এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  ইতিহাস

  • শিবাজী ও শম্ভাজীের হিন্দুরাষ্ট্রঃ ইতিহাসবিদ আচার্য যদুনাথ সরকারের চোখে  --পর্ব ১

    Ranjan Roy লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | ইতিহাস | ২৮ অক্টোবর ২০২৫ | ৬৯ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • শিবাজীর হিন্দুরাষ্ট্রঃ ইতিহাসবিদ আচার্য যদুনাথ সরকারের চোখে  

     যাঁরা আজ ধর্মের সাদাকালো বিভাজনের ভিত্তিতে ভারত ইতিহাসের পুনর্লিখনে ব্যস্ত, তাঁরা দুই বাঙালী ইতিহাসবিদ যদুনাথ সরকার এবং রমেশ চন্দ্র মজুমদারের নাম শুনলেই দণ্ডবত হন।
     মনে হয় তাঁরা যদুনাথ সরকারকে মন দিয়ে পড়েন নি।
     
    আচার্য যদুনাথ সরকার সেই সময়ের হিসেবে রীতিমত ডিসিপ্লিন্ড ইতিহাসবিদ। 
    উনি সমস্ত উপলব্ধ তথ্যের প্রাসংগিকতা এবং বিশ্বাসযোগ্যতা সমসাময়িক অন্য তথ্যের সঙ্গে মিলিয়ে দেখে তাকে তাঁর গবেষণার অন্তর্ভুক্ত করেন।
    বর্তমান প্রবন্ধটি ডঃ সরকারের শিবাজীকে নিয়ে একশ’ বছর আগে প্রকাশিত দু’টি বইয়ের--  Shivaji and his Times (১৯১৯)  এবং The House of Shivaji--ভিত্তিতে লেখা। 
    এখানে বর্তমান লেখকের নিজস্ব মতামত না দিয়ে আচার্য যদুনাথের বক্তব্য উদ্ধৃত করে নির্ণয়ের ভার পাঠকের উপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে।
     
     
    যদুনাথ তাঁর Shivaji and his Times এর প্রথম সংস্করণের (১৯১৯) ভূমিকায় বলেছেন--
     ক্যাপ্টেন গ্রান্ট ডাফের তিন খন্ডে মারাঠাদের ইতিহাসে  সমস্ত তথ্য আন- ক্রিটিক্যালি নেয়া হয়েছে। 
    গ্রান্টের তথ্যসূত্র শিবাজীর  মৃত্যুর ১০৮ বছর পরে লেখা বিবরণ এবং জন্মের ১৮৩ বছর পরে রচিত ‘চিটনিস বাখার’ লোকগাথা যা বাগাড়ম্বর এবং মিথ্যা বিবরণে পূর্ণ।

    যদুনাথ নির্ভর করেছেন এবং প্রাথমিকতা দিয়েছেন শিবাজীর সমসাময়িক লেখাপত্র, দলিল -যেমন 'সভাসদ বাখার' এবং ফার্সি, ওলন্দাজ ও বৃটিশ ডকুমেন্টসকে।
    উনি লক্ষ্য করেছেন
     কীভাবে শিবাজীকে নিয়ে মিথ এবং গালগল্পের নির্মাণ দ্রুত বেড়ে উঠেছে, এমনকি বিংশ শতাব্দীতে এই উদ্দেশ্যে জাল দস্তাবেজও তৈরি হচ্ছে। (পৃঃ ৭, ভুমিকা)।
    যদুনাথ তাই যেসব তথ্যপ্রমাণের সত্যতা প্রশ্নাতীত সেগুলি  লিপিবদ্ধ করেছেন এবং অন্য সম্ভাবনাগুলোর সত্যতা খুঁটিয়ে দেখেছেন। (ঐ)  
    বর্তমান নিবন্ধের প্রথম পর্বে  শিবাজীর অংশটিতে প্রথম বই Shivaji and his Times (১৯১৯) থেকে উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে। 
    শম্ভাজীর রাজত্ব অংশের সব উদ্ধৃতি দ্বিতীয় বই The House of Shivaji থেকে নেয়া। সেটা দ্বিতীয় পর্বে দেয়া হোল। 
     
    যদুনাথের শিবাজী চর্চার প্রেক্ষিতঃ
    উনি বলছেনঃ 
    সপ্তদশ শতাব্দীর দাক্ষিণাত্যের জটিল ইতিহাসে মারাঠারা অন্যতম গ্রন্থি মাত্র, একমাত্র নয়। তাই শিবাজীর উদ্ভবকে বুঝতে হলে মোঘল সাম্রাজ্য, বিজাপুর এবং গোলকোণ্ডার আভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে বিশদ বুঝতে হবে। তাই ওঁর বইটি শুধু শিবাজীর জীবনী নয়। (ঐ)  

    একই সঙ্গে যদুনাথ দেখিয়েছেন যে লড়াইটা মূলতঃ ক্ষমতা পাওয়া এবং ধরে রাখা নিয়ে, অর্থাৎ হিন্দু বনাম মোগল এমন সাদাকালো নয়। 
    ধর্মীয় উপাদান নিশ্চয়ই ক্রিয়াশীল, কিন্তু সর্বোপরি নয়।
    যেমন,  মোগল সম্রাট ঔরঙজেবের প্রধান সেনাপতি ছিলেন হিন্দু রাজা জয় সিং, পরে যশবন্ত সিং। 
    আবার মারাঠাদের এবং মোগলদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বিজাপুরের সুলতানের সেনাপতির নাম ভেঙ্কটাদ্রি মুরারী!  (পৃঃ ৩৬৪) 
    আর রাণা রাজ সিং সম্রাট ঔরংজেবের সঙ্গে সখ্যতা করে নিজের রাজ্যে দিব্যি ছিলেন।  
    শিবাজী কাজী হায়দারকে তাঁর সচিব নিযুক্ত করেছিলেন। তাঁর প্রধান নৌ সেনাপতি ছিলেন সিদ্দি মিসরি নামের আবিসিনিয়ান মুসলমান।
     
    আবার শিবাজীর বড় ছেলে শম্ভাজী শিবাজীর বিরুদ্ধে মোগল সেনাপতি দিলীর খাঁ’র সঙ্গে যোগ দিলেন। 
    সম্রাট ঔরঙজেব তৎক্ষণাৎ শম্ভাজীকে সাতহাজারী  মনসবদার করে তাঁকে একটি হাতি উপঢৌকন পাঠিয়ে দেন। 
    শম্ভাজী মোগল বাহিনীর সঙ্গে গিয়ে শিবাজীর ভুপালগড় দুর্গ তছনছ করেন।  এক বছর পরে আবার পিতার কাছে ফিরে আসেন।
     

    শিবাজীর মোগল বশ্যতা এবং বিদ্রোহঃ ঘটনা পরম্পরা
    শিবাজী নিজে পুরন্দর দুর্গের যুদ্ধে মোগল সেনাপতি জয় সিংহের কাছে পরাজিত হয়ে শর্ত মেনে মোগল পক্ষে যোগ দিয়ে বড় ছেলে শম্ভাজী এবং কিছু নজরানা নিয়ে ঔরংজেবের দরবারে হাজির হন। 
    কিন্তু অপেক্ষাকৃত সম্মান না পেয়ে দরবার ছেড়ে চলে আসেন, এবং কিছুদিন পরে প্রাণদণ্ডের আশংকায় পালিয়ে বিজাপুরে চলে আসেন।
     সেই বিদ্রোহের শুরু। উনি মোগলদের বিরুদ্ধে অনেকবার বিজাপুরের সুলতানের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন।
     
    শিবাজীকে লেখা মোগল সম্রাট ঔরংজেবের চিঠিগুলো এ বিষয়ে কিছু ধারণা বদলে দেবে।
    ২২ এপ্রিল ১৬৫৭ ঔরংজেবের শিবাজীকে লেখা চিঠি—
    উনি আদেশ দিচ্ছেন যে বিজাপুরের যে দুর্গগুলো শিবাজীর অধীনে রয়েছে তার দায়িত্বভার  শিবাজীর প্রার্থনা অনুযায়ী তাঁকে অর্পণ করা হল। পৃঃ ৯৪
    ২০ এপ্রিল, ১৬৫৮ –তোমার অপরাধ গম্ভীর। তবু এবারের মত মাফ করলাম। কারণ, তুমি এখন থেকে আমার অনুগত থাকার কথা দিয়েছ। পৃঃ ৯৭

    একবছর পরে। 
    সব শত্রুকে হারিয়ে সিংহাসনে বসেছি। তুমিও আনন্দ কর এবং সিংহাসনের প্রতি অনুগত থাক। তবে তোমার অভিলাষ পূর্ণ হবে। 
    শায়েস্তা খাঁকে দাক্ষিণাত্যের সুবেদার নিযুক্ত করা হয়েছে। তুমি তার অধীনে কাজ করতে থাক। পৃঃ ৯৮
    কিন্তু শিবাজী সে বান্দাই নন। উনি শায়েস্তা খাঁকে অগ্রাহ্য করে সুরাত এবং আরও কিছু সম্পন্ন নগর লুঠ করলেন। 
     
    ওনার গেরিলা আক্রমণে শাহী ফৌজ ব্যতিব্যস্ত। তখন ঔরঙ্গজেব এই ‘পাহাড়ী ইঁদুরকে” ধরতে রাজা জয় সিংকে দাক্ষিণাত্যে পাঠালেন। 
    শিবাজী ১২ জুন ১৯৬৫ তারিখে পুণেতে জয় সিংহের কাছে আত্মসমর্পণ করলেন।  

    তার আগে জয় সিং কড়া করে চিঠি দিলে শিবাজী দুটো প্রস্তাব রাখলেনঃ
    ১ শিবাজী আত্মসমর্পণ করতে রাজি, যদি তাঁর  প্রাণ এবং সমস্ত সম্পত্তি নিরাপদ থাকবে –এমন গ্যারান্টি দেয়া হয়।
    নইলে,
    ২ শিবাজী নিজের কিছু এলাকা বিজাপুরের সুলতানকে দিয়ে তাঁর সঙ্গে সন্ধি করে দুজনে মিলে মোগল সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাবেন। পৃঃ ১০৬

    শিবাজী এলে জয় সিং শর্ত রাখলেনঃ হয় শিবাজী তাঁর অধীন সমস্ত দুর্গ মোগলদের হস্তান্তর করুন এবং আগ্রায় গিয়ে সম্রাটের কাছে মাফি চান।
     তাহলে উদার হৃদয় সম্রাট মাফ করতে পারেন। নয় শিবাজী নিরাপদে নিজের জায়গায় ফিরে যান।  
    শিবাজী বললেন—আমি এখন মোগল সাম্রাজ্যের অধীনতা স্বীকার করে তার জন্যে সেবা প্রদান করতে এসেছি। 
    তাই আমার যত দুর্গ স্বতঃ মোগল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে।
     
    মাঝরাত পর্য্যন্ত দরাদরির পর ঠিক হল শিবাজীর ছোট বড় মিলিয়ে ২৩ টি কেল্লা মোগল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হবে। 
    আর রাজগড় সমেত ১২টি ছোট বড় কেল্লা শিবাজীর অধীনে থাকবে। তবে শর্ত হল শিবাজীকে তার কাজকর্মে মোগল সাম্রাজ্যের বশ্যতা ও আনুগত্য দেখাতে হবে।
    শিবাজী বললেন—আমার আর বাদশাহের সামনে যাওয়ার মত মুখ নেই। তাই আনুগত্যের প্রমাণ হিসেবে আমার ছেলেকে (শম্ভাজী) আগ্রায় পাঠাচ্ছি। 
    তাকে যেন, আপনার কথামত,  পাঁচ হাজারী মনসবদার করে দেয়া হয়। (পৃঃ ১০৮ এবং ১০৯ )

    ১৩ জুন, ১৬৬৫ নাগাদ মোগল সেনাপতি মির্জা জয় সিং এবং রাজা শিবাজীর মধ্যে পুরন্দর দুর্গের সন্ধি সাক্ষরিত হল।
    যদুনাথ বলছেন—এই সন্ধিটা যেন দুই ডাকাতের মধ্যে লুঠের মালের বাঁটোয়ারা! বিজাপুর সাম্রাজ্যকে (আদিল শাহ) ভাগাভাগির চক্রান্ত। 
    তবে এটা স্পষ্ট –কোথাও শিবাজীকে বিজাপুর এলাকায় চৌথ আদায় করার অধিকার দেয়া হয় নি বা দাক্ষিণাত্যের ভাইসরয় করার আশ্বাস দেয়া হয় নি—
    যদিও এসব সভাসদ বাখার ৩৮ এ বলা আছে। যদুনাথের মতে এধরণের আশ্বাসনের দাবি অসম্ভব মনে হয়।  পৃঃ ১২১

    শিবাজীর ঔরঙ্গজেবকে লেখা বশ্যতা স্বীকার করে পত্র লিখলেন, জুন ১৬৬৫ (পৃঃ ১২২)।
    সম্রাট ঔরঙ্গজেবের থেকে ফরমান (লিখিত সম্মতি) এলে শিবাজী আনন্দের সঙ্গে জয় সিং এর শিবিরে ২৭ সেপ্টেম্বর ১৬৬৫ তারিখে এলেন।
    ডিসেম্বর ১৬৬৫ নাগাদ চল্লিশ হাজার মোগল সৈন্য জয় সিং এর নেতৃত্বে বিজাপুর আক্রমণ করে। তাঁর সঙ্গে যুক্ত হয় শিবাজীর সাত হাজার পদাতিক এবং দুই হাজার অশ্বারোহী। পৃঃ ১১৮
    ঔরঙ্গজেব শিবাজীকে রত্নখচিত ছোরা উপহার দিলেন। পৃঃ ১৩১
     

    ঔরঙ্গজেব সকাশে আগ্রায় শিবাজীঃ ইতিহাসের মোড়
    ১২ মে, ১৬৬৬। শিবাজী দেওয়ান -ই-খাসে সম্রাটের সামনে উপস্থিত হয়ে ১০০০ মোহর এবং ২০০০ টাকা নজরানা এবং ৫০০০ উপহার হিসেবে দিলেন। 
    পুত্র  শম্ভাজী দিলেন ৫০০ মোহর, ১০০০ টাকা নজরানা এবং ২০০০ টাকা নিসার। সেদিন সম্রাটের জন্মদিন। 
    প্রধান মন্ত্রী জাফর খান এবং প্রধান সেনাপতি জয় সিং কে খেলাত দেয়া হল, আর কাউকে নয়।
    শিবাজী অসন্তুষ্ট। সম্রাট জানতে চাইলেন শিবাজীর কীসের অসুবিধে হচ্ছে?
     
    উনি কুমার সিংকে বললেন—আমাকে যথোচিত মর্যাদা দেয়া হয় নি। এতক্ষণ সম্রাটের সামনে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে! আমার মনসবদারি চাই না।  আমি চললাম, আমার মাথা কেটে ফেললেও আর সম্রাটের দরবারে হাজির হচ্ছি না। এই শেষ।
    ঔরংজেব জানতে পেরে তিন অমাত্যকে পাঠালেন—এই খেলাত শিবাকে দাও এবং বুঝিয়ে সুজিয়ে শান্ত করে আমার দরবারে নিয়ে এস।
    শিবাজী ফিরলেন না। দরবারে বিরোধী অমাত্যের দল বলতে লাগল—এত বড় বেয়াদপি! তবু সম্রাট সহ্য করছেন! (পৃঃ ১৩৫)

    ১৫ মে পর্য্যন্ত শিবাজী দরবারে গেলেন না, জ্বর হয়েছে। তবে নিজের ছেলে শম্ভাজীকে পাঠিয়ে দিলেন। সম্রাট শম্ভাজীকে একটি শিরোপা, রত্নখচিত ছোরা এবং মুক্তোর মালা উপহার দিলেন। পৃঃ ১৩৭।
    রাজা জয়সিং এর বিরোধীরা—যেমন রাজা যশবন্ত সিং প্রধান উজির জাফর খান এবং বেগম সাহিবা সম্রাটের কান ভাঙাতে লাগলেন।
     জয় সিং এর আশকারায় শিবা আপনাকে অপমান করল।
    ঔরংজেব শিবাজীকে কোতল করার নির্দেশ দিলেন। 
    কিন্তু জয় সিং পুত্র কুমার রাম সিং জানতে পেরে আমিন খানকে বললেন—আগে আমাকে মারুন।
    তখন বলা হল যদি রাম সিং জামিন হয় যে শিবাজী আগ্রা ছেড়ে যাবেন না তাহলে তাঁর প্রাণ রক্ষা হবে। 
    রামসিং শিবাজীকে দিয়ে তাঁর ঘরে শিবের মাথায় হাত রেখে শপথ করালেন এবং তারপর জামিন দস্তাবেজে দস্তখত করে মোহর লাগালেন। পৃঃ ১৩৯
     

    কিন্তু ১৭ অগাস্ট, ১৬৬৬ তারিখে শিবাজী তাঁর ছেলে শম্ভাজীকে নিয়ে ফলের ঝুড়িতে লুকিয়ে আগ্রার গৃহবন্দী অবস্থা থেকে পালিয়ে গেলেন।
     মোগল বাহিনী অনেক পরে টের পেয়ে তাড়া করেও ধরতে পারেনি। এটা মোগল সম্রাটের পক্ষে অত্যন্ত লজ্জাজনক হার।
    কিন্তু তারপরেও শিবাজী ও ঔরংজেবের মধ্যে শাসক ও বিদ্রোহী সম্পর্ক হয় নি। বরং ঔরংজেব কূটনীতির মাধ্যমে শিবাজীর আনুগত্যের চেষ্টা চালিয়ে গেছেন।
     
    ৬ মে ১৬৬৭।
    সম্রাট একজন বার্তাবাহকের মাধ্যমে শিবাজীকে খবর পাঠালেন যে তাঁর অপরাধ ক্ষমা করা হয়েছে, শিবাজীর ছেলেকে মনসবদার পদে উন্নীত করা হয়েছে ।
    এবং শিবাজী চাইলে বিজাপুর সাম্রাজ্যের যে কোন কিলা নিজের দখলে রাখতে পারেন; 
    নইলে নিজের জায়গায় থাকুন, কিন্তু শাহজাদা মুয়াজ্জিমের প্রশাসনিক নির্দেশ মেনে চলুন। পৃঃ ১৫৩

    শিবাজীকে লেখা ঔরংজেব নিযুক্ত দাক্ষিণাত্যের শাসক শাহজাদা মুয়াজ্জমের চিঠি, তারিখ ৯ মার্চ, ১৬৬৮
    রাজা শিবাজী! আমি মহামহিমকে আপনার আনুগত্য এবং নিষ্ঠার কথা জানিয়েছিলাম। উনি খুশি হয়ে আপনাকে “রাজা” উপাধি দিয়েছেন—যেমনটি আপনি চাইছিলেন। আশা করি,  সম্রাটের এই অনুগ্রহের প্রতিদান স্বরূপ আপনি আগের থেকে আরও বেশি করে সাম্রাজ্যের সেবায় আত্মনিয়োগ করবেন। তাহলে মোগল দরবারে আপনার সম্মান ও প্রতিপত্তি বাড়তেই থাকবে। পৃঃ ১৫৬
     
    কিন্তু শিবাজী ক্রমশঃ মোগল সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক নির্দেশ মানার চাইতে দাক্ষিণাত্যে নিজের সাম্রাজ্য গড়ে তুললেন।
    শিবাজীর রাজ্যাভিষেক হয় ৬ জুন ১৬৭৪,  পৃঃ ১৭৫
    তারপর শিবাজী ছয় বছর জীবিত ছিলেন, স্বাস্থ্য ভেঙে গেছল। 

    শিবাজীর সরকার পরিচালনা, সংগঠন এবং নীতি
    শিবাজীর সৈন্যরা কৃষকদের থেকে “চৌথ” আদায় করত। অর্থাৎ জমির খাজনার এক চতুর্থাংশ। আচার্য যদুনাথের মতে এটা একধরণের র‍্যানসম, কারণ এটার বদলে মারাঠা সৈন্যরা প্রজাদের রক্ষার বা শাসনের কোন দায়িত্ব নিত না। (p. 407)

    শিবাজীর সময়ে মুক্তিপণ আদায়ের উদ্দেশ্যে ইংরেজ ব্যাবসায়ী, হিন্দু বানিয়া, ভারতীয় মুসলিম, আরব বণিক এবং পার্শী বণিকদের ওয়াইসাতি কেল্লায় বন্দী করে যন্ত্রণা দেয়া হত এবং পেটানো হত। (পৃঃ ৩৮৫)।
    শিবাজীর ক্ষমতাধীন এলাকায় ছিল ২৪০ কেল্লা যার মধ্যে ৭৯ ছিল মহীশূর এবং মাদ্রাজে অবস্থিত। শিবাজীর আয় ছিল কাগজপত্রে ৯ কোটি টাকা। বাস্তবে আদায় হত আরও কম। কখনও এক দশমাংশ, অর্থাৎ ৯০ লক্ষ টাকা। (পৃঃ ৪০৮)। 
     
    শিবাজীর সৈন্যবল গোড়ার দিকে ছিল কুড়ি হাজার, এর মধ্যে সাতশো ছিল মুসলমান। শেষ জীবনে তাঁর সৈন্য সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল প্রায় দুই লাখ। তবে মাওলে সম্প্রদায়ের (দলিত জাতি) পদাতিক ছিল এক লক্ষ(পৃঃ ৪০৯)।
    তাঁর রাজ্যে বিচার হত সংস্কৃত আইনের বই (স্মৃতিশাস্ত্র অনুসারে), পৃঃ ৪১১।
     
    শিবাজীর আট জন সদস্যের মন্ত্রীসভায় উনিই ছিলেন সর্বেসর্বা। শাস্ত্রীয় ব্যাপারে উনি পেশোয়া নির্ভর ছিলেন, নিজে নাক গলাতেন না। 
    আচার্য যদুনাথের মতে তার কারণ উনি ছিলেন নিরক্ষর এবং জাতে ছোট, (ঐ)
    প্রধান সেনাপতি ছাড়া সবাই ব্রাহ্মণ। 
     
    শিবাজীর যুদ্ধকালীন নিয়মঃ (পৃঃ ৪১৭)
    • বর্ষার তিনমাস সৈন্যেরা শিবিরে থাকবে। বিজয়া দশমীর দিন থেকে লুন্ঠনে বেরোবে। এভাবেই ওদের খরচা তোলা হবে এবং বাড়তি দ্রব্য ওরা সরকারের খাজানায় জমা করবে।
    • কোন সৈন্য সঙ্গে নারী, দাস অথবা শিশুদের নিয়ে যেতে পারবে না। আদেশ না মানলে মুন্ডচ্ছেদ করা হবে।
    • শুধু পুরুষদের বন্দী করা হবে, মহিলা এবং শিশুদের নয়।
    • গাভী লুট করা যাবে না, কিন্তু বলদ কেবল গাড়ি টানতে ব্যবহার করা যাবে।
    • ব্রাহ্মণদের উপর অত্যাচার করা চলবে না। (মনুস্মৃতিও তাই বলে)।
    • কোন সৈনিক যুদ্ধে গেলে মহিলাদের সঙ্গে কদাচার করবে না। 
    • যুদ্ধে যাওয়ার সময় সৈনিক কী কী জিনিস সঙ্গে নিয়ে যাবে তার অনুমোদিত সূচী আছে।
    • ফিরে আসার পর সবার শরীরের তল্লাসি হবে। আগের সূচীর বেশি কিছু পাওয়া গেলে তার মাইনে  থেকে কাটা যাবে। কিছু লুকিয়ে ধরা পড়লে তাকে বন্দী করে শাস্তি দেয়া হবে। 
    কর আদায় ও কৃষি (পৃঃ ৪১৮)
    • নতুন কৃষককে বীজ এবং হাল-বলদের জন্য ঋণ দেয়া হবে যা দুই বা চার বার্ষিক কিস্তিতে আদায় করা হবে। 
    • জমির মাপ নিয়ে খাজনা নির্ধারণ হবে এবং সেই খাজনা ফসল ওঠার সময় আদায় হবে।
    • শিবাজী সরকার এবং কৃষকদের মধ্যে মধ্যসত্ত্বভোগী সমাপ্ত করে দিলেন। কোন জমিদার, দেশমুখ বা দেশাইয়ের চাষিদের উপর হুকুম চালানোর রাজনৈতিক অধিকার থাকবে না।
    শিবাজীর ধার্মিক নীতি (পৃঃ ৪২১)
    Shivaji’s religious policy was very liberal. He respected the holy places of all creeds in his raids and made endowments for Hindu temples and Muslim Saint’s tombs and mosques alike.  He not only granted pensions to Brahmin scholars versed in the Vedas, astronomers and anchorites but also built hermitages and provided subsistence at his own cost for the holy men of Islam, notably Baba Yaqut of Kelshi”.
    শিবাজীর আধ্যাত্মিক গুরু ছিলেন স্বামী রামদাস। কিন্তু তিনি তাঁর আধ্যাত্মিক গুরু ছিলেন, রাজনৈতিক গুরু নয়। তিনি শিবাজীর হিন্দুধর্ম রাজ্য স্থাপনের প্রেরণা ছিলেন বলে যে জনশ্রুতি আছে তার পক্ষে কোন স্পষ্ট সন্দেহাতীত প্রমাণ নেই। (পৃঃ ৪২২)।
    রবীন্দ্রনাথের “বসিয়া প্রভাতকালে সেতারার দুর্গভালে—“ কবিতাটি পরবর্তী কালের জনশ্রুতি নির্ভর, কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই।

    শিবাজীর শাসনের নীতিগুলো বাস্তবে কতখানি মানা হত?
    শিবাজী সর্বত্রগামী এবং সবজায়গায় একই সঙ্গে উপস্থিত হতে পারেন না। কাজেই তাঁর সৈন্যরা অনেক সময় লুট করে আনা সম্পদ সরকারে হিসেবমত জমা দিত না। মারাঠা ফৌজ চলে গেলে ছুটকো লুঠেরা আসত। “পিণ্ডারী”দের অত্যাচার এইরকম মারাঠা ফৌজের ‘লজিক্যাল করোলারি’। (পৃঃ ৪২৩)।
    শিবাজী তাঁর সৈন্যদের নিয়মিত লুটপাটের অভ্যেসকে সুরাতের গভর্নরের কাছে এভাবে ‘উচিত’ ঠাউরেছিলেনঃ
    “তোমাদের মুঘল সম্রাট আমাদের বাধ্য করেছেন নিজের এলাকায় আত্মরক্ষার জন্য সৈন্যবাহিনী রাখতে। তাহলে তাদের জন্য নাগরিকেরা কর দেবে না”? 
     
    আচার্য যদুনাথের ভাষায় “Such a plea must  have been true at the beginning of his career, and in relation to Mughal territories only, but cannot explain his raids into Bijapur and Golkonda, Canara and Tanjore. It fails altogether as a defence of the foreign policies of the Peshwas”. P. 423
    শিবাজীর সময়ে মুক্তিপণ আদায়ের উদ্দেশ্যে ইংরেজ ব্যাবসায়ী, হিন্দু বানিয়া, ভারতীয় মুসলিম, আরব বণিক এবং পার্শী বণিকদের ওয়াইসাতি কেল্লায় বন্দী করে যন্ত্রণা দেয়া হত এবং পেটানো হত। (পৃঃ ৩৮৫)।
     

    শিবাজীকে নিয়ে যদুনাথের উপলব্ধিঃ
    ১ রাজা হওয়ার অভিষেকের পর মাত্র ছ’বছর জীবিত ছিলেন। 
    এর মধ্যেই নিজের অধীন অঞ্চলে প্রজাদের শান্তি ও সুরক্ষা দিতে পেরেছিলেন যা সার্বভৌম রাষ্ট্রের প্রধান কর্তব্য।
    ২ নারীর সম্মান। সবচেয়ে সুন্দরী বন্দীকেও মাতৃ সম্বোধন করতেন। যুদ্ধে বন্দী সাবিত্রী বাঈয়ের অসম্মান করায় নিজের এক সেনাপতির দুই চোখ উপড়ে নিয়েছিলেন।
    ৩ তাঁর বাহিনীতে অনেক মুসলমান সেনানায়ক ছিল। নিজের ফৌজকে কড়া নির্দেশ দিয়েছিলেন যেন কোন মুসলিম ধর্মগুরুর আশ্রম লুন্ঠিত না হয়। যুদ্ধে কোন কোরান পাওয়া গেলে সেগুলো সসম্মানে মুসলমানদের ফেরত দেয়া হত । পৃঃ ৮১

    জন্মেছিলেন হয়ে একজন ছোটখাট জাগিরদারের ছেলে, কিন্তু হলেন  বিশাল মুঘল সাম্রাজ্যের শক্তি ও সামর্থ্যের মোকাবিলায় অদম্য। ঔরঙ্গজেব হতাশ! কী করে একের পর এক সেনাপতিরা ব্যর্থ হচ্ছেন।ঔরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে তাঁর দরবার ও পরিবার  ছিল হিন্দুদের ঘুরে দাঁড়ানোর কেন্দ্র।(!)

    শিবাজীর শাসনপদ্ধতি কতটুকু অভিনব?
    যদুনাথ বলছেন---শিবাজীর রাষ্ট্রনীতি এবং প্রশাসন পদ্ধতি খুব একটা অভিনব কিছু নয়। পৃঃ ৪২৭
    মনুস্মৃতি অনুসারে রাজার উচিত শরতকাল এলে প্রতিবেশি রাজ্য দখল করতে রাজ্যবিস্তারে বেরিয়ে পরা। 
    হিন্দুরাজাদের শরত কালে রাজ্যের সীমানা বাড়াতে যুদ্ধ করা রেওয়াজ ছিল।
    পরবর্তী কালে উত্তর এবং দক্ষিণ ভারতের মুসলিম শাসকদেরও অনুরূপ আচরণ করতে দেখা গেছে। 
    কিন্তু এই রাজ্যবিস্তারকে ওরা ওদের ধর্মীয় অনুশাসনের নামে উচিত ঠাওরাতো।
    কুরানের নীতি অনুযায়ী কোন মুসলিম দেশ এবং বিধর্মী প্রতিবেশি দেশের মধ্যে শান্তি বজায় রাখা তখনই সম্ভব যখন ওরা ইসলাম গ্রহণ করে।
     কেবল তখনই ওরা মুসলিম সাম্রাজ্যের আশ্রয়ে শান্তিতে বাস করবে।
     
    শিবাজীর পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে একজন কুরান মেনে চলা রাজার নীতির এত বেশি মিল যে শিবাজীর সভাসদ কৃষ্ণাজী অনন্তের লেখা শিবাজীর জীবনী এবং বিজাপুর সাম্রাজ্যের ফার্সিতে লেখা সরকারি ইতিহাস –দুটোতেই প্রতিবেশী রাজ্যে নিয়মিত হামলা করা্র রাজনৈতিক আদর্শের জন্যে একটাই শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে—‘মুল্ক-গিরি’!
    কিন্তু একটা স্পষ্ট তফাত আছে, অন্ততঃ তত্ত্বগত ভাবে।
     
    একজন গোঁড়া মুসলিম রাজা তাঁর বিজয় যাত্রার পথে যত মুসলিম রাজ্য পড়বে তাদের ছাড় দেবেন। অন্ততঃ স্বধর্মীর রক্তে মাটি ভেজাবেন না।
    কিন্তু  শিবাজী এবং তাঁর পরবর্তী পেশোয়ারা কেউই পড়শি হিন্দু বা মুসলমান রাজ্যকে কোন ছাড় দেন নি। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশিষে লুঠ করেছেন। 
    এবং ধনী হিন্দুদেরও মুসলিম ধনীদের মতই নির্মম ভাবে নিংড়ে নিয়েছেন।

    আরেকটা ব্যাপার ছিল।
    মুসলিম রাজারা পড়শি রাজ্য দখল করে ধর্ম পরিবর্তন করার পর সেটা তাদের সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যেত। 
    এবং নাগরিকেরা প্রাথমিক রক্তক্ষয়ের পর বাকি অংশের মতই শান্তি পেত। 
     
    কিন্তু শিবাজীর মারাঠা ফৌজের লক্ষ্য রাজ্যবিস্তার নয়, শুধু নিয়মিত লুঠ। 
    তাঁর দরবারের অমাত্যদের দ্বারা লিখিত ইতিহাস—সভাসদ বাখার ২৯নং-অনুযায়ী শিবাজীর নিজের কথায়
     “ The Maratha forces should feed themselves at the expense of foreign countries for eight months every year, and levy blackmail—”  ( পৃঃ ৪২৮)
    শিবাজীর সময়ে মুক্তিপণ আদায়ের উদ্দেশ্যে ইংরেজ ব্যবসায়ী, হিন্দু বানিয়া, ভারতীয় মুসলিম, আরব বণিক এবং পার্শী বণিকদের ওয়াইসাতি কেল্লায় বন্দী করে যন্ত্রণা দেয়া হত এবং পেটানো হত। (পৃঃ ৩৮৫)।

    আচার্য যদুনাথের মূল্যাংকনঃ
    “ Thus, Shivaji’s power was exactly similar in origin and theory to the power of the Muslim states in India and elsewhere, and he only differed from them in the use of that power. Universal toleration and equal justice and protection were the distinctive features of the permanently occupied portion of the Swaraj, as we have shown elsewhere” (p. 429).
    শিবাজীর উদার ধার্মিক মনোভাবের প্রমাণ  হিসেবে জিজিয়া কর চাপানো নিয়ে ঔরংজেবকে লেখা দীর্ঘ চিঠির কিছু অংশ উদ্ধৃত করা হল।  মূল ফার্সি থেকে ইংরেজি অনুবাদ করেছেন যদুনাথ সরকার।

    মহামহিম বিবেচনা করে দেখুন, সাম্রাজ্যের ভিত গেড়েছেন জালালুদ্দিন আকবর পাদশাহ। তিনি ৫২ চান্দ্র বছর পর্য্যন্ত পূর্ণ বিক্রমে রাজত্ব করে গেছেন। 
    উনি সমস্ত ধার্মিক সম্প্রদায়ের জন্যে——সর্বধর্মসমন্বয়ের প্রশংসনীয় নীতি গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর উদার-হৃদয়ের লক্ষ্য ছিল সমস্ত মানুষের আদর এবং সুরক্ষা।
     তাই তিনি “জগতগুরু” নামে (বিশ্বের আধ্যাত্মিক গুরু) প্রসিদ্ধ হয়েছিলেন।
     
    “তারপর সম্রাট জাহাঙ্গীর  ২২ বছর---- এবং সম্রাট শাহজাহান ৩২ বছর---- বিশ্ববাসীর মাথার উপরে ছাতা ধরেছিলেন। তাঁদের শাসনকালে অনেক রাজ্য বশ্যতা স্বীকার করে।
     এখানে জাঁহাপনা আপনি তাঁদের ঠিকমত অনুসরণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন।
    “তাঁদেরও জিজিয়া কর বসানোর ক্ষমতা ছিল, কিন্তু তাঁরা ধার্মিক গোঁড়ামিকে হৃদয়ে স্থান দেননি।
    কারণ তাঁরা ঈশ্বরের সৃষ্ট সমস্ত মানুষকে , ছোট বা বড়, বৈচিত্র্যময় ধর্মমত এবং রুচির উদাহরণ হিসেবে দেখতেন। (পৃঃ ৩৬৮)
     
    “কিন্তু আপনার রাজত্বে অনেকগুলো দুর্গ আপনার হাতছাড়া হয়েছে, আরও হবে। কারণ। বাকিগুলো বিধ্বস্ত না করে আমি থামবো না। 
    আপনার কৃষকেরা দারিদ্র্যের শিকার। খাজনা আগের তুলনায় এক-দশমাংশ আদায় হচ্ছে। আপনার রাজত্বে বণিকেরা নালিশ করছে। 
    মুসলিমরা কাঁদছে, হিন্দুরা অত্যাচারিত। অধিকাংশ মানুষ রাত্রে রুটি খেতে পায় না, সকালে উঠে নিজের গালে চড় মারে। 
    এর উপর আপনি জিজিয়া কর চাপিয়ে দিলেন কী ভেবে?
      (পৃঃ ৩৬৯)
    “আপনি কি সত্যিই কুরানে আস্থা রাখেন? তাহলে বই খুলে দেখুন –ওখানে সব মানুষের ঈশ্বরের কথা বলা হয়েহে, খালি মুসলমানের ঈশ্বরের নয়।
    মসজিদের আজান এবং মন্দিরের ঘন্টাধ্বনি—সব একই ঈশ্বরের উদ্দেশে ধ্বনিত হয়। 
    তাই কোন এক ধর্মের আচরণকে একমাত্র ভেবে গোঁড়ামি করা মানে পবিত্র কিতাবকে অগ্রাহ্য করা। (পৃঃ ৩৭০)
    "
    আর জিজিয়া কর রাজনৈতিক চোখে দেখলে অন্যায় এবং ভারতে নতুন আবিষ্কার। 
    যদি মনে করেন ধর্মের খাতির প্রজাদের উৎপীড়ন করা এবং হিন্দুদের ভয় দেখানো সঠিক নীতি তাহলে বলব, আগে রাণা রাজসিংহের থেকে জিজিয়া আদায় করুন।
     উনিই তো হিন্দুদের প্রধান!
    তারপর দেখবেন, আমিও জিজিয়া দেব’খন”।
    শেষ পাতেঃ
    দেখা যাচ্ছে আচার্য যদুনাথের সাক্ষ্য অনুযায়ী শিবাজীর সময়েই একজন “বিশ্বগুরু” হয়েছিলেন। 
    মোগল সম্রাট আকবর! আর ওই খেতাবটি দিয়েছিলেন হিন্দুকুলতিলক শিবাজী স্বয়ং!
      শিবাজীর জীবনের শেষভাগ
    বেলগাঁও জেলার ছোট্ট একটি গ্রাম বেলওয়াড়ির মালিক ছিলেন বিধবা সাবিত্রী বাঈ। তিনি শিবাজীর সেনার  রসদবাহী গাড়ি লুট করেন। 
    অবিলম্বে তাঁর ছোট মাটির দুর্গটি ঘিরে ফেলা হয়। কিন্তু তিনি বীরত্বের সঙ্গে ২৭ দিন লড়াই করে বন্দী হন। 
    এই ঘটনায় শিবাজীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয় বলে আচার্য যদুনাথের ধারণা। (পৃঃ ৩৫৪)

    শিবাজীর এক নায়ক সাখুজী গায়কোয়াড় সাবিত্রী বাঈয়ের মর্যাদাহানি করেন। 
    জানতে পেরে শিবাজী সাখুজীর দুটো চোখ উপড়ে নেন এবং তাকে মানাউলি গ্রামে বন্দী করে রাখেন।(ঐ)
    মধ্য ও পূর্ব কর্ণাটকের অনেকখানি শিবাজী দখল করেছিলেন।
     
    শিবনের দুর্গ দখল করতে আসা শিবাজীর একটি সৈন্যদলকে কিলাদার  আবদুল আজিজ খান পর্যুদস্ত করে বন্দীদের ফেরত পাঠিয়ে সংগে একটি মেসেজ পাঠান
    —যদ্দিন আমি এই দুর্গের কিলাদার, ততদিন তুমি শিবনের দুর্গ দখল করতে পারবে না।
    শিবাজীর দাক্ষিণাত্য অভিযানের খরচ বহন করেছিলেন কুতুব শাহ, একদল সৈন্য এবং গোলন্দাজ বাহিনীও পাঠিয়েছিলেন। 
    কিন্তু লুঠের ভাগ বা কোন দুর্গ তিনি পেলেন না। টাকাও ফেরত নয়। সন্ধি ভেঙে গেল। (পৃঃ ৩৬০)
     
    And now the Maratha plot to capture Bijapur by treachery destroyed the last trace of patience in the Golkonda king. (ibid).
    কিন্তু নতুন বিজাপুরী শাসক সিদ্ধি মাসুদ শিবাজীকে পত্র লিখে বললেন—আমরা প্রতিবেশি। আমরা দুজনেই এই অঞ্চলের কল্যাণ চাই।
      তাই মুঘলদের বিরুদ্ধে আমাদের এক হতে হবে। (পৃঃ ৩৬১)
    দেখা যাচ্ছে শিবাজীর মোগল সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম আদৌ হিন্দু বনাম মুসলমানের সাদা-কালো লড়াই নয়। 
    অনেক বাঁকবদল এবং কূটনৈতিক সমঝোতার সাক্ষ্য ইতিহাসে রয়েছে।
     শিবাজীর মৃত্যুর পর ক্ষমতায় আসীন বড়ছেলে শম্ভাজীর আচার-আচরণ থেকে ব্যাপারটি আরও স্পষ্ট হবে। 
     (আগামী পর্বে শম্ভাজী হয়ে শেষ)
     

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ২৮ অক্টোবর ২০২৫ | ৬৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • হীরেন সিংহরায় | ২৮ অক্টোবর ২০২৫ ১১:৪৭735304
  • কিছুই পড়ানো হয় নি আমাদের বিদ‍্যা মন্দিরে । কত যে ভুল জেনেছি। অশেষ ধন্যবাদ তোমাকে । বাতি জ্বালো । জ্বালিয়ে রাখো 
  • Manali Moulik | ২৮ অক্টোবর ২০২৫ ১২:১৮735305
  • শিবাজী ১২ জুন ১৯৬৫ তারিখে পুণেতে জয় সিংহের কাছে আত্মসমর্পণ করলেন।  
     
    এটি সম্ভবতঃ ১৬৬৫ হবে। 
    আন্তরিক কৃতজ্ঞতা এমন বিষয়টিকে নির্ভেজাল সত‍্যের আলোকে তুলে ধরার জন‍্য। অজস্র অজানাকে জানা গেলো। বাকি পর্বগুলির জন‍্য সাগ্রহে অপেক্ষা করছি।
  • Anirban M | ২৮ অক্টোবর ২০২৫ ১২:৩৮735307
  • এটা খুব ভালো করলেন রঞ্জনদা। বিভিন্ন মিথ ভাঙার জন্য খুবই সহায়ক। আমাদের পক্ষে যদুনাথ এর মূল বই পড়ে দেখা সম্ভবপর হতো না। সময় বের করা মুশকিল আজকাল। আপনার এই সারসংক্ষেপ সেদিক থেকে ভাবনা চর্চায় খুব সাহায্য করল। ধন্যবাদ।
  • Ranjan Roy | ২৮ অক্টোবর ২০২৫ ১২:৪৭735308
  • হীরেনদা,
     আমিও জানতাম না। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে জানলাম। 
    হয়েছে কি, শান্তিনিকেতনের এক ভ্রাতৃপ্রতিম বিজেপি সমর্থক অধ্যাপক আমাকে চ্যালেঞ্জ করলেন।
    --সাহস থাকলে আচার্য যদুনাথের লেখা ইতিহাস পড়ুন; খালি ইরফান হাবিব ও গৌতম ভদ্র পড়লে হবে? দেখুন তাঁর সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত হন কিনা! 
     
    আমি বরাবরই "চ্যালেঞ্জ নিবি না শালা!" মোডে উৎসাহিত হই। 
    পড়লাম সোজা বিজেপির সরকারি ইন্টারনেট আর্কাইভ থেকে আচার্য সরকারের দুটো বই ডাউনলোড করে।  তারপর বললাম-- আমি একমত। আপনি? বলে গ্রুপে এই লেখাটার সংক্ষিপ্ত রূপ পোস্ট করলাম।
    উনি আর উচ্চবাচ্য করলেন না, বছর ঘুরে গেছে।
     
    ওই চিন্তাধারার বিরুদ্ধে আমার অভিযোগ ওরা বই পড়াকে, মূল দস্তাবেজ পড়া ও রিসার্চকে নিরুৎসাহ কএ।  শুধু সোশ্যাল মিডিয়ায় ওদের প্রচারিত গালগল্পকে ইতিহাস বলে বিশ্বাস করাতে চায়। 
    ওই অদ্যাপক নিজের বিষয়ে (কৃষি) ডক্টরেট ও অনেকের রিসার্চ গাইড।
     
    কিন্তু এই বিষয়গুলো নিয়ে পড়াশুনোর দরকার মনে করেন নি।  
     
  • Ranjan Roy | ২৮ অক্টোবর ২০২৫ ১২:৪৯735309
  • মনালি,
    ভুল ধরিয়ে দেবার জন্যে ধন্যবাদ। তবে এই লেখাটা দুটো পর্বেই শেষ হবে। আগামীকাল শম্ভাজীকে নিয়ে। দেখবেন, সিনেমা আর ইতিহাসে আকাশ পাতাল তফাৎ।
  • Ranjan Roy | ২৮ অক্টোবর ২০২৫ ১৩:০০735310
  • অনির্বাণ
    আমি তো আপনার অর্থনীতির উপর ছোট ছোট প্রবন্ধের চমৎকার সংকলনটি (হারিত প্রকাশনের) এবং কিছু ছোটগল্প পড়ে ফিদা।
     
    সাভারকরের উপর বাংলায় প্রথম পূর্ণাঙ্গ বই লিখে ফেলেছি। এগারোটা অধ্যায়। প্রায় তিনশ পাতা। এখনো প্রকাশক পাইনি, কয়েকজন পড়ছেন। 
    তাতে আন্দামান ও ইংল্যান্ড পর্বে ওনার সমসাময়িকদের দলিল থেকে উদ্ধৃতি আছে। প্রত্যেক অধ্যায়ের শেষে একটা পরিচ্ছেদ শুধু সেই সময়ের মিথ বাস্টিং এর জন্য। এছাড়া সাভারকরের হিন্দুত্ব তত্ত্বের কাটাছেঁড়া , গান্ধীজি, নেতাজির সঙ্গে তুলনা ইত্যাদি আছে। শ্যামাপ্রসাদের ডায়েরি থেকে সাক্ষ্য আছে। 
     
    গান্ধী হত্যা নিয়ে ৬০ এর দশকে কাপুর কমিশনের রিপোর্ট থেকে তথ্য আছে।
    খুব খেটেছি। 
    সাভারকরের নিজের লেখা ৫ বই, অন্যদের সাভারকরকে নিয়ে লেখা ৮ বই, সেই সময় নিয়ে আর সি মজুমদার ও বারীন, হেমচন্দ্র, উপেন্দ্রনাথ--কিছুই ছাড়ি নি। মোট ৪২টি বই থেকে এবং সেই সময়ের কাগজ থেকে প্রায় ৩০০ ফুটনোট রয়েছে।
    এখন শুধু প্রকাশক পাওয়ার অপেক্ষা। 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। মন শক্ত করে প্রতিক্রিয়া দিন