রোদে মেলা সাবান কাচা কাপড় গুলি শুকিয়ে ওঠে, পাঁচিলের ছায়া লম্বা হয়, সর সর করে শুকনো পাতা উড়ে আসে। সেই কমলা রোদের দিকে তাকিয়ে ওরা মাদুর গুটয়। চুলে হাত খোঁপা করে। ওগুলোকে গরম জামা পরায় দুজন মিলে ধরে। বিমলা ওপরে যায়, রাতের রুটি করা আছে। তারপর একটু টেস্ট পেপার খুলে বসবে। কাকা,দাদা দোকান থেকে ফিরলে খেতে দেওয়া আছে, মায়ের পায়ে মালিশ আছে। বিমলার বাবাকে মনে পড়েনা। মোহও রান্নাঘরে ঢোকে। রাতের রান্নাটুকু স্টোভেই সারে। কেরোসিনের শিশিটা তাই একবার দেখে নেয়। রবিবার অবধি চলবেতো?
মোহর স্বামী ফেরেন। চুপচাপ প্রসন্ন মানুষটি, মোহর মামাদের সাথে আড্ডা তাঁর। মোহ হেসে হেসে চা দেয়। মোহ গল্প বলে সারাদিনের। গামছা জড়ানো মানুষের কথা তোলেনা। তিনি শোনেন মন দিয়ে, তারপর খবরের কাগজ হাতে নেন। রেডিও তে খবর পড়ে ভারী কোনো পুরুষ বা আত্মবিশ্বাসী মহিলা কণ্ঠ। কুয়ো পাড়ে বাল্ব জ্বলে। ছোট ছোট কাটা কাটা কথা বার্তা, মোহর হালকা হাসি ভেসে আসে। মোহর নিজের দুটি এখন রং পেন্সিল দিয়ে রং করে চলেছে সহজ পাঠের লাইনে আঁকা ছবি গুলি। পাগুলি লেপের ভিতর। পঙ্গপালের রং কী হবে ভেবে উঠতে পারছেনা!
বাকি শিশুগুলিকে বাড়িতে ফেরত দিয়ে এসেছে বিমলার ভাই শাম। ওরাও একসময় মোহর অমৃত সুধায় ভাগ বসিয়েছে। মোহ বলে আর হাসে, হামাগুড়ি দিয়ে তড়বড় করে এসে মোহর নিরীহ বড়োটাকে কেমন পা ধরে টেনে নামিয়ে মোহর কোলে উঠে বসতো। ওরা আগে পরে সব জন্মেছে যৌথ যাপনের কোলে। ওদের মায়েদের সাথে মোহর শাড়ির ভাগাভাগি, কার বাক্সে আর কত থাকত? আর তাতেই জমতো মজা, জমতো গল্প! সেই যে সেবার হোলির সময় ----মোহ সেজো মাইমা কে আচ্ছা করে রং মাখিয়ে পালিয়েছিল আর মাইমা রং নিয়ে লুকিয়ে ছিল মোহ স্নান করে এলেই আবার ভূত করে দেবে। এদিকে মোহ স্নান করে সেজর ই শখের গোলাপী ভয়েলের শাড়িটি পরে হাসি হাসি মুখে এসে উঠোনে দাঁড়ালো! হাতে রং নিয়ে সেজো গজ দাঁত বার করে হেসে ফেলে ‘মুখপুড়ি’ বলে গাল দিয়েছিলো! মোহ বিমলাকে, হেনাকে বলে এসব, ওরা খুব হাসে। ওরাও হোলি খেলতে চায় এমনই যাতে গল্প হয়ে যায়।
তবে হোলির আগে পরে কোনো এক সময়ে বিমলার বিয়ে হয়ে যায়, উচ্চ মাধ্যমিক না দিয়েই। ডাল বাট্টি খা ভে আকে হামারও গাঁভ ---বলে কেউ বুঝি নিয়ে যায় তাকে সেই যোধপুরের কাছাকাছি কোনো গাঁয়ে। হাফ বঙ্গালী বনে যাওয়া, ব্যবসায় পিছিয়ে পড়া, জৌলুস হীন বাড়ির মেয়ের বড়ো শহরের পাত্র আসেনা। খেতি বাড়ি,ছোট মোটো ব্যবসা নিয়ে মোটামুটি স্বচ্ছল পরিবার।পড়ে থাকে টেস্ট পেপার, আর খাতা গুলি। ছিপছিপে দেহাতি ছেলেটা কে তার পছন্দ হয়েছিল। যেতে যখন হবেই তখন পছন্দের লোকের অন্ন খাওয়াই ভালো। আচ্ছা বিমলা তো উল বুনে টাইপ শিখে টিউশনি করে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে বাড়ির অমত সত্ত্বেও, মানে গল্পে যা হয় আরকি, কোনো পছন্দের ছেলে বিয়ে করে দিলদারেই থাকতে পারতো? এমনটা হলেই তো ভালো হত! সেরকম কিছু আসলে ঘটেনি। কি হতে পারতো বা কি হলে ভালো হত বড্ড ভেসে থাকা ব্যাপার। ভাবনা গুলিতো আর বাজারে পাইকারি হারে বিক্কিরি হয়না,যার যেটা খুশী নিয়ে এসে জীবন চালাবে তাকে ভাঙিয়ে! ভাবনা আমাদের মধ্যেই শিকড় বাকড় ছড়িয়ে বড়ো হয় পরিবেশের প্রভাবে, বাস্তবের সাথে ঘাত প্রতিঘাতের রসায়নে। অন্য বিকল্প ঘটলে ঘটতেই পারতো,ঘটেনি,কারণ তা ঘটে ওঠেনি । এই তো যেমন মোহর খুব ইচ্ছে করতো স্ল্যাক্স আর ঢোলা কুর্তি পরে সাইকেল চালাবে। মাথায় চওড়া ব্যান্ড বাঁধবে, চিরুনির কোনা দিয়ে কাজল টানবে আর সাইকেল চালাতে চালাতে গান গাইবে-‘ম্যায় চলি ম্যায় চলি’! কি এমন অসম্ভব ইচ্ছে? কিন্তু সেটাও কি আর হয়ে উঠলো? মোহ কি সব কিছু পিছনে ফেলে ওই ইচ্ছেটার ফ্রেমে আটকে দিতে পারলো নিজেকে? নাকি দুজনের জীবন ই ষোলো আনা মাটি হয়ে গেল? বিমলা বিয়ের পরে এক বছর পরে আসতে পারলো, তারপর দুই, পাঁচ…। তার শরীর ভারী হলো, কথায় বাঙালি টানের চেয়ে শ্বশুরবাড়ির দেহাতি টান প্রকট হলো, দিলদারে এসে বন্ধুদের বাড়ি ছোটা শেষ হলে সে তার বর্তমান ঘরের গরু মহিষ খেতি সংসার নিয়ে চিন্তা করতে লাগলো, তারপর চোখে জল নিয়ে ফিরে গেল। সেখানে কেমন হোলি খেলা হয় সেই গল্প আর ততটা হয়ে ওঠেনি ।
বিমলা চলে যাওয়ার পর প্রথম প্রথম মোহর বড্ড ফাঁকা ফাঁকা লাগতো। রোদ এখন চড়া, দুপুরের খাওয়া ঘরের মধ্যেই পাখা চালিয়ে। খেয়ে দেয়ে একদিন দুপুরে ঘুমিয়েই পড়েছিল মোহ দেখলো একটা মোটর গাড়ি, তাতে কেউ একটা স্টিয়ারিং ধরে, অন্ধকার মুখের পাশটুকু শুধু চোখে পড়ছে। মোহ উঠে বসতে গেল পাশের সিটে, কিন্তু বিমলা এসে বসে গেলো সেখানে! মোহর মনটা খারাপ হয়ে গেল। ঘুম ভেঙে মোহ শুয়ে থাকলো চুপচাপ। তারপর উঠে জানলা দরজা খুললো ঘরের। রোদ নেমে গেছে। মোহ গা ধুয়ে ছেলেদের নিয়ে বেরোলো। এটা ওটা কিনলো। ছেলেদের গন্ধ রবার, মোম পেন্সিল, নিজের জন্য একটা মেরুন নেলপালিশ, ছোট ছোট নানান রঙের কুমকুমের শিশি বসানো গোল মতো ডাব্বা, উপরে স্বচ্চ প্লাস্টিকের ঢাকনা। কাঠি আইসক্রিম খেল তিনজন। এসে দেখে ছেলেদের বাবা চা নিয়ে বসে খবরের কাগজে। মোহর চা ঢাকা আছে সাদা কাপে। মোহ চা খেল। রাতের জন্য একটু পরোটা বানাল,আর কালো জিরে দিয়ে আলু চচ্চড়ি। সবাই খুব খুশী হলো। মোহর খুব ভালো লাগলো।
সেদিনও অনেক রাতে ল্যাম্প পোস্টের তলায় নাকি আবার সেই সাদা জামা গামছা ঢাকা মানুষ দেখা গেছিল। পরদিন স্নান সেরে করে ঠাকুর কে জল দিতে দিতে শুনেছিল দরজার ওপাশ থেকে রাস্তার ভেসে আসা কথায়। মোহর সেদিন খুব পান খেতে ইচ্ছে করেছিল। দেওয়ান দীঘি পেরিয়ে ল্যাম্প পোস্ট কে ছুঁয়ে বাঁ দিকে একটা ছোট মোটো দোকান আছে। ওই একটাই। বড়ো রাস্তায় না গিয়ে ওখান থেকেই পান আর ছেলেদের টিকটিকি লজেন্স নিয়ে ফিরে এসেছিলো। সন্ধ্যের মুখে একটা জাল দেওয়া পুলিশের গাড়িকে দু তিনবার যাওয়া আসা করতে দেখলো। কেউ কি কড়া নাড়লো? মোহনা… বলে ডাকলো কেউ ? বিমলাকে খুব দরকার ছিল সেদিন।
শামের বিয়েতে শেষ দেখা বিমলার সাথে। তারপর তো ওদের আরো ঘরের দরকার হলো। মোহ অন্য পাড়ায় উঠে গেল। এবাড়ি সে বাড়ি করে নিজেই দেড় খানা ঘর তুলতে পারলো শেষ পর্যন্ত। সে ঘরের সামনে এবড়ো খেবড়ো জমিতে কুল গাছ,লজ্জাবতী র ঝোপ। কোনের দিকে একটা কুঁয়ো অনেকটা খুঁড়েও জল পাওয়া গেলোনা, তেমনিই পড়ে রইলো। জমি জুড়ে মোহ গাঁদা, সন্ধ্যামনি, নয়নতারা লাগালো, লাউ মাচা, কুমড়ো মাচাও হলো। আর লাগালো মাধবী লতা।
ওরা এখন ইস্কুল কলেজের সীমানায়। মোহ একটু ভারী হয়েছে। জোর করে ওরা সকালে হাঁটতে। দু দিন যায়, তিন দিনের দিন রেস্ট নেয়। সিঁড়ির নীচে বসে ন্যাতা ন্যাতা শাড়ি পরে রান্না করে আর ওদের গল্প শোনায়। শশা কেটে রেখে কুমড়ি ভাজতে বসে। ওরা অপেক্ষা করে। মোহ একবার পুরী গিয়েছিলো। নীলাচল পৌঁছতে অনেক রাত করলো। ছেলে দুটি কুটি কুটি ঘুমে ন্যাতা। বাপ মাও ক্লান্তি তে খিদেতে অবসন্ন। হোটেলের নাম বলতে পারেনা মোহ , কিন্তু ম্যানেজার কে খুব মনে পড়ে। শিশু দুটি দেখে ভারী অপ্রস্তুত, ভারী ব্যাস্ত হয়ে উঠলেন! কিছুই যে নেই আর, ভাত আর ডাল ছাড়া! একটু অপেক্ষা করতে বলে চলে গেলেন হেঁসেলে, তাড়াতাড়ি আলুভাজা, ডিমভাজা ডাল গরম করে ভারী যত্নে সামনে দাঁড়িয়ে খাওয়ালেন। মোহর মতে মাছ তরকারি ফুরিয়ে ভালোই হয়েছিল! আলো আলো মুখে মোহ বলে: কেমন মজা! ডিম ভাজা! হাপুস হুপুস্! সমুদ্রের কথা বলতে ভুলে যায় সে , মন্দিরের কথাও। নাকি আরো বড়ো সমুদ্রের ছোঁয়া পেয়েই গিয়েছিলো দিলদার নগরের নাগরিক?
ওরা শসা আর কুমড়ির ভাগ নিয়ে খুনসুটি করে দেখে মোহ হাসে। কবে যেন সন্তানসম বোনটিকে শসা দিয়েছিলো পাতে, নিজের ছেলেটিকেকে না দিয়ে, সে ভারী গোল করেছিল এ নিয়ে, নিজের বোন বলে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তুলে! মোহ সেই গল্পও বার বার করে। কারুর একঘেয়ে লাগেনা। ওরা উদযাপন করে বার বার এই জড়ি মড়ি উষ্ণতার উৎসব, এই লীলা বয়ে নিয়ে যেতে চায় সারা জীবন। ওরা মোহর আঁচলে হাত মুছে ঘরে আড্ডা মারে।এক হাঁড়ি খিচুড়ি বসায় মোহ। এই বাদলা দিনে ওগুলো এটুলির মত সেটে থাকবে সারাদিন আজ। একটু আলুভাজা আর হাফ ওমলেট এই হয়ে যাবে। লম্বা করে চাদর পেতে দিতে হবে মেঝেতে।
মোহর কানে ভেসে আসে ওদের হাসি, কথা বার্তা। কোচিং এর সুজয় স্যার এর দিদি সুলেখা পিসির খিটখিটেমি আর ছুচিবাই নিয়ে! মোহর মনে পড়ে অফিস থেকে ফেরার পথে একদিন মোহর দিকে চেয়ে কেমন সুন্দর করে হেসেছিলো সুলেখা। সে অনেক দিন আগের কথা। একটা লোক সেদিন ওদিকের পিচ রাস্তা অবধি ছেড়ে দিয়ে গিয়েছিলো ওকে। সামনের কাঁকর রাস্তায় আর নামেনি। ওই একদিনই দেখেছিলো, আর দেখেনি।
আসলে বিকেলের দিকে ওদিকে দাঁড়ানো কম ও হতো। সেদিন পুচকা বৌ বায়না ধরেছিল নৃত্যনাট্য দেখতে যাবে--- চণ্ডালিকা। কোলকাতা থেকে নাকি দল এসেছে। স্বামীটির সময় হবেনা। ঈশ্বর মন্দির দিলদারের খুব পুরোনো রঙ্গমঞ্চ। ভিতপাথরে রবি ঠাকুরের ছোঁয়া। বাড়াবাড়িহীন তার ছিমছাম সাদা ইমারতটি দাঁড়িয়ে আছে অনেকটা নরম ঘাসজমি আর গাছপালা নিয়ে।এই হলটি ভারী ভালো লাগে মোহর। কেমন যেনো মাটির কাছাকাছি। রাঙা পথ চলে গেছে তার পানে ---উদাসী নির্জন কিছুটা। কলেজের বিস্তৃত মাঠ, আর বাঁদিকে ছমছম পুরোনো জেলখানা পেরোলেই লাল ধুলোর রাস্তা টা হটাৎ যেন কেমন একা হয়ে যায়!কেমন যেন চারপাশে সামনে পিছনে কেউ নেই আর! মন খারাপ করে, বিশেষ করে শেষ বিকেলে। আবার একটু এগিয়ে এলেই যখন সামনের আড়াআড়ি পিচ রাস্তার ওপারে রেড ক্রসের বাড়িটা চোখে পড়ে, লোক জন রিক্সা র প্যাঁ পো কানে আসে, মন ফেরে নিশ্চিন্তির প্রাত্যহিকে । ডানদিকে ততক্ষন শুরু হয়ে যায় ঈশ্বরের পাঁচিল। হলের ভিতর ঢুকে প্রথমেই নজরে পড়ে ঠিক ছাদের নিচে চারদিকের দেওয়াল জুড়ে হাতে আঁকা ছবির সারি। মানুষ--- মানুষ--- কাজে কম্মে, জল মাটি আকাশ ---আহা কি উজ্জ্বল সেই মৃত্তিকা গাছপালা ঘরবাড়ি –এবং মানুষ!এগুলোকে মুৱ্যাল বলে ---বলেছিলো অরুনাভ মামা –ছবি আঁকিয়ে। কে আঁকলে এসব? সে এক মস্ত শিল্পী, মাটির কাছে যার ঋণ ---নগেন রায়।
মনে পড়ে, রিক্সয় ক্যাচ কোচ করে অনেক দূরের সিদ্ধা কালী মন্দিরে পুজো দিতে যাওয়ার সময় রাস্তার দুপাশে অনেক অনেক গাছপালাওয়ালা পুরোনো পুরোনো সব বাড়িঘর পড়তো। ডান দিকে দুরে একটা পরীর শরীর দেখা যেত পাঁচিলের ওপাশ থেকে গাছপালা ছাপিয়ে । ও খালি বলতো ওই বাড়িটাতে ঢুকে একদিন পরীটা ভালো করে দেখবে।খুব ফিসফিস করে খুব ভক্তিতে মা বলতো, ওতো নগেন রায়ের বাড়ি! মোহ বুঝতোনা এতো গদগদ হবার কারণ কি। নগেন--- খগেন কারুর একটা বাড়িতো হবেই। আর্টিস্ট কথার মর্ম তখন কী বুঝতো কে জানে! পরে বুঝেছিলো নিয়ম ভেঙে মাটির ঋণ স্বীকার করে বিশ্ববিজয়ী এই দিলদারেরই সন্তান। শিল্পীকে সম্মান দিতে শিল্পী না হলেও চলে। একটি দরদী মন ই যথেষ্ট। আর সে শিল্পী যদি সাধারণের এলেবেলে জীবন, তার গল্পসল্পকেও অসামান্য আলো দিয়ে ফুটিয়ে তোলেন, যদি বিশ্বভরা প্রাণের মাঝে তার অবস্থানটি চিনিয়ে দেন তাকে? সবার প্রাণের মাঝে ঠাঁই হয়ে যায়নাকি তাঁর? ততদিনে ও পড়ে ফেলেছে বুড়ো আংলা, রাজকাহিনী। দেখে ফেলেছে ছবি লেখা অবন ঠাকুর আর তাঁর শিষ্যদের সহজিয়া দেশী ছবিগুলির অনেকগুলিই ।
অনেক বছর পরে কোনো এক কাজবাড়িতে আলাপ হলো শিল্পীর সঙ্গিনীর সাথে। তিনি তখন নেই। সত্যিই নেই কি? সুরমা রায় কেমন যেন আপন করে নিয়েছিলেন মাত্র আধ ঘন্টার মধ্যেই মোহকে। তিনিও শিল্পী। গল্প বলছিলেন শান্তিনিকেতনে কেমন চাঁদের আলোয় শালবনে হেঁটেছিলেন দুজনে। মোহকেই বুঝি এই গল্প করা যায় সেদিন। মোহদের দিলদারেতো কত শাল সেগুন। চাঁদের আলোয় কখনওতো তো হাঁটেনি, তাই মোহও তাঁর সাথে সেদিন হাঁটছিলো, চাঁদ দেখতে দেখতে সিঁড়ি দিয়ে খেতে উঠছিলো ছাদে। হটাৎই চাঁদে গ্রহণ লাগলো। ব্যস্ত সমস্ত এক মানুষ, কোমরে গামছা বাঁধা, তড়বড় করে উপর থেকে নেমে আসতে আসতে মুখোমুখি। সুরমার দিকে চকিতে তাকিয়ে বললেন আপনি নিচে যান। তর্জনী তুলে সিঁড়ির কোনার দিকটা দেখিয়ে বললেন :
ওখানেই বিধবাদের পাত পড়েছে।
ব্যাচ শেষ হওয়ার আগেই মোহ নিচে নেমে উঠোনে পাতা প্লাস্টিকের চেয়ারে বসেছিল, ওনার নেমে যাবার চাউনিখানি বুকে রেখে। ওখানেই টিউব ওয়েলটা। উনি এলেন মোহকে দেখে এগিয়ে এলেন। মোহ আর উনি সেদিন অনেকটা পথ হেঁটেছিলেন দিলদারের নির্জন রাস্তায়।
আরেকদিন মোহর খুব খুব ইচ্ছে হয়েছিল ওনার কাছে পালিয়ে যেতে। শান্ত মানুষটি এক ঘন্টার নোটিসে চুপচাপ তারা হয়ে গেলেন। পরবর্তী যা যা উনি মানতেন না তাই তাই হতে লাগলো। আতপচাল ঘি, তিল গামছা, কালো ইঞ্চি পাড় শাড়ী ---চক্ষু লজ্জার সাদার বদলে হালকা বেগুনি যদিও ---অনেক খুঁজে দুদিক রক্ষা করে কিনে আনা----মোহ রিক্সা নিয়ে শালবনে চলে যেতে চেয়েছিলো সুরমার হাত ধরে। পায়নি তাকে। তবে ওদের দল টা ঘিরে রেখেছিলো মোহ কে, মুরুব্বি দের বৃত্তের বাইরে থেকে। শাড়িটায় সবার অজান্তে কেউ নিপুন হাতের ব্লেড চালিয়ে দিয়েছিলো।
বেশ কিছুদিন পর বৃষ্টি নামলে ওরা মোহ কে নিয়ে বিরিয়ানি পার্টি করেছিল ফতে আলী চালিয়ে।একটু নেচেও নিয়েছিল।শান্ত মানুষ নিশ্চিন্তে হাসছিলেন ফটো থেকে।ব্রিটিশ ম্যাজিস্ট্রেট মারা, দ্বীপান্তরের সাজা ভোগা পরিবার তাঁর, বাবা বসেছেন রাজনারায়নের চেয়ারে! পুলিশের নির্মম অত্যাচারেও মুখ দিয়ে কথাটি বার হয়নি! যা বোঝেন যা করেন চুপচাপ ও একান্ত নিজের শর্তে , যেন এটাই হওয়ার। নিরীহ ঔদ্ধত্য নিজেকে সহজে বুঝতে দেয়না, তাকে অতিক্রম করাও আবার খুব কঠিন!যারা তার ছায়ায় থাকে তারাও শিখে যায় নিজেদের অজান্তেই। তারাও সেরকমই উদ্ধত হয়ে ওঠে আসতে আসতে, না হলে তো নরমটুকু রক্ষা করা যায়না!
ওদের দলটাকে মেজো মাইমা কিন্নর দল বলতো। সে দল এখন ছাড়া ছাড়া, বিয়ে থা চাকরি বাকরি ----শহর ছাড়তে হলো কয়েকটা কে।তবে একসাথে হওয়ার সুযোগ পেলেই আবার আগের সময়টাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালায় ওরা। মোহর প্রেসারের মাথা ঘোরা, ছেলে দুটি কাজে কম্মে বেরোয়, তাই সারাদিন সাথ দেয় হাসনু বানু । মিষ্টি মুখের রোগা মেয়েটা। ক্যালেন্ডারে পাহাড়ে অরণ্যে যেমন মুখের ছবি পাওয়া যায়। শান্ত মুখের চোখদুটি বুদ্ধি আর ছেলেমানুষি দুস্টুমি তে ভরা। তার মা জুবেদা হই চৈ করে আসে দমাদ্দম ঠিকে কাজ সেরে চলে যায়। ছোটোখাটো রোগ জ্বালার লতাপাতা মশলা শিকড় তার কাছে মজুদ। হাসনুবানু তার কপালে এসে পড়া কোকড়া চুল ক্লিপ দিয়ে আটকে দুই বিনুনি দুলিয়ে চৌকো পরোটা বেলতে পারে । দুপুরবেলা মোহর পাশে দুয়ারে বসে খাতা পেন্সিল নিয়ে অংক কষে, ইংরেজি পড়ে, বাংলা পড়ে। যেটুকু ইস্কুলে পড়েছিল হাতড়ে হাতড়ে বের করে আনার চেষ্টা চালায় মোহ। আর মোহ পড়ে মৈত্রেয় জাতক। চোখে এখন তার খয়েরি ফ্রেমের চশমা, চশমা খুলে বাইরে তাকিয়ে সেও প্রশ্ন করে :কী চান দেবতারা? দুপুরের হাওয়ায় ওবাড়ির আকাশমণি গাছের পাতা ঝর ঝর শব্দ তোলে। মোহর মাধবী লতা উত্তর দেয় লালসাদা ফুলের ঝুঁটি দুলিয়ে।একটা গিরগিটি শুকনো পাতার উপর দিয়ে চলে যায় সরসর করে। হাসনুবানু একবার উঠে গিয়ে দেখে টাইম কলে জল এলো কিনা, বালতি বসিয়ে দিয়ে আসে। গড়ানো বিকেলে টুং টুং ঘন্টা বাজিয়ে ঝুরো শোনপাপড়ি র বাক্স নিয়ে যায় বছর তেরো চোদ্দো র এক ছেলে। মোহ ডাকে তাকে, শুকনো শালপাতা মোড়া শোনপাপড়ি দেয় হাসনুর হাতে। ছোটবেলায় মায়ের চুলের কাঁটা দিয়ে কেমন করে ভাঁড় থেকে পয়সা বের করে এগুলি কিনতে ছুটতো তার গল্প বলে হাসনু কে। তখন ও এমনই একটা ছেলে আসতো। তবে সেই শোনপাপড়ির স্বাদ বুঝি অনেক বেশী ভালো ছিল।
রোদের রং সোনালী থেকে কমলা হয়, আসতে আসতে মিলাতে থাক, আর নীল রং গড়িয়ে আসে। একটা দুটো তারা সেই নীলের গায়ে ফুটে উঠতে থাকে। রাস্তা দিয়ে সারাদিনের কাজ শেষে পরিশ্রম করা মানুষরা গল্প করতে করতে, হাঁটতে হাঁটতে বা সাইকেলে বাড়ি যায় ---নদীর কাছাকাছি বা ওপারে মাটি মাটি গন্ধ ওয়ালা ঘরগুলিতে। দূরে কোর্টের কোয়ার্টার গুলিতে আলো জ্বলতে থাকে একেক করে। বাসের হর্ন ভেসে আসে দূর থেকে। শহরে যারা এসেছিলো কেউ ফিরে যাচ্ছে, কেউবা ছেড়ে যাচ্ছে এ শহরের গৃহকোন। মোহ নিশ্চিন্তে তার ঘরখানিতে আলো জ্বালে , ঠাকুরের সামনে ধূপ দেয়। টিভি র সামনে চিত্রহার দেখতে বসা হাসনুকে বলে, কাঁচের চুড়ি যদি ভালো কিনতেই হয় তবে যেতে হবে মির্জা বাজারে। দুজনে রিক্সা চড়ে যাবে পরের দিন বেলাবেলি।ওখানে যাওয়াই ভালো। চুলের ক্লিপ হেয়ার ব্যান্ড, গয়না ---সব গাদা গাদা।
পরদিন দুপুর দুপুর ই দুজনে বেরিয়ে পড়ে, চেপে বসে গগন রিক্সাওয়ালার রিক্সতে। গগনের রিক্সটি বেশ বাহারি। মস্ত বড় ডিমের মত স্টিলের আলো লাগানো সামনে,দুই হ্যান্ডেলের কভারে জিলিমিলি ঝোলে, উঠবার পাদানি, ঝকঝকে রেকসিনে মোড়া সিট আর সিটের পেছনে পিঠের কাছে চিত্র তারকাদের ছবি ---সকলেরই ঠোঁট গাঢ় লাল। রিক্সা র হুডটিতেও বেশ ফুল লতাপাতা লাগানো। গগনের কোঁকড়ানো একটু কটা চুল পিছনে উল্টে আঁচড়ানো, রংটি তার তামা পোড়া, মুখে খুশবুদার জর্দা পান। গুন গুন করে গান গায় আর প্যাডেলে চাপ দেয়। হাওয়া কেটে ছোটে গগনের রিক্সা ---এক আজনবী হাসিনা সে ---
ইঁউ মুলাকাত ---
হো গেয়ি…!
হাসনুর কচিকলাপাতা ফ্রকের বুকের কাছে সাদা ঝালর থির থির করে কাঁপে, মোহর নীল হলুদ ছাপা শাড়িটির আঁচল ওড়ে পত পত করে। মেঘ আর রোদের খেলায় ইতি উতি ছড়ানো শাল গাছের ফুলগুলি আকাশ ছুঁয়ে ইস্পাতের মত ঝক ঝক করে।
মাঠ ছাড়িয়ে ঘাট ছাড়িয়ে ---
দেওয়ান মাজার
পাটনা বাজার
বাবলু মোটরস্
প্রিয়াঙ্কা স্টোর্স
ফকির কুঁয়া
আঁচের ধোঁয়া
মঞ্জু নিলয়
বাসনালয় ---
পেরোতে পেরোতে তো গিয়ে পৌঁছয় মির্জাবাজারে।
সে এক হরেক কিসিমের মেলা। শাড়ী জামাকাপড়, খেলনা পুতুল, মনোহারী গোলদারি ---সব নিয়ে প্রতিদিনের উৎসব যেন!গ্রামের লোক সকাল সকাল আসে সারাদিন বাজার করে আবার শেষ বিকেলে বাস ধরে ফিরে যায়।
ওরা পৌঁছয় বেলোয়ারীর পসরার রাস্তায়।হাসনু আলো আলো মুখে নানা রঙের চুড়িগুলি খালি দেখতেই থাকে। চুড়ি দোকানের পাশে ছোট্ট চায়ের দোকান। তার বাইরে টুলে বসে এক বুড়ো মতো রোগা মানুষ মাটির ভাঁড়ে চা খাচ্ছিলো। একটু ঝুঁকে গেছে যেন সামনে, দুহাতের ডানা দুটি জামার দুপাশে বাদুড়ের ডানার মতো উঁচু হয়ে আছে, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। চোখদুটি ভারি উজল আর হাসি হাসি, চোখের কোনেও হাসির দাগ। হাসনুর রোগা রোগা আঙ্গুল গুলির প্রতিটি রঙের উপর ঘোরাফেরা দেখতে দেখতে সে মিটি মিটি হাসতে থাকে। তারপর বলে ওঠে হটাৎ:
"রঙের মেলায় যখন এসেই পড়েছো, সব রং থেকেই দুটি দুটি নিয়ে নাও রে মা। কোনো রংই তো ফেলনা নয় গো জীবনে!"
এই বলে সাদা জামার পকেটে হাত গলিয়ে একটা জরাজীর্ণ পঞ্চাশ টাকার নোট বার করে এগিয়ে দেয় চুড়িওয়ালাকে।
এভাবেই চলতে থাকে দিলদারি কথা। গল্পের থেকে গল্পে, পথ থেকে পথে, সকাল থেকে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে বিকেল---- সন্ধ্যা আসবে---- রাত নামবে---- মোহর গল্পজাল কি ফুরোয় কখনো? মোহ কি আর একটা মাত্রাতেই বাঁধা?
দিলদারে আবার আলাদা করে কে মুক্তি চায়?