তীরে বসেই কাটলো বেলা চোরাবালির ভয় করে---
ডুবলো যে জন, রইলো বেঁচে
‘' আমি" হয়ে অন্তরে !
খুঁজতে যে খুব একটা কষ্ট হলো তা নয়। ঐ রাস্তায় তিন চারটে মোটর মেকানিক এর দোকান আছে। তবে বাবলু হকের দোকান কোনটা সেটা আলাদা করে জানতোনা কাঞ্চন। গোলাম বলে দিয়েছিল যেটার পাশে একটা কাঁঠাল গাছ আছে আর তলায় একটা রাম ছাগল বাঁধা আছে সেটাই বাবলুর গ্যারেজ।বাকি গুলোর থেকে আলাদা করে তাই চিনতে অসুবিধা হয়নি। সোজাসুজি স্টেশন বরাবর পিচ রাস্তা যেখানে চৌমাথায় মিশেছে, তার একটু আগেই রাস্তার একদিক একটু ঢালু, বেশ কিছু শাল গাছ জঙ্গল মতো করে রেখেছে,তাদের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে লাল ইঁটের ছিমছাম এক ছোট্ট রাজবাড়ী। লোকে বলে 'প্রবীর রাজার বাড়ি' । সে রাজাকে কাঞ্চন দেখেনি। শালপথ দিয়ে লোকে শর্টকাট মেরে কোনাকুনি গিয়ে আবার ডান দিকের পিচ রাস্তায় ওঠে। চৌমাথা দিয়ে আর ঘোরেনা। বাম দিকে ছড়ানো ছেটানো নিম, ছাতিম,সজনে, গুলঞ্চ ইত্যাদির মাঝে পর পর মোটর গ্যারেজগুলি গজিয়েছে মানুষের প্রয়োজনেই। রাস্তার শ্রী খানিকটা ঘুচেছে, ফেলে দেওয়া এটা সেটা , তেলচিটে কালিঝুলি কাপড়ের ন্যাতা কানি মিশেছে লাল ধুলোয় । গরমে শাল ফুলের গন্ধ, হেমন্তে ছাতিমের গন্ধে ঢুকে পড়ে পেট্রোল আর ডিজেল পোড়ার গন্ধ।
বাবলু হকের মোটর গ্যারেজে ওরা উর্দু ও ফার্সির টিচার খুঁজতে এসেছে। গোলামই প্রাথমিক যোগাযোগ কর্তা, কারন সে বাবলু হককে চেনে আর বাবলুর নাকি উর্দু টিচার এর সাথে জানাশোনা। কাঁঠাল গাছের তলায় রাম ছাগল ঢুলু ঢুলু চোখে বসে কাঁঠাল পাতা খাচ্ছে,তার দুই কানে কে যেন উপহার বাধার লাল রিবন বেঁধে দিয়েছে! কাঞ্চন হেসে ফেলে। খাটিয়ায় বসা গোলাম বা বাবলু হক হাসেনা। পয়মন্ত জীবটি বাবলুর জীবনে এসেছিলো এক অলৌকিকতার রোমাঞ্চ নিয়ে। তাকে তাই সে পালন করে চলেছে পরম মমতা ও আদরে। তার বর্ণনায় ধুয়ো দিতে থাকে গোলাম। কোনো এক ঝড় জলের রাতে রেল শহর থেকে দিলদারে ফেরার সময় পীর লোহানির মাজারে সে দাঁড়িয়েছিল বেশ খানিক সময় । বৃষ্টি ধরতেই বেরিয়ে এসে স্কুটারে স্টার্ট দিতে গিয়ে দেখে তার পা রাখার জায়গায় বসে আছে সে নিরীহ জীবটি , বড়ো সড়ো শরীরটি নিয়ে।কিছুতেই আর নড়ে না। অগত্যা তার দুপাশ ঘিরে পা দুটি দুপাশে বেড় দিয়ে কোনো ক্রমে সে বাড়ি ফেরে।বাবলুর আব্বুর পুরোনো বাজাজ চেতক সেদিন বেশ চওড়া হাসি হেসেছিলো। পরদিন লটারির টিকিট লাগে পঁচিশ হাজারের ! তাতে গ্যারেজের শ্রী বৃদ্ধি। গোলাম নিজেও ইতিউতি কাজে রেল শহরে যখনই যায় , পীর লোহানির কাছে দুবার দাঁড়াবেই। বাবলুর সার্ভিসিং এর মোটর সাইকেল ,স্কুটার ও চালায় প্রায়শই। শরিফাকে 'রামছাগল' বললে বাবলু খুব রাগ করে। আসলে ও জেনানা , ওর একটি নাম ও আছে। উপরওয়ালার উপহার সে। গোলাম ও তা মানে।
গোলাম কাঞ্চনের পাড়ার বন্ধু, এক সময় কলেজে ঝুটঝামেলাতে বডি গার্ড। সে নিজে কলেজে ভর্তি হয়নি ।হায়ার সেকেন্ডারি থার্ড ডিভিশন এ পাশ করে আর ও মুখো হয়নি সে। কিন্তু কাঞ্চনের ডাক পড়লেই সে পৌঁছে যেত সেখানে। তেমন গুরুতর পরিস্থিতিতে পুরো হাঁড়ী পাড়া ডোম বস্তির গ্যাং ওর মজুদ থাকে। কলেজে ঢুকতে না দিক , বাইরে দাঁড়িয়ে কিচাইন করলেও অনেক। ওদের নেত্রী হটহটি বুড়ি। সে গোলামের ধম্মো মা। তার বাড়ি গোলামের খাওয়া বসা। কেন গোলাম হটহটি র বাড়ি আরাম পায় আর কেনই বা কাঞ্চনের হয়ে মারপিট করতে ছুটে যায় আর কেনই বা সে বুড়ি গোলামের বন্ধুর জন্য যুদ্ধ যাত্রা করে--- তার উত্তর দেওয়া মুশকিল।গোলাম নিজেও কি আর দিতে পারবে? দাঁত বের করে খানিকটা হাসবে। হাসলে তাকে দশ বছরের বালক লাগে।
সে যে কখন কোথায় থাকে কখন কোথায় যায় তার ঠিক নেই।সকালে বাড়ি থেকে বেরোয়,যারপর কেউ ই বলতে পারেনা কখন কোথায় তাকে দেখা যাবে।সে পরের মুশকিল আসান,ঘর জ্বালানে! দিলদরিয়া অথচ রাশভারী বাবা তার বেলায় আর রাশটি ধরে রাখতে পারেননি। তিন ছেলেমেয়ের পর সর্ব কনিষ্ঠটিকে আর বাগে আনতে না পেরে হাল ছেড়ে দিয়েছেন। অদ্ভুত এক অন্ধ স্নেহে তাঁকে বন্দি করে ফেলেছে এই শেষ সন্তান টি! আপন পর ভেদহীন সে কখন কী করে বসে তার ঠিক নেই।তাকে নিয়ে ছোট থেকেই সামাল সামাল। গোলামের মা হিসেব করেন হাতের কড় গুনে---কুকুরে কামড়েছে তিন বার,হাত ভেঙেছে দুইবার, কুয়ো তে পড়েছে একবার,মাথা ফেটেছে দুই বার। শরীর নিয়ে তার কোনো ভয় ডর নেই। যেকোনো ঝামেলার কাজে সে বুক চিতিয়ে— কুঁয়োয় পড়ে যাওয়া বেড়াল ছানা তোলা,আটকে যাওয়া নর্দমা পরিষ্কার,ইলেক্ট্রিকের কাজ,পাখা লাগানো ---সে আছে! সে তার সমস্ত ঝামেলা নিয়েও তাই বাবার অগাধ প্রশ্রয়ের আশ্রয় ---তাঁর 'আজিজ' । উত্তেজনা যে কাজে ,সে কাজেই ডাকা মাত্র হাজির তাঁর আদরের ‘গোলাম’। তার মাথাটিই নাকি ভাই বোনেদের মধ্যে সবচেয়ে পরিষ্কার, হিসেব নিকেশ চটপট, হাতের লেখাটিও খাসা। কিন্তু সে দিকে গেলেতো! তাকে ভরসা করা যায় , আবার বিশ্বাস ও করা যায়না পুরোপুরি। আত্মীয় স্বজন পাড়া পড়শি তাকে গাল দেয়,আবার ভালো না বাসে তার সাধ্য কি?সে চলে আপন দিলটির পাখনাদুটি মেলে, নিয়ম তার কাছে বিষবৎ পরিত্যাজ্য। মা তার চুপ করে গেছেন। খেতে চাইলে খেতে দেন,শুতে চাইলে বালিশ এগিয়ে দেন। কিছু ভারী কাজ পেলে সে খুশি হয়ে করে, কাউকে হুমকি দিতে হলে তাকে একবার বললেই হয়।কিন্তু,সাধারণ দিন যাপনের ডিউটি দিতে গেলে সে পালায়।শক্ত পোক্ত জোরালো শরীরটির অপরিসীম বল নিয়ে সে কি করবে ভেবে পায়না।এভাবেই বাপের আল্লাদি ডাকটির হাত ধরেই গহন সেন তার পোশাকি নামটি থেকে সরে এসে হয়ে যায় ‘গোলাম’। সদা পরিবর্তনশীল অতি ইচ্ছার দাপটের কাছে নিজেকে সমর্পণ করেই হয়তো !
আপাতত কাঞ্চনের উর্দু মাস্টার খুঁজে দিতে সে বদ্ধ পরিকর।কবিতা লেখা কাঞ্চনের এর শখ হয়েছে শের শায়েরি পড়ার। খৈয়াম পড়বে সে মূল ফার্সিতে। তবে প্রথমে উর্দুর হাত ধরে সে পথে এগোবে সে ,সেটিই সুবিধের হবে। বাবলুর গ্যারেজে মাদ্রাসার কেউ জানা আছে কিনা, তাই এসেছে সে।তা ছাড়া বাবলু তার গ্যারেজের পাশে মহাদেব সাউ এর হরলিক্স দেওয়া চা এনে খাওয়ায়। সিটিও কাঞ্চনকে খাওয়াবে গোলাম। আসলে সুখাদ্য বা সুপেয়্ র শুধু দাম বা গুন দিয়েই বিচার হয়না, কোথায় কার সাথে বসে তা গ্রহণ করছি তাও আমাদের মনের জগতে অদৃশ্য খেলা করে তার স্বাদ বাড়ায় বা কমায়! গোলাম বাড়িতে হরলিক্স খায়নি এমন তো নয়, তবু বাঁধন ছেঁড়া সে বান্দা কোথায় কীসে স্বাদ পাবে-- তা নির্ভর করে বুঝি একটি খোলা আকাশের উপর ।
বাবলু জানায় বহুত 'প্রফেসর' এর সাথে তার জানা আছে,মুশকিল নেই কোনো।কাঞ্চন খুশি হয়। এর মধ্যে চা নিয়ে আসে একজন পাশের দোকান হতে।গোলাম নির্বিকার চুমুক মারে । কিন্তু কাঞ্চন লক্ষ্য করে লোকটির ময়লা ভরা নখের তর্জনী গ্লাসের চা ছুঁয়ে আছে। সে তাই সুযোগ খোঁজে। আস্তে আস্তে গ্লাস কাত করে চা ঢালতে থাকে খাটিয়ার পাশে–ধুলোতে। বাবলুর চোখ পড়ে যায়! সে কিছু বলেনা। কাঞ্চন বাবলুর মনের কথা আঁচ করার চেষ্টা করে। তারপর আর কথা বেশি দূর গড়ায়না না ।বাবলু আঁকা বাঁকা হাতের লেখায় নাম ঠিকানা দেয় কোনো একজনের।মাদ্রাসায় পড়ান তিনি। কাঞ্চন পকেটে পোরে সে ঠিকানা ।
কাঞ্চন আর ঐ গ্যারেজ মুখো হয়না । তবে সেই 'প্রফেসর' এর খোঁজ করে। তাঁর বাড়িও দিন কয়েক যায়। কিন্তু খৈয়াম এর জগতের সাথে সেই শিক্ষকের বারো ঘর এক উঠান এর ছাপোষা গেরস্থালি মেলাতে পারেনা, তার কল্পনার তারে, নাজুক মেজাজে বুঝি ঘা দেয় তারে ঝোলানো গামছা, লুঙ্গি, শাড়ি, কাঁথা---উঠোনে শুকোতে দেওয়া অ্যালুমিনিয়াম,প্লাস্টিক আর স্টিলের বাসন কোসন। খৈয়াম রোজ ঘুম থেকে উঠে দাঁত মাজতেন বা নিজেকে হালকা করতেন কিনা , সে প্রশ্ন থেকে সে দূরে থাকতেই চায়। সেই ব্যক্তিটির পাঠ দানের সরল গভীরতা, বিষয়ের প্রতি ভালোবাসা সে অস্বীীকার করতে ও পারেনা,কিন্তু তার আর যাওয়া হয়ে ওঠেনা সে বাড়ি । এক ধরনের লজ্জাকর অস্বস্তি বুঝি তাকে গ্রাস করে।আঙ্গিনার সরিষা কলাই এর সাথে কিছুতেই সে আকাশ ভরা সূর্য তারা মেলাতে পারেনা ।কেউ মিলিয়ে দিলেও সে তা মেনে নিতে পারেনা। তার ভাব বিশ্ব তাই বাস্তব আর কল্পনার নানান অমীমাংসিত সমস্যায় ভরে থাকে। সে তাদের পুকুরের ঘাটে বসে ট্রানজিস্টর রেডিওতে গান শোনে,কবিতার কথা ভাবে,প্রেম পরিণয়ের কথা ভাবে। একটি চাকরিও করবার তার ইচ্ছে —ঝুট ঝামেলাহীন। তেমন কোনো চাকরি সে এখনও পেয়ে ওঠেনি, প্রেমের ব্যাপারেও তেমন অগ্রগতি হয়নি। এক জনকে ভালো লেগেছিলো।সেও গররাজি ছিলোনা। ফেলুর বিখ্যাত ফুচকা খেতে গিয়েছিল তারা। মুগ্ধ হয়ে সে মেয়েটির ফুচকা খাওয়া দেখছিলো। ফেরার পথে সে মেয়ে বললো নীলুর গম কল ঘুরে যাবে, এক থলি গম ভাঙাতে দেওয়া আছে।কাঞ্চন প্রেমিকার হাতে লীলা কমলের স্বপ্ন দেখে! গমের থলি মানতে পারেনি।আর ফুচকা খেতে যায়নি। সেই বছরই মহালয়ার গোলাপি ভোরে কপিশার ঘাটে তর্পণ সেরে উঠতে গিয়ে দেখে সে মেয়ে হাতে সত্যি সত্যি লীলাকমল ধরে, আঁচল উড়িয়ে কোনো এক যুবকের সাথে চলে গেল কথা বলতে বলতে। ছেলেটির হাতে কাশের গুচ্ছ। সে বলতে পারেনি , “বোলোনাক কথা ওই যুবকের সাথে”। বাড়ি ফিরে তক্তপোষে সে ঝিম মেরে শুয়ে থাকে অনেক্ষণ।
এখন বাবলুর গ্যারেজের কাছে এলেই তার সাইকেলের গতি বেড়ে যায়।
কাঞ্চন সৌখিন মানুষ। তার মাথার ধব ধবে সাদা বালিশে সে ছোট্ট একটি তোয়ালে দিয়ে শোয়।পাশে টর্চ রাখে। পাট পাট করে ভাঁজ করে সে রুমাল রাখে পকেটে। হাতকাটা একটি সোয়েটার আর একটি মাফলার লক্ষীপুজোর আগেই রোদে দেয়। সে বাংলা অনুবাদেই এখন খৈয়াম ,রুমি ইত্যাদি পড়ে। তার পদ্য স্থানীয় কিছু কাগজে বেরোয়। গোলাম ওসব থেকে বহু দূরে। । সে কদিন প্রশ্ন করেছিল তার উর্দু শিক্ষার আগ্রগতি বিষয়ে ।পরে ভুলে যায়।কালীপুজোতে মেতে ওঠে।
তবু কাঞ্চন সে হেমন্তের দুপুরটির কথা ভাবতে ভাবতে কবিতা লেখে,চাকুরীর কথা ,সংসার করার কথা ভাবে। সেদিন ফেরার সময় গোলাম সঙ্গে ছিলোনা। নাওয়া খাওয়ার বেলা পড়ে আসছিল। গোলামের ওঠার কোনো তাগিদ ছিলোনা। তাই বাবলুর গ্যারেজেই তাকে ফেলে নিজের বাড়ির পথ ধরেছিল কাঞ্চন। গোলামের বৌদিকে ভাতের এঁটো কাটা ফেলতে দেখলো। গোলামের ভাত ঢাকা থাকে ও জানে। সে ফিরবে কিনা সে গ্যারান্টি যদিও কেউ দিতে পারেনা।মাও তাই আর বসে থাকেননা । গোলাম ছাড়াই সে পরিবারের ঘড়ির কাঁটা চালাতে বাধ্য হয়েছে তারা। স্থায়ী উপার্জনের তেমন কোনো চেষ্টাও তার নেই।তবু গড়িয়ে গড়িয়ে চলে যাচ্ছে দিন। আবার যাচ্ছেও না।উটকো ঝামেলায় জড়িয়ে পড়তে তার তুলনা নেই!
আসলে নিজের শর্তে নিজের খুশিমত বাঁচতে গেলে কাউকে অসুখী বুঝি করতেই হয়।সংসারী মানুষ ভারসাম্য রক্ষা করে চলে।গোলামের সে দায় নেই। এই পড়ন্ত হেমন্তের বেলায় ঠান্ডা ভিজে রান্নাঘরে পিঁড়িতে বসে চচ্চড়ি, ডাল , মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেতে সে নারাজ। সে এবেলা আর বাড়ি ফিরবেনা।তার চেয়ে হট হটি বুড়ির দাওয়ায় রোদের ওম খাওয়া তালাইটার উপর গিয়ে শোবে। হটি এই সময়েই সান্ধ্য চাটের মুরগির গিলামেটের বা খাসির চটপটির ঘুগনি নামায়। তাই মেরে দেবে দুটো রুটি বা পাউরুটি দিয়ে। হটি বুড়ি তার মাথায় বিলি কেটে দেয় ভোঁতা নখের আঙ্গুলগুলি দিয়ে। সাত বাড়ি কাজ করেও তার হাতের আঙ্গুলগুলি ভারী নরম।
ওদিকে কানা উঁচু স্টিলের থালায় গোলামের ভাত আর মাছ তরকারি বাটিতে বাটিতে বেড়ে ঢাকা দিয়ে রেখে তার মা নিজের পাতের ঠান্ডা ভাতে একসাথে ডাল তরকারি মেখে গিলতে থাকেন ক্লান্তি খিদে আর কিছুটা অপরাধ বোধের তিক্ততা মেখে। এই অপরাধবোধ এর প্রশিক্ষন তাঁকে ভারী যত্ন করে দেওয়া হয়েছে সেই বালিকা বয়স থেকেই।
এরই মধ্যে হটাৎ গোলাম বিয়ে করে বসলো! কনের নাম ফেমিলা! দিলদারে সে নার্সের চাকরিসূত্রে এসেছিলো উত্তর পুবের পাহাড় থেকে। আবারো ধাঁধা লাগলো লোকের ! কিন্তু এরও উত্তর অধরাই থাকলো।রাস্তার ও পারে পাঁচ ঘর এক উঠোনের টালির চলের ভাড়া বাড়িতে উঠেছিলো ফেমিলা। সেখানেই তারা সংসার পাতলো। টিপটপ ফেমিলা শার্ট এর তলায় লম্বা চাদর লুঙ্গির মত পেঁচিয়ে, নখে নখ পালিশ ঠোঁটে লিপস্টিক পরে বাজারে যেত। পটল কুমড়োর চেয়ে তার ব্যাগ থেকে শাক পাতাই বেশি উঁকি মারতো। আর কি নিত ফেমিলা? সে নিমাই এর কাছ থেকে প্রায়ই নিত মাছের তেল আর পরবেশের কাছ থেকে মাঝে মধ্যে খাসির মাথা। মুরগি নিত গোটা । সে বেস্পতিবার লক্ষীপুজো করতে শুরু করেছিল ভাড়াটিয়া দাস গিন্নির কাছে শিখে। গোলাম তাই বাজারে আসতো ফুল কিনতে।এর বেশি সওদাপাতিতে তাকে দেখা যেতোনা। রাতে প্রায়ই রান্নাবান্না কিছু তেমন করতোনা বুঝি ওরা।মাসের প্রথমে ওদের বেশি দেখা যেত সবুজ আলো সাজানো ড্রীমল্যান্ড রেস্তোরায়,মাসের শেষের দিকে গোলাম রুটি ডিমতড়কা বা রুটি কাবাব কিনে নিয়ে যেত শস্তার এনাদিয়া থেকে। এ ভাবেই মাস ছয়েক চলেছিলো।
তারপর রাগারাগী কান্নাকাটির পর বাইশের গোলাম আর বছর চব্বিশের নরুন চোখ আর রেশম চুলের ফেমিলাকে যুগলে ঠাই দিলে পরিবার।দুই দিদি জামাইবাবু এসে পড়লো দিলদারের ইধার উধার থেকে, ওদের বাড়ি তে বেশ হই চই লাগলো। স্নেহর অধিক্যই যাদের দুর্দশার কারণ বলে মনে করে পাড়ার লোকে।তবে অনেকে বললে, সরকারি চাকরিটি নেহাত আছে তাই মেয়ে ঘর পেল! সে মেয়ে রোজ সেজেগুজে নিউ কাট জুতো খট খট করে হাসপাতালে বেরোয়। দুয়ারে গোলামের ঘোমটা দেওয়া বৌদি হাত নেড়ে হাসে,গুটি কয় মানুষের বুকে ব্যাথা হয়। সিনেমা টিনেমা যাওয়া, হাসাহসি লেগেই থাকে গোলামদের বাড়িতে।
ফেমিলা তার নামের মানে বলতে পারেনা। ওরাতো আর অভিধান দেখে ছেলেপুলের নাম রাখেনা। হয়তো হারানো দিনের ফেমিলা স্নো তে আসক্ত ফেমিলার মা বা দিদিমা তার নামটি রেখেছিলেন। সবসময় নামের মানে জানতে হবে তারই বা কী দরকার! ভালো লাগলেই হলো।সেই ভালোলাগা থেকেই ফেমিলার এক ইস্কুল না যাওয়া মাসি নাকি মেয়ের নাম প্রস্টিটিউট রাখতে চেয়েছিলেন। তিনি ইনস্টিটিউট শুনেছেন।ব্যাপটাইজ করতে গিয়ে ফাদার নাম শুনে তাঁকে আড়ালে ডেক নিয়ে যান কিছু বোঝাতে। তারপর সেই মেয়ের নাম 'আনা' রাখা হয় ফেমিলা র ব্যাপটিজম এর নাম 'হানা'- র সাথে মিলিয়ে। নামের মানেও এক ই রইল । সে এখন কোয়েম্বাট্টুরে নাকি নান হয়ে বাস করছে নামের মাহাত্ম ধরে রেখে। হানা ফেমিলা লিংডোহ -র ‘ফেমিলা’ নামটাই চালু নাম। এসব কথা ফেমিলাই একদিন বলেছিলো তার ভাড়া বাড়ির দাস গিন্নিকে।এজমালি উঠোন কুয়ো আর কলঘর ব্যবহার করতে করতেই মানুষ কাছাকাছি এসে পরে, ভাষা ,সংস্কৃতি, ধর্ম--- সব বেড়া ডিঙিয়ে। সে খুব বেশি কথা বলেনা নিজে থেকে,তবে গল্প করলে অকপটে কথা বলে। কথা না বুঝলে হাসে।
কাজে কম্মে চটপটে ফেমিলা এখন শ্বশুরবাড়ির টাইম কলের গর্তে নেমে সব জল তুলে ফেলে একাই, ঘরদোর সকাল হলেই ঝেড়ে পুঁচ্ছে সাফ করে ,দাদার ছেলেটিকেও অনায়াসে ঘুম থেকে তুলে খাইয়ে দাইয়ে পরিষ্কার করে দিয়ে নিজেও তৈরী হয়ে বেরিয়ে পড়ে।ওঠে সে খুব ভোরে।গোলামের মা পাহাড়ি বৌ এর উপর ভারী সন্তুষ্ট।রবিবার সে পবিত্র হৃদয় চার্চ এ যায়, মাঝে মধ্যে খোকাকেও নিয়ে যায় সাথে, কপালে কাজলের টিপ দিয়ে। ফেরার সময় খোকার হাতে বিস্কুট টফি,কেক---কিছুনা কিছু থাকে। শীতের সকালে চাদরে জড়িয়ে তাকে পিঠে বেঁধে নেয় ফেমিলা,খোকাও বুঝি বেশ আরামে ঝোলে।খোকার মা ঠাকুমা হাসে।বেস্পতিবার সে শাশুড়ি জা এর সাথে বসে আলতা পরে আর পায়ে সুড়সুড়ি লাগায় হাসতে থাকে।
গোলাম বিবাহিত পুরুষের মর্যাদা রক্ষার্থে উঠে পড়ে লাগে বলেই মনে হয়। পাট পাট করে চুল আঁচড়ে বেশ ক দিন তাকে দেখা যায় পাড়ার নাগেদের মস্ত গোলদারির দোকানে খাতা লিখতে। তরতরিয়ে কাজ সে করে অনায়াসে। হাতের লেখাটিও বেশ পরিষ্কার তার। নাগেরা খুশি, খুশি ঘরের মানুষ। মাস দুয়েক যায়, হটাৎ সে উধাও হয় একদিন। বাড়ির লোকের কাছেও হদিস থাকেনা। ফেমিলার মুখে মেঘের ছায়া,কিন্তু কাজে সে রোজ যায়। মা প্রায় অন্ন জল ত্যাগ করার মুখে ,সপ্তাহ খানেক পরে সে ফিরে আসে। বালি,চিপসের ব্যবসা করবে ,হাতে কলমে তাই শিখতে সে চান্ডিল চলে গিয়েছিল কোন এক রতনের লরিতে।রতনকে এ পাড়ার কেউ কেউ চেনে। গোলাম নাগেদের কাছ থেকে বকেয়া মাইনের অতিরিক্ত টাকা চায় ব্যবসার জন্য,তারা দিতে অস্বীকার করলে ঘুসি দেখায়। রাতে গাছ বোম ফাটায় বন্ধ দোকানের বাইরে।বেশ গন্ডগোল দানা বাধে।আবার মিটেও যায়। ফেমিলা আর গোলাম কে অরোরা টকিস এ নাইট শো তে দেখে অনেকে। খিল খিল করে তারা নাকি হাসছিলো আর ফ্যান্টা খাচ্ছিলো । স্টোন চিপসের ব্যবসার লাভ নিয়েই হয়তো তারা আলোচনা করছিলো।
তবে চান্ডিল আর যায়নি গোলাম। তার বদলে ঘোষেদের রোয়াকে তাকে দুপুরবেলা গাঁজা টানতে দেখে কেউ কেউ। রোয়াকে বসে আপন মনে খেলছিলো কোন বাচ্চার জুতোর বাক্সে জমানো সিগরেটের রাঙতাও নাকি সে জোর করে কেড়ে নিয়েছে,কলকের উপর গোল্লা পাকিয়ে বসিয়ে জুত করে ধোঁয়া টানবে বলে! বাচ্ছাটা চিল চিৎকার জুড়েছিল। পরে নাকি সে বাচ্চাকে এক ঠোঙা লজেন্স কিনে দিতে গিয়েছিল ,তার মা বেরিয়ে এসে খেদিয়ে দিতে গিয়েও নাকি হেসে ফেলেছে গোলামকে দেখে। আগের সপ্তাহেই উড়ে যাওয়া ফিউজ সারিয়ে দিয়ে গেছে সে ও বাড়ির,পুরুষরা যখন আপিসে। গোলাম হাসছিলো সামনের বড় দাঁত দুটো বার করে।
দিন কয়েক পরে রাতের দিকে গোলামের বাড়িতে একটা গোল বেধেছিলো। দাদা রোজ সকাল ন টায় আপিস বেরোয়, ঠাকুর প্রণাম করে "মা আসছি বাবা আসছি " বলে। বৌ এর দিকে তাকিয়েও হাত নাড়ে হেসে। অল্পে তার চোখে জল আসে,হাহা করে হাসে।সে মানুষ এর ধৈর্যের বাঁধ ভাঙলো যখন গোলাম কে কাজ কর্মের কথা বলতে গেলে গোলাম আল টপকা বলে দেয়: খাওয়াচ্ছ বলে কথা শোনাচ্ছ? শুধু এখানেই সে থামেনা, সে বলতে থাকে তার বৌ এর টাকাতে সংসার চলছে, বৌকে খুব খাটানো হচ্ছে ঝিয়ের মতো …এমন কত কি !সে পুলিশে কমপ্লেইন করবে! পাহাড়ি বৌ তখন বড়দার ছেলেকে কাঁখে নিয়ে রাস্তার কুকুর দেখাচ্ছিলো। বৌদি রান্না ঘরে। মা কাঁদতে থাকেন বাবা সামাল দিতে চান। বড়দা রাগতে রাগতে কাঁদতে কাঁদতে গোলামকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলে।গোলাম বৌ কে ডেকে বলে বেরিয়ে যেতে হবে ।এসব কাজিয়ার মাথা মুন্ডু কত টা কি সে বুঝলো কে জানে। তবে গোলাম যেহেতু বলেছে, সেও অমনি তার সুটকেশ গোছাতে চলে গেলো খোকটিকে চুমু খেয়ে তার মায়ের কোলে দিয়ে। আবার যাবার সময় ঘোমটা দিয়ে সবাইকে প্রণাম করতেও ভুললোনা। বাড়ি তেও সে ইদানিং শাড়ি ই পড়ছিলো।হালকা পুলকা ভয়েল বা ঐ ধরণের ---যা সে সামলাতে পারে ।
বাড়িটা হটাৎ চুপ করে গেল। গোলাম মহামায়া লজে গিয়ে ওঠে। তারপর হাসপাতালের কোয়ার্টার এ। বৌ হাসপাতাল কামাই দেয়না এক দিন ও। সেখানেও কখনো গোলামের প্রসঙ্গ ওঠে, তাকে চেনেনা এমন লোক দিলদারে খুব কম। গোলাম এর কাজ কারবার নিয়ে নানা গল্প ছড়ায়। টাকা ধারের গল্প আসে। মারামারি হুমকি র জন্য একবার কেস খায়। ফেমিলা সে আলোচনা হাসি হাসি মুখে শোনে,উত্তর করেনা কোনো। কেউ কেউ ফেমিলা কে হিংসে করে খুব গোপনে। কিছুদিন পর ফেমিলার বদলি হয় মহুলিয়ার গ্রামীণ হাসপাতালে---দিলদার থেকে পশ্চিমে জঙ্গল পথে এক ঘন্টার বাস রাস্তা।সে সংসার তুলে চলে যায় মহুলিয়া। গোলাম মহুলিয়াবাসী হয়। তাকে আর তেমন দেখা যায়না দিলদারে। মাঝে মধ্যে হটাৎ দুপুরের দিকে হয়তো বাবলুর গ্যারেজ বা অন্য কোথাও সে হাজির হয়।তবে বিকেলের বাসেই ফিরে যায়। বাড়ি সে যায় কিনা তার সঠিক উত্তর দেয়না, তবে অনেকে বলে দুপুর বেলায় তারা তাকে সে বাড়ির বারান্দায় আঁচাতে দেখেছে। লোকে জানে সে নাকি ওষুধ সাপ্লাই এর ব্যবসা ধরেছে।
বেশ কিছুদিন পর এক দুপুরে লোকে দেখে গোলামের দাদা,মা,দিদি বৌদি বড় বড় চটের থলিতে জিনিস পত্তর নিয়ে রওনা দিচ্ছে খোশ মেজাজে বাসে চেপে। মা এক গাল হেসে বলে যান পাহাড়ি বৌ এর খুকি হবার কথা। সবাই ফিরে আসে পরের দিন ,মা শুধু থেকে যান আরো কিছুদিনের জন্য। তারপর নাকি স্থানীয় একটি মেয়ে পেয়ে নাতনি সামলানোর ভার দিয়ে ফিরে আসেন। খোকার জন্য মন কাঁদে। ছুটি ছাটায় আবার গোলাম ফেমিলাকে এখন দেখা যায় দিলদারে।খুকিটি বাড়ির আদর পায়। গোলাম দেদার জিনিস কেনে খুকির জন্য,খোকার জন্য। গোলাম সবাইকে দেশি মুরগির লোভ দেখিয়ে মহুলিয়া নিয়ে যেতে চায়। কেউ অবশ্য তেমন সাড়া দেয়না। গোলামের অতিথ্য গ্রহণ করার আগে তাকে আরো কিছুদিন মেপে নিতে চায় হয়তো।
দিন কাটে, মাস গড়ায়, বছর ঘুরতে চলে। হটাৎ ই এক কাক ভোরে ফেমিলাকে দেখা যায় খুকিটিকে চাদরে ঢেকে বাস থেকে নেমে হন হন করে গোলামের বাড়ি আসতে।তার চুল উস্কো খুস্ক, চোখ লাল। গোলামের বাড়িতে হই চই কান্নাকাটি শুরু হয়।পাড়ার লোক ভিড় করে।যা ঘটনা ফেমিলা কথা, তা হল, গোলাম দিল্লির কোনো ডিলার এর কাছ থেকে ওষুধ, বেবিফুড ইত্যাদি অনেক কম দামে পাবার খবর পায়।যারা সে খবর দিয়েছিল তাদের সাথেই দিল্লি রওনা হয়। সে সাধারণত দিলদার বা বড়জোর কলিকাতার থেকেই মাল আনতো।ফেমিলা বাধা দিয়েছিল তাকে।তার ভালো লাগেনি।রেল শহরের ঐ লোকদুটিকেও সে চিনতোনা । কথা শোনেনি গোলাম। দিল্লি পৌঁছে সকালে টেলিফোন করেছিল হাসপাতালে।তারপর সেই বিকেলেই সে আবার ফোন করে বলে যে সে সেই রাতেই ফিরে আসবে। । ঐ মাল ঠিক নয়। সঙ্গের নয়া বন্ধুরা আশ্চর্য় হয়েছে, যে সে জানেইনা ওগুলি এক্সপায়ারি ডেট চলে যাওয়া মাল ,নতুন করে ছাপ দিয়ে আবার বাজারে ফেলার জন্যাই ওরা এসেছে! কে নয়তো এতো কমে মাল ছাড়ে! তারা হাসাহাসি করে ওকে নিয়ে। গোলামের মাথায় আগুন ধরে যায়,তাদের সাথে হাতাহাতির দিকে প্রায় চলে যায়। ওদের সঙ্গে আর থাকবেনা সে, সেই রাতেই নীলাচল ট্রেন ধরে ফিরছে সে। টিকিট পেয়েছে স্লীপার এর।সে জানায় স্টেশন এর পাশেই পাহাড়গঞ্জ এর কোনো এক দোকান থেকে সে ফোন করছে। খুকির গলা শুনতে চায় সে তারপর বার বার। তারপর আর খোঁজ নেই তার। সে নীলাচল গাড়ি কখন রেলসহর ছেড়ে পৌঁছে গেছে তার গন্তব্যে গতকাল সন্ধ্যেতেই। রেল শহর থেকে মহুলিয়া একটু কাছে,সেখানেই তার নামার কথা ছিলো সকালে।
এরপর যা হয় তাই হলো। রেলসহরে ছোটাছুটি,খোঁজ খবর, যে যাকে চেনে তার সূত্র ধরে।গহন সেন চড়েছিল ট্রেনে প্রমান মেলে, কিন্তু কখন সে নেমে গেছে ---তার কোনো খবর নেই। সেই লোক দুটিকে আর কোথায় পাবে তারা! একটা জ্বলজ্যান্ত লোক উবে গেল স্রেফ! বাবলু পীর লোহানির মান্নাত মাগলো।হটহটি বুড়ি এলো ,ঘুরে গেল কাঁদতে কাঁদতে।
কিছুদিন পর ফেমিলার মা মাসি আর দিদি এলো দিলদারে।তারা তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চায় সোহরা, সবাই যাকে চেরাপুঞ্জি বলে চেনে। শিলং এর ন্যাজারেথ হাসপাতালে তার কাজের ব্যবস্থা হয়ে যাবে। লোকে অবাক হয় ,যখন দেখে, চারজনের দলটির তিনজন ট্রেনে ওঠে, আর ফেমিলা খুকি কোলে ফিরে আসে গোলামের বাড়িতেই। আরো কিছুদিন মহুলিয়ায় একলা মেয়ে নিয়ে কাটাবার পর সে ফিরে আসে দিলদার হাসপাতালে।
গোলামের বাবা বেশিদিন রইলেননা আর ,মাও চলে গেলেন তার বছর খানেক পর। সংসারটি কেমন অন্য রকম ভাবে শান্ত ভঙ্গিতে বইতে লাগলো। ছেলেমেয়েদুটি বড়ো হতে লাগলো।গোলাম কে নিয়ে জল্পনা কল্পনা ,তার নানান কীর্তি কাহিনী আলোচনা হতে থাকলো কিছুদিন। যতই তার জ্বলজ্যান্ত অস্তিত্ব টি ফিকে হতে লাগলো,ততই মানুষের স্মৃতিতে তার মধ্যেকার বিরক্তি উদ্রেক কারী নেতিবাচক উপাদান গুলি শুকনো মাটির মত খসে পড়তে পড়তে তাকে যেন ক্রমশ লোককথার আশ্চর্য় চরিত্র করে তুলতে থাকলো।
কাঞ্চন চাকরি জোগাড় করতে না পারলেও টিউশানিতে দিব্যি পসার করেছে। সে পড়ায় ইতিহাস, ভূগোল, রাষ্ট্রবিজ্ঞান আর বাংলা। নিচু ক্লাসে ইংরেজিও পড়ায়। তার বিয়ে হয়েছে। বৌ প্রাথমিক ইস্কুলের দিদিমনি। একটিমাত্র ছেলে দিলদার নগর বিদ্যাপীঠ এ পড়ে দ্বিতীয় শ্রেণীতে। ছেলেকে ইস্কুলে নিয়ে যেতে আসতে সে দেখে গোলামদের বাড়িতে বছর ষোলোর সতেজ কিশোরী কি অনায়াসে গিটারে ঝড় তুলে গান গাইছে।তার তরুণ দাদাটিও গলা মেলাচ্ছে। ফেমিলার কপাল চওড়া হয়েছে, গালে মেচেতা,তবু মুখের হাসি একই রকম।সে বুঝি আজও অপেক্ষায়। দাদা বৌদি বুঝি নীরব চালচিত্র।
অপেক্ষায় কি আর কেউ নেই? পিচ গলা, লু ছোটা দুপুরে হটাৎ ই বাবলুর গ্যারেজে বা অন্য কোথাও বুকের দুটো বোতাম খুলে ঝাঁকড়া চুলের কাউকে তেরছা ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলে ওর হৃৎপিন্ড লাফিয়ে ওঠে কেন? ঘনঘোর বর্ষা বা খড়ি ওঠা শীতের অবেলায় এ শহরে যারা মোটর সাইকেল হাঁকিয়ে ঘুরে বেড়ায়,পথের পাশে চা খায়---তাদের মধ্যে অনেক সময়েই কি সে গোলামকে দেখে ছুটে যেতে চায়না? আবার সে ভয় ও পায় যেন তার মুখোমুখি হতে! গোলাম তার রোমান্টিক সত্তার গোপন ফ্যান্টাসি। গোলাম বুঝি তার সংশয়ী সাবধানী যাপনের গোল্লা পাওয়া মার্কশীট ।
প্রতিটি মানুষের গহনে বুঝি এমন এক জীবন ক্ষুধার হিসেব কাজ করে দিনের শেষে ----যেখানে উচিত- অনুচিত,পাপ -পুণ্য, ভালো- মন্দের চর্চিত সব হিসেব যেন তীব্র এক মাদকের ঝাঁজে উড়ে পুড়ে যায়। জীবন রূপ সে মাদকের ভান্ড গুটি কয়েক মানুষই বুঝি হতে পারে। সে ভান্ডও বুঝি আর বেশিদিন নিজেকে রক্ষা করে উঠতে পারেনা সেই মাদকের হাত থেকে, যা আসলে হলাহল আর অমৃতর দ্বৈত নৃত্য ! সে নিজের উচ্ছাসেই ফেটে পড়ে, তারপর হাওয়ায়, আলোয়, রোদে, বৃষ্টিতে, ঘাসে, পাতায় ---ধোঁয়া ধোঁয়া হয়ে উড়ে বেড়ায়।
হয়তো আরো বছর কুড়ি পর , কোনো বলিরেখাময় হেমন্তের রাতে, ঘুম আর জাগরণের আলোয় কালোয় তার মনে হবে, সত্যিই 'গোলাম' ওরফে 'গহন সেন' বলে কেউ বাস করতো কি দিলদারে? নাকি সে তারই বিকল্প সত্তা ---যাকে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছে পেছন থেকে, অথচ সে ঘুরে দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রাখলেই আর সহ্য করতে পারেনি,ভয়ে পিছিয়ে এসেছে বার বার?
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।