১৫
রমেন মন দিয়ে পড়ে ফেলে ''বসন্তের দূত রুক''।
এরপর পেত্রোগ্রাদের রাস্তায় বিশাল শোকমিছিল। রমেনের চোখের পাতা ভিজে যায়।
তবে কিছুদিন পরে বুঝতে পারে ওর সবচেয়ে বেশি ভাল লেগেছে যখন ইস্ক্রাপন্থীরা গুপ্তপ্রেস দাঁড় করানোর চেষ্টা করছেন তখন্কার একটি বর্ণনা।
একটি গাঁয়ের ঘরে সেই গোপন ছাপাখানা। একটি মেয়ে আর দুজন কর্মী আগামী সংখ্যার প্রকাশন নিয়ে ব্যস্ত। সব প্রায় ঠিক।
কিন্তু লেনিনের একটি বাইরে থেকে পাঠানো ছোট প্রবন্ধ এখনও এসে পৌঁছয়নি যে। বিশেষ দূত এক মহিলা সেসব নিয়ে আসবেন।
অবশেষে সেই মহিলা পৌঁছে গেলেন। বাইরে তুষার বৃষ্টি। মোটা মত মহিলা শীতে কালিয়ে গেছেন।উনি ওনার কোট খুলতে লাগলেন। আর রোগা হতে থাকলেন।
ভেতরে গায়ে গায়ে বেঁধে এনেছেন গোপন ইস্তেহার। কোট নামাতেই উনি হয়ে গেলেন একহারা সুন্দরী মহিলা।
আর কি কান্ড! বাউম্যান দৌড়ে গিয়ে তাঁকে চুমো খেতে লাগলেন। আসলে তিনি বাউম্যানের স্ত্রী, হেডকোয়ার্টারের গোপন কর্মী।
ওঁদের দেখা হল এক বছর পর।
রমেন এবার রোমাঞ্চিত। তাহলে বিপ্লবী হতে গেলে আনন্দমঠের সন্ন্যাসী হতে হবে না! রোম্যান ক্যাথলিক পাদরী ও নয়!
রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসীরা যেমন মাছমাংস খান, তেমনি সত্যিকারের কমিউনিস্ট বিপ্লবীরাও বেশ রসে বশে থাকেন।
--দূর বোকা! মার্ক্সের ছিলেন জেনী, এংগেলসের এক আইরিশ বিপ্লবী মহিলা। লেনিনের ক্রুপ্স্কয়া, স্তালিনের তো মেয়েও ছিল। আর মাও?
-- ওনার তো চারটে বউ।
-- বাজে বকিস না! প্রথম বিয়ে তো বাল্যবিবাহ-পুতুলখেলা। দ্বিতীয় বউকে ফাঁসিতে লটকে দেয়া হলে মাও সারারাত কেঁদে কবিতা লিখেছিলেন--
I have lost my proud poplar!
----বেশ, কিন্তু তৃতীয় বউ? কাব্যে উপেক্ষিতা? লং মার্চের সাথী, অতগুলো বাচ্চার মা। শেষে অপেরার হিরোয়িন ল্যাং পিং এর সঙ্গে দেখা হতেই আগের জনকে তালাক!
ধম্মে সইবে? মেয়েটা তো প্রায় আদ্দেক বয়সের।
-- ওতো লাভ ম্যারেজ, বয়সের কথা কোত্থেকে আসছে?
--ছো: লাভ ম্যারেজ! মাও তখন নয়াচীনের একমেবাদ্বিতীয়ম! উনি চাইলে কোন মেয়ে না করবে?
-- এসব চীপ বুর্জোয়া অপপ্রচার!
মিথিলেশ বলে-- এইসব অনর্থক তক্কাতক্কি! এসব চীনের পার্টি ও জনগণ বিচার করবে? আমাদের কি মাথাব্যথা? বরং এই ম্যাপটাকে দেখ, ফোর্ট উইলিয়মের।
রমেন, ভাব তো কোথায় কোথায় এল এম জি বসালে ফোর্ট উইলিয়মের চারদিকে ঘেরাবন্দী করে অন্তত: দশঘন্টার মত ফোর্ট উইলিয়ম থেকে সৈন্যেরা বেরোতে না পারে।
রমেন ভ্যাবাচাকা খায়। ফোর্ট উইলিয়ামের ম্যাপ! মানে?
আমরা কি ইস্টার্ন কম্যান্ডের ঘাঁটি দখল করতে যাচ্ছি? কবে? এই ক'জন মিলে!
এ কোথায় এসে পড়েছি? পাগলাগারদে?
--এই আমাদের মেইন প্রোগ্রাম, ক্যালকাটা আপসার্জ! কোড নেম--‘ক্যাল আপ’।
ও ভাবতে থাকে।
কি করে এদের সঙ্গে জুটলাম!
গত বছর স্কটিশ চার্চ কলেজের ইকনমিক্স ডিপার্টমেন্টের এক সিনিয়র স্টুডেন্টে বাসবদার বাড়িতে যাওয়া হয়েছিল।
কিছু বইয়ের লেনদেন এবং আড্ডা।
উনি তখন ভারতে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের জায়গায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের তত্ত্বের প্রবক্তা।
ওনার মতে নকশালরাও সিপিএম এর ব্যুরোক্র্যাটিক কালচার নিয়ে এগোচ্ছে। তাই ওদেরও কোন ভবিষ্যৎ নেই।
আর চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লব যে ভাবে এগোচ্ছে তাতে মনে হয় এখন বুড়ো মাওয়ের ডেভলাপমেন্ট জৈবিক নিয়মেই বন্ধ হয়ে গেছে।
এখন কমরেড চিয়াং চিং হলেন বিশ্ববিপ্লবের নেতা ইত্যাদি ইত্যাদি।
* ইনি মাওয়ের চতুর্থ স্ত্রী, পরে দেং জিয়াও পিং এর আমলে চারচক্রের প্রধান হিসেবে বন্দী এবং সম্ভবত: জেলেই প্রয়াত।
রমেন সব সময়েই নতুন কথা এবং মাইনরিটি ভয়েসের প্রতি আকৃষ্ট হয়।
তাই সে ভরদুপুরে হাজির দক্ষিণ কোলকাতার বিবেকানন্দ পার্কের পাশে ওঁর সরকারি চাকুরে বাবার ফ্ল্যাটে।
গিয়ে দেখে সেখানে আরেকজন তরুণের সঙ্গে ওঁর তুমুল তর্ক চলছে। তার মধ্যে কিছু কথাবার্তা কোডে হচ্ছে, যার মানে বোঝা ওর অসাধ্য।
সে যাই হোক, একসময় রমেন উঠে দাঁড়ায়।
সেই অন্য ছেলেটিও, অনেকটা বক্সার মহম্মদ আলির মত দেখতে, উঠে দাঁড়ায়। বলে- চল, বাস স্টপ অব্দি একসঙ্গে যাই।
সিনিয়র দাদাটির সঙ্গে মহম্মদ আলির চোখে চোখে কথা রমেন দেখতে পায় ।
তৃতীয় দিন কলেজের ক্যান্টিনে মামুর দেয়া কাগজের আগুনে রমেন চার্মিনার ধরাচ্ছিল, বাসব ওর পিঠে হাত রাখল।
-- নীচে রাস্তায় চল, তোর সঙ্গে কথা আছে।
ও চমকে উঠলো। কথা ঘোরানোর চেষ্টায় বললো--দেখেছ বাসবদা, এখন থেকে চার্মিনারের প্যাকেট দাম বেড়ে ২৮ পয়সা হয়ে গেছে।
আর ভেতরে একটা পাতলা সাদা কাগজ ও জোড়া হয়েছে। বিজিত বলছিল-- চারুবালা আজকাল সায়া পরা শুরু করেছে।
-- বাজে কথা ছাড়্। সেদিন আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে কোথায় গিয়েছিলি? সোজা বাসস্টপ তো যাসনি। ওই ছেলেটা নিশ্চয় তোকে বিবেকানন্দ পার্কে নিয়ে গেছল। তারপর চা-সিগ্রেট খাইয়েছে আর তোকে বলেছে বাসব জিগ্যেস করলে এসব অস্বীকার করতে।
রমেনের হাওয়া বন্ধ। ও তোতলাতে থাকে।
-- শোন, ন্যাকামো বন্ধ কর। তুই কী বলবি আর কী বলবি না—সব জানি! ও আমার পুরনো বন্ধু। যা বলছি মন দিয়ে শোন।
ও একটা ফ্যাসিস্ট অর্গানাইজেশনের সঙ্গে যুক্ত। ওরা ইয়ং ছেলেদের নিয়ে খুব ভাও দেয়। লেনিন-স্তালিন-বাউম্যান-জেরজিনস্কি আওড়ায়।
তারপর ক্যাল-আপ এর কথা বলে।
-- ক্যাল-আপ?
-- হ্যাঁ, হ্যাঁ, ক্যালকাটা আপসার্জ। বিপ্লবের এমন গেঁড়ে ব্লু-প্রিন্ট কোথাও পাবি না। এদের কোন ইডিওলজিক্যাল কথাবার্তা বলতে শুনতে পাবি না।
শুধু স্টেনগান, এল এম জি, মর্টার এইসব। এদের লং মার্চের বোকা-- প্রোগ্রাম আর মাওয়ের ইয়েনান অব্দি কয়েক হাজার লি লং মার্চ একদম আলাদা ব্যাপার।
তোকে নিশ্চয়ই আবার কোন পার্কে বা সিনেমা হলের সামনে দেখা করতে বলেছে? খবর্দার যাবি না।
-- সত্যি কথা বলতে কি, কালকেই বিকেল সাড়ে তিনটেয় ভিক্টোরিয়ার সামনে দেখা করার কথা।
-- এদের কাজকম্মো সব পঞ্চাশ বছর আগের অনুশীলনী, যুগান্তর দলের মতন।
--- বাসবদা, এদের তাত্ত্বিক নেতাটি কে?
-- পরে কখনও জানতে পারবি। এক বিগড়ে যাওয়া প্রাক্তন বিপ্লবী।
ছোটবেলায় ভূতের গল্পে পড়িসনি তান্ত্রিকবাবার পিশাচসিদ্ধ হবার সাধনা করতে গিয়ে নিজেই পিশাচ হয়ে যাওয়া? প্রায় সেইরকম।
না, আমি সেদিন অ্যাপয়েন্টমেন্ট রাখতে পূর্ব নির্ধারিত জায়গায় যাইনি। বেশ কিছু মাস কেটে যায়।
ওদের কথা প্রায় ভুলে গেছলাম। কিন্তু তাহলে কী করে আজ ওদের সঙ্গে বসে আছি?
জানি, বসে আছি বিজনদার জন্যে। এমন ভালমানুষ বিজনদা, সবার জন্যে ভাবে। ওকে না বলা মুশকিল। ও আমার পেছনে অনেক টাইম ইনভেস্ট করেছে।
রাজনৈতিক পন্ডিতিতে কাঁচা, কিন্তু কোন ভড়ং নেই। আমি বিজনদাকে ভালবাসি।
আর কিছু? বলে ফেল; মনের অগোচরে পাপ নেই।
হ্যাঁ, আমি বুঝি যে আমার ভেতরে একটা আমোদগেঁড়ে অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় ছেলেমানুষ লুকিয়ে আছে।
ওই বন্দুক তুলে নেওয়ার স্বপ্ন!
অন্য পার্টিগুলিতে আগে সমর্থক হও, তার পরে এজি গ্রুপ মেম্বার, তারপর ক্যান্ডিডেট মেম্বারশিপ।এতগুলো ধাপ পেরিয়ে তবে ফুলটাইম মেম্বার।
শালা! যেন মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, গ্র্যাজুয়েট হয়ে তারপর পোস্ট গ্র্যাজুয়েট।
আর এখানে সোজা গণমুক্তি ফৌজের সদস্য। এমন সুযোগ কি ছাড়া যায়?
একদিন অলিভ গ্রীন ইউনিফর্ম পরে স্টেনগান ঝুলিয়ে নাকতলায় ফিরব, সেদিন সবার চোখ ট্যারা হয়ে যাবে।
তোমার ওই ‘সবার’ মধ্যে গীতশ্রীও আছে তো? ভাগ শালা!
--রমেন, কি ভাবছ? শোন, তোমার চেনা কোন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার আছেন? এই পেন্সিলে আঁকা ডায়াগ্রামটা নাও।
আমি এর একটা প্ল্যান এলিভেশন আর আইসোমেট্রিক ভিউ চাই--ভাল করে ড্রয়িং শীটে আঁকা । যদি কিছু অল্পসল্প খরচা লাগে তাহলেও চলবে।
রমেন একনজর দেখে বাড়ানো কাগজটা। তাতে সিলিন্ড্রিক্যাল একটি ফিগার, তার গোলাকার মুখটাতে গোটা পাঁচেক ফুটো।
এটা কি কোন এলএমজি বা অমনি কোন অস্ত্রের ড্রয়িং? আবার তাকে বিশ্বাস করে কাজটা দেয়া হয়েছে! রমেন রোমাঞ্চিত বোধ করে।
বিশ্বাসের সম্মান রাখতেই হবে। ও আশৈশব ল্যাবা আতাক্যালানে বটে, কিন্তু কারো বিশ্বাসের বাড়ানো হাতের সঙ্গে ধোঁকা!
না, নিজের কাছে ছোট হয়ে যাবে যে!
সত্যি? তাহলে হায়ার সেকেন্ডারির সময় মিত্রার ব্যাপারটা কি হল?
না, ওকে তো ঠকানো হয় নি। কিন্তু ও নাকতলা ছেড়ে হুগলী চলে গেলে আমার আর কী করার আছে।
-- অ্যাই রমেন! ওঠ, আমরা যাই। এখন বড়দের মধ্যে ক্যাচাল হবে। তুই-আমি এসবের মধ্যে কেন থাকবো?
চল, ধর্মেন্দ্র-আশা পারেখের নতুন ফিল্ম "শিকার'' এসেছে মেনকায়।
হেলেন আছে, আর আশার "পর্দে মেঁ রহনে দো''--- টপ দিয়েছে।
শচীন ওর দিকে হাসি-হাসি মুখে তাকিয়ে।
রমেনের চটকা ভাঙে, দেখে ঘরের মধ্যে আবহাওয়া বেশ গরম। রীনা চৌধুরির মাসের ওয়েজ পুরো খরচা হয়ে গেছে। হাতে আরো বারো দিন।
দলনেতা মিথিলেশ ওয়েজ বাড়াতে বা অ্যাডভান্স দিতে একেবারে রাজি নয়।
-- আপনি এত কথায় কথায় ট্যাক্সি চড়লে এই ওয়েজে পোষাবে না। বাসে সবাই যাতায়াত করছে। ট্যাক্সি এমার্জেন্সিতে।
আপনার রোজই এমার্জেন্সি হয় কি করে! কী এমন রাজকাজ?
খোঁচা খেয়ে রীনা চৌধুরি প্রায় ব্যাগ গুছিয়ে বেড়িয়ে যাচ্ছিলেন।
-- আপনি মেয়েদের সমস্যা বোঝার চেষ্টা করছেন না। সবসময় ভীড়ের বাসে আমি উঠতে পারি না।
শচীন ও রমেন বেরিয়ে যায়।
রাস্তায় শচীন ওকে বোঝায়।
-- দেখ্, আমরা যখন তখন পয়সা ওড়াতে পারিনা। লোকের চোখ
টাটাবে; তারপর পুলিশের খোচরের কানে যাবে।
-- আর পোস্ট অফিস ডাকাতির মামলা সলভড্ হয়ে যাবে।
ওরা দুজনে হাহা করে হেসে ওঠে।
-- দেখ, আমরা ক্রিমিনাল নই। আমরা রাজনৈতিক ডাকাত। আদর্শের জন্যে। অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের মত।
আমরা এই পয়সায় লাক্সারি করতে পারি না। মাগীবাজি করতে পারিনা।
-- তা আজ যে সিনেমা দেখবো? হিন্দি সিনেমা!
-- ৬৫ পয়সার সাধারণ সীটে বসবো, ব্যালকনিতে নয়। এটুকু কিছু না। আমেরিকান থ্রিলারগুলো পড়ে দেখবি --
সব সাকসেসফুল ডাকাতরা ধরা পড়ে বেধড়ক পয়সা খরচ করতে গিয়ে আর রন্ডীবাজি করতে গিয়ে।
ভালকথা, চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন নিয়ে সিনেমাটা দেখেছিস?
-- না:, কিন্তু প্রীতিলতার জীবনী পড়েছি, সুর্য্য সেনের জীবনী পড়েছি।
-- "চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ'' দু'খন্ডে, --পড়েছিস? অনন্ত সিংয়ের লেখা। পড়ে ফ্যাল, ঠকবি না।
-- রীনাদির ব্যাপারটা কী বলতো? মিথিলেশদা একটু হার্শলি বিহেভ করছে না কি?
-- ঠিক করছে। রীনা ওর লাভারের সঙ্গে ফাট দেখিয়ে ট্যাক্সি করে ঘুরবে সংগঠনের পয়সায়? ওর ওয়েজ বাড়াতে হবে? এটা কোন কথা হল?
আমাদের লাভার নেই তো কি আমরা ফালতু! বন্দুক ধরবো আমরা আর--।
শোন, রীনা হল মিথিলেশের শালী, কিন্তু ওদের মধ্যে খাড়াখাড়ি আছে।
কারণ মিথিলেশ যখন রীনার বড় বোনকে বিয়ে করতে যায়, তখন রীনা বাধা দিয়েছিল।
-- কেন?
-- মেয়েদের সাইকোলজি তুমি কি বুঝবে, তুমি এখনও বাচ্চাছেলে!
শচীন হা-হা করে হেসে ওঠে।
আনন্দবাজার পত্রিকা গোষ্ঠী ১৯৬৮র শীতের শেষে ময়দানে মুক্তমেলার আয়োজন করলেন।
এক রোববার। জানা গেল কোথায় তুষার রায় গাছের তলায় দাঁড়িয়ে তাঁর কবিতা ""ব্যান্ড মাস্টার'' পড়ছেন।
সমরেশ বসু গান শোনাচ্ছেন দেখে সুনীল গাঙ্গুলী বলছেন আমিও গান গাইব। পাবলিক উৎসাহ দিচ্ছে—চালিয়ে যাও মহারাজ!
কোথাও একটি আলাদা ভীড়ের সামনে কোন বাউল পল্লীগীতি গাইছে। কোথাও থিয়েটার ক্যাম্প বলে একটি নাটকের দল ভিয়েৎনাম নিয়ে নাটক করছে।
আমাদের কাছে খবর পৌঁছলো যে ওখানে আবাপ গোষ্ঠী ডেকাডেন্ট কালচার প্রোমোট করছে।
ওখানে নাকি মা-মেয়ে হাতে রুমাল নিয়ে ভীড়ের সামনে নাচছে-- '' বোল, গোরী বোল, তেরা কৌন পিয়া''।
আর নাকি শকুন মেরে গাছ থেকে টাঙিয়ে তার নীচে কবিতা পড়া হচ্ছে।
- কেন?
-- ব
ুঝলি না?ওটাই তো বিকৃতি। এইসব আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদী সংস্কৃতির ধামাধরা ইয়ের দল যৌনবিকৃতি আর অসুস্থ সংস্কৃতির প্রচার করে।
ওরা ড্রাগস্-গাঁজা না খেয়ে লিখতে পারে না। ওই আবাপ'র কবিগুলোকে দেখ, বীটনিক কবি অ্যালেন গীনস্বার্গ এর বন্ধু।
ওদের লেখায় শ্রেণীসংগ্রাম নেই, খালি সেক্স আর অবক্ষয়। ইয়ং জেনারেশনকে গোল্লায় পাঠানোর চক্রান্ত।
আমাদের কিছু করা দরকার।
--তাই?
--হ্যাঁ রে ! সুনীল গাঙ্গুলী বলে ওদের একজন উঠতি সাংবাদিক পূজো সংখ্যা ‘দেশ’ পত্রিকায় ‘আত্মপ্রকাশ’ বলে একটা যা তা নভেল লিখেছে।
এসব কয়েক বছর আগে থেকেই শুরু হয়েছে। এককালের কমিউনিস্ট সমরেশ বোসের ‘বিবর’, ‘প্রজাপতি’, ‘দগ্ধশুক্র’ এসব পড়েছিস?
আমাদের পালটা আঘাত হানতে হবে।
সম্ভবত: দু'সপ্তাহ পরে যখন মুক্তমেলার দ্বিতীয় প্রোগ্রাম আবাপ'তে ঘোষণা করা হল। ছোট ছোট দলে কিছু নকশালপন্থী ছেলেরা ওখানে পৌঁছলো।
রমেনের তখন তিন জায়গায় ঠেক। কফি হাউস-প্রেসিডেন্সির আড্ডায় যাওয়া বেশ কমে এসেছে। আছে নাকতলা- গড়িয়া-বাঘাযতীন , যার কেন্দ্রবিন্দু এন্ড্রুজ কলেজ, মানে মলয়-দেবু-মনোজ-হিমাদ্রী-বাদল। আর অবশ্যই একটি মেয়ে, ওর সঙ্গে দেখা হলেই ও হাসে। মেঘলা দিনটা ঝলমলিয়ে ওঠে।
কিন্তু মেয়েটি পড়াশুনো ছেড়ে বামপন্থী রাজনীতি করাকে নাকচ করে দেয়।
যাকগে, ময়দানে পৌঁছে ও দেখলো একজায়গায় প্রকাশ কর্মকার ও শর্বরী রায়চৌধুরী তাঁদের ছবি ও ইনস্টলেশন সাজিয়ে বসে আড্ডা দিচ্ছেন।
দেশ পত্রিকার দৌলতে ওঁদের আধুনিক পেইন্টিং ও ভাস্কর্যের রঙিন ছবি রমেন দেখেছে বটে, কিন্তু কিস্যু বোঝে নি।
আর এক জায়গায় একটি গ্রুপ করচ্ছে অলীকবাবু নাটক।
তাতে এক অভিনেতা তাঁর অসাধারণ চার্লি চ্যাপলিনোপম বডি ল্যাংগোয়েজযুক্ত অভিনয়ে পাবলিককে নড়তে দিচ্ছে না।
তারপর অভিনীত হল "কালোজাম'' বলে একটি আধাঘন্টার নাটক, পাঁচশ' বছর আগের স্প্যানিশ নাট্যকারের লেখা।
তাতে রঙ্গব্যঙ্গের আড়ালে ফুটে ওঠে গরীব চাষীর সামান্য জমি পাওয়ার চিরন্তন স্বপ্ন।
এবার ও যায় বাউলদের আড্ডায়--"সর্প হইয়া দংশ গো গুরু, রোজা হইয়া ঝাড়; রমণী হইয়া গুরু পুরুষের মন হর। ও গুরু, কাঙাল জানিয়া পার কর।''
বাউলেরা একটু দম নিলে ধুতির ওপর কালো কোট পরা গ্রামীণ চেহারার একজন ব্যক্তি দাঁড়িয়ে ওঠে--
আমি বিহারের পুর্ণিয়া জেলার; আপনাদের একটি চুটকুলা শোনাতে চাই।
ভীড় সমস্বরে-- চালাও, চালাও!
-- আমাদের গাঁয়ের একজন রেলগাড়িতে চড়ে কলকাত্তা আসবে, কোনদিন রেলগাড়ি দেখেনি, কী করে চিনবে?
আমি বলেছি,- ইস্টেশান যাইয়ে। ওহাঁ লাইন পর যো দিখবে কালে রং, নীচে সে পানি ছোড়বে, উপর সে ধুঁয়া, ওটাই রেলগাড়ি আছে। ব্যস্, চড় যানা।
তো হমার দোস্ত করল কি ইস্টেশানে গিয়ে দেখল বাঙালী টিটিবাবু কালা কোট, মুখে সিগারেট, লাইনের ওপর বসে পিসাব করছে।
তো ও সোজা ওর পিঠে চড়ে বসে বললো-- অব্ লে চলো কলকাত্তা!
ভীড়ের মধ্যে কেউ হাসল না।
হটাৎ দৌড়তে দৌড়তে এসে হাজির সুকান্ত,-- আরে রমেন, তুই এখানে কি করছিস্? চ, চ! ওদিকে ঝামেলা লেগে গেছে।
একটা জায়গায় বিশাল জটলা। পাঁচ-ছজনের হাতাহাতি চলছে, কিন্তু নিরপেক্ষ জনগণ একটু পরেই দুই যুযুধান পক্ষকে আলাদা করে জানতে চাইলেন ব্যাপারটা কি?
আশুতোষ কলেজের ছাত্রনেতা সৎপথী উত্তেজিত ভাবে বললো--এখানে বাংলার মাটিতে অবক্ষয়ী ইয়াংকি কালচারের প্রচার আমরা সহ্য করব না!
(আজকে কেমন বেঙ্গালুরুর মর্যাল পুলিশদের কথার মত মনে হয় না?)
তখন দর্শকদের মধ্য থেকে বলা হলো ঝগড়া না করে আপনারাও আপনাদের মত বিপ্লবী সংস্কৃতির পরিচয় দিন না!
আপনারা আপনাদের গান বা নাটক করুন,অন্যদের ওদের মত করে করতে দিন। আমরা সবারটাই দেখতে রাজি।
একজন বাউল বল্লেন-- আমরাও ইয়াংকি কালচার?
আমাদের বন্ধুরা আলাদা বৃত্ত বানিয়ে নিজেদের মত করে গান শুরু করলেন।
উৎপল দত্তের লিটল থিয়েটার গ্রুপের অভিনেতা শান্তনু ঘোষের লেখা এবং অজিত পান্ডের সুর
-"বল কৃষ্ণে কি আর কংসকারায় বেঁধে রাখা যায়,
আহা, মাঠে মাঠে লক্ষ কৃষ্ণ অগ্নিবাঁশের বাঁশি বাজায়।''
কিন্তু সবাই তো আর গায়ক নয়। গান জমল না। ভীড় অন্য দিকে সরে গেল। তখন আই পিটি এর গায়ক প্রদীপকে গাইতে বলা হল।
সে ডায়েরি বের করে গাওয়ার চেষ্টা করলো। গানের নির্বাচন ভালো হচ্ছিল না, জমলো না।
হটাৎ হাজির সৎপথী। সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বললো- একটা কথা কমরেডস্! সবাই শুনুন।
আমরা একই প্ল্যাটফর্মে ওদের সঙ্গে থেকে গান গেয়ে ওদের প্রোগ্রামকে একরকম লেজিটিমেসি দিচ্ছি, এটা ঠিক নয়।
বিপ্লবী এবং প্রতিবিপ্লবী সংস্কৃতি একসাথে থাকতে পারে না, হয় ওরা নয় আমরা!
সঙ্গে সঙ্গে দুটো পেটো ফাটলো।মারামারি শুরু, এখানে ওখানে, বিচ্ছিন্ন ভাবে। কে যে কাকে মারছে বোঝা মুশকিল।
ফক্কড় রমেনের বরাবর মারামারিতে অনীহা। ও ভীতুর ডিম। চটপট নিরাপদ জায়গা খুঁজতে লাগলো।
ও গেছলো ভবানীপুরের ইন্দ্র রায় রোড, নন্দন রোডের ছেলেগুলোর সঙ্গে।
দেখা গেল ওই পাড়ার একটা ছেলেকে অচেনা কিছু লোক বেধড়ক পেটাচ্ছে। ও শ্যামাদাকে ডেকে আনলো।
বয়স্ক শ্যামাদা পুরনো বক্সার। উনি গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজেদের ছেলেটাকেই পেটাতে লাগলেন। কলার ধরে টেনে নিয়ে যেতে বল্লেন-- এটাকে আমি ভাল করে বানাচ্ছি।
আপনারা অন্যদের দেখুন। তারপর ওকে টেনে কিছুদূর নিয়ে গিয়ে বল্লেন-- এবার পালা, যত জোরে পারিস।
ওদিকে নতুন রিক্রুট শিবাশিস চারজন রথীর সঙ্গে একাই দারুণ লড়ে যাচ্ছে।
আসলে দুটো রথী লড়ছে, আর দুটো মুখের কাছে চোঙার মত হাত করে চেঁচাচ্ছে-- নকশালপন্থীরা সি আই এর দালাল!
এর পরে পুলিশ এসে গেল। কিছু এলোপাথাড়ি অ্যারেস্ট হল।
কিন্তু সৎপথীর রণনীতি সফল, মুক্তমেলা ভেস্তে গেল।
ফেরার পথে রমেন বন্ধুদের সঙ্গে নিজাম গিয়ে বীফরোল খেয়ে পরমবিপ্লবী কর্তব্য পালনের আনন্দ নিয়ে ঠেকে ফিরল।
সকালে দেখলো আনন্দবাজার লিখেছে কিছু ফুলকচি তরুণেরা হাঙ্গামা করেছিলেন।
এঁদের নকশালপন্থী বললে হয়তো আসল নকশালরা রাগ করতে পারেন। এরা নাদান।
এইভাবেই চলছিল। কিন্তু সময় বদলে যাচ্ছে।
রমেন হুগলি জেলায় একটি নকশাল গ্রুপের নেতৃস্থানীয় এক তুতো দাদা্ ও তার বন্ধুদের সঙ্গে নিজের মেন্টর মিথিলেশের
হাওড়া স্টেশনের ভেতরে বিশাল ঘড়ির পাশে কফিশপে দেখা করার ব্যবস্থা করল। ওরা গরমের মধ্যে কফিশপে বসে একঘন্টা কাটিয়ে দিল।
তবু দাদা ও তার কমরেডদের পাত্তা নেই। হতাশ হয়ে ওরা ফিরে গেল।
সাতদিন পরে খবর এল দাদারা ঠিক সময়ে ঘড়ির নীচে দাঁড়িয়ে আধঘন্টা অপেক্ষা করে চলে গেছে।
নতুন বিপ্লবী সংগঠনের প্রতিনিধিরা যে কফিশপের ভেতরে বসে গাঁটের পয়সা খরচ করবে তা হুগলির সিনিয়রদের ভাবনায় আসেই নি ।
শেষে মরিয়া হয়ে ওরা তিনজন, মিথিলেশ, সুকান্ত ও রমেন, ভোরের ট্রেন ধরে হুগলি গিয়ে এক ডেরা থেকে ঘুমন্ত দাদা ও তাদের সঙ্গীদের জাগিয়ে দেয়।
হুগলি গ্রুপ এদের ম্যান-মানি-গান ও ক্যাল-আপ প্রোগ্রামকে তুড়ি দিয়ে উড়িয়ে দিয়ে বলে যে এসব বালখিল্য কল্পনা, পুরনো সন্ত্রাসবাদী দলের অনুকরণ।
এর সঙ্গে ব্যাপক জনগণকে রাজনৈতিক ভাবে উদ্বুদ্ধ করে বিপ্লবের পথে নিয়ে আসার প্রোগ্রামের কোন সম্পর্ক নেই।
প্রেসিডেন্সি-মৌলানার বন্ধুদের থেকে খবর আসে যে ওরা কোলকাতা ছেড়ে মেদিনীপুর জেলার ডেবরা-গোপীবল্লভপুরে যাবার কথা ভাবছে।
ওকে বলে—তৈরি থাক, পরের ব্যাচে তুইও যাবি।
রমেনের বুঝভম্বুল অবস্থা। এতগুলো গ্রুপ। সবাই বলছে কৃষিবিপ্লব; একটা ছোট গ্রুপ বলছে – না , এখানে শহরকেন্দ্রিক শ্রমিক অভ্যুত্থান হবে।
প্রেসিডেন্সি গ্রুপের কাকার নেতৃত্বে একদল গ্রামে যাচ্ছে। কেউ বলছে-- আগে পার্টি তৈরি হোক।
আর ও যে দলে মাথা মুড়িয়েছে –তারা বলে পার্টি-ফার্টি পরে তৈরি হবে। আগে বকবকানি আর আঁতলেমি ছেড়ে বন্দুক হাতে নাও।
লেট আস অর্গানাইজ ক্যালকাটা আপসার্জ!
ইতিমধ্যে একদিন রাত এগারোটায় বেহালার অজন্তা সিনেমার কাছে একটা শস্তা রেস্তোরাঁ থেকে রাতের খাবার খেয়ে বেরোনোর সময়
ও মুখোমুখি হয় ওর নাকতলা স্কুলের ইকনমিক্সের মাস্টারমশায়ের। উনি তখন পাশের পানদোকানের পাটের দড়ি্র আগুন থেকে সিগ্রেট ধরাচ্ছিলেন।
ওঁর মুখের অভিব্যক্তিতে বিস্ময়, রাগ ও ঘেন্না পরপর খেলা করে গেল।
ক’দিন পরে বাড়িতে ছোটকা ওকে ডেকে বললেন—তুই বাজে জায়গায় রাত্তিরে ঘুরে বেড়াস।
ওরা কারা? কাদের সঙ্গে আজকাল বন্ধুত্ব হয়েছে?
রমেন বাড়ি ছাড়ল। (চলবে)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।