এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  আলোচনা  দর্শন

  • পশ্চিমা দর্শনের গপ্পোগাছা — সংস্কৃতির প্রেক্ষিতে এথেন্স

    প্যালারাম
    আলোচনা | দর্শন | ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫ | ৪৪ বার পঠিত
  • The Death of Socrates - Jacques-Louis David , সূত্র


    সক্রেটিসের আগে

    সংস্কৃতির প্রেক্ষিতে এথেন্স


    খ্রিস্টপূর্ব ৪৯০ আর ৪৮০-৪৭৯ নাগাদ দুটি পারসিক যুদ্ধের সময় থেকে এথেন্সের প্রসিদ্ধির শুরু। এর আগে যুগপুরুষ তৈরি হত আয়োনিয়া আর ম্যাগনা গ্রিসিয়া (দক্ষিণ ইতালি ও সিসিলির গ্রিক নগরীগুলি)-তে। ম্যারাথনে (৪৯০ খ্রি.পূ.) পারস্যরাজ দারিয়ুসের বিরুদ্ধে এথেন্সের জয় আর তার সন্তান ও উত্তরাধিকারী ক্সেরক্সিজ় (Xerxes)-এর বিরুদ্ধে, এথেন্সের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ গ্রিক নৌবাহিনীর জয় – এ দুইটি এথেন্সের মর্যাদা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। এশিয়া মাইনরের দ্বীপগুলির ও কিছু অংশে মূল ভূখণ্ডের আয়োনীয় জনতা পারস্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল, আর—গ্রিসের মূল ভূখণ্ড থেকে পারসিকরা বিতাড়িত হওয়ার ফলে—তাদের মুক্তিযুদ্ধে এথেন্সের প্রভাব ছিল। স্পার্টানরা নিজেদের এলাকা ছাড়া আর কিছু নিয়ে তেমন মাথা ঘামাতো না, তাই এই সংঘর্ষে অংশগ্রহণ করেনি। পারস্যের বিরুদ্ধে তৈরি জোটে এথেন্স প্রধান অংশীদার হয়ে ওঠে [১] । এই জোটের সংবিধান অনুসারে, যেকোনো মিত্র রাজ্য – এক নির্দিষ্ট সংখ্যক জাহাজ দিতে বা তার দাম ধরে দিতে বাধ্য ছিল। অধিকাংশই দ্বিতীয় বিকল্পটি বেছে নিতো, ফলে বাকি জোটসঙ্গীদের ওপর এথেন্স নৌ-আধিপত্য তৈরি করে আর ধীরে ধীরে জোটটিকে এথেনীয় সাম্রাজ্যে পরিণত করে। এথেন্স ক্রমশঃ বিত্তশালী হয়ে ওঠে, আর পেরেক্লিসের (Pericles) নেতৃত্বে আরও সমৃদ্ধি লাভ করে। ৪৩০ খ্রি.পূর্বে তাঁর পতনের আগে অবধি পেরেক্লিস প্রায় তিরিশ বছর জনতার স্বাধীন পছন্দে শাসন করেছিলেন[২]



    ডেলিয়ান লিগের দেশগুলি। ভূমধ্যসাগরের উপবৃদ্ধি এজিয়ান উপসাগরের উপকূল বরাবর। হলুদ দেশগুলি এথেন্সের জোটসঙ্গী, লালগুলি স্পার্টার। নীল দেশগুলি নিরপেক্ষ। ডানদিকে বেগুনি পারস্য সাম্রাজ্য। ছবি বড় করে দেখতে হলে এখানে ক্লিক করুন


    এথেন্সের ইতিহাসে পেরিক্লিসের সময়কাল সুখ, শান্তি আর গৌরবের সেরা উদাহরণ। এস্কিলস (Aeschylus)—যিনি পারসিক যুদ্ধে লড়াইও করেছিলেন—গ্রিক নাটকে ট্র‍্যাজেডির সূত্রপাত করেন; ‘পারসিকরা’ (Πέρσαι; Persai, রাসেলের বানান: ল্যাটিনীত Persae) [৩] নামের তাঁর একটি ট্র‍্যাজেডিতে তিনি—হোমারের চরিত্রদের ব্যবহার করার চলতি নিয়ম থেকে সরে—ক্সেরক্সিজ়-এর পরাজয়কে বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। তাঁকে শীঘ্রই অনুসরণ করেন সোফোক্লিস, যাঁর আবার অনুসারী ছিলেন ইউরিপিদিস। পেরিক্লিসের মৃত্যুর পরে শুরু হওয়া পেলোপোনেশীয় যুদ্ধের অন্ধকার সময় অবধি এই দুজনেই বেঁচে ছিলেন, আর ইউরিপিদিসের লেখা নাটকে এই পরবর্তী সময়ের সংশয়বাদের ছবি ফুটে ওঠে। তাঁর সমসাময়িক রসিক কবি আরিস্তোফ়ানিস, জোরালো, কিন্তু সীমিত বাস্তববুদ্ধি কাজে লাগিয়ে সব মত‘বাদ’ (ism)-কেই উপহাস করেছেন; বিশেষ করে সোক্রাতেসকে তিনি এমন একজন ব্যক্তি সাজিয়ে নিন্দে করেছেন, যিনি জ়িউসে বিশ্বাস রাখেন না আর অপবিত্র অপবিজ্ঞানের রহস্য নিয়ে মেতে থাকেন।

    ক্সেরক্সিজ় এথেন্স দখল করেছিলেন আর সেই সময় অ্যাক্রোপোলিসের ওপরের মন্দিরগুলি আগুনে পুড়ে ধ্বংস হয়। পেরিক্লিস সেগুলির পুনর্নির্মাণে নিজেকে সমর্পণ করেছিলেন। পার্থেনন ও অন্যান্য যে মন্দিরগুলির ধ্বংসাবশেষ আমাদের সময়কেও প্রভাবিত করে, তা তাঁরই বানানো। রাষ্ট্র, ভাস্কর ফিদিয়াস-কে দেবদেবীদের মহাকায় সব মূর্তি বানানোর বরাত দেয়। এই পর্বের শেষে এথেন্স, হেলেনীয় জগতের সবচেয়ে সুন্দর আর চোখধাঁধানো নগরীতে পরিণত হয়েছিল।

    ইতিহাসের জনক ইরোদোতোস (Herodotus) ছিলেন এশিয়া মাইনরের হেলিকার্নাসোস শহরের আদি বাসিন্দা, কিন্তু থাকতেন এথেন্সে, আর পারসিক যুদ্ধের খতিয়ানও লিখেছিলেন এথেনীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই।

    পেরিক্লিসের সময়কালে এথেন্সের কৃতিত্ব ও উন্নতি বোধহয় ইতিহাসের সবচেয়ে বিস্ময়কর অধ্যায়। এর আগে পর্যন্ত এথেন্স অন্য অনেক গ্রিক নগরীর থেকেই পিছিয়ে ছিল; শিল্পে বা সাহিত্যে কোনো কৃতী ব্যক্তিত্ব প্রসবও করতে পারেনি (একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন সোলোন, মূলত একজন আইনপ্রণেতা)। হঠাৎই, ভাস্কর, স্থপতি এবং নাট্যকারেরা—আজও আমরা যাঁদের অতিক্রম করতে পারিনি—একাধারে বিজয়, বিত্ত আর পুনর্নির্মাণের প্রয়োজনে এমন সব সৃষ্টি করতে শুরু করেন, যা আধুনিক যুগ পর্যন্ত পরবর্তী সব সময়কালেই অপ্রতিরোধ্য ছিল। যখন ভেবে দেখি, এই কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত জনসংখ্যা ঠিক কতটা নগণ্য, এই কৃতিত্বের মাহাত্ম্য আরও আশ্চর্যজনক ঠেকে। ৪৩০ খ্রি.পূ. নাগাদ—এথেন্স যখন তার আয়তনের সর্বোচ্চ সীমায়—ক্রীতদাসদের ধরে তার মোট জনসংখ্যা ছিল ২ লক্ষ ৩০ হাজারের আশেপাশে, আর তাকে ঘিরে থাকা আটিকা-র গ্রামাঞ্চলে সম্ভবত আরও ক্ষুদ্রাকৃতি জনপদ ছিল। এর আগে বা পরে, কখনোই কোনো জনগোষ্ঠী এই অনুপাতে সর্বোচ্চ স্তরের কাজ করার ক্ষমতা প্রদর্শন করেনি।



    যুদ্ধে মৃত সৈনিকদের উদ্দেশ্যে পালিত গণ-অন্ত্যেষ্টির সভায় বক্তৃতারত পেরিক্লিস; Philipp Foltz-এর আঁকা (১৮৫২)। উৎস: ব্রিটানিকা


    দর্শনে এথেন্সের অবদান মাত্র দুটি নাম – সোক্রাতেস ও প্লেটো। প্লেটো অনেক পরবর্তী সময়ের মানুষ হলেও, সোক্রাতেস তাঁর যৌবন আর সাবালক জীবনের প্রথমদিকটি পেরিক্লিসের শাসনকালেই কাটিয়েছেন। দর্শনের প্রতি এথেনীয়দের উৎসাহ এতটাই ছিল, যে তাঁরা অন্য শহরের শিক্ষকদের কথাও সোৎসাহে শুনতেন। যে সব তরুণ বিতর্কের শিল্প শিখতে চাইতেন, তাঁদের কাছে সফিস্টদের বেশ কদর ছিল; প্রখ্যাত কোনো এক অতিথির কথা আকুল শিষ্যরা কেমন হাঁ করে শুনতেন – প্রোটাগোরাস বইয়ে প্লেটোর কল্পিত সোক্রাতেসের মুখে তার মজাদার বর্ণনা আছে। আমরা পরে দেখবো – পেরিক্লিস আমন্ত্রণ করে এনেছিলেন দার্শনিক আনাক্সাগোরাসকে, আর সোক্রাতেসের মতে, সৃষ্টির ক্ষেত্রে মনের প্রধান ভূমিকার কথা আনাক্সাগোরাসের থেকেই তিনি শিখেছিলেন।

    প্লেটোর বক্তব্য অনুযায়ী তাঁর কথোপকথনের অধিকাংশই পেরিক্লিসের সমসাময়িক, আর তাতে ধনীদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে বেশ ভালো এক ছবি ফুটে ওঠে। প্লেটো এক বনেদি এথেনীয় পরিবারের সন্তান, আর সেই সময়ের ঐতিহ্যবাহী, যখন যুদ্ধ আর গণতন্ত্র এসে উচ্চশ্রেণীর সম্পত্তি ও নিরাপত্তা নষ্ট করেনি। তাঁর রচনার তরুণদের কাজ করে খেতে হয় না, তারা তাদের অবসরের অধিকাংশ কাটায় বিজ্ঞান, দর্শন ও গণিতের চর্চায়, হোমার তাদের কণ্ঠস্থ এবং পেশাদার আবৃত্তিকারদের কলার তারা পরিশীলিত সমালোচক। কিছুদিন আগেই অবরোহী যুক্তির শিল্পটি আবিষ্কৃত হয়েছে, আর তাই জ্ঞানের গোটা ক্ষেত্র জুড়েই, ঠিক-ভুল – দু-ধরনেরই নতুন তত্ত্ব আবিষ্কারের উত্তেজনা তুঙ্গে। এ যুগে একাধারে ধীমান ও সুখী হওয়া—বিশেষ করে বুদ্ধির ব্যবহার করে খুশি থাকা—যেভাবে সম্ভব হয়েছিল, খুব কম সময়েই তেমনটা সম্ভব হয়েছে।

    তবে, ক্ষমতার যে ভারসাম্য এই স্বর্ণযুগ প্রসব করেছিল, তা মোটেই স্থিতিশীল ছিল না। ঘরে-বাইরে তার বিপদ ছিল – ঘরের বিপদ ছিল গণতন্ত্র, আর বাইরের – স্পার্টা। পেরিক্লিসের পরে ঠিক কী হয়েছিল বুঝতে হলে আমাদের সংক্ষেপে একবার অ্যাটিকা-র আগের ইতিহাসটা খেয়াল করতে হবে।

    ইতিহাসের সূচনালগ্নে অ্যাটিকা ছিল এক স্বয়ংসম্পূর্ণ ছোট্ট কৃষিপ্রধান অঞ্চল; তার রাজধানী এথেন্স আকারে বড় না হলেও, দক্ষ কারিগর ও অস্ত্রবিশারদদের আস্তানা ছিল। এঁরা নিজেদের উৎপাদিত সামগ্রী বিদেশে রপ্তানি করার স্বপ্ন দেখতেন। ক্রমে দেখা গেল, শস্য উৎপাদনের বদলে আমদানি করলে—মূলত কৃষ্ণসাগর-এর উপকূল থেকে আমদানি করলে—আর আঙুর ও অলিভ চাষ করলে, লাভ বেশি। এই ধরনের কৃষিকাজে শস্য চাষ করার তুলনায় বেশি মূলধন প্রয়োজন হত, আর তাই কৃষকরা ঋণগ্রস্ত হতে শুরু করলেন। অন্যান্য গ্রিক রাষ্ট্রের মতো অ্যাটিকাতেও হোমারের সময়ে রাজতন্ত্র ছিল, তবে রাজা ক্রমে রাজনৈতিক ক্ষমতাহীন এক ধর্মীয় আধিকারিকে পরিণত হন। ক্ষমতা যায় অভিজাতবর্গের হাতে, যারা একইসঙ্গে গ্রামের চাষী ও শহুরে কারিগরদের শোষণ করতে শুরু করে। গণতন্ত্রের পক্ষ নিয়ে আপোস প্রথম করেন সোলন—খ্রি.পূ. ষষ্ঠ শতকের শুরুতে—যাঁর অধিকাংশ কাজই পরবর্তী পিসিস্ত্রাতোস ও তার উত্তরাধিকারীদের স্বৈরতন্ত্রের সময়কালেও টিকে ছিল। এর পরে, স্বৈরতন্ত্রের বিকল্প হিসেবে অভিজাতরা নিজেদের গণতন্ত্রের দিকে চালনা করেন। পেরিক্লিসের পতনকাল অবধি গণতান্ত্রিক প্রকরণগুলি আসলে অভিজাতদের হাতেই ক্ষমতা তুলে দিত—যেমন দিত ঊনবিংশ শতকের ইংল্যান্ডে, কিন্তু তাঁর জীবনের শেষের দিকে এথেন্সের জননেতারা রাজনৈতিক ক্ষমতার আরও বড় শরিকানা নিজেদের জন্যে দাবি করা শুরু করে। ঠিক এই সময়েই, তাঁর যে সাম্রাজ্যবাদী নীতিগুলির সঙ্গে এথেন্সের উন্নয়ন ওতপ্রোত জড়িয়ে ছিল, তা স্পার্টার ক্রমবর্ধমান বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায় আর অবশেষে তার ফলাফল ছিল পেলোপোনেশীয় যুদ্ধ (৪৩১-৪০৪ খ্রি.পূ.), যে যুদ্ধে এথেন্স সম্পূর্ণ পরাজিত হয়।

    রাজনৈতিক ধ্বস নামলেও, এথেন্সের মর্যাদা টিকে থাকে, আর প্রায় এক সহস্রাব্দ দর্শনের মূল ঘাঁটি এথেন্সই ছিল। অঙ্ক আর বিজ্ঞানে আলেক্সান্দ্রিয়া এথেন্সকে ছাপিয়ে যায়, কিন্তু প্লেটো আর আরিস্তোতল এথেন্সকে দার্শনিক প্রতিপত্তির শীর্ষে নিয়ে যান। যে ‘আকাদেমি’-তে প্লেটো পড়াতেন, তা অন্য সব ঘরানা আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চেয়ে বেশিদিন টিকে ছিল, আর রোম সাম্রাজ্যের খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করার পরেও প্রায় দুই শতাব্দী পেগানিজ়ম বা পৌত্তলিকতার দ্বীপ হয়ে ছিল। অবশেষে, ৫২৯ খ্রিস্টাব্দে, জাস্টিনিয়ান তার নিজের ধর্মীয় গোঁড়ামির কারণে আকাদেমি বন্ধ করেন আর ইউরোপে অন্ধকার যুগ নেমে আসে।


    চলবে... (এর পরের পর্ব: আনাক্সাগোরাস)


    বার্ট্রান্ড রাসেল
    A History of Western Philosophy বইটির ষষ্ঠ পরিচ্ছেদের প্যালারাম-কৃত অনুবাদ



    টীকা-টিপ্পনীর ব্র্যাকেটের মধ্যে অক্ষর থাকলে তা রাসেলের আসল ফুটনোট, সংখ্যা থাকলে তা অনুবাদকের পাকামো। ফুটনোট কণ্টকিত লেখাটির জন্যে ক্ষমাপ্রার্থী, তবে ছবি-ছাবা দিয়ে সেই দোষ স্খালনের একটা চেষ্টা করা হয়েছে।




    [১] দেড়শো থেকে সাড়ে তিনশো-র মত জনপদ মিলে ৪৭৮ খ্রি.পূর্বে তৈরি হওয়া এই জোটের প্রধানেরা মিটিং করতেন ডেলোস দ্বীপের অ্যাপোলোর মন্দিরে। তাই ইতিহাসে এর নাম ‘Delian League’।
    [২] পৃথিবীর ইতিহাসে খুব মানুষের নামেই কোনো এক যুগকে চিহ্নিত করা হয়। চোরলাগো জনপদের জ়ান্থিপুস-পুত্র পেরিক্লিস (Pericles, son of Xanthippus of deme Chorlagos) সেই গৌরবের অধিকারী। বিরাট ব্যক্তিত্ব, রংদার চরিত্র। একদিকে বছর কুড়ি বয়সেই এস্কিলসের ‘পারসিকরা’-র পৃষ্ঠপোষক, দেশি-বিদেশি বাঘা বাঘা পণ্ডিত আর বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে নিত্য ওঠাবসা, এথেন্সের স্বর্ণযুগের কারিগর, শিল্পকলায় এথেন্সের গরিমার প্রধান রূপকার – এতই প্রভাবশালী, যে ইরোদোতোসের যোগ্য উত্তরসূরী থুকিদিদিস (Thucydides) তাঁকে প্রায় এথেন্সের ‘মুকুটহীন সম্রাট’ বলেই ফেলেছিলেন। অন্যদিকে, ৪৫১ খ্রি.পূ-তে নিজেরই প্রণীত আইনের বলে, বিদেশিনী প্রেমিকাকে বিয়ে করতে পারেননি – যে কুখ্যাতি কমেডি রচয়িতাদের পৌষমাস হয়ে উঠেছিল। একদিকে স্থিতধী, বাগ্মী রাজপুরুষ, অন্যদিকে কমেডির বোহেমিয়ান, প্রবৃত্তিতাড়িত চরিত্র – এ দুই সম্পূর্ণ বিপরীত ছবিকে স্বয়ং প্লুতার্ক-ও মেলাতে না পেরে পেরিক্লিসের এক অস্বচ্ছ জীবনীই লিপিবদ্ধ করেছেন। তাঁর কাছে তবু সমসাময়িক সূত্রগুলি ছিল, যা পরবর্তী আধুনিক ইতিহাসবিদদের হাতে নেই।

    তাই রাসেলের সময়াবধি পেরিক্লিসের এই অতিরঞ্জিত গরিমাময় জীবনীই প্রচলিত ছিল। ‘পেরিক্লিসের যুগ’ (siècle de Périclès)-এর ধারণা এতটাই প্রভাববিস্তার করে, যে ভলতেয়ার উদ্বুদ্ধ হয়ে ‘Le Siècle de Louis XIV’ নামের একখান গোটা বই-ই লিখে ফেলেছিলেন। এই যুগটিকে পেরিক্লিসের যুগ বলে ডাকা বেশিদিনের নয়। সম্ভবত ভলতেয়ারের পত্রবন্ধু, প্রাশ্যা (Prussia)-র ফ্রেডরিক দ্য গ্রেট-এর লেখা ‘অ্যান্টি মেকিয়াভেল’-এ প্রথম এর উল্লেখ ছিল।

    আধুনিক পাঠগুলিতে অবশ্য সূক্ষ্মবিচার অনেক বেশি। উপলভ্য সূত্রের সীমাবদ্ধতা মাথায় রেখেও, এগুলিতে পেরিক্লিসকে মানুষ হিসেবে দেখার, তাঁর সমসময়ের প্রেক্ষিতে দেখার চেষ্টা কিছু হলেও বেশি। একটা উদাহরণ – Vincent Azoulay-এর ‘Pericles of Athens’।
    [৩] পূর্ণাঙ্গরূপে পাওয়া যায়, এমন প্রাচীনতম গ্রিক নাটক। দিওনিসুসের নামে এথেন্সে বাৎসরিক এক বিরাট উৎসব হত, তার নাম ‘দিওনিসিয়া’। গ্রামের উৎসব আগে হত, শীতের ঠিক পর। আর তা শেষ হওয়ার পর শহরে শুরু হত মার্চ-এপ্রিল নাগাদ। শোভাযাত্রা হত, যার পুরোভাগে থাকতেন সবচেয়ে ধনাঢ্য পৃষ্ঠপোষক বা খোরিগি (χορηγοί; chorēgoí : এর থেকেই ইংরেজি কোরাস chorus এসেছে)-রা। শোভাযাত্রার শেষে সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা, ষাঁড় বলি - এসব হত। দ্বিতীয় দিনে হত নাট্যানুষ্ঠান – সেটিও প্রতিযোগিতা। ৪৭২ খ্রি.পূর্বের প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছিল যে তিন টুকরো নাটক, তার দ্বিতীয় অংশের নাম ‘পারসিকরা’। শুধু এইটিই এখনো পাওয়া যায়। সেই বছরের খোরিগি আর এই নাটকের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন বছর বিশের পেরিক্লিস।

    George Romney-র আঁকা পারসিকরা - নাটকের একটি দৃশ্য। দারিয়ুসের প্রেতাত্মা আতুসা-র সামনে আবির্ভূত হয়েছে। উৎস: উইকি

     

    চলবে... (এর পরের পর্ব: আনাক্সাগোরাস)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • আলোচনা | ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫ | ৪৪ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    পত্তাদকাল - %%
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • হীরেন সিংহরায় | ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫ ০০:৫৭736636
  • অসাধারণ । এতো সহজে এতো বড়ো ক‍্যানভাসকে ধরেছেন। আলোক বিচ্ছুরিত হলো। অনেক ধন‍্যবাদ।
     
    আধুনিক গ্রিকে এইচ নি:শব্দ কিন্তু হেরোডোটাসের আমলেও কি তাই ছিল ? 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আদরবাসামূলক প্রতিক্রিয়া দিন