এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক

  • দিলদার নগর -৯

    Aditi Dasgupta লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | ২৩ নভেম্বর ২০২৪ | ১১৮ বার পঠিত
  • রূপটি ছাপিয়ে সে যে অরূপিণী আলো!
    অন্ধজন তাই বুঝি দেখে তারে কালো।

     
    কালীপুজোর রাত এক আশ্চর্য রাত! দুর্গা তো ঘরের মেয়ে, এক মাত্র কন্যা রত্নটির আদর যত্ন, তাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা, আমোদ, বিষাদ।। কিন্তু কালী যেন তিন মেয়ের মধ্যে মেজো টি! একেবারে বাঁধন ছেঁড়া। বড়টি প্রথম সন্তানের মর্যাদা পায়, ছোটো টি অনেক সময় পিতৃতান্ত্রিক হতাশা নিয়ে আসলেও কোল পোঁছা। কিন্তু মেজটি এর কিছুরই ভাগ পায়না, তাই জন্ম স্বাধীন, প্রতিবাদী, ঝামেলার! রং টিও কালো! খালি নেচে বেড়ায়, বসনের ধার ধারেনা, চুল ওড়ে হাওয়ায়। তার  উদ্দামতার কাছে হার মানতে ভালো লাগে। আসলে সেই তো সর্বরূপিণী ----নয়তো জীব কাটে কেন? দিলদারে দুর্গা পুজো হয় পুজোর মত, কালী পুজোয় সে মেতে ওঠে। সে বুঝি নীল অরণ্যর রহস্য হাতছানিকেই বেশি করে নিজের মনে করে। রহস্যর সাথেই ঘর জমাতে চায়, তাকে বুঝতে চায় তার মত করে! তবু কুমোর বৌ সিঁদুর মাখা পাকা চুল নাড়িয়ে পাশের বাড়ির বৌ ঝিদের কাছে দুঃখ করে :তার বেটার নতুন বৌ এর রং ‘ময়লা ‘! সেই ময়লা বৌ তকতকে করে রাখে উঠোন গোয়াল, তারপর তুলি ধরে রং করতে বসে ঘট সরা, চোখ আঁকে প্রতিমার । সংসারের চাকা তো কিছু আটকায়না! বুড়ি কুমোর বৌ ও তা ভালোই জানে। তবু সংসারে চলতে গেলে জেনে বুঝেও অচল চাকাতে একটু তেল লাগিয়ে রাখলে তলে তলে নিজের মত কাজ সারা যায়, ওই আরকি! ছেলে বিলু মা কে দেখেও এক গাল হাসে, বৌকে দেখেও, আর চাক চালায়, গম ভাঙার মেশিন ও কেনে। মায়ের কাছে, মেয়ের কাছে, বোনের কাছে, বৌ এর কাছে স্বেচ্ছায় হার মানা পুরুষের চেয়ে নমনীয় কে? তার চেয়ে শক্তি আর কে ধরে? 
     
    এই সময় এ শহর দিনে গেরুয়া রং ধারণ করে। সূর্যাস্তের সময় সে রং হটাৎ ই রক্তে রঞ্জিত হয়ে ভাসিয়ে দেয় শহরের বাড়ি ঘরের ছাদ,মন্দিরের মসজিদের চার্চ এর চূড়া, পথ,মাঠ ঘাট। তেঁতুলতলার ঢেউ খেলানো তেপান্তরের মাঠ থেকে খেলা সেরে ফিরে আসা বালকের দলও সেই রাঙা আলো মাখে । পিছনে জেলখানাও লাল হয়ে ওঠে। জেলের ভিতরে যারা? তারা তখন কী করে?কারা থাকে সেথায়? দুস্টু বদমাস খুনিই কি শুধু? এ জেলখানা সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই কত অপরাধে কত লোককেই না ধরে রেখেছে! ন্যায়ের দাবীতে প্রতিবাদী কত কন্ঠ, স্বাধীনতা র আগে পরে আটকে থেকেছে এই কারা পাঁচিলের ওপারে!  সেখানে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রাগ সামলাতে না পেরে মুহূর্তের ভুলে দাগি হয়ে যাওয়া নিরীহ মানুষ ও  গিয়ে ঢোকে,আর ঢোকে অরণ্যর অধিকার থেকে উচ্ছেদ হওয়া বনের মানুষ। তাদের স্বাভাবিক জীবন যাপন করার অপরাধে শাসকের আইনে দোষী! ।মাঝারি মাপের মাঝারি দায়িত্বে র কর্মচারীরা এদের উপরেই জুলুম করতো, করে বেশী।এদিকে খুনী ডাকাত দের তোয়াজ করে তারা। 
     
     আসলে রাজনৈতিক ক্ষমতার হস্তান্তর কে মানুষের স্বাধীনতা করে তুলতে সবাইকেই এগিয়ে আসতে হয়, নয়তো সুযোগ সন্ধানী পাজিদের হাত শক্ত হয়, সহজ মানুষের ভোগান্তি জোটে! স্বাধীনতা র পরেও গরীব সাঁওতাল মেয়েগুলি কে ধরে নিয়ে আসা হয় চোলাই তৈরীর অপরাধে, পুরুষগুলি ছাড় পেয়ে যায় জানি কেমন করে! নিজেদের হাতে তৈরী হাঁড়িয়া আর মহুয়া কেবল বেচার জন্য নয়, নিজেদের গলায় একটুক না ঢাললে কাম করবে কী করে? তার অভাবে জেলের ভিতর কেরোসিন চুরি করে খেতে হয় তাদের--- খাটনি সেখানে ই বা কম কী ? সশ্রম কারা দণ্ড তারা দণ্ডিত না হয়েও স্বভাব গুনেই জেলের হেঁসেলের ডাল ভাঙা চাল বাছা করে দিত আর সেটাই হয়ে যেত দস্তুর! জমাদারনী রা খাটায় তাদের, হাত পা টেপানো, আরো কত কি! সব দিন শরীর কি দেয়? জমাদারনী একদিন সেই রাগে কারো একজনের গায়ে তুল্লে ঝাঁটা! ব্যাস!বেরিয়ে এল তাদের ঝোড়ো সত্তা, কেউ খেলেনা সেদিন, তার পরদিন…..জেলার এর কানে গেল।কানে তুললো পূব বাংলা থেকে আসা এক মেয়ে ---মনি না কুন্তলা ---কী নাম যেন ----স্বাধীনতা র আগে বা পরে যার লড়াই শেষ হয়না গ্রামে গঞ্জে। স্বাধীন দেশের জেলে তাই তারও ঠাঁই। জেলখানা সেদিন হটাৎ দেখল ক্ষমতার উর্দিতে ঋজু মানবতা। মুখ লাল হয়ে উঠল জেলারের। জমাদারনী ক্ষমা চাইতে বাধ্য হলো। তিনি সাঁওতাল মেয়েগুলির কাছে গিয়ে নম্র স্বরে  বললেন :
    এবার তোমরা খাও মা! 
     
    হয়তো শৈশবেই তাঁর কপালে আঁকা হয়ে গিয়েছিল সেই অদৃশ্য ছাপ তিলক ----যা তাঁকে ক্ষুব্ধ মাতৃমূর্তির সামনে নমনীয় হতে শিখিয়েছিল! কে জানে কে কেমন ভাবে বড়ো হয়---কোন গেরস্ত ঘরের মহা মাতৃকুল তার সংস্কার চারিয়ে দেয় তাদের ছেলেপুলেদের মধ্যে যা শত ক্ষমতার হাতছানির মধ্যেও তাদের অমানুষ হতে দেয়না ----একই উর্দির লোকের মধ্যেও তাই বুঝি এত্ত ভেদ! 
     
    বৈরাগীদের ঘটনাটা আজও আলোচনা করে হাসাহাসি করে লোকে।আপিস ছুটির পর চা দোকানে দাঁড়িয়ে সরকারকে গাল দিচ্ছিলো নাটুকে অবিনাশ বৈরাগী।তখন নাকি জরুরি অবস্থা। তা সেই অবিনাশ কে তুলে নিয়ে গেল পুলিশ, তাকে যথা স্থানে গচ্ছিত করলো, তারপর একটা কালো গাড়িতে বাড়ির চারপাশে টহল দিতে থাকলো ‘সন্দেহজনক’ খোঁজার সরকারি দায়িত্বে। সেই সময়েই অন্ধকারে রাস্তায় আবার দেখা পেল তারা অবিনাশের! গেল জোর ঘাবড়ে !কি করবে ভেবে না পেয়ে তারই সামনে গিয়ে বলে :নমস্কার অবিনাশ বাবু! অবিনাশ বাবুর প্রতিলিপি ছোট ভাই অভিলাষ হেসে টিটকিরি দেয় :গাঁজা খেয়েছেন নাকি?তাকে তো নিজেরাই তুলে নিয়ে গেলেন! তারা ভারী লজ্জিত হয়ে চলে যায়। হেরে গিয়েও তারা সেদিন জিতে গিয়েছিল সেই কারণেই বুঝি।
     
     অবিনাশের মা,বাড়ির মেয়ে বৌরা ছেলেপুলে নিয়ে দেখা করতে যায় জেলে, গগন রিক্সা ওয়ালার রিক্সা তে ক্যাচ কোচ করে। গোলগাল শ্যামলা রং এর 
    জেলার মনোতোষ বাবুকে প্রতিপক্ষ বা শত্রু মনে হয়না, তিনিও বন্দীর কাছ থেকে ধার করে পড়েন মুজতবা আলী। কোনো এক কয়েদি সে বাড়ির শিশু কন্যাটিকে কোলে নিতে চায়, আর হাউ হাউ করে কাঁদতে থাকে তাকে জড়িয়ে। হয়তো সেও অন্য এক কাবুলিওয়ালা! চারটি মাস জেল খেটে এমনই এক কালীপুজোর আগের দিন অবিনাশ ছাড়া পায়।বাড়ির আর পাড়ার মানুষ তাকে আনতে যায়। মনোতোষ বাবু, সেই কয়েদি ও আরো অনেক কে একদিন বাড়িতে ভাত খেতে আসার নেমন্তন্ন করে তারা ফেরে। মনোতোষবাবু সেই কয়েদি ও অন্যান্যদের নিয়ে ভাত খেতে গিয়েছিলেন কিনা সেটা বড়ো কথা নয়। 
     
    এমন সব ঘটতো, ঘটেও এখনো বুঝি দিলদারে। অনেক বছর পর সেই জেলখানার সেন্সরড হয়ে ছাড়পত্র পাওয়া বই এর সিপিয়া পাতার উপর বেগুনী রং এর স্ট্যাম্প----দিলদার নগর সেন্ট্রাল জেল---ফিস ফিস করে গল্প শোনায় কত না বলা মানবিক রসায়নের! বাইরে মোড়কে কি সব কিছু বোঝা যায়?আগুন খাওয়া কত বিপ্লবীর ঘরেও তো ছয়টি মেয়ের পর একটি ছেলে হয়! 
     
    কাজেই পাড়ার বিখ্যাত বকাটে ছেলে পা কাটা বুজু যখন তার কাঠের পাটা টেনে একটু খোঁড়াতে খোঁড়াতে জর্দা পান মুখে “পুচকা কই? পুচকি কই? “ –হাঁক দিতে দিতে উঠোনে এসে দাঁড়ায় তখন তাকে বাধা দিতে মন চায়না বাড়ির মানুষের। মুখে বকাবকি করে যদিও –কোথা থেকে পয়সা পাস….ইত্যাদি! কারণ বাজি এনেছে ও সবচেয়েয়ে ছোট দুটির জন্য। রথের মেলাতে কিংবা পৌষ মেলায় খেলনা দিয়ে যেতে ভোলেনা। অদ্ভুত ছায়াময় সেই কার্তিকের শেষ দুপুরে তাকে দুটি ভাত খেতে বলে বাড়ির মানুষ কাকিমা জেঠিমা। পান খাওয়া লাল দাঁত নিয়ে রতন হেসে চলে যায়। জানে এখানে পাত পেড়ে বসতে নেই! ও এখন বসবে গিয়ে সাউ দের রকে।
     
    দুর্গাপুজোর জৌলুসের ক্লান্তি মেটায় ঘরের কোনে শান্ত লক্ষী পুজো। তারপর শুকনো আর হিম হিম বাতাসের সাথে পরিচিত হতে হতে কালীর কাঠামোয় খড় বাঁধা, মাটির প্রলেপ। খুব ভোরে কুয়াশা মেখে বেরিয়ে পড়ে গৌড়ীয় মঠে র নগরকীর্তন। ঝুঁকে পড়া রোগা বুড়ো বাবাজি হাঁপের টানে শ্বাস ফেলতে ফেলতে সেই কুয়াশা কেটে এগোতে চায় অন্যদের সঙ্গে তাল রেখে। ঘুম থেকে উঠে পড়ায় বসতে হয় পড়ুয়াদের। চায়ের দোকানে আঁচ পড়ে। হরিজন পল্লীর বাচ্চারা পড়তে বসেনা, তারা রাস্তা ঝাঁট দেয় লাল চোখে।নিজেদের মধ্যে মারামারি ও করে নেয় একটু। চাদর মুড়ি দিয়ে কৃষ্ণাও এ সময় বাড়ি ঢোকে। দিলদারে অনেকেই চেনে তাকে।
     
    শুধু কি কালী মূর্তি তৈরী হয় এই সময়? দেওয়ালি পুতুল আছেনা? ডিবরি, প্রদীপ বানানো আছেনা? তাই কুমোর পাড়ায় ভারী ব্যস্ততা এখন । দিলদারে দেওয়ালি পুতুল ছাড়া দেওয়ালি হয়না। ঋজু দেওয়ালি পুতুল মেয়ে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, দুই হাত বাড়িয়ে। সে হাতের পাতা নেই। বাহুর শেষ প্রান্ত ঘুরে বেঁকে মনিবন্ধ কে ছোঁয় আর তৈরী করে একটা বলয়--- প্রদীপ রাখার বা ডিবরির ফানেলের মত সরু লম্বা নিচের অংশ টি গুঁজে রাখার জন্য।তবে এমনি আলো দেওয়ার ডিবরির নিচে সরু লম্বা হয়না, পেট মোটা মাটির কলসির মত তলাটি তার থ্যাবড়ানো, তাই দিব্যি গ্যাট হয়ে বসে থাকে। তেল ও ধরে অনেকটাই, কেরোসিন ---অনেক রাত অবধি জ্বলে। তবে মাটির পিদিমের মত স্নিগ্ধ আলো নয়, মশালের মত বুনো। দেওয়ালি পুতুল মেয়ের সাদা ঘাগরার সামনে মস্ত বড়ো পুষ্প, কত উজল সে রং, সারা ঘাগরাই প্রায় ঢেকে দেয় সে! হলুদ সূর্যমুখী কিংবা গাঢ় ম্যাজেন্টা পদ্ম।নীল পদ্ম ও থাকে। ব্লাউজ ও ঘোর রঙা। মিষ্টি মুখের চারপাশে কোকড়া চুল, মাথায় কখনো মটুক। ভারী স্বাধীন সে মেয়ে। দুই হাতে দাউ দাউ আগুন ধরে দাঁড়িয়ে থাকে গেরস্তের বারান্দায়, উঠোনে, ছাতে। দেওয়ালি পুতুল মানবীই হয়। কচ্চিত কদাচিত দু এক পিস রাক্ষ স খোক্কস।মানব দেওয়ালি পুতুল হয়না!কেন কে জানে! ছেলেরা কি কেবল যুদ্ধ ক্ষেত্র আর জঙ্গলেই মশাল জালে? বাড়িতে নয়? নাকি ইচ্ছে থাকলেও পূর্ব নির্দিষ্ট বিধি নিষেধ? যাগ্গে!
     
     পুতুলের পিছনে কখনো থাকে ইঁট দিয়ে বানানো ছোট্ট দেওয়ালি ঘর---এক তলা, দোতলা ---চুনকাম করা, কখনো ছোট্ট মাটির পাহাড় -সবুজ সে পাহাড়। এক সপ্তাহ আগেই পাহাড় বানানোর সাথে সাথে সর্ষে দানা ছড়ানো হয়ে গিয়েছিল,দানা ফুটে কচি চারা উঁকি দেয় সারা পাহাড় জুড়ে আজ। ছোট ছেলে পিলেরা ক দিন ধরেই আর ঘরে থাকতে চায়না, ভোর ভোর উঠেই দৌড় মারে। মা ঠাকুমা রা জোর করে সোয়েটার হনুমান টুপি পরিয়ে দিতে চায়, তাও ঠান্ডা লাগায়, নাক দিয়ে জল ঝরে, পায়ে খড়ি ফোটে। গুলি খেলার মাটির গর্ত থেকে ভিজে ভিজে গন্ধ ওঠে, দেয়াল পাঁচিলের ধার ঘেঁষে সে গর্ত খুঁড়তে হয়,সবসময় তাই ছায়াময়। সেখানে দাঁড়ালে গা শির শির করে, নাক ব্যাথা করে। তাও খেলা চলে। তারপর ধরে বেঁধে আনা,সর্ষের তেল ফাটা চামড়ায় পড়তেই জ্বালা আর ঠাণ্ডা জল পড়তেই চিল চিৎকার, উঠোনের রোদ টুকু নিয়ে কাড়াকাড়ি। খাওয়ার পর এখন ঘুমোতে বলেনা কেউ এই শির শিরে দুপুরে। সন্ধ্যে হওয়ার আগেই অনেক বাড়ির ছাদেই জ্বলে উঠবে আকাশ পিদিম। ওরা হিসেব করে কারা কারা আকাশ থেকে দেখছে এই আলো। খুব বেশিদুর এগোতে পারেনা,কারণ অতীত আর তাদের কত টুকু? কত জনকেই বা তারা হারিয়েছে, খুব দুর্ভাগা না হলে? তাদের বাপ মারা অনেকের কথাই ভাবে, আর বুড়ি ঠাকমা তাঁর শৈশব যৌবন পুরোটাই দেখতে পান ওই আকাশে-----সেই পিদিমের আলোয়। ঝাপসা বেদনার হিমে ছেয়ে থাকে সে আকাশ। তাই চোদ্দো পিদিম আর পরদিন দীপাবলির আলোর ছটায় সব জমে ওঠা অন্ধকার তাড়াতে বুড়োরাও এসে দাঁড়ায় ছোটদের চারপাশে। তারাবাতি রং মশালের আলোয় মনকে আবার রঙিন করে তুলতে চায় তারা।
     
    বাহারি চুলওয়ালা কোনো মামা কিংবা দাদা এসে হাজির হয় সে রাতে ফেরেস্তার মত। তারা আসা মানে আরো রং মশাল, আরো তুবড়ি আর দত্ত কেবিনের মোগলাই। সারা রাত ধরে রাস্তায় মানুষের চলা ফেরা কথা বার্তা। যারা বাজি পুড়িয়ে ক্লান্ত, যারা রাতে ঘোরার অনুমতি পায়নি, যাদের পরীক্ষা সামনে ---তারা মোটা কাঁথা খানা জড়িয়ে আধো ঘুমে শোনে সে শব্দ। পরদিন পোড়া বাজি মাড়িয়ে খানিকটা বারুদ খানিকটা শিশিরের গন্ধ পেরিয়ে তারা দাঁড়ায় গিয়ে মাঠের প্যান্ডেলে খিচুড়ির লাইনে। প্যান্ডেলের কাপড় থেকে কেমন একটা গন্ধ বেরোয়। রাশি রাশি মরা শ্যামা পোকায় ভরে থাকে প্যান্ডেলের বাঁশের গোড়াগুলো। বেলা বাড়ে, লাউড স্পিকারে গান বেজেই চলে উৎসব কে ধরে রাখতে। এসে পড়ে ভাইফোঁটা। পুজোর ছুটির লোকজনের মন সেদিন সারাদিন আনন্দের ফাঁকে ফাঁকে হুহু করে ওঠে। চন্দনের ফোঁটায় টান লাগে শুকনো বাতাসে। ওস্তাগর থেকে শীতের গরম কাপড় ইতিমধ্যে এসে গেছে। এখন গোছানোর পালা। উৎসব শেষে ফিরে যাওয়া কর্মস্থলে। দিলদার ছেড়ে যেতে পা ভারী হয়ে আসে, চোখও। কবে আসবে বড়দিন! 
     
    যারা থাকে তারা চলে যাওয়া লোকজনের কথা ভাবে, আলোচনা করে, কেউ কেউ চোখের জল লোকায়। তারা বাজার করে, কয়লা আনে,রান্না করে, গেরস্থালী সামলায়, দুপুরের রোদে পিঠ দিয়ে ভাত খায়, উল বোনে,কাগজ পড়ে কিংবা উলি শাড়িতে চুমকির নকশা তোলে। ছেলেপিলেরা পড়াশুনো করে পরীক্ষা দিতে যায়, ফিরে আসে শুকিয়ে যাওয়া মুখ আর আঙুলে কালির দাগ মেখে। কিছু খেয়ে মুড়ি সুড়ি দিয়ে আবার পড়তে বসে এক নীরব কঠোর পরিচালনায়।রোদ পড়ে এলে বড্ড তাড়াতাড়ি এখন বন্ধ হয়ে যায় জানালাগুলি।  বেগুন পোড়া আর ফুলকপির গন্ধের সাথে মিশে যায় শীতের ক্রিমের গন্ধ। দীর্ঘ  ভারি শীতের রাত গড়াতে থাকে আসতে আসতে। সেই অন্ধকার দীর্ঘ রাতে বাইরে বাতাসের শব্দ শোনা যায়। সেই রাতে কারুর কারুর ঘুম আসেনা। ঘুম না এলে সে হয়তো স্মৃতি চারণ করে পেছনে ফেলে আসা কালীপুজো আর দেওয়ালির উজ্জ্বল রাতের, কিংবা ভাবতে থাকে সামনের বড়দিনের কথা। দেওয়ালি পুতুলের মত দুহাতে সুস্থিতির মশাল জেলে বুক চিতিয়ে নীরব প্রতীক্ষায় জেগে থাকে সেই মায়াবী মেরী মাতা ---নাকি মেরী ম্যাগডালেন ? নাকি দিলদারকে ঘিরে রাখা নীল জঙ্গলের আদিম কোনো শক্তি, যা একাধারে লিলিথ এবং হবা?
            
     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ২৩ নভেম্বর ২০২৪ | ১১৮ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Kakali Bandyopadhyay | 223.223.***.*** | ২৩ নভেম্বর ২০২৪ ২৩:৪২539594
  • এবার বেশ  কিছুদিন  বাদে  আবার  দিলদার  নগরে  ফিরতে  পেরে  আনন্দ পেলাম ....মনে  পড়ে গেল  ঠাকুর  দেখতে  বেরিয়ে  দত্ত  কেবিনে  ছোটকাকুর  সাথে  মোগলাই  খেতে  গিয়ে  হাত  থেকে  কাঁটাচামচ  ছিটকে  পড়ার  ঘটনা ..সেই   কাকুও  এখন  কোথায়  যে  ছিটকে  চলে  গেল ...
  • kk | 172.58.***.*** | ২৪ নভেম্বর ২০২৪ ০১:২২539597
  • অপূর্ব !
  • পাপাঙ্গুল | 103.24.***.*** | ২৪ নভেম্বর ২০২৪ ০২:০৪539600
  • পরের পর্ব আবার বড়দিনের পর আসবে :D ?  
  • Santosh Kumar Pal | ২৪ নভেম্বর ২০২৪ ০৮:৫২539610
  • বেশ লাগল।
  • Aditi Dasgupta | ২৪ নভেম্বর ২০২৪ ১৯:৫৭539617
  • @পাপাঙ্গুল :সিটিতো আমার হাতে নেই ভাই, তেঁনারা  তাঁদের মর্জি মতো আসেন। তবে খেরোর খাতায় বড়দিন এর কথা কিছু আছে।
    ধন্যবাদ জানবেন সকলে।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খেলতে খেলতে মতামত দিন