে সামান্য কয়টা নিরোধ আছে তার দাম দিয়ে দেব।
তাহলে আমরা সাধারণ লোকজনের সহানুভূতি পাব আর নড়াকে বোঝাব যে ও যেন এসব জিনিস দোকানে না রাখে।
সবাই সমর্থন করায় গৌরী উৎসাহ পেয়ে আরও বলল-- দেখ, এর একটা প্র্যাকটিক্যাল দিক আছে। আমরা দাম দিয়ে দিলে ও পুলিশে যেতে পারবে না।
নইলে পুলিশ ডেকে আমাদের বিরুদ্ধে দোকান লুঠের চার্জ লাগাতে পারে।
এটা ভাবিনি তো! নাঃ, মেয়েটার বুদ্ধি আছে। আগামী দিনে ভালো গেরিলা হবে।
--শোন কমরেড্স্, আমাদের কাজ হল প্রচার অভিযান, গুন্ডামি নয়। আমরা অ্যাকশানের মধ্যে দিয়ে এইসব যৌনচেতনা নিয়ে সুড়সুড়ি,
এইসব নতুন নতুন সেক্স ম্যাগাজিন --মানে "জীবন যৌবন", "সুন্দর জীবন" এগুলির ভেতরের রাজনীতি নিয়ে মানুষকে সচেতন করব।
গৌরী আবার হাত তুলল।
--তাহলে ব্যাপারটা এইভাবে হোক। আমরা প্রথমেই ওর দোকানের জিনিসগুলো, মানে কী যেন বলে ওইগুলো সবকটা কিনে নেব, দাম দেব।
তারপর ওর দোকানের সামনে ওগুলো পুড়িয়ে দেব আর লোককে বোঝাব। এর জন্যে আমরা সবাই চাঁদা তুলে পয়সা জোগাড় করব।
আমার কি গৌরীকে একটু একটু হিংসে হচ্ছে? এমন প্ল্যান আমার মাথায় কেন আসেনি?
ঠিক হল, শনিবার দিন আমরা বিকেল চারটেয় নিজেদের তোলা পয়সাকড়ি নিয়ে নাকতলা স্কুলের মাঠে মিট করব, বিকেল চারটেয়।
চারটে গড়িয়ে পাঁচটা হল, তারপর ছ'টা। কেউ আসেনি। শুধু আমি আর গৌরী। আমি ছটফট করছি।
গৌরী হাসছিল। বলছিল-- হবে , হবে সব হবে। অধৈর্য হোস না।
তারপর হঠাৎ বলল-- শোন্, একটা কথা আছে। আমি কিন্তু ওইসব নিরোধ পোড়ানো অ্যাকশনে থাকতে পারব না, পয়সা দিয়ে দেব।
রাগের চোটে মাথায় আগুন জ্বলল।
নিজের অজান্তেই ওর হাতটা কখন মুচড়ে ধরেছি।
-- তোর পয়সাও চাই না; তোকেও না। সবাই গেছে, তুইও যা।
--উঃ, ছাড় দিকি, লাগছে।
আমি লজ্জা পেয়ে ছাড়তেই ও দেখাল জায়গাটা কেমন লালচে হয়ে উঠেছে।
--শোন, তুই এত লড়াইক্ষ্যাপা কেন? এভাবে চললে তোকে দিয়ে কিস্যু হবে না। ব্যাপারটা বোঝ।
আমি প্ল্যানটা মাকে বলেছিলাম। মা বলল প্ল্যানটা ভাল। মা সাপোর্ট করবে। অন্য মাসিমাদের সঙ্গেও সাপোর্টে বলবে। কিন্তু আমার থাকা চলবে না।
আমি এখনও স্কুলে পড়ি। নিরোধ আন্দোলন করলে পাড়ায় নানান কথা উঠবে। এটা তোরা ছেলেরাই আগে শুরু কর।
আমি চুপ। এবার বাড়ি ফিরতে হবে। ওকে জিগ্যেস করলাম-- কিন্তু বাকি ছেলেগুলো কথা দিয়েও এল না কেন?
গৌরী ফিক করে হেসে ফেলল-- ওরা আজ আসবে না। ওদের আজ রামগড়ের মাঠে মেজদি ডেকেছে যে!
মেজদি! সে আবার কে?
আছে আছে; রামগড়ের দিকে থাকে। এই আমারই বয়সী, বড়লোকের মেয়ে। দেখতে টপ! ওর কথায় রামগড় গাঙ্গুলীবাগান এলাকার শ'খানেক ছেলে ওঠাবসা করে।
তুই ওদের ডেকেছিস, কিন্তু ঠিক ওই সময়েই মেজদি ডেকেছে যে! ওর ডাক একবারে নিশির ডাকের মত, যেতেই হবে।
--আমি বিশ্বাস করি না। আমার কোন কমরেডের ওপর কোন মেয়ের এমন জাদু চলতে পারে না।
-- বেশ, বিশ্বাস করিস না; আগে বাজিয়ে দেখে নে। সবাইকে আরেকটা ডেট দে।
এমন দিবি যেন সেদিন মেজদিও ডাকে। তারপর হাতে পাঁজি মঙ্গলবার।
সেই ডেট এল, এক বৃহস্পতিবার।
সেদিন মহাশিবরাত্রি।
সকাল থেকে মেয়ের দল শাড়ি থেকে ফ্রকপরা সবাই দলে দলে হাতে বেলপাতা, দুধের ঘটি নিয়ে নাকতলার শিবমন্দিরে যাচ্ছে, শিবের মাথায় ঢালবে বলে।
আর পাড়ার মোড়ে ফচকে ছোঁড়াগুলো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঝারি করছে ।
এবং মেয়েদের শুনিয়ে শুনিয়ে বলছে-- অতদূরে মন্দিরে গিয়ে লাইন দেওয়ার দরকার কি? শিবপূজো তো এখানেই --।
মেয়েরাও হাসি চেপে না শোনার ভান করে চলে যাচ্ছে, বিশেষ করে সঙ্গে মা -কাকিমা থাকলে।
কেউ কেউ মুখ ঝামটা দিয়ে উঠছে-- হ্যাঁ হ্যাঁ, শিবের ষাঁড়গুলোকে এখানেই দেখতে পাচ্ছি।
এইভাবেই বিকেল এল, --আবার সেই নাকতলা স্কুলের মাঠ, আবার বিকেল চারটে থেকে গড়িয়ে সাড়ে চারটে, শেষে পাঁচটা।
মাঠে শুধু আমি আর গৌরী; আমি রাগে চিড়বিড় করছি আর ও মুচকি মুচকি হাসছে।
এবার ও আমার হাত ধরল।
চল। --আরে কোথায় যাব?
চলই না; এখানে দাঁড়িয়ে মুখখারাপ করার চেয়ে ভাল হবে।
আমরা পদ্মশ্রী সিনেমা হল পেরিয়ে দুটো কচুরিপানা ভরা পুকুর ছাড়িয়ে মেঠো রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে একটা বড় ফাঁকা মাঠে এসে গেছি।
না , ঠিক ফাঁকা নয়।
মাঠের এককোণায় দাঁড়িয়ে জনা পনের ইয়ংছেলে; অধিকাংশের পরণে হাফপ্যান্ট, এদের মধ্যে দেখি চারজন আমাকে দেখে ধরণী -দ্বিধা- হও ভঙ্গিতে মুখ লুকোচ্ছে।
আমার সেই চার স্যাঙাৎ, যাদের জন্যে এতক্ষণ রোদ্দূরের মধ্যে মাঠে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলাম।
এদের সঙ্গে পরে হিসেব করব।
আপাততঃ আমার চোখ এদের লীডার দেবী চৌধূরাণীর দিকে। এই তবে মেজদি! যার আদেশে ছেলেরা ওঠে বসে?
মেয়েটিকে আগে কখনও দেখিনি। পানপাতার মত মুখ, পাঞ্জাবী মেয়েদের মত গড়ন, হাইট প্রায় আমারই কাছাকাছি।
মেয়েটিও আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে, ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি।
সবাই চুপ। সবার চোখ আমাদের দুজনের দিকে। আমরা একাগ্র । আমি চোখ নামাব না। দেখি, ও কতদূর যায়?
-- কী রে গৌরী? এই তোর সেই বয়ফ্রেন্ড? যার কথা এত বলেছিস? এ তো পাতি গুন্ডার মত দেখতে। উঠতি বয়েসের মাস্তান!
-- ভ্যাট! বাজে বকিস না তো? আয়, তোদের আলাপ করিয়ে দিই।
এ হল আমার পুরনো বন্ধু--সুদর্শনা চক্রবর্তী, আমার জামরুল, মানে আমরা জামরুল পাতিয়েছি তো।
একেই পাড়ার ছেলেরা মেজদি বলে ডাকে। কেমন দিদি -দিদি ভাব তো, তাই।
--- আর ও হচ্ছে তোর বয়ফ্রেন্ড অলক, বা তোর ম্যাচো লাভার। যাকে সবাই ভয় পায়?
--- তুই তো পাস না!
-- আমি কোন পুরুষকেই ভয় পাই না। খামোকা তোর লাভারকে কেন--
--- একদম ফালতু কথা বলবেন না!
ওর কথা শেষ হবার আগেই আমি গর্জে উঠেছি।
আমি কারও বয়ফ্রেন্ড বা লাভার নই। আমরা কমরেড! কমরেড মানে বোঝেন?
-- কই না তো! এ তো একদম নতুন শব্দ শুনছি। তা আপনি বুঝিয়ে দিন না।
আমার হাড়-পিত্তি জ্বলে গেল। এসব ন্যাকা ন্যাকা কথা আমার একেবারে সহ্য হয় না।
--- লাইনে আসুন। এইসব ছেলেপুলেদের মাথা খাচ্ছেন কেন?
-- আমি? মাথা খাচ্ছি?
-- হ্যাঁ, খাচ্ছেন। আপনি আপনার সৌন্দর্য্যের আপনার ব্যক্তিত্বের অপব্যবহার করছেন।
সুদর্শনা খিলখিল করে হেসে ওঠে।
-- তাহলে মানছেন যে আমি দেখতে সুন্দর? আপনার চোখেও?
--- আমি জানতে চাইছি এইসব জোয়ান ছেলেদের ভেড়া করে রেখেছেন, কেন?
-- ওরে জামরুল! এ যে বেশ কথা বলে। তা আপনিও আমার ভেড়ার পালের মেম্বার হবেন নাকি? আপনাকেই কম্যান্ডার করে দেব।
কী রে জামরুল? ছাড়তে পারবি তো? ভেবে দেখ।
মেয়েটার ফর্সা গালে পাঁচ আঙুলের দাগ বসিয়ে দেবার উদগ্র ইচ্ছেটা অনেক কষ্টে দমন করলাম।
--- আবার বলছি, কেন এমনি করছেন? কেন আমার মিটিং এর দিনই ওদের ডেকেছেন?
-- আপনার দোকানে গিয়ে চোটপাট করা গ্যাং এর মিটিং কবে এবং কোথায় ডাকবেন তার আমি কি জানি?
-- তাহলে এটা কী? কো-ইন্সিডেন্স?
--- তা কেন হবে? এবারের দিনক্ষণ তো জামরুল ঠিক করে দিয়েছে, মানে আপনার কমরেড গৌরী!
এসব কী হচ্ছে! গৌরী আর মেজদি বন্ধু? জামরুল! যত্তো সব গাঁইয়া কারবার! আর সেটা গৌরী লুকিয়েছে।
--- দেখুন, আমরা সিরিয়াস। আপনাকে বলছি যে যেদিন আমাদের কাজ থাকবে সেদিন আপনি এদের ডাকবেন না। এইটুকু ভদ্রতা নিশ্চয় আশা করতে পারি?
-- এটা কোন কথা হল? আপনারা বিপ্লব করতে চান? সেটা তো কোন অফিসের চাকরি না যে ক্যালেন্ডার আর ঘড়ি ধরে হবে?
-- তাহলে আপনি কো-অপারেট করবেন না?
আমি ছোট এবং সরু চোখে তাকাই।
--- শুনুন; আমি কিছুই করব না। আপনি আপনার ছেলেদের ভাল করে বোঝান। যদি আপনার কথায় কোন সারবস্তু থাকে তবে ওরা এমনিই আমার কাছে আসবে না।
নইলে বুঝতে হবে কোথাও গোড়ায় গলদ আছে; মানে আপনার বিপ্লবের থিওরিতে।
এরপর আমাদের কোন অসুবিধে হয় নি।
নড়ার দোকানের নিরোধ-পোড়ানো হেব্বি সাকসেস হল। অনেক লোকজন খোলাখুলি সমর্থন করলেন। নড়াকে আগেই দাম দিয়ে দেওয়ায় ও খুশি হল।
এমনিতেই এইসব জিনিস পানের দোকানে কিনতে লোকে লজ্জা পাচ্ছিল। তাই রেখেও খুব একটা বিক্রি হত না।
আর এতে দলের মধ্যে আমার ওজন খুব বেড়ে গেল। কথা হল, আগামী বছর আঠেরোয় পা দিলেই আমাকে পার্টি মেম্বারশিপ দিয়ে দেবে।
এখন আমি ক্যান্ডিডেট মেম্বার!
গড়িয়াহাট রোড ধরে দ্রুত পায়ে এগোচ্ছি হটাৎ পেছন থেকে --শুনছেন? এই যে কমরেড!
পেছন ফিরে দেখি--মেজদি!
-- আরে আপনি! আপনাকে যে কী বলে--!
--- যা দেবার সেটা ফুটপাথে লোকের ভিড় আর ধূলোবালির মধ্যে না দিলে বিপ্লব হবে না?
মেজদির চোখের হাসিতে এসব কিসের আভাস?
-- মানে?
-- আর দশ'পা এগোলেই নির্মলা বলে একটা নতুন রেস্তোরাঁ খুলেছে---সাউথ ইন্ডিয়ান কুইজিন। একটু চেখে দেখবেন নাকি?
-- হবে না। আমার পকেটের দৌড় কাঠের বেঞ্চিতে বসে কাঁচের গেলাসে ফোটানো চা আর চার্মিনার পর্য্যন্ত।
--- আহা! ডেকেছি তো আমি,--।
--- সে হয় না। আপনি পেমেন্ট করবেন আর আমি সাঁটাবো--!
-- পার্টির হোলটাইমাররা সিমপ্যাথাইজারদের পয়সায় সাঁটায় না?
-- ফালতু কথা বলবেন না! আমি কোন হোলটাইমার নই, আর আপনিও আমাদের সিমপ্যাথাইজার না।
-- ও বাবা! আপনার পার্টিকে নিয়ে একটু মজা করতে পারব না? আপনি কি পাগলা জগাই না রামগড়ুরের ছানা?
(চলবে)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।