এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক

  • দিলদার নগর 

    Aditi Dasgupta লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | ২৩ মে ২০২৪ | ৫৭০ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • ২য় পর্ব

    কপিশা র কোল ঘেঁষে আমার মদিনা

    সে স্রোতস্বিনী কি আজকের? সেই কবে রঘুবংশ কাব্যে কালিদাস বলে গিয়েছেন তার কথা। পাহাড়ি নদীর মতিগতি বোঝা ভার! বালি পেরিয়ে কাঁচের মত তার জল, কখনো আকাশের নীল রঙ ধারণ করে সে বুঝি নীল যমুনা। জলের তলায় খেলা করে কত ছোট ছোট মাছ! হাঁটু জল পেরিয়ে ওপার থেকে লোক আসে এপারের বাজারে সবজি বেচতে, সওদা করতে। বর্ষায় সেই ভীরু বালিকাই হয়ে ওঠে পাগল পারা! ভব্বর মালভূমিয়া ঢাল পর্যন্ত উঠে এসে নৃত্য চলে তার। তার ডাকে সাড়া দিয়ে কর্কশ লাল মাটির বুকে বন্দি যে জল --- কুলকুল করে এগিয়ে যায় তারই দিকে। ছেলে পুলেকে সাইকেল, বাইকে চাপিয়ে লোকে জল দেখতে আসে। মেঘলা দিনে ছুটি ছুটি ভাব। ছিটে বেড়ার দু এক খানা চালায় চা, বিড়ি, সিগারেট। পাশে চপ মুড়ি। খাটনির কাজে কম্মে নদীধার আসা মানুষগুলি জল ঢেলে নেয় মুড়িতে, তাদের জন্য উঁচু কাঁসি। বাকিদের জন্য কাগজের ঠোঙা বা শালপাতার খালা। রেল ব্রিজের উপর দিয়ে ঝুঁক ঝুঁক করে ট্রেন ঢোকে, বেরোয়। শহরে ফিরে আসে কেউ, কেউ চলে যায়। রেলগাড়ী একটু দাঁড়ায় নদী হল্ট এ, মূল শহরে ঢোকার প্রস্তুতি, বা ছেড়ে যাওয়ার আগে একটু দেখে নেওয়া।

    পুব দিকের শেষ প্রান্তে বাস ব্রিজ এর নিচে সে নদী যেন গেরস্ত ঘরের মা, নিজেকে বিছিয়ে দিয়েছে সবুজ হলুদ আঁচলখানা পেতে। পশ্চিমের কুমারী রুক্ষতা সরিয়ে জমি এখানে সমতল। আজিব এই শহর ভাই! দুই দিকে দুই রূপ! পশ্চিম দিক থেকে পুব দিক ঢালু,এক পাড়া আরেক পাড়ার চেয়ে নিচুতে। পরিশ্রমের ওঠা নামায় রিকশওয়ালার ভাড়াও ঠিক হয় আপ ডাউন ধরে। ঢালু রাস্তা এখানে গড়ান, বড়সড় গর্ত গচকান। এখানে লোকে কথা বলে বাংলা, উৎকল, হিন্দি, সাঁওতালি, ফার্সি, আরবী হরেক ভাষার মিশেলে। ছুঁড়ে দেওয়া এখানে ফিকে দেওয়া, ধোপার বাড়ির সমান্তরাল চলে ওস্তাগর ।

    সড়ক ব্রিজের উপর দাঁড়ালে চোখ যায় অনেক দূর। সাহেবদের লাল ইটের পুরাতন ব্রিজের থামগুলি জেগে আছে, নতুন ব্রিজ ধরে রাস্তা এগিয়ে যায় সিধে চৌমোহনায়। এখানে বাঁ দিক থেকে মহা সড়ক চৌমাথা কেটে ডান দিকে চলে গেছে কত কত পাহাড় জঙ্গল দুপাশে নিয়ে, বুনো পাতার গন্ধ আর রোদ বৃষ্টি মেখে। আদিম কৌম সভ্যতার টোটেমগুলি ছুঁতে ছুঁতে সেই রাস্তা পৌঁছে দেয় পশ্চিম সাগর তীরের সেই জমকালো নগরে, যার ঢেউ অল্প বয়সীদের দেখায় চমৎকারের স্বপ্ন। সেখানে লোকে খুব রোদ চশমা পরে। বিশেষ করে কেউ মরে গেলে। রাতে অনেকে চোখ ঢাকে চাঁদ চশমায়।

    সোজা রাস্তাটা সিধে চৌমোহনা পেরিয়ে পীর লোহানীর পা ছুঁয়ে পৌঁছে দেয় নানা ভাষা নানা মত এর রেল শহরে। এ শহরের বোলবোলাও কিছু কম ছিলনা! খাঁটি সায়েব-মেম, ইঙ্গ ভারতীয়, দিশি সায়েবসুবো, মাদ্রাজি, গুজরাটি, পাঞ্জাবি, তেলেগু, নেপালী --- কত মানুষই না পেটের টানে এসে রয়ে গেছে হেথায়! রেলগাড়ী ঘিরে সে কি পেল্লাই কাজ কারবার! আর তাকে ঘিরে বাংলো, কোয়ার্টার, স্টেডিয়াম, ঝকঝকে ইস্কুল, পার্লার, হোটেল এর সম্ভার নিয়ে সে বিলাসিনী হাতছানি দেয় নদীর এপারের ছাপোষা জীবনকে।

    এই শহর ছুঁয়েই পথ চলে গেছে নীল মাধবের তীর্থে।

    এদিকে আবার একটা ঘরোয়া রাস্তা নদী পেরিয়েই আর কেতা দুরস্ত পথে চৌমোহনার দিকে এগোনোর সাহস করেনি, বরং, নদীকে ছাড়তে না পেরে বাঁ হাতে তাকে আঁকড়ে ধরেই চলতে শুরু করেছে। ডান দিকে তার ক্যানেল, ক্যানেলের ওপারে গাছে ঢাকা গ্রাম। এ রাস্তা মাটি, গোবর, ঘুটের গন্ধ নিয়ে অনেকদূর এগিয়ে দেয় শহরের মানুষকে পূব দিকে কল্লোলিনী তিলোত্তমা মহানগরীর পথে। তারপর আর এগোয় না। যেমনতেমন করে শাড়ী পরা ঘরোয়া মায়েরা আর বড়ো রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে পারেনা সন্তানকে, যদিও দুচোখ ভরে দেখতে থাকে যতদূর তাকে দেখা যায়!

    শহরের উত্তর গিয়ে মিশেছে প্রাচীন মালভূমির নীলজঙ্গলে ।

    উত্তরে আবাস গড়ে লড়ে কে দামিনী?
    মস্তকের মণি আহা, হেরে বিজয়িনী!
    পশ্চিমের গড় নিয়ে তর্ক বিস্তৃত -
    মৎসরাজ গোশালা না বৌদ্ধরাজ কৃত?
    পূর্বের ভূমি দেখো শস্য ক্ষেত্রে মেশে।
    দক্ষিণে কপিশা বহে তারে ভালবেসে।।
    যথা যাই হৃদ মাঝে তথা সে জাগরী।
    থেকে থেকে মন চলে মদিনা নগরী।।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ২৩ মে ২০২৪ | ৫৭০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • &/ | 151.14.***.*** | ২৩ মে ২০২৪ ২৩:৫১532255
  • খুব ভালো লাগল এই পর্বও। অনেক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।
  • Kakali Bandyopadhyay | 223.223.***.*** | ২৪ মে ২০২৪ ০৮:১৫532270
  • সেই ক্যানেল পারে আছে আমার দিলদার নগর। বাঁশের সাঁকোটা ভেঙ্গে ভেঙ্গে গেছে ।..এপার থেকে ওপারে যেতে পা ওঠেনা , কিন্তু মন ????
    তাকে আটকে রাখবো সাধ্য কি ? 
  • Suvasri Roy | ২৪ মে ২০২৪ ১১:৩১532283
  • অপূর্ব লেখা 
  • কাকলি মল্লিক | 2405:201:9006:b4:6511:33b5:7ca0:***:*** | ২৪ মে ২০২৪ ১৫:০০532290
  • আহা! বুকের ভেতর উথাল পাথাল হলো।ভারি মায়াময় এ লেখা। 
  • :|: | 174.25.***.*** | ২৫ মে ২০২৪ ১১:২৪532305
  • সুন্দর। 
    সামান্য দৃষ্টি-আকর্ষণ : পুব হলে হ্রস্ব উ; যথা, "পুব-হাওয়াতে দেয় দোলা" অথবা "পুব সাগরের পার হতে"। 
    আর পূর্ব হলে দীর্ঘ ঊ; যথা, "পূর্বগগনভাগে দীপ্ত হইল সুপ্রভাত"।
  • Aditi Dasgupta | ২৫ মে ২০২৪ ১৮:৪৯532314
  • অনেক ধন্যবাদ। বানান ধরিয়ে দেওয়ার জন্য ডবল।
  • | ১২ জুন ২০২৪ ২০:০৫533072
  • আরে এটা মিস করে গেছিলাম। 
    চমৎকার।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লাজুক না হয়ে মতামত দিন