এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক

  • দিলদার নগর ১১

    Aditi Dasgupta লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪ | ৩৪৭ বার পঠিত | রেটিং ৫ (২ জন)
  • প্রসন্ন এ প্রাতে -----
    তোমার করুণা পথ উঠিতেছে জাগি।
    বাদ্য নিষিদ্ধ এই পথে ---
    শব্দহীন শিশিরের লাগি।
     
    জলের ধার ঘেঁষেই মানুষের বসত। নদী কি সাগরের একেবারে গায়ে গায়ে আগে থাকতো অন্তজ জনের বাস । গন্যি মা ন্যি র আবাস ছিল শহরের ভিতরে,সবচেয়ে নিরাপদ আর সুবিধার জায়গাটিতে। যত আপিস, কাছারি, চওড়া রাস্তা ঘাট, উদ্যান সবই সেখানে। দিলদার ও তার ব্যতিক্রম হয় কী করে?তাই রক্ত মৃত্তিকাময় চড়াই উৎরাই মালভূমির ঢাল ঘেঁষে কপিশার ধারে ধারে হরিজন বস্তি।পুবে সবুজ সমভূমি র পাললিক মাটিতে চাষআবাদ, তাই সেখানে থাকে চাষা ভুসো , জেলে দুলে। খোড়ো ঘরগুলি থেকে উঠে আসে আঁচের ধোঁয়া আর মাটি মাটি গন্ধ। তাকে ঘিরে পুকুর বন বাদাড় । আজকাল এসব জায়গায় অবিশ্যি বড়ো মানুষদের জন্য প্রকৃতি র কোলে প্রাকৃত জনের ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে পাঁচ মেশালী আনন্দের আলোকময় পাঁচিল দেখা যায়। তখন এমনটা ছিলোনা।জল মাটি ঘিরে যাদের পেশা তারা জলের ধারে মাটির কোলে থাকতো, জল মাটি ও তাদের তাই ভয় পেতোনা, কারণ একের সাথে অপরের টিঁকে থাকার সম্পর্ক ছিল খুব কাছাকাছি ।
     
    এখানে দাঁড়ালে কল্পনা করা যায়না। এই শহরেরই আরেকটা দিকের কথা। সেখানে পেল্লাই সব সরকারি বাংলো বাড়ি, জমি থেকে অনেক উঁচু ঢাকা বারান্দা, মোটা মোটা থাম, তারপর ঘর--- মস্ত উঁচু ছাদ তার। ঘর পেরিয়ে আবার বারান্দা, ভিতরের উঠোন চাকর বাকরদের আবাস! বাড়ির সামনে লন।সেখানে বেতের চেয়ার, টেবিলে সাজানো চা টা। আগে থাকতো সায়েবরা এখন উঁচু পদের সরকারি চাকুরে। তাদের কেউ কেউ সায়েব সুবো। এই অঞ্চল জুড়েই কত কিছু। পুলিশ লাইন, ফরেস্ট অফিস, সরকারি দপ্তর পোস্ট আপিস, এমনকি ক্যাথলিক চার্চ ও। প্রতিবাদী খিস্টান দের ইস্কুল, চার্চ আর বসতি অবশ্য এর প্রান্ত সীমায়। কেতার হোটেল বল, রেস্তোরাঁ বল সবই এই দিকটার যত কাছে আসতে পারে ততই তাদের যেন জাতে ওঠা ।এখানে রাজপথ, এখানে পেল্লাই লাল ইটের জলের ট্যাঙ্ক, কেমন জানি ভয় জাগানো সম্ভ্রম ---লাল ইটের ই আপিস কাছারি, পোস্ট আপিস। কোর্ট অবশ্য একটু দূরে, নদীর কাছাকাছি, একটু ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে।-নানান কিসিমের মানুষের মিলমিশ কিনা সেথায় ---চোর, ডাকাত, বিপ্লবী! সেখানেও সেই লাল ইটের বারান্দা ওলা সারি সারি ঘর, বাইরে মেলা---চা, পান, বিড়ি সিগারেট,ফলমুল, ধনেশ পাখির ঠোঁট- জড়িবুটি থেকে বাচ্চাকাচ্চার জামা জুতো অবধি!
     
    এই দুই প্রান্তের মাঝে আছে ঘিঞ্জি পুরোনো শহর, মশলা, বেলফুল, আতর আর দশকর্মের গন্ধ মেখে ---ওস্তাগর,বাজি, গোলদারি, ধুনুরি, পাতলা ইটের বসে যাওয়া চায়ের দোকানের আবছা গোলাপ ফুলের খোদাই,গলির ভিতর ভাঙা মাজারে বসন্তের ঘেঁটু ফুল ----মন্দির, মসজিদ, মাজার আর বাজার নিয়ে! আর আছে তার নিজস্ব আমোদ---ওই যে ----দুগ্গা কালী সরস্বতী, হনুমানজী…উরস পাক ..বিয়ে শাদী।
     
     আবার যত নদীর দিকে, জমির দিকে, বনের দিকে এগোবে--- ততই আসবে শীতলার ভর, বড়াম বুড়ি, টুসু, বাঁধনা…ধামসা ---ডোম বাজনা….! তারই মাঝে হয়তো এক আধ ঘর খ্রিস্ট ভজা। তারা অবশ্য শূদ্র কেরেস্তান, খাস কেরেস্তান বলে দাবিদারদের ক্রমোচ্চ্চ গল্পে! তবে বেশ আছে এ শহর সব কিছু নিয়ে।
     
     অঘ্রান থেকে পৌষ আসে, জমির ধান ওঠে, ওঠে নতুন গুড়। আহা সোনালী নবান্ন! এই তো পরবের মরসুম! ঘরে খাবার না থাকলে উৎসব কোথা? দুগ্গা পুজো আসে বন্যা রোগ জ্বালার গায়ে গায়ে। করতে চাইলেও তেমন আমোদ আর হয় কই? পয়সা কড়িও তেমন থাকেনা হাতে! সময় ঘুরলে, ফসল উঠলে তবেই না মোরগ লড়াই, ফুটবল খেলা, বড়দিন!  মাফলার চাদরে গুড়িসুরি মেরে তৃপ্ত মুখে মানুষ, ছেলেপুলে নিয়ে আমোদ করা মানুষ ভীড় জমায় তাদের ই মতো খড় মাটি র গন্ধমাখা মানব জন্মের উদযাপনে।মেরী মা র কোলে যীশু বাবা, পাশে তার বাবা, আর জ্ঞানীগুণী মানুষরা, তারার আলোর পথ চিনে ঠিক পৌঁছে গেছেন আস্তাবলে! ফুল দিয়ে সাজানো চারপাশটি। চার্চ এর পেছনে খ্রিস্টান পাড়ার বাড়িগুলিও আজ সেজে উঠেছে, সেখানেও পুতুল আর আলোর সাজ। পিছনে নির্জনে পড়ে থাকা, কবর খানার সন্ত জোহনের গির্জেতেও রং এর প্রলেপ, একটু আলো। দল বেঁধে বন পাহাড়--- নদীর ধার থেকে আসে তারা ----তেমন আলাদা করে চড়ুই ভাতি করেনা। বাড়িতে বসে খাওয়া তাদের দিনের বেলা তেমন হয়ই না, চাষের মরসুমে বিশেষ করে! তারা রোজই চড়ুইভাতি করে মাঠে ময়দানে ----কেউ বা নতুন নতুন বাড়ির ইঁট গাঁথার ফাঁক ফোকরে! । তারা খাস শহরে বড়দিনের মেলায় আসে। তারা টাকা কম রোজগার করে, ভবিষ্যৎ না ভেবে উড়িয়ে দেয়, ঠকে, কাঁদে, আবার হোহো করে হাসে। দুম করে মরেও যায়। কিন্তু বাঁচে বেশ জবর!
     
     মধ্য শহরের মানুষ ও আসে, তাদেরও নিজস্ব রং ঢঙ। তারা আসে চতুর সব রসিকতা ছুঁড়ে দিতে দিতে ---যা প্রায় প্রত্যেক বছর এই এই সময় তারা এই এই ভাবেই করে থাকে ---কমিকসের চরিত্রের মত ---একই বৃত্তে ও ছন্দে। তাই আগের বছর--- পরের বছর এর সাথে তেমন ইতর বিশেষ হয়না। কেউ খুব মজাদার, কেউ গম্ভীর  কেউ দুঃখি, কেউ ঝগড়াটে ----একটি মাত্র মাত্রাতেই তারা স্বীকৃতি পায় আর নিজেদের ও সেরকম ই ভাবা ছাড়া আর উপায় থাকেনা । তারা সেরকমই  দেখিয়ে যায় নিজেদের তাই। খুব খারাপ ও না খুব ভালোও না, পেটে ভাত থাকা ---এই মানুষ জন কেবল জীবনের আহ্নিক গতিতেই নিশ্চিন্ত বোধ করে!
    সায়েব সুবোরা এ মেলায় আসেনা। তেমন। তারা কলকাতা যায় দার্জিলিং যায়। আর কোথায় কোথায়? তাদের জীবনও গতিময়, উদ্ধত।তাদের অনেকের মোটর গাড়ি আছে।
     
    পুরোনো ঘিঞ্জি মধ্য শহর যেখানে চুপিসাড়ে পুকুর, ঢালু জমি আর ঝোপঝাপ এর পাশ দিয়ে গিয়ে মিশেছে জেলে দুলেদের মাটির উঠোনে, তারপর উঠোন পেরিয়ে খোলা মাঠ বেয়ে এসে পড়েছে একেবারে সোনালী বালির কপিশার বুকে ----ঠিক তার আগেই পড়ে এই পাড়াটি। এখানে অনেক পুরোনো ইঁট বের করা শরিকি বাড়ি, কিছু অতিরিক্ত কোঠাবাড়ি -যাদের এই সময় ধান ওঠে শহর থেকে একটু দূরের চাষ বাড়িতে। গরুর গাড়ি আসে সেই ধান বোঝাই করে। আর আছে ভাড়াটে বসানোর অতিরিক্ত আয়োজন ---যাতে নগদ টাকাও কিছু আসে।-চুনকাম করা দেওয়াল, আলকাতরা মারা লোহার শিকের জানালা আর কড়ি বরগা নিয়ে ---আসা যাওয়া ভাড়াটে আর মেস নিয়ে সেখানে কিছুটা মুখের বৈচিত্র। তাদের আসল বাড়ি হয়তো অন্য কোথাও অন্য কোনোখানে, অথবা এখানেই এখানেই ---তাদের জন্নত ---চাল কিনে খেতে হলেও! আর আছে গুটি কয় মাটির বাড়ি, একতলা দোতলা। লম্বা সাপের মত পিচের সরু রাস্তার পাশে পড়ে থাকা মাঠ গুলির তিন দিকে এই সব বাড়ি ঘর, গাছপালা ও কিছু। ছেলেরা মাঠে খেলে, টুর্নামেন্ট হয় এই শীতের সময়, মেয়েরা দুপুর রোদে পিঠ দিয়ে উলের প্যাটার্ন তোলে, রাস্তার কলে জল ধরে বেলা পড়লে।
     
    বড়দিন বা তার আগে পরে পাড়ার চড়ুইভাতিটি হয় রেল ব্রিজের নিচে।ভোর বেলা পাড়া ঝেটিয়ে হেঁটে হেঁটে যায় তারা কলবল করতে করতে বাচ্ছা কাচ্চা নিয়ে। ছেলেছোকরা রা একটা দল রাত থাকতেই উঠে চলে গেছে উনুন ধরানো আর জলখাবারের তোড়জোড় করতে। কুয়াশা রোদে মাখা সকাল শুরু হয় মুড়ি বেগুনী, বোঁদে দিয়ে হয়তো। লুচিও হয় রেস্তো থাকলে। শুকনো হাওয়া মেখে একদল উঁচু নীচু খোয়াই ধরে কুল পড়তে যায়, নদী নাইতে নামে। স্বচ্ছ জলের তলায় বালি দেখা যায়, মাছও, ধরা মুশকিল গামছা দিয়ে। দুপুরের ভোজ জমে ওঠে শুকনো শালপাতায় গরম ধোঁয়া ওঠা ভাত, বাঁধাকপি, মাংস, চাটনি তে, বেলা গড়ায়, কমলা রোদে আর আঁচ থাকেনা, এঁটো শালপাতা ঘিরে কাকেদের মারামারি দেখতে দেখতে হয়তো বা চোখের পাতা জড়িয়ে আসে কারো, কাউকে বা সবাই মিলে পেছনে লাগে, আসতে আসতে সব গুছিয়ে বাড়ির পথ ---রাস্তার হলুদ বাতিগুলি জ্বলে উঠতে থাকে। গত বছর যে ছিল সে হয়তো এবছর নেই, হয়তো বা নতুন কেউ যোগ দিল এবার, কিছু হাসাহাসি, কিছু কানাকানি, কিছু মন খারাপ, কিছু অন্য ব্যাথা হয়তোবা। তাও হৈচৈ করতে করতেই দলটা ফেরে চকচকে চোখ, ফাটা ঠোঁট আর গাল নিয়ে। সারাদিন নিস্তেজে রোদ পোয়ানো পাড়া আজ সন্ধ্যেতে সরগরম, খানিকটা সময়। কেউ হয়তো ঘরে গিয়ে বিছানা নেবে, কেউ বা নতুন উদ্যমে যাবে চার্চ এর মেলায়।
     
    মাঠের পাশের একটেরে একটি মাটির বাড়ি খড়ের চালা এ বছর যোগ দেয়না! কবে আবার দেবে কেউ বলতে পারেনা ---চুপ করে চেয়ে থাকে তারা ওদিকে। ওবাড়ির পাঁচ জন মানুষ হেমন্তের এক লালচে বিকেলে বিলাপ করছিলো একটি বছর আগে। সরকারি চাকুরে কর্তাটি আগাম কোনো সংকেত না দিয়েই নেই হয়ে গেলে। কালীপুজোর সময় প্রজেক্টর নিয়ে এসে নানান পুরোনো সিনেমা দেখাতো শান্ত কমকথার মানুষটি, সে বারও সবাই দেখেছিলো ---মৌচাক আর ঝিন্দের বন্দী । পদ্মফুলের মত স্নিগ্ধ শান্ত বৌ তাঁর, পুত্রটি দশম শ্রেণী, কন্যাটি নবম ---পাড়ার লোক বলতো শ্যামলা মনীষা কৈরালা! বাকি দুজন? রোগা সামনে ঝুঁকে পড়া একমাথা সাদা চুলে ডগদগে সিঁদুর পরা মা আর শক্ত পোক্ত মোটা সাদা গোঁফ বুড়ো বাবাটি! কেউ কাউকে বলছিলো :এই পঁয়তাল্লিশ থেকে পঞ্চাশ--- বয়সটাই মারাত্মক!
     
    ভালো লোকদের চেষ্টায় পদ্মবৌ স্বামীর চাকরিটি পায় তাঁর আপিসে খুব তাড়াতাড়িই। তবে কী কাজ সেখানে তাকে করতে হত তার সেই ক্ষেত্রের যোগ্যতার ভিত্তিতে, কতই বা মাইনে, তা কেউ আর আলোচনা করেনা। সাদা শাড়ির ঘোমটার খুঁট আর একটা লম্বাটে বিষন্ন কালো পার্স একসাথে বুকের কাছে চেপে ধরে তাকে হেঁটে হেঁটে যেতে দেখা যায় এখন আপিস পাড়ায় অনেকদূরে। সেই ব্যাগ থেকে কটা টাকা নিজের জন্য খরচা করতো ---সে খোঁজ নেবার মত কৌতূহল কারুর হত কিনা জানা যায়না। হলেও জিগ্যেস করার স্বীকৃত সামাজিক পথ ছিলোনা। কোনো টিফিন বা জলের ব্যাগ ---যা এখন কাজে বেরোনো সব মেয়েদের সাথেই ঝোলে সেসব কিছুও থাকতোনা। হয়তো পদ্ম বৌ জানতোইনা ওসব তার লাগে বা লাগাটা দরকারি। খিদে পেলে খাবার অধিকার আছে তাই বা কটা মেয়ে সাহসের সাথে মানতে আর পালতে পারে?
     
    তবে পদ্ম বৌদের মাটির দোতলা বাড়িখানি ভারি স্নেহের ওমে জড়ানো, বিশেষ করে ছোট ছেলে পুলেদের কাছে। মাঠের দিকে মুখ ফিরিয়ে তার একখানা দরজা ---যা দিয়ে ঢুকলেই তুমি পৌঁছে যাবে অন্দারের ঢাকা দাওয়ায়। সেখানে চাটাই পেতে দেবে ওরা তুমি ঢুকলেই। এক গাল হেসে টুকটুকে পান খাওয়া ঠোঁট নিয়ে ঠাকুমা ছোট্ট একটা চাঁচি পান যত্ন করে সেজে এগিয়ে দেবে তোমার দিকে, যেন তুমি একজন মস্ত বড় অতিথি! দাওয়ার লাগোয়া বড় সড় একটি শোবার ঘর আর পাশের কাঠের সিঁড়ি দিয়ে উঠে উপরে আরেকখানা। ব্যাস এদিকে ঝাড়া হাত পা!শোবার ঘরটি র বড়ো রাস্তা মুখো এক খানা দরজা, সেদিকেও বড়োসড় খড়ের চাল ঢাকা দাওয়া, কিন্তু সে দরজা বড়ো একটা খোলা হয়না, কেবল রাস্তার কল থেকে জল ধরার সময় ছাড়া। আব্রু থাকেনা নয়তো! ভিতরের সরু দাওয়াটি এল অক্ষরের মত ডান দিকে বেঁকে গেছে ---গেরাস্তালির কত জিনিস পরিপাটি করে গুছিয়ে রাখা থাকে সেখানে । ওদিকে শেষ প্রান্তে একটা ইটের খটখটে তকটকে ঘর ---একটাই মাত্র। তক্তপোষে পরিষ্কার চাদর বালিশ, বালিশের উপর ছোট্ট তোয়ালে, পাশে টর্চ। ওই ঘরের ও একটা বাইরের দরজা। বড়ো রাস্তা থেকে বাড়ির পাশ দিয়ে ঢুকে যাওয়া গলির ভিতর তার মুখ। গলি আর কতটুকু, গুটি দুতিন বাড়ির পরই তো আবার খোলা জায়গা, ভাঙাচোরা পরিত্যক্ত একটা বাড়ি ঘিরে। সেখানে পাড়ার ছেলেরা ব্যায়াম করে, লুকিয়ে বিড়ি ফোঁকে। মুরগি চুরি করে ফিষ্টি করে। সামনে একটা ঝোপঝাড় পানা ভরা পুকুর। এদিকের কোঠা ঘরটি তাই পুরুষের। দাওয়ার নিচে এদিকে ছোট্ট উঠোনে তুলসী মঞ্চ, একটি পাঁচিল ভর করা পেয়ারা গাছ, গন্ধরাজ একটি আর কিছু সন্ধ্যা মালতি নয়নতারা ইত্যাদি।শীতের মরশুমে গাঁদা কিছুবা।
    এ বাড়িতে পাঁচ ফোড়ন, আদা- মৌরি- হিং, ভাজা ধনে, দোক্তা আর পানের গন্ধর সাথে বুঝি জড়িয়ে থাকে কোনো পরম ভরসার অসাধারণ সাধারণের গন্ধ। ছোট্ট কপালে ঢেউ খেলানো চুল টেনে দুই বিনুনি কিশোরীর কানে সোনার মাকড়ি--- যার ছোট্ট ঝুমকোদুটি দুলে ওঠে হাসলে। কিশোরটি পেয়ারা পাড়ে ছোট্ট উঠোনের গাছটি থেকে, চুল ঝাড়তে ঝাড়তে তাদের মা জিগ্যেস করে এটা ওটা, বাবাটি আপিস যাওয়ার আগে পরে টুকটুক করে কাজ করে যায় , কাজ করে শক্ত পোক্ত বুড়া বাবাও ----এক পারিবারিক জীবন ---বয়ে চলেছে কবে কোন সুদূর অতীত থেকে ---সে ছবি কি আঁকা হয়েছিল মহেঞ্জোদড়ো কালে? হরাপ্পা বা ঢোলাবিরা --- নাকি নীল নদের ধারে? ভলগা কিংবা হোয়াঙ হো? টাইগ্রিস কিংবা দানিযুব এর ধারে ধারে? রাজাদের গল্পের ফাঁকে ফাঁকে সাধারণের ইতিবৃত্ত?
     
    এখন অবশ্য সে বাড়ির কালো দরজা বন্ধ।ঝুপসি কুয়াশায় মিশে নিজেকে যেন লুকিয়ে রাখতে চায় বিবর্ণ খড়ের চাল। তবে বুড়া বাবা মাঝে মাঝেই বেরিয়ে চলে আসে বাইরে, ঘোরাঘুরি করে এখন হারা উদ্দেশ এদিক সেদিক । আগের মত টুক টুক করে আর এটা সেটা করতে দেখা যায়না। অদ্ভুত ভাবে হাসে মাঝে মাঝে, ঠিক আগের মত নয় সে হাসি! লোকে অবাক হয়, চিন্তায় পড়ে।ছেলে মেয়ে দুটি চুপচাপ ইস্কুলে যায়। এদেরও দেশবাড়ি থেকে চাল আসেনা।
     
    বড়ো সুন্দর এ শহরে বড়দিনের সকাল। নীল আকাশ শিশির ভেজা সোনালী জরিদার। কথা বললে কেমন ধোঁয়া ধোঁয়া বেরোয়। শুকনো হাওয়ায় তরতাজা বুনো গন্ধ! বড়দিন আরেকটা বাড়ি ফেরার মরশুম। দেওয়ালির পর যারা কাজের জায়গায়, দূরের কলেজে চলে গিয়েছিল উৎসব সাঙ্গ করে, তারা ফিরে আসে চনমনে শীতে। বাড়ি বাড়ি আত্মীয় স্বজন আসে এ অঞ্চলের পশ্চিমা শীত উপভোগ করতে। মাসের শেষে পকেটে একটু টান থাকলেও বাজার সস্তা, মন ফুরফুরে, তাই গুষ্ঠী সুখের পথে তেমন বাধা পড়েনা, আর চাহিদাই বা কতটুকু? একটু কেক কেনা পাড়ার পাউরুটি বিস্কুটের দোকান থেকে, একটু হয়তো মেলায় যাওয়া, রাতে রাম পাখির সাথে হোটেলের আনানো রুমালি কি তন্দুরি ----তাতেই ---“ইয়ারী হ্যায় ইমান মেরা ইয়ার মেরি জিন্দেগী”!
     
    ভাড়া বাড়ির চাকুরে নির্মল পাত্র আজ ফুরফুরে মনে বাজারের ব্যাগ নিয়ে বেরিয়েছিল এমনই গুষ্টি সুখের রসদের সন্ধানে। সবজির থলি বোঝাই করে মাছের দিকে এগোতে একটা গোল কানে আসে, একটা ভীড় চেচামেচি, কাকে যেন ধরা হয়েছে! একটু এগিয়ে দেখতে পায় বুড়া বাবা দাঁড়িয়ে আছেন দুহাত ছড়িয়ে উপরে তোলা, আর মাছ ওয়ালা তাঁর ফাতুয়ার পকেট থেকে বার করে আনছে মাছের পেটি!, চারপকেটে চারটে। ফতুয়ার উপর কালো জীর্ণ কোটের মস্ত পকেট থেকে বেরোয় গুড়ি আলু গোটা চার পাঁচ, ভিতরের পকেট থেকে কাঁচা লঙ্কা, একটু আদা, দুটো টমেটো ।কেউ হাসছে কেউ রাগ করছে কেউ বা অবাক চোখে দেখছে। কেউ বা শুধুই চুপচাপ! বুড়ো কর্তার চোখ অস্বাভাবিক চকচকে, তিনি হাসছেন আর হাসছেন। কোনোমতে ঠেলে ঠুলে তাকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে সে। বাজাড়ুরাও ছেড়ে দেবার পক্ষে । দোকানিরা বলে--- এগুলি আর রাখবোনা আপনি নিয়েই যান আজ, তবে ফের যদি দেখি…!  জিনিস গুলি শালপাতা আর ঠোঙায় করে দিয়ে দেয় তারা। বিড় বিড় করে নিজেদের মধ্যে ----বচ্ছরকার দিন ! আর কি করা যাবে ! কী হয়ে গেল!
     
     নির্মল জিনিসগুলি হাতে করে ধরে আলগোছে নিজের সবজির থলিতেই রাখে। মাছ ও পরে এসে নাহয় নিয়ে যাবে। এখন বুড়া বাবাকে বাড়ি দিয়ে আসতে হবে। বুড়া বাবা মিটি মিটি হাসতেই থাকে--- কী মজার কান্ডই না ঘটছে তার চারপাশে! কিছুদূর এগিয়ে নির্মল আবার ফিরে আসে বুড়োকে নিয়েই। একটা দাম ধরে মিটিয়ে দিতে চায়। পসারীরা অবাক হয়ে বলে :আপনি দেবেন কেন বাবু? নির্মল জোর করে। তারা কমসম ই রাখে। বাড়ির পথে যেতে যেতেও বুড়া বাবা হাসতেই থাকে চতুর চতুর চোখ মুখ নিয়ে। কি আমোদটাই না হলো আজ! তিনি দিলেন সবাইকে আজ! নাতি নাতনির সান্তা ক্লজ হতে গিয়ে!
     
     এদিকে নির্মল মনে মনে একটা গপ্প ফাঁদতে থাকে ---পদ্ম বৌ এর হাতে ওগুলি তুলে দিতে গেলে যেমন গপ্প জুতসই হয় আরকি ! দিলদারের এই কুয়াশা মাখা রোদেলা বড়দিনে একসাথে অনেকের উপরেই হালকা মতো সান্তা ক্লসের ভর হয় ! কালী -শীতলার ভরের মত পাড়া জানিয়ে, ঢাক ঢোল পিটিয়ে নয়। সান্তা কবে আর সেভাবে এসেছে ! তাকে আসতে নেই ওভাবে।
     

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪ | ৩৪৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Kakali Bandyopadhyay | 223.223.***.*** | ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৯:০০540265
  • ঠিক ঠিক ....সান্তারা  আসে  চুপচাপ ...
    তারপর  টুসু  আসে পুরুষের  ছদ্মবেশে ...
    ঘুমভাঙ্গা  চোখে  গান  শুনি  " আশীব্বাদী  করতে  গেলে  সাইকেল  ঘড়ি  আগে  চায় / কলিযুগের  এই  তো  রীতি  ভাই / এই  তো  রীতি  ভাই / বাবুদের  মেয়ে  বিকা  বড়  দায় "...
    অন্তজ  যারা , বাবুদের  দুঃখ  তারাও  বোঝে ..
    এভাবেই  মিলেমিশে  থাকুক  দিলদারের  মানুষগুলো .
     
     
     
  • Aditi Dasgupta | ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪ ২১:১৬540270
  • @kakoli  মেয়েগুলির ঘর হোক 
  • সুপর্ণা চক্রবর্তী | 2409:40e0:7:2cac:8000::***:*** | ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৩:৪৮540335
  • লেখাটি ভারি চমৎকার! 
  • kk | 172.58.***.*** | ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪ ২২:১২540340
  • মন ভরানিয়া লেখা।
  • অমিতাভ চক্রবর্ত্তী | ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৩:০৬540345
  • অহরহ না হলেও হা হা করে হেসে ওঠা গল্প পড়া হয় মাঝে মাঝে। কিন্তু এই নিভে আসা বেলায় শব্দ করে কেঁদে ওঠা সামলাতে মুখে হাত চাপা দেওয়া, দুঃখে মোড়া সুখের গল্প আর জোটে কই! এই এল একটি। 

    আগের দিনের পর থেকে বাকি থাকা পর্বগুলি পড়ে নিলাম আজ। এই পর্বের পরে আর পড়বার সাধ্য এখন হত না।  
  • Aditi Dasgupta | ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪ ২২:১০540378
  • কি অদ্ভুত সুন্দর ভাবে আপনারা মতামত দিচ্ছেন নিজের নিজের ভাবনা ও ভঙ্গিতে! শুভেচ্ছা।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আদরবাসামূলক মতামত দিন