

খ্রিস্টপূর্ব ৪৯০ আর ৪৮০-৪৭৯ নাগাদ দুটি পারসিক যুদ্ধের সময় থেকে এথেন্সের প্রসিদ্ধির শুরু। এর আগে যুগপুরুষ তৈরি হত আয়োনিয়া আর ম্যাগনা গ্রিসিয়া (দক্ষিণ ইতালি ও সিসিলির গ্রিক নগরীগুলি)-তে। ম্যারাথনে (৪৯০ খ্রি.পূ.) পারস্যরাজ দারিয়ুসের বিরুদ্ধে এথেন্সের জয় আর তার সন্তান ও উত্তরাধিকারী ক্সেরক্সিজ় (Xerxes)-এর বিরুদ্ধে, এথেন্সের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ গ্রিক নৌবাহিনীর জয় – এ দুইটি এথেন্সের মর্যাদা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। এশিয়া মাইনরের দ্বীপগুলির ও কিছু অংশে মূল ভূখণ্ডের আয়োনীয় জনতা পারস্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল, আর—গ্রিসের মূল ভূখণ্ড থেকে পারসিকরা বিতাড়িত হওয়ার ফলে—তাদের মুক্তিযুদ্ধে এথেন্সের প্রভাব ছিল। স্পার্টানরা নিজেদের এলাকা ছাড়া আর কিছু নিয়ে তেমন মাথা ঘামাতো না, তাই এই সংঘর্ষে অংশগ্রহণ করেনি। পারস্যের বিরুদ্ধে তৈরি জোটে এথেন্স প্রধান অংশীদার হয়ে ওঠে [১] । এই জোটের সংবিধান অনুসারে, যেকোনো মিত্র রাজ্য – এক নির্দিষ্ট সংখ্যক জাহাজ দিতে বা তার দাম ধরে দিতে বাধ্য ছিল। অধিকাংশই দ্বিতীয় বিকল্পটি বেছে নিতো, ফলে বাকি জোটসঙ্গীদের ওপর এথেন্স নৌ-আধিপত্য তৈরি করে আর ধীরে ধীরে জোটটিকে এথেনীয় সাম্রাজ্যে পরিণত করে। এথেন্স ক্রমশঃ বিত্তশালী হয়ে ওঠে, আর পেরেক্লিসের (Pericles) নেতৃত্বে আরও সমৃদ্ধি লাভ করে। ৪৩০ খ্রি.পূর্বে তাঁর পতনের আগে অবধি পেরেক্লিস প্রায় তিরিশ বছর জনতার স্বাধীন পছন্দে শাসন করেছিলেন[২] ।
এথেন্সের ইতিহাসে পেরিক্লিসের সময়কাল সুখ, শান্তি আর গৌরবের সেরা উদাহরণ। এস্কিলস (Aeschylus)—যিনি পারসিক যুদ্ধে লড়াইও করেছিলেন—গ্রিক নাটকে ট্র্যাজেডির সূত্রপাত করেন; ‘পারসিকরা’ (Πέρσαι; Persai, রাসেলের বানান: ল্যাটিনীত Persae) [৩] নামের তাঁর একটি ট্র্যাজেডিতে তিনি—হোমারের চরিত্রদের ব্যবহার করার চলতি নিয়ম থেকে সরে—ক্সেরক্সিজ়-এর পরাজয়কে বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। তাঁকে শীঘ্রই অনুসরণ করেন সোফোক্লিস, যাঁর আবার অনুসারী ছিলেন ইউরিপিদিস। পেরিক্লিসের মৃত্যুর পরে শুরু হওয়া পেলোপোনেশীয় যুদ্ধের অন্ধকার সময় অবধি এই দুজনেই বেঁচে ছিলেন, আর ইউরিপিদিসের লেখা নাটকে এই পরবর্তী সময়ের সংশয়বাদের ছবি ফুটে ওঠে। তাঁর সমসাময়িক রসিক কবি আরিস্তোফ়ানিস, জোরালো, কিন্তু সীমিত বাস্তববুদ্ধি কাজে লাগিয়ে সব মত‘বাদ’ (ism)-কেই উপহাস করেছেন; বিশেষ করে সোক্রাতেসকে তিনি এমন একজন ব্যক্তি সাজিয়ে নিন্দে করেছেন, যিনি জ়িউসে বিশ্বাস রাখেন না আর অপবিত্র অপবিজ্ঞানের রহস্য নিয়ে মেতে থাকেন।
ক্সেরক্সিজ় এথেন্স দখল করেছিলেন আর সেই সময় অ্যাক্রোপোলিসের ওপরের মন্দিরগুলি আগুনে পুড়ে ধ্বংস হয়। পেরিক্লিস সেগুলির পুনর্নির্মাণে নিজেকে সমর্পণ করেছিলেন। পার্থেনন ও অন্যান্য যে মন্দিরগুলির ধ্বংসাবশেষ আমাদের সময়কেও প্রভাবিত করে, তা তাঁরই বানানো। রাষ্ট্র, ভাস্কর ফিদিয়াস-কে দেবদেবীদের মহাকায় সব মূর্তি বানানোর বরাত দেয়। এই পর্বের শেষে এথেন্স, হেলেনীয় জগতের সবচেয়ে সুন্দর আর চোখধাঁধানো নগরীতে পরিণত হয়েছিল।
ইতিহাসের জনক ইরোদোতোস (Herodotus) ছিলেন এশিয়া মাইনরের হেলিকার্নাসোস শহরের আদি বাসিন্দা, কিন্তু থাকতেন এথেন্সে, আর পারসিক যুদ্ধের খতিয়ানও লিখেছিলেন এথেনীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই।
পেরিক্লিসের সময়কালে এথেন্সের কৃতিত্ব ও উন্নতি বোধহয় ইতিহাসের সবচেয়ে বিস্ময়কর অধ্যায়। এর আগে পর্যন্ত এথেন্স অন্য অনেক গ্রিক নগরীর থেকেই পিছিয়ে ছিল; শিল্পে বা সাহিত্যে কোনো কৃতী ব্যক্তিত্ব প্রসবও করতে পারেনি (একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন সোলোন, মূলত একজন আইনপ্রণেতা)। হঠাৎই, ভাস্কর, স্থপতি এবং নাট্যকারেরা—আজও আমরা যাঁদের অতিক্রম করতে পারিনি—একাধারে বিজয়, বিত্ত আর পুনর্নির্মাণের প্রয়োজনে এমন সব সৃষ্টি করতে শুরু করেন, যা আধুনিক যুগ পর্যন্ত পরবর্তী সব সময়কালেই অপ্রতিরোধ্য ছিল। যখন ভেবে দেখি, এই কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত জনসংখ্যা ঠিক কতটা নগণ্য, এই কৃতিত্বের মাহাত্ম্য আরও আশ্চর্যজনক ঠেকে। ৪৩০ খ্রি.পূ. নাগাদ—এথেন্স যখন তার আয়তনের সর্বোচ্চ সীমায়—ক্রীতদাসদের ধরে তার মোট জনসংখ্যা ছিল ২ লক্ষ ৩০ হাজারের আশেপাশে, আর তাকে ঘিরে থাকা আটিকা-র গ্রামাঞ্চলে সম্ভবত আরও ক্ষুদ্রাকৃতি জনপদ ছিল। এর আগে বা পরে, কখনোই কোনো জনগোষ্ঠী এই অনুপাতে সর্বোচ্চ স্তরের কাজ করার ক্ষমতা প্রদর্শন করেনি।

দর্শনে এথেন্সের অবদান মাত্র দুটি নাম – সোক্রাতেস ও প্লেটো। প্লেটো অনেক পরবর্তী সময়ের মানুষ হলেও, সোক্রাতেস তাঁর যৌবন আর সাবালক জীবনের প্রথমদিকটি পেরিক্লিসের শাসনকালেই কাটিয়েছেন। দর্শনের প্রতি এথেনীয়দের উৎসাহ এতটাই ছিল, যে তাঁরা অন্য শহরের শিক্ষকদের কথাও সোৎসাহে শুনতেন। যে সব তরুণ বিতর্কের শিল্প শিখতে চাইতেন, তাঁদের কাছে সফিস্টদের বেশ কদর ছিল; প্রখ্যাত কোনো এক অতিথির কথা আকুল শিষ্যরা কেমন হাঁ করে শুনতেন – প্রোটাগোরাস বইয়ে প্লেটোর কল্পিত সোক্রাতেসের মুখে তার মজাদার বর্ণনা আছে। আমরা পরে দেখবো – পেরিক্লিস আমন্ত্রণ করে এনেছিলেন দার্শনিক আনাক্সাগোরাসকে, আর সোক্রাতেসের মতে, সৃষ্টির ক্ষেত্রে মনের প্রধান ভূমিকার কথা আনাক্সাগোরাসের থেকেই তিনি শিখেছিলেন।
প্লেটোর বক্তব্য অনুযায়ী তাঁর কথোপকথনের অধিকাংশই পেরিক্লিসের সমসাময়িক, আর তাতে ধনীদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে বেশ ভালো এক ছবি ফুটে ওঠে। প্লেটো এক বনেদি এথেনীয় পরিবারের সন্তান, আর সেই সময়ের ঐতিহ্যবাহী, যখন যুদ্ধ আর গণতন্ত্র এসে উচ্চশ্রেণীর সম্পত্তি ও নিরাপত্তা নষ্ট করেনি। তাঁর রচনার তরুণদের কাজ করে খেতে হয় না, তারা তাদের অবসরের অধিকাংশ কাটায় বিজ্ঞান, দর্শন ও গণিতের চর্চায়, হোমার তাদের কণ্ঠস্থ এবং পেশাদার আবৃত্তিকারদের কলার তারা পরিশীলিত সমালোচক। কিছুদিন আগেই অবরোহী যুক্তির শিল্পটি আবিষ্কৃত হয়েছে, আর তাই জ্ঞানের গোটা ক্ষেত্র জুড়েই, ঠিক-ভুল – দু-ধরনেরই নতুন তত্ত্ব আবিষ্কারের উত্তেজনা তুঙ্গে। এ যুগে একাধারে ধীমান ও সুখী হওয়া—বিশেষ করে বুদ্ধির ব্যবহার করে খুশি থাকা—যেভাবে সম্ভব হয়েছিল, খুব কম সময়েই তেমনটা সম্ভব হয়েছে।
তবে, ক্ষমতার যে ভারসাম্য এই স্বর্ণযুগ প্রসব করেছিল, তা মোটেই স্থিতিশীল ছিল না। ঘরে-বাইরে তার বিপদ ছিল – ঘরের বিপদ ছিল গণতন্ত্র, আর বাইরের – স্পার্টা। পেরিক্লিসের পরে ঠিক কী হয়েছিল বুঝতে হলে আমাদের সংক্ষেপে একবার অ্যাটিকা-র আগের ইতিহাসটা খেয়াল করতে হবে।
ইতিহাসের সূচনালগ্নে অ্যাটিকা ছিল এক স্বয়ংসম্পূর্ণ ছোট্ট কৃষিপ্রধান অঞ্চল; তার রাজধানী এথেন্স আকারে বড় না হলেও, দক্ষ কারিগর ও অস্ত্রবিশারদদের আস্তানা ছিল। এঁরা নিজেদের উৎপাদিত সামগ্রী বিদেশে রপ্তানি করার স্বপ্ন দেখতেন। ক্রমে দেখা গেল, শস্য উৎপাদনের বদলে আমদানি করলে—মূলত কৃষ্ণসাগর-এর উপকূল থেকে আমদানি করলে—আর আঙুর ও অলিভ চাষ করলে, লাভ বেশি। এই ধরনের কৃষিকাজে শস্য চাষ করার তুলনায় বেশি মূলধন প্রয়োজন হত, আর তাই কৃষকরা ঋণগ্রস্ত হতে শুরু করলেন। অন্যান্য গ্রিক রাষ্ট্রের মতো অ্যাটিকাতেও হোমারের সময়ে রাজতন্ত্র ছিল, তবে রাজা ক্রমে রাজনৈতিক ক্ষমতাহীন এক ধর্মীয় আধিকারিকে পরিণত হন। ক্ষমতা যায় অভিজাতবর্গের হাতে, যারা একইসঙ্গে গ্রামের চাষী ও শহুরে কারিগরদের শোষণ করতে শুরু করে। গণতন্ত্রের পক্ষ নিয়ে আপোস প্রথম করেন সোলন—খ্রি.পূ. ষষ্ঠ শতকের শুরুতে—যাঁর অধিকাংশ কাজই পরবর্তী পিসিস্ত্রাতোস ও তার উত্তরাধিকারীদের স্বৈরতন্ত্রের সময়কালেও টিকে ছিল। এর পরে, স্বৈরতন্ত্রের বিকল্প হিসেবে অভিজাতরা নিজেদের গণতন্ত্রের দিকে চালনা করেন। পেরিক্লিসের পতনকাল অবধি গণতান্ত্রিক প্রকরণগুলি আসলে অভিজাতদের হাতেই ক্ষমতা তুলে দিত—যেমন দিত ঊনবিংশ শতকের ইংল্যান্ডে, কিন্তু তাঁর জীবনের শেষের দিকে এথেন্সের জননেতারা রাজনৈতিক ক্ষমতার আরও বড় শরিকানা নিজেদের জন্যে দাবি করা শুরু করে। ঠিক এই সময়েই, তাঁর যে সাম্রাজ্যবাদী নীতিগুলির সঙ্গে এথেন্সের উন্নয়ন ওতপ্রোত জড়িয়ে ছিল, তা স্পার্টার ক্রমবর্ধমান বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায় আর অবশেষে তার ফলাফল ছিল পেলোপোনেশীয় যুদ্ধ (৪৩১-৪০৪ খ্রি.পূ.), যে যুদ্ধে এথেন্স সম্পূর্ণ পরাজিত হয়।
রাজনৈতিক ধ্বস নামলেও, এথেন্সের মর্যাদা টিকে থাকে, আর প্রায় এক সহস্রাব্দ দর্শনের মূল ঘাঁটি এথেন্সই ছিল। অঙ্ক আর বিজ্ঞানে আলেক্সান্দ্রিয়া এথেন্সকে ছাপিয়ে যায়, কিন্তু প্লেটো আর আরিস্তোতল এথেন্সকে দার্শনিক প্রতিপত্তির শীর্ষে নিয়ে যান। যে ‘আকাদেমি’-তে প্লেটো পড়াতেন, তা অন্য সব ঘরানা আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চেয়ে বেশিদিন টিকে ছিল, আর রোম সাম্রাজ্যের খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করার পরেও প্রায় দুই শতাব্দী পেগানিজ়ম বা পৌত্তলিকতার দ্বীপ হয়ে ছিল। অবশেষে, ৫২৯ খ্রিস্টাব্দে, জাস্টিনিয়ান তার নিজের ধর্মীয় গোঁড়ামির কারণে আকাদেমি বন্ধ করেন আর ইউরোপে অন্ধকার যুগ নেমে আসে।
— বার্ট্রান্ড রাসেল
A History of Western Philosophy বইটির ষষ্ঠ পরিচ্ছেদের প্যালারাম-কৃত অনুবাদ
টীকা-টিপ্পনীর ব্র্যাকেটের মধ্যে অক্ষর থাকলে তা রাসেলের আসল ফুটনোট, সংখ্যা থাকলে তা অনুবাদকের পাকামো। ফুটনোট কণ্টকিত লেখাটির জন্যে ক্ষমাপ্রার্থী, তবে ছবি-ছাবা দিয়ে সেই দোষ স্খালনের একটা চেষ্টা করা হয়েছে।

হীরেন সিংহরায় | ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫ ০০:৫৭736636