একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাকবাহিনী ও তার সহযোগী রাজাকারদের হাতে অগণিত মানুষ নিহত হন। এঁদের বলিদানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এসেছে।
এই সত্য ভুলিয়ে দেওয়ার লোকের অভাব নেই। দীর্ঘদিন ধরেই তারা সক্রিয়, এখন আরো বেশী। নির্লজ্জের মতো তারা বলে, আটাত্তর বছরে কিছুই ঘটেনি! এদের চেনা একান্ত প্রয়োজন।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে কিছু সংক্ষিপ্ত আলোচনা।
এই ইতিহাস আমরা যেন ভুলে না যাই!
--------------------------------------------------------------------
নাম ছবি দাস, জন্ম ১৯৫৪ সালে ঝালকাঠির কীর্তিপাশা ইউনিয়নের স্থান সিঙ্ঘপুর গ্রামে। ১৯৭১ সালে পাকবাহিনী যখন ঝালকাঠি আক্রমণ করে তখন ছবি স্বামীপুত্র কন্যা নিয়ে এই গ্রামে পালিয়ে আসেন। দেখতে পান গ্রামে অসংখ্য মানুষ আশ্রয় নিয়েছে।
এর তিনদিন পরে পাকবাহিনী ও রাজাকার বাহিনী এই গ্রামে গানবোটে করে আসে। তারা গুলি করতে করতে গ্রামে ঢোকে। সবাই আগান বাগানে পালিয়ে গেল। ছবি বিশ্বাস গোয়াল ঘরে লুকিয়ে রইলেন। পাকবাহিনী তাকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এলো। রাজাকাররা জিজ্ঞেস করল, "তোর কী জাত?"
আগেই কপালে সিন্দুর দেওয়া বন্ধ করেছিল হিন্দু মহিলারা। হাতের শাঁখা খুলে ফেলেছিল। ছবি বিশ্বাস তাদেরকে উত্তর দিল, জাত খ্রিস্টান।
তারা তার হাতের সোনার বালা কেড়ে নিল। তারপর তার দূর সম্পর্কের দেবেন মামাকে বাগান থেকে ধরে আনল।
ছবি দাস লিখেছেন, "বড় একখান উঠানের পাশে নারকেল গাছের সাথে দাড় করাইয়া আমার চোখের সামনে গুলি করল তারে। একটা কপালে আর একটা বুকে।
একখান চিৎকার দিয়া চিৎ হইয়া পড়ল মামা।
আউশ ধানখেতে অনেক পুরুষ মানুষ পলাইয়া ছিল। ধানখেত বেড় দিয়া ধইরা ফেলাইল কতজনরে। গোয়ালের পাশ দিয়া যখন তাগো নিয়া যায়, দেহি তার মধ্যি আমার বড় ননদের দেওর বিমল। বিমল আমারে দেখতি পাইয়া কাইন্দা ফেলাইল। কইল, বৌদি মায়েরে আমার কথা কয়েন।
সেইদিন মোট তেরো জনকে এইখান থেকে ধইরা গরু যেমন ধাওয়াইয়া নিয়া যায়, সেই রকম পাল ধইরা লইয়া গেল নদীকূলে। সেখানে গুলি কইরা মারা হইলো।
খানিক দূরে যাইয়া দেহি তরু দত্তর ছেলে গোপাল বছর ষোলো বয়স হইবে, মনে হয় দৌড়াইয়া সরছিল, পিছন থেইক্যা তারে গুলি করছে। পেটের পাশে গুলি লাগছে, নাড়িভুড়ি বাইরাইয়া পড়ছে। ছেলেটা তহনও মরে নাই। 'একটু জল একটু জল' বইলা দাপাদাপি করছে।"
ছবি বিশ্বাসের আত্মীয় ছায়ার সতের-আঠারো বছরের ভাইকে গুলি করে মারা হয়েছে। ছায়া নদীকুলে গিয়ে দেখেন, একটা ট্যাকের পাশে হাত বান্ধা একটার পর একটা মানুষ পড়ে আছে। তখন তারা আর মানুষ নয়, লাশ। এদের মধ্যে তিনজনকে চিনলেন ছায়া। তার স্বামী, ভাশুর আর প্রতিবেশীর ছেলে বিজয়।
এই সময় নদী দিয়ে একজন মুসলমান চাষী নৌকা করে আউশ ধান কেটে বাড়ি ফিরছিল। ইশারা করে ডাকল ছায়া। নৌকা ভিড়ল তীরে। ছায়া তার পায়ে পড়ে কইল, "তুমি আমার বাপ। আমারে তুমি ছাড়া সাহায্য করার কেউ নাই।"
গ্রামের উদার সরল চাষি, তার নৌকার সব ধান নামিয়ে দিল নদীর চরে। তারপর ধানকাটার কাস্তে দিয়া সব মৃতদেহগুলোর হাতের বাঁধন কেটে দিল। দুইজনে মিলে তিনখানা লাশ টেনে তুলল নৌকায়। আর লাশগুলো পড়ে রইল নদীর ধারে...অন্ধকারে...
----------------------------------------
বইয়ের নাম : ভাগফল ৭১, মেয়েদের কথা।
সংকলন ও সম্পাদনা : ঝর্ণা বসু
-----------------------------------------
আমার নানা ফজরের নামাজ পড়ে ক্ষেতে পাট কোপাতে গেলেন। তখন ১১টার মতো বাজে। তারপরে পাকিস্তানিরা রাস্তা দিয়ে যাবার সময়ে তাকে দেখে তার কাছে গেল। তাকে জিজ্ঞাসা করলো, তুমি হিন্দু না মুসলমান।
তখন তিনি বললেন, আমি মুসলিম। তিনি চার কালেমা পড়ে তাদেরকে শোনালেন। তখনও তারা বিশ্বাস করলো না। তাকে উলঙ্গ হতে বললো।
তিনি বললেন, আমি উলঙ্গ হতে পারবো না।
তখন তাকে গুলি করলো। তিনি পাট ক্ষেতে মারা গেলেন।
সেখানে একটা গরু ছিলো, সেটাকেও গুলি করলো।
------------------------------------------------------------------------
মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী-ভাষ্য-
বর্ণনাকারী
রিজিয়া বেগম
গ্রাম : বাদলা, পোস্ট : দেহেরগাতি।
উপজেলা : বাবুগঞ্জ। জেলা : বরিশাল।