দিন-দুনিয়া নিয়ে যেসব ধ্যানধারণাকে আমরা সাধারণত ‘দার্শনিক চিন্তা’ বলে দাগাই, তা মূলত দু-ধরনের উপলব্ধির যোগফল –
একদিকে, উত্তরাধিকার হিসেবে পাওয়া ধার্মিক ও নৈতিক বোধবুদ্ধি আর অন্যদিকে—‘বিজ্ঞান’ শব্দটির খুব আলগা মানে করলে—‘বিজ্ঞান’সম্মত সব অনুসন্ধানের ফলাফল। কোনো না কোনো অনুপাতে এই দুইয়ের একত্র উপস্থিতিই যে ‘দর্শন’-এর প্রধান বৈশিষ্ট্য – তা প্রায় সব দার্শনিকই মেনে নিয়েছেন, তবে এদের মধ্যে কোনটির প্রভাব তাঁদের ব্যক্তিগত দর্শনে কতটা – তা নিয়ে তাঁদের মধ্যে বিস্তর মতপার্থক্য আছে।
‘দর্শন’-শব্দটির ব্যবহার নানারকমভাবে হয়, তার কোনোটি সঙ্কীর্ণ অর্থে, কোনোটি বিস্তৃত। শব্দটিকে আমি খুবই আলগা, ছড়ানো এক অর্থে ব্যবহার করবো—বুঝিয়ে বলছি...
দর্শন বলতে আমি বুঝি – ধর্মতত্ত্ব আর বিজ্ঞানের মাঝামাঝি কিছু। যে সমস্ত বিষয়ে সুনির্দিষ্ট জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব নয়, সেসব বিষয়ে জল্পনা বা আন্দাজ যেমন ধর্মতত্ত্বের অংশ—তেমনই দর্শনেরও; আবার, বিজ্ঞানের মতো, দর্শনও আমাদের যুক্তি-বুদ্ধির দরবারে আপিল করে, কোনো ‘গুরু’জনের—যেমন ঐতিহ্য বা শাস্ত্রের—কাছে নয়। আমার প্রস্তাবে, সমস্ত উপলভ্য, ‘নির্দিষ্ট’ (definite) জ্ঞান হল বিজ্ঞানের জমিদারি আর তার আওতার বাইরের সমস্ত অনড়, স্থির বিশ্বাস (dogma; ডগমা) হল ধর্মতত্ত্বের দখলে। ডগমা আর অর্জিত জ্ঞান – এই দুইয়ের সীমানার মাঝে যে ‘নো ম্যানস্ ল্যান্ড’—দু-তরফই যাকে ক্রমাগত দখল করার চেষ্টা করে—সেইখানেই দর্শনের রাজত্ব। কল্পনাবিলাসী মানব-মননে অহরহ উঁকি দেওয়া প্রশ্নগুলোর মধ্যে যেগুলো সবচেয়ে আকর্ষণীয় – তার প্রায় সবই বিজ্ঞানের আওতার বাইরে। অন্যদিকে, গত শতক অবধি, ধর্মতত্ত্ব প্রত্যয়ী উচ্চারণে সেইসব প্রশ্নের যা সব উত্তর দিয়েছে—আজকাল আর তাদের ততটা নিঃসংশয়ে ঠিক বলে মনে হয় না।
জগত কি সত্যিই দুটি ভাগে বিভক্ত – মনোজগৎ আর পার্থিব / বস্তু জগৎ (mind and matter)? এ যদি সত্যি হয়, তবে ‘মন’-ই বা কী আর পদার্থ-ই বা কী? মনোজগৎ কি পার্থিব জগতের ওপর নির্ভরশীল, নাকি তার কোনো স্বতন্ত্র ক্ষমতা আছে? এই মহাবিশ্বের অস্তিত্বের কি আদৌ কোনো মোক্ষ / মহত্তর উদ্দেশ্য আছে? কোনো বিশেষ লক্ষ্যের দিকে কি এগিয়ে চলেছি আমরা, আমাদের মহাবিশ্ব? ভৌতবিজ্ঞানের সূত্রগুলির কি সত্যিই অস্তিত্ব আছে, নাকি আমাদের অন্তরে গ্রন্থিত শৃঙ্খলার কারণেই আমরা সেই সূত্রগুলি খুঁজে পাই? একজন জ্যোতির্বিজ্ঞানীর চোখে মানুষ যেমন—একটি ক্ষুদ্রকায়, নগণ্য গ্রহের ওপর অসহায়ভাবে চরে বেড়ানো, ভেজাল-মেশানো কার্বন আর জলের মিশ্রণ—মানুষ কি সত্যিই তাই? নাকি হ্যামলেট তাকে যেভাবে দেখেছিল, তা-ই মানুষের আসল রূপ [১]? নাকি একাধারে দুই-ই? এ কি সত্য, যে, জীবনধারণের কিছু পথ মহৎ, আর কিছু ইতর? নাকি, সবই রাস্তাই আদতে অর্থহীন? কোনো জীবনযাপন যদি সত্যিই মহত্তর হয়, তবে সে রাস্তার ধরন কেমন, আর আমরা কীভাবে সেই রাস্তায় চলতে পারি? যা ভালো—তা কি অনন্তকালই ভালো, নাকি গুটি গুটি পায়ে অবশ্যম্ভাবী প্রলয়ের দিকে চলতে থাকা এই ব্রহ্মাণ্ডেও ‘ভালো’-কে বেছে নেওয়ার অর্থ আছে? প্রজ্ঞা বলে কোনো বস্তু কি আদতে আছে, নাকি তা মূর্খামিরই পালিশ করা চকচকে রূপ?
এসব প্রশ্নের উত্তর কোনো পরীক্ষাগারে পাওয়া সম্ভব নয়, আবার ধর্মতত্ত্ব ঢাকঢোল পিটিয়ে ঘোষণা করেছে, যে, প্রশ্নগুলো সহজ, আর উত্তরও তার জানা। সেসব উত্তর এতই নিরেট, এতই গোছানো, যে আধুনিক মনন তাকে গভীর সন্দেহের চোখে দেখে। এইরকম সব প্রশ্নেরই—উত্তর দিতে পারাটা আসল কথা নয়—চর্চা করা হয় যে বিষয়ে, তা-ই ‘দর্শন’।
আপনি জিজ্ঞেস করতেই পারেন, কেন খামোকা এইসব প্রশ্নের পিছু ধাওয়া করে, মাথা খাটিয়ে, সময় নষ্ট করা? এর উত্তর দু-ভাবে দেওয়া যায় – হয় একজন ঐতিহাসিকের দৃষ্টিকোণ থেকে, নয়তো এমন এক ব্যক্তির চোখে, যে এই মহাবিশ্বে তার নিজের নশ্বর অস্তিত্বের ভয়াবহ একাকীত্ব টের পেয়েছে।
এই লেখায়, আমার পক্ষে যতটা সম্ভব, ওই ঐতিহাসিকের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই আলোচনা হবে। যবে থেকে মানুষ বাধাহীন কল্পনার ক্ষমতা পেয়েছে—তখন থেকেই, তার সমস্ত কাজের পিছনে কোনো না কোনো কারণ ছিল—অগণিত রকমের কারণ—কিন্তু নিঃসন্দেহে জগত-জীবন, শুভ-অশুভ নিয়ে তৈরি কোনো না কোনো দার্শনিক তত্ত্ব থেকেই সেই কারণ উৎসারিত। একথা যতটা প্রাচীনকালের জন্যে সত্যি, বর্তমানের জন্যেও তেমনই প্রযোজ্য। কোনো দেশ বা কালকে বুঝতে হলে আগে সেই দেশ বা কাল-এর দর্শনকে বুঝতে হয় আর সেই দর্শন বুঝতে হলে, আমাদের সকলকেই অল্পবিস্তর দার্শনিক হতে হবে বৈকি! এইখানে একটা কার্যকারণের চক্র আছে—ব্যক্তির জীবনযাপন, অভিজ্ঞতার ফলে যেমন তার দর্শন প্রভাবিত হয়, তার অধীত দর্শনও তেমনই তার জীবন, অবস্থাকে প্রভাবিত করে। শতকের পর শতক ধরে চলা এই টানাপোড়েনের গল্পই এই লেখার আলোচ্য বিষয়।
অবশ্যই, এর একটা ব্যক্তিগত জবাবও আছে। যা আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব—বিজ্ঞান আমাদের সে কথা জানায়, কিন্তু ‘যা আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব’—তার পরিমাণ নগণ্য। আমাদের সম্ভাব্য অজ্ঞানতার পরিধি যে কী বিশাল—তা যদি মনে না রাখি, তবে অনেক দরকারি বিষয়ের থেকেই আমাদের নজর সরে যাবে।
উলটোদিকে, ধর্মতত্ত্ব আমাদের মনে একরকম গোঁড়া (dogmatic) বিশ্বাস পয়দা করে, যে, এইসব বিষয় আমাদের অজানা তো নয়ই, বরং খুব ভালোরকম জানা। এই ভুল চর্চার ফলে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রতি আমাদের একরকমের নির্বোধ ঔদাসীন্য তৈরি হয়। আমাদের অনুভূতিগুলি – আশা-আকাঙ্খা, ভয় – সবই খুব উজ্জ্বল, স্পষ্ট; সেসব সামনে রেখে তাই—‘জীবন মূলত অনিশ্চিত’—এই বোধ নিঃসন্দেহে খুবই বেদনাদায়ক। কিন্তু সে বেদনা সহ্য না করে, মোলায়েম রূপকথায় ভর করে বাঁচাও তো অর্থহীন। দর্শন যে সব কঠিন প্রশ্ন করে, তাদের বেমালুম ভুলে যাওয়াও যেমন কাম্য নয়, তেমনই, তাদের নিশ্চিত, নিঃসন্দেহ উত্তর পেয়ে গেছি – এমন ভাবাও বোকামি। দর্শনের পড়ুয়ারা যেমন জীবনের অনিশ্চয়তাকে মেনে নিতে শেখে, তেমনই, সেই অনিশ্চিতের সামনে দ্বিধায়, কুণ্ঠায় জড়বৎ না হয়ে বাঁচতেও দর্শনই তাদের শেখায়। আমাদের এই যুগে এইটেই বোধহয় দর্শন-অধ্যয়নের প্রধান গুরুত্ব।
ধর্মতত্ত্বের অংশ নয়, একটি স্বতন্ত্র বিষয় হিসেবে দর্শনের চর্চা প্রথম শুরু হয়েছিল গ্রিসে, খ্রিস্টপূর্ব ষোড়শ শতকে। এই যুগের নটেগাছটি মুড়োলে, আবার, রোমের পতনের পর এবং খ্রিস্টধর্মের উত্থানের সঙ্গে, দর্শনকে গিলে খেল ধর্মচর্চা। দ্বিতীয়বার যখন দর্শনের সুসময়—একাদশ থেকে চতুর্দশ শতকে—সম্রাট দ্বিতীয় ফ্রেডরিক (Frederick II; ১১৯৫-১২৫০)-এর মতো কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া দর্শনের ওপর তখন মৌরসীপাট্টা ছিল ক্যাথলিক চার্চের। এই সময়কালের অন্তে যে ডামাডোল শুরু হয়, তারই পরিণতি ‘সংস্কার আন্দোলন’ (Reformation; রিফর্মেশন)। দর্শনের তৃতীয় গৌরবময় অধ্যায়ে—সপ্তদশ শতক থেকে আজকের সময় পর্যন্ত—দার্শনিক চিন্তার ওপর ‘বিজ্ঞান’-এর নিয়ন্ত্রণ অন্য অধ্যায়দুটির থেকে অপেক্ষাকৃত অনেক বেশি। প্রথাগত ধর্মবিশ্বাসের গুরুত্ব এখনও অটুট, কিন্তু তাদের দাবিগুলি আর প্রশ্নের / ব্যাখ্যার ঊর্ধ্বে নয়; বরং বিজ্ঞানের সঙ্গে বিরোধ বাধলে তাদের বদলানোর প্রয়োজন পড়ে। প্রায় কোনো সমসাময়িক দার্শনিককেই এখন আর তথাকথিত সনাতনী ক্যাথলিক মতানুসারী বলা চলে না; তাঁদের জল্পনায় এখন চার্চের বদলে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের গুরুত্ব অনেক বেশি।
এই গোটা সময়কাল জুড়ে ধর্ম আর বিজ্ঞানের মধ্যে হয় ঝগড়া, নয় অস্বস্তিকর এক আপোস চালু ছিল। এই একই সম্পর্ক – সামাজিক সংহতি আর ব্যক্তিস্বাধীনতার মধ্যেও। প্রাচীন গ্রিসে সামাজিক সংহতি নিশ্চিত করতো—নগররাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকের আনুগত্য। অ্যারিস্টটলের জীবদ্দশায় যদিও আলেক্সান্ডার নগররাষ্ট্রের ধারণাটিকেই প্রায় বিলুপ্ত করে দিয়েছিলেন, তবু অ্যারিস্টটলও এর থেকে শ্রেয় কোনো রাজনীতি খুঁজে পাননি। নগররাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্যের এই কর্তব্য অবশ্যই ব্যক্তিস্বাধীনতাকে খর্ব করতো, কিন্তু তার পরিমাণ বিভিন্ন নগররাষ্ট্রে বিভিন্নরকম ছিল। স্পার্টায় ব্যক্তির জন্যে বরাদ্দ স্বাধীনতার সঙ্গে বর্তমান জার্মানি আর রাশিয়ার তুলনা করা যেতে পারে [২]; অন্যদিকে, কিছু বিচ্ছিন্ন অবিচারের নিদর্শন বাদে, এথেন্সের নাগরিকরা রাষ্ট্রের বিধিনিষেধের হাত থেকে এক অভূতপূর্ব স্বাধীনতা উপভোগ করতেন। অ্যারিস্টটলের সময় অবধি, নগরের প্রতি ধর্মীয় ও দেশাত্মবোধক আনুগত্যেরই প্রাধান্য ছিল গ্রিক চিন্তনে, মননে। অপরপক্ষে, রাষ্ট্রের নৈতিক কাঠামোর বদল হত ‘নাগরিক’দের জীবনের কথা মাথায় রেখেই, ফলত, তাতে রাজনীতির ভালোরকম গুরুত্ব ছিল। গ্রিকরা যখন এরপরে প্রথমে ম্যাসিডোনিয়া, পরে রোমানদের অধীন হলেন, স্বাধীনতা-সংক্রান্ত সেই ধারণাগুলি আর বলবৎ থাকলো না। এর ফলে, একদিকে যেমন ঐতিহ্যের সঙ্গে সংঘাতের মাধ্যমে জাতি হিসেবে গ্রিকরা শৌর্যবীর্য হারালেন, অন্যদিকে জাতিগত নীতিবোধ আরো বেশি করে ব্যক্তিমুখী, সমাজবিমুখ হতে শুরু করলো। যেমন, স্থিতধী (stoic; স্টোয়িক)-দের মতে – আত্মার সঙ্গে ঈশ্বরের সম্পর্কের ফলেই নৈতিক বোধের উদয় হয়, নাগরিকের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্কের ফলে নয়। খ্রিস্টধর্মের পথ এঁরাই প্রশস্ত করেছেন ভাবা যেতে পারে। স্টোয়িকদের মতোই, খ্রিস্টানরাও শুরুতে অরাজনৈতিক ছিলেন—কারণ আর কিছুই না—খ্রিস্টান ধর্মের প্রথম তিন শতাব্দী কোনো সরকারের ওপর তাঁদের প্রভাব খাটানোর ক্ষমতা ছিল না। আলেক্সান্ডারের সময় থেকে কন্সটান্টাইনের সময় অবধি, সামাজিক সংহতির উৎস না ছিল দর্শন, না অতীতের আনুগত্য। এই সামাজিক আঠার কাজটি সম্পন্ন হয়েছিল বলপ্রয়োগের মাধ্যমে – প্রথমে সামরিক, পরে প্রশাসনিক বলপ্রয়োগে। রোমান সৈন্যদল, রোমান রাস্তাঘাট, রোমান আইন, রোমান প্রশাসন – এরা সকলে মিলে এক প্রভূত ক্ষমতাশালী কেন্দ্রমুখী রাষ্ট্র পত্তন ও দীর্ঘ সময় ধরে তার দেখভাল করেছিল। এর একচুল কৃতিত্বও রোমান দর্শনের নয় কিন্তু – কারণ তার তো কোনো অস্তিত্বই ছিল না!
গ্রিক ব্যক্তিস্বাধীনতার স্বর্ণযুগ থেকে আসা বহমান ধারণাগুলি, এই দীর্ঘ সময়ে, ক্রমাগত পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। এদের মধ্যে কিছু তত্ত্ব—যাদের আমরা ‘ধর্মঘেঁষা’ বলতে পারি—এই সময় অপেক্ষাকৃত বেশি গুরুত্ব পায়, আর কিছু অন্য ধারণা—মূলত যৌক্তিক—সমসময়ের সুরে সুর মেলাতে না পারায় সরাসরি পরিত্যক্ত হয়। ঠিক এইভাবেই, পরবর্তীকালে প্রকৃতি-পূজারী পৌত্তলিক (pagan; পেগান)-রা গ্রিক ঐতিহ্যকে কেটেছেঁটে আসন্ন খ্রিস্টান মতবাদের উপযোগী করে তুলেছিল।
স্টোয়িকদের শিক্ষার মধ্যে একখানা দরকারি ধারণা নিহিত ছিল, যা ঠিক প্রাচীনকালের দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে মানাতো না। ধারণাটি হল – ঈশ্বরের প্রতি কোনো ব্যক্তির দায়বদ্ধতা, রাষ্ট্রের প্রতি তার কর্তব্যের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ (ক)। খ্রিস্টধর্ম পরে এই ধারণাটিকেই জনপ্রিয় করে তোলে। সোক্রাতেস বা যীশুর প্রেরিতরা (Apostles) যা শিখিয়েছিলেন—‘মানুষের নয়, ঈশ্বরের উপাসনা করো’—তা কন্সটান্টাইনের ধর্মান্তরের পরেও টিকে ছিল, কারণ প্রথমদিকের খ্রিস্টান সম্রাটেরা ছিলেন এরিয়ান (Arian) বা এরিয়ান-বান্ধব। পরবর্তী সনাতনী (orthodox: অর্থোডক্স) সম্রাটদের সময়ে মতটি জনমানসের অগোচরে চলে যায়। এর পরের বাইঞ্জান্টাইন সাম্রাজ্য বা রাশিয়ান সাম্রাজ্যে—যাদের খ্রিস্টধর্ম আসলে কন্সটান্টিনোপল থেকে আমদানি করা—এই ধারণা সুপ্ত হয়ে ছিল (খ)। পশ্চিম ইউরোপে, প্রাচীন গল (ফ্রান্স)-এর কিছু অংশ ছাড়া প্রায় সর্বত্রই ক্যাথলিক নৃপতিদের প্রায় তৎক্ষণাৎই সরিয়ে সিংহাসনে বসে বিধর্মী বহিরাগত (barbarian) রাজারা। সেখানে তাই রাজনৈতিক আনুগত্যকে ছাপিয়ে জয়ী হয়েছিল ধর্মীয় আনুগত্য—আজও যা কথঞ্চিৎ বর্তমান।
বহিরাগত আক্রমণ প্রায় ছয় শতাব্দীর জন্যে পশ্চিম ইউরোপের সভ্যতার আলো নিভিয়ে দিয়েছিল। নবম শতাব্দীতে ডেন (ডেনমার্কের বাসিন্দা)-দের হাতে ধ্বংস হওয়ার আগে অবধি এই সভ্যতা টিকে ছিল আয়ার্ল্যান্ডে; নেভার আগে তা যে উজ্জ্বল ব্যক্তিত্বের জন্ম দেয়, তাঁর নাম: স্কোটাস এরিজেনা (John Scotus Eriugena)। পূর্ব ইউরোপে গ্রিক সভ্যতা টিকে ছিল—জাদুঘরে রাখা বিবর্ণ পুঁথির মতো নীরস চেহারায়—১৪৫৩ সালে কন্সটান্টিনোপলের পতন অবধি। কিন্তু একটি বিশেষ শৈল্পিক ধারা এবং জাস্টিনিয়ানের রোমান আইনের সংগ্রহ (Codes of Roman Law) ছাড়া, দুনিয়া এই সময়ের কন্সটান্টিনোপল থেকে কিছু তেমন বলার মতো পায়নি।
পঞ্চম শতকের শেষ থেকে একাদশ শতকের মাঝ অবধি চলা অন্ধকার সময়ে, রোমান জগতে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য বদল ঘটলো। খ্রিস্টধর্ম যা প্রচার করেছিল—‘ঈশ্বরের প্রতি কর্তব্য বনাম রাষ্ট্রের প্রতি কর্তব্য’—এই সংঘাতের চেহারা বদলে গিয়ে হল – চার্চ বনাম রাজার লড়াই। চার্চের কর্তা হিসেবে, পোপের কানুনের এখতিয়ারে (ecclesiastical jurisdiction) ছিল ইতালি, ফ্রান্স, স্পেন, ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জ, আয়ার্ল্যান্ড, জার্মানি, স্ক্যান্ডিনেভিয়া আর পোল্যান্ড। প্রথমদিকে, ইতালি আর দক্ষিণ ফ্রান্স ছাড়া অন্যান্য অঞ্চলের বিশপ এবং অ্যাবটদের ওপর পোপের প্রভাব আলগা-ই ছিল, কিন্তু একাদশ শতকের শেষদিকে ষষ্ঠ গ্রেগরি (Pope Gregory VI)-র সময় থেকে এই প্রভাব শক্তপোক্ত, প্রভাবশালী চেহারা নেয়। এই সময় থেকে ১৩০০ সাল পর্যন্ত, খ্রিস্টান ধর্মযাজকমণ্ডলী (clergy; ক্লার্জি) গোটা পশ্চিম ইউরোপ জুড়ে এক সংহত, রোমকেন্দ্রিক সংগঠনের জন্ম দেয়, যার কাজই ছিল বুদ্ধি খাটিয়ে নিরলস ক্ষমতা দখল করার চেষ্টা—ধর্মনিরপেক্ষ শাসকদের সঙ্গে এই সংঘাতে তারা অনেকাংশে সফলও হয়েছিল। চার্চের সঙ্গে রাষ্ট্রের এই সংঘাত যে কেবল ক্লার্জি বনাম জনসাধারণ ছিল—তা নয়, এই লড়াই আসলে উসকে দিয়েছিল অনেক পুরোনো আরেক বিবাদের স্মৃতি—ভূমধ্যসাগরীয় (রোমান) সমাজ বনাম উত্তরের বহিরাগতরা (জার্মানরা)। চার্চের সাংগঠনিক ঐক্যের মধ্যে রোমান ঐক্যের প্রতিধ্বনি শোনা যেত—চার্চের মন্ত্রোচ্চারণ হত ল্যাটিনে, তার গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হত মূলত ইতালি, স্পেন বা দক্ষিণ ফ্রান্সের বাসিন্দারা। যখন শিক্ষার পুনরুদ্ভব হল, তখন সেই শিক্ষার স্বরূপ ছিল সনাতনী (classical); চার্চের আইনকানুন, প্রশাসনের মারপ্যাঁচ, সমসাময়িক শাসকবর্গের তুলনায় নিশ্চিত মার্কাস অরেলিয়াস বেশি ভালো বুঝতে পারতেন। অতীত আর সমকালীন ‘সভ্যতা’-র মধ্যে ধারাবাহিকতার, সংযোগের প্রতীক ছিল চার্চ।
উলটোদিকে, ধর্মনিরপেক্ষ ক্ষমতা, প্রাচীন জার্মান-ভাষী টিউটনিক (Teutonic) বংশোদ্ভূত রাজা ও জায়গিরদারদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল; জার্মানির জঙ্গল থেকে আনা তাদের সমাজ-সংস্কৃতি যতটা সম্ভব টিকিয়ে রাখাই এদের একান্ত চেষ্টা ছিল। সর্বব্যাপী, চূড়ান্ত ক্ষমতালাভের জন্যে চার্চের অদম্য বাসনা-ও যেমন এই রাজন্যবর্গের মাথায় ঢুকতো না, তেমনই, আইনের কচকচিও একঘেয়ে মনে হতো। রাজা তাঁর ক্ষমতা সামন্তপ্রভু-অভিজাতবর্গের সঙ্গে ভাগ করে নিতেন ঠিকই, কিন্তু সকলেরই বাসনা ছিল – মনের ভেতর জমে ওঠা আবেগ-উত্তেজনার এক দমকা প্রকাশ করার সুযোগ তাঁদের কালেভদ্রে দেওয়া হোক – খুন-জ়খম, যুদ্ধ, লুটপাট বা ধর্ষণের মাধ্যমে। রাজারা না হয় পরে অনুতাপ করে নেবেন—হাজার হোক, তাঁরা তো আসলে ভক্তই—আর কে না জানে, অনুতাপ একরকম চরম আবেগেরই বহিঃপ্রকাশ! আধুনিক চাকুরিদাতারা একরকম শান্ত, পেশাদারি ভালো ব্যবহার আশা করেন না, তাঁদের কর্মীদের থেকে? বহুলাংশে সে ব্যবহার লাভ-ও করেন?—শত চেষ্টাতেও চার্চ কিছুতেই এই টিউটনিক-বংশীয়দের মধ্যে তা জাগাতে পারেনি। এদের ভাবখানা ছিল – গোটা দুনিয়া জয় করে কী ছাতার মাথা হবে, যদি, যখন-যেমন-ইচ্ছে সুরাপান, খুন-জখম, প্রেম-ভালোবাসা-ই না করা গেল? আর তাছাড়া, যাদের সৈন্যদলে অসংখ্য দৃপ্ত, উজ্জ্বল নাইট গিজগিজ করছে, তাঁরা কোন দুঃখে একদল বইমুখো, সৈন্যসামন্তহীন, তার ওপর কৌমার্যের ব্রতপালনকারী লোকের কথায় ওঠাবসা করবে? পোপের অফিসের রক্তচক্ষু সত্ত্বেও এরা ডুয়েল আর যুদ্ধের মাধ্যমে বিচার (trial by battle)-এর প্রথা ত্যাগ তো করেইনি, বরং প্রতিযোগিতামূলক প্রদর্শনী (tournament; টুর্নামেন্ট) এবং দরবারি প্রেম (courtly love)-এর সূত্রপাত করেছিল। ক্বচিৎ, আবেগের অনবদমিত তাড়নায় তারা এক-আধজন নামজাদা ধর্মযাজককে কোতলও করে ফেলেছে বৈকি!
সমস্ত সামরিক বল শাসকদের হাতে থাকা সত্ত্বেও, এ বিবাদে চার্চই জিতেছিল। এর কারণ, কিছুটা – শিক্ষাজগতের ওপর চার্চের তখনকার একচেটিয়া দখল, কিছুটা এ-ও, যে, রাজারা নিজেদের মধ্যে খেয়োখেয়িতেই অধিকাংশ সময় ব্যস্ত থাকতো। তবে আসল কারণ হল – কিছু ব্যতিক্রম বাদে, শাসক-প্রজা-নির্বিশেষে সকলেই বিশ্বাস করতো – চার্চের হাতেই স্বর্গের চাবিকাঠি। চার্চ যেমন ঠিক করে দিতে পারে কোনো শাসক অনন্তকাল স্বর্গে কাটাবেন না নরকে, তেমনই, চার্চ চাইলে দেশদ্রোহিতার দোষ ক্ষমাও করে দিতে পারে (অতএব, বিদ্রোহ বাধানো নেহাতই সহজ)। সর্বোপরি, আসল নির্ণায়ক কারণটি ছিল বণিকসমাজের পৃষ্ঠপোষণ – নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে চার্চ ছিল স্থায়িত্বের প্রতীক, তাই তারা সমাজে উঠতি বণিকমহলের সমর্থন পেয়েছিল।
চার্চের সর্বময় কর্তৃত্ব থেকে নিজেদের অন্তত অংশত স্বাধীন রাখার এই টিউটনিক চেষ্টা কিন্তু কেবল রাজনীতিতেই সীমাবদ্ধ ছিল না—এর প্রকাশ ঘটেছিল যুদ্ধে, প্রেমে, শিল্পে, বীরধর্মে (chivalry)। শুধু, শিক্ষা যেহেতু পুরোপুরি ক্লার্জির কুক্ষিগত ছিল, তাই বৌদ্ধিক জগতে এই স্বাধীন চেতনার প্রভাব বিশেষ দেখা যায়নি। মধ্যযুগীয় ‘সুস্পষ্ট দর্শন’ (explicit philosophy) কিন্তু আদতে সেই সময়কালের জনমানসের সঠিক বিম্ব নয়—কেবল একটিমাত্র দলের ভাবনার প্রকাশ। কীরকম? ধর্মযাজকদের মধ্যে এক অংশ—বিশেষ করে সন্ত ফ্রান্সিসের ভক্ত সন্ন্যাসীরা (Franciscan friars)—বিভিন্ন কারণবশত, মোটেই পোপের মতামতের অন্ধ সমর্থক ছিলেন না। ওদিকে আল্পসের উত্তরের অঞ্চলগুলির তুলনায় ইতালিয়ান সমাজ অনেক আগেই সংস্কৃতিমনস্ক হয়ে উঠেছিল। পোপ-বিরোধী সংস্কৃতির বোধহয় সবচেয়ে বড় উদাহরণ দ্বিতীয় ফ্রেডরিক, যিনি একটা নতুন ধর্মই প্রবর্তন করতে উঠেপড়ে লেগেছিলেন। আবার, ফ্রেডরিক যেখানে রাজত্ব করেছেন, সেই নেপলস-এ জন্মানো থমাস অ্যাকুইনাস বোধহয় এখনো অবধি পোপ-এর দর্শনের প্রবলতম সমর্থক। এই দুই বিবদমান মতের এক সমন্বয় (synthesis) সাধন করতে পেরেছিলেন একমাত্র দান্তে (Dante Alighieri), বছর পঞ্চাশ পর—মধ্যযুগীয় দর্শনের একমাত্র সুষম নিদর্শন সম্ভবত তাঁর লেখাতেই পাওয়া যায়।
দান্তের পর যে এই মধ্যযুগীয় দার্শনিক সমন্বয় নষ্ট হল, তার কারণ, একইসঙ্গে রাজনৈতিক এবং বৌদ্ধিক। যদ্দিন টিকে ছিল, এই আপাত-পরিচ্ছন্ন দর্শনটি যতই ক্ষুদ্র, সীমাবদ্ধ হোক, একরকমভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল। এই দর্শন যা কিছু নিয়ে মাথা ঘামিয়েছে, নিজের বড়ই সীমিত ব্রহ্মাণ্ডে তাদের একের সঙ্গে অন্যের নির্দিষ্ট সম্পর্কও সংঙ্গায়িত করেছে। কিন্তু এরপর, প্রথমে চার্চের অভ্যন্তরে ‘মহাবিচ্ছেদ’ (the Great Schism), তার জবাবে কনসিলিয়ার আন্দোলন (conciliar movement) এবং অবশেষে নবজাগরণ (Renaissance; রেনেসাঁ) – রিফর্মেশনের আবির্ভাব নিশ্চিত করে। এর ফলে খ্রিস্টধর্মের ঐক্য এবং পোপকে ঘিরে গড়ে ওঠা প্রশাসনের পুঁথিগত তত্ত্ব – দুয়েরই জলাঞ্জলি হল। রেনেসাঁ-য় যতই নতুন জ্ঞানের দরজা খুললো—তা সে অতীতের পুনরাবিষ্কারই হোক, বা জাগতিক নতুন আবিষ্কার—ততই তখনকার মানুষের চোখে এইসব রীতিনীতি-র বাড়াবাড়ি – কাঠামো কম, শেকল বলে বেশি ঠাওর হল। টলেমি (Ptolemy)-র মহাবিশ্বে পৃথিবীর—এবং মানবজাতির—গর্বিত অবস্থান ছিল কেন্দ্রে; তুলনায় কোপার্নিকাস (Copernicus)-এর পৃথিবী এবং মানুষ, কেন্দ্র থেকে সরে অপেক্ষাকৃত সাধারণ এক অবস্থানে এল। যুক্তিতর্ক, বিশ্লেষণ, প্রণালীবদ্ধকরণ – এরকম যা যা কিছু থেকে বুদ্ধিমানেরা আনন্দের খোরাক পেতো, তাদের জায়গা নিল – নতুন আবিষ্কারের আনন্দ। রেনেসাঁ-র শিল্প যদিও নিয়মে বাঁধা ছিল, চিন্তার জগতে কিন্তু তার বেজায় পছন্দ ছিল বিশৃঙ্খলা—ফলপ্রসূ বেনিয়ম। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে, মন্টেনিয় (Michel de Montaigne) এই যুগের দার্শনিকদের সেরা নজির।
শিল্প বাদে অন্য সব বিষয়েই শৃঙ্খলা তার সিংহাসন হারায়। স্বভাবতই, রাজনীতিও রক্ষা পায়নি। মধ্যযুগে আইনের প্রয়োগ যতই উচ্ছৃঙ্খল হোক না কেন, মননে সে ছিল নীতির নিগড়ে বাঁধা, রাজনৈতিক ক্ষমতার এক নিরেট তত্ত্বে বিশ্বাসী। কী তত্ত্ব? সমস্ত ক্ষমতার চূড়ান্ত উৎস – ঈশ্বর। ঈশ্বর নিজেই তাঁর হয়ে সমস্ত ধর্মীয়, পবিত্র বিষয়ে দেখভালের ভার পোপকে দিয়েছেন আর ধর্মনিরপেক্ষ সব বিষয়ের জন্যে সম্রাটকে নিয়োগ করেছেন। মুশকিল হল, পঞ্চদশ শতকে, একইসঙ্গে পোপ এবং সম্রাট জনমানসে তাঁদের উচ্চাসন হারালেন। ইতালির যে সব রাজপুরুষ, রাজনৈতিক ক্ষমতাদখলের বিচ্ছিরি প্যাঁচালো খেলায় নির্লজ্জ অংশগ্রহণ করেন – তাঁদের সঙ্গে পোপের আর কোনো পার্থক্য রইলো না। ফ্রান্স, স্পেন ও ইংল্যান্ডে গড়ে ওঠা নতুন রাষ্ট্রভিত্তিক রাজবংশগুলি তাদের নিজেদের দেশে কী করবে—তা নিয়ে পোপ বা সম্রাটের আর বিশেষ কিছু বলার থাকলো না। বারুদের আবিষ্কারের সঙ্গেসঙ্গেই, মানুষের মননে, আবেগে, দেশাত্মবোধ এমন এক জায়গা করে নিল—যা আগে কখনো হয়নি। ব্যস, পৃথিবীব্যাপী ঐক্যবদ্ধ সভ্যতার যে স্বপ্ন রোমানরা দেখেছিলেন, তারও শেষের শুরু হল।
মেকিয়াভেলি-র প্রিন্স (Prince) বইটিতে এই রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলারই ছায়া পড়েছে। কোনোরকমের আদর্শ না থাকায়, রাজনীতি আর ক্ষমতাদখলের নগ্ন প্রতিযোগিতার মধ্যে কোনো ফারাক আর ছিল না; সে খেলায় জিততে গেলে কী করা উচিত – তা নিয়েই নানা কূট পরামর্শ দিয়েছে 'প্রিন্স'। গ্রিসের স্বর্ণযুগে যা হয়েছিল, তার পুনরাভিনয় হল রেনেসাঁ-র ইতালিতে – প্রথা আর ঐতিহ্যের সঙ্গে কুসংস্কারকে এক দৃষ্টিতে দেখা হল; নীতিপুলিশ অন্তর্হিত হল; শৃঙ্খলমুক্ত ব্যক্তি-মানুষের উদ্দীপনা, সৃষ্টিশীলতা – সবই প্রত্যাশা ছাড়ানোর ফলে এক উজ্জ্বল প্রতিভার বিচ্ছুরণ দেখা গেল ঠিকই, কিন্তু নীতিবঞ্চিত এই সমাজে ক্রমবর্ধমান নৈরাজ্য ও ঠগবাজির ফলে জাতিগতভাবে ইতালির পতন হল। ঠিক গ্রিকদের মতোই, ইতালির দখল নিল তুলনামূলকভাবে কম সভ্য, কিন্তু সামাজিকভাবে বেশি সংহত জাতিগোষ্ঠীরা। ইতালির অবস্থা যদিও গ্রিসের মতো অতটা খারাপ হয়নি। কারণ, স্পেন বাদে, এই নব-ক্ষমতাশালী দেশগুলি সকলেই দেখাল, যে, সুযোগ পেলে তারাও ইতালির সমান কৃতিত্ব অর্জনের অধিকারী।
ষোড়শ শতক থেকে ইউরোপের চিন্তাজগতের ইতিহাস শাসন করেছে ‘রিফর্মেশন’। রিফর্মেশন এক জটিল, বহুমুখী আন্দোলন আর তার সাফল্যের পিছনের কারণও অনেক। এককথায়, রোমের নতুন করে পাওয়া আধিপত্যের বিরুদ্ধে উত্তরের দেশগুলির বিদ্রোহই আসলে রিফর্মেশন। এই দেশগুলিকে যে শক্তি অতীতে বশীভূত করেছিল, তা ছিল ধর্ম, কিন্তু এতদিনে রোমে ধর্মের অবক্ষয় ঘটে গেছে—পোপ ও তাঁর দলবল এক প্রতিষ্ঠানমাত্র হয়ে থেকে গেছেন, বছর বছর জার্মানি ও ইংল্যান্ড থেকে মোটা অঙ্কের নজ়রানাও তাঁরা জোগাড় করেন। এই দেশগুলির নৃপতিকুল ধর্মপ্রাণ, কিন্তু ইতালির বোর্জিয়া (Borgias) আর মেদিচি (Medicis)-দের প্রতি কোনোরকম ভক্তিই আর তাদের অবশিষ্ট ছিল না। এরা অর্থের বিনিময়ে মানুষকে নরক (purgatory)-বাস থেকে বাঁচানোর প্রতিশ্রুতি দিত, আর তারপর সেই অর্থ বিলাসে, ব্যভিচারে ব্যয় করতো। রাষ্ট্রীয়, অর্থনৈতিক, নৈতিক – এই তিন উদ্দেশ্যের ত্র্যহস্পর্শেই রোমের বিরুদ্ধে এই বিদ্রোহ জোর পেয়েছিল। তার ওপর, এইসব দেশের রাজন্যবর্গ বুঝতে পেরেছিল – তাদের নিজেদের দেশে চার্চকে সীমাবদ্ধ রাখতে পারলে তার ওপর ছড়ি ঘোরানোর ক্ষমতাও তাদের হাতেই থাকবে, ফলে সুদূর রোমের পোপের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগ করে নেওয়ার আর প্রয়োজন হবে না। ধর্মতত্ত্বের যেসব মেরামতির প্রস্তাব লুথার (Martin Luther) এনেছিলেন, সেগুলো এই কারণেই উত্তরের দেশগুলির বৃহত্তর অংশের রাজা-প্রজা – সবার কাছে সমান গ্রহণযোগ্য হয়েছিল।
ক্যাথলিক চার্চের উৎস ত্রিবিধ: এর পবিত্র ইতিহাস ইহুদি, ধর্মতত্ত্ব গ্রিক, আর আইনকানুন, প্রশাসন—আংশিক হলেও—রোমান। রোমান মশলাটুকু রিফর্মেশন বর্জন করেছিল, গ্রিক উপাদানগুলিতে মিশিয়েছিল জল আর ইহুদি উপাদানগুলির খুঁটি ভালোরকম শক্ত করেছিল। প্রথমে রোমান সাম্রাজ্য আর পরে রোমান চার্চের মূল অবদান ছিল সামাজিক সংহতি। যেসব রাষ্ট্রীয় শক্তি এই সংহতির পুনর্নবীকরণের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল, তাদের সঙ্গে স্বভাবতই রিফর্মেশন সহযোগিতা করছিল। ক্যাথলিক মতে – মানুষের সঙ্গে ঈশ্বরের দৈব সম্পর্ক শুধু শাস্ত্রবচনেই সীমাবদ্ধ নয়; যুগ-যুগান্তর ধরে চার্চের কার্যকলাপ, নির্দেশের মাধ্যমেও তার প্রকাশ হয়। অতএব, ব্যক্তির চেতনা সর্বদাই চার্চের অনুমোদনের অধীন। উলটোদিকে প্রোটেস্টান্টরা, অবিনশ্বর আত্মা আর ঈশ্বরের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে চার্চকে সম্পূর্ণ খারিজ করলো; তাদের দাবি – একমাত্র বাইবেলই ঈশ্বরের বাণী, আর তার অর্থ অনুধাবনের অধিকার প্রতিটি মানুষের পৃথক; নেহাতই যদি সেই আসমানী কিতাবের অর্থ নিয়ে গোল বাধে, তার নিষ্পত্তি করতে পারে—এমন কোনো প্রতিষ্ঠান প্রোটেস্টান্ট তত্ত্বে নেই। যদিও বাস্তবে চার্চের শূন্যস্থান পূরণ করেছিল রাষ্ট্র—তত্ত্বের দিক থেকে সে ছিল নেহাতই জবরদখল।
এ এক বিরাট বদল – সত্যানুসন্ধানের জন্যে আর কোনো প্রতিষ্ঠানের দ্বারস্থ হতে হবে না, বরং নিজের অন্তরে ডুব দিতে হবে। ফলত, রাজনীতিতে নৈরাজ্যের আর ধর্মে অতীন্দ্রিয়বাদের (mysticism; সনাতনী ক্যাথলিক মতবাদের সঙ্গে এর আগে যা কখনোই খাপ খায়নি) দিকে ঝোঁকার একটা স্পষ্ট লক্ষণ দেখা গেল। মাত্র একখানা প্রোটেস্টান্ট গোষ্ঠী নয়, গাদাখানেক সম্প্রদায় তৈরি হল এইসময়; শাস্ত্রমুখো পাণ্ডিত্যের বিরুদ্ধে একটি নয়, প্রায় যতজন দার্শনিক—ততগুলিই দর্শন তৈরি হল; ত্রয়োদশ শতকের মতো, পোপের বিরুদ্ধাচরণকারী একখানা সম্রাট নয়, দেখা দিল অনেকগুলি বিধর্মী রাজা। সাহিত্যের মতো চিন্তার জগতেও, আত্মবাদ (subjectivism; সাব্জেক্টিভিজ়ম)-এর গুরুত্ব বাড়ছিল – প্রাথমিকভাবে চিন্তার দাসত্ব থেকে মুক্তির পথ হিসেবে এর প্রভাব শুভ হলেও, ব্যক্তিকে ক্রমাগত সমাজ-বিচ্ছিন্ন করার ফলে আদতে এর প্রভাবে সমাজ মোটের ওপর অপ্রকৃতিস্থই হয়।
আধুনিক দর্শন শুরু হয় দেকার্তে (Descartes)-কে দিয়ে। তিনি কেবল তাঁর নিজের অস্তিত্ব ও নিজের চিন্তা নিয়েই নিঃসন্দেহ, সেখান থেকেই বাকি গোটা জগতের অস্তিত্ব অনুমান করতে হবে। এ তো কেবল শুরু। এরপর বার্কলি (Berkeley) আর কান্ট (Kant) হয়ে ব্যাপার গড়াবে ফিশ্টা (Fichte) অবধি, যাঁর মতে—গোটা দুনিয়াই আসলে আমাদের অহংয়েরই একরকম বহিঃপ্রকাশ। সেইসময় থেকেই, একদিকে এই অপ্রকৃতিস্থ মতবাদ আর অন্যদিকে দৈনন্দিন কাণ্ডজ্ঞান – এ দুইয়ের মধ্যে দর্শন আজও দোদুল্যমান।
দর্শনের জগতে সাবজেক্টিভিজ়ম আর রাজনীতির জগতে নৈরাজ্যবাদ হাত ধরাধরি করে চলে। লুথারের জীবদ্দশাতেই, তাঁর কিছু অবাঞ্ছিত ও অস্বীকৃত ছাত্র তৈরি করলেন অ্যানাব্যাপ্টিজ়ম (Anabaptism), যা মুন্সটার (Münster) শহরে বহুদিন আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছিল। এদের মতে – একজন ভালো মানুষ, সর্বদাই পবিত্র সত্ত্বা (Holy Spirit; হোলি স্পিরিট)-র নির্দেশ অনুসারে জীবনযাপন করেন। হোলি স্পিরিটকে যেহেতু কোনো ফর্মুলায় ফেলা চলে না, তাই এঁরা আইনকানুনকেই ত্যাগ করলেন। এই পূর্বশর্ত থেকে শুরু করে এঁরা পৌঁছলেন সাম্যবাদ (communism; কমিউনিজ়ম) আর বন্ধনহীন যৌনতায়। অতএব, বীরের মতো প্রতিরোধ গড়ে তোলার পরও তাঁদের একসময় নির্মূল করা হল। অ্যানাব্যাপ্টিস্টরা নির্মূল হলেও, তাঁদের চিন্তাধারা—কিছুটা নতুন চেহারায়—হল্যান্ড, ইংল্যান্ড ও আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়ে। ঐতিহাসিকভাবে কোয়েকার মতের (Quakerism) উৎস এরাই। ঊনবিংশ শতকে নৈরাজ্যবাদের আরেক তেজিয়ান সংস্করণ মাথাচাড়া দিল, যার সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই। রাশিয়া, স্পেন, আর অল্প হলেও, ইতালিতে এই মতবাদ বেশ সফল হল, যেজন্যে আজও আমেরিকান ইমিগ্রেশনের এরা মাথাব্যথার কারণ। এই আধুনিক মতবাদটি ধর্মের বিরোধী হলেও, এর মধ্যে এখনো প্রোটেস্টানিজ়মের গোড়ার দিকের আঁচ স্পষ্ট, পার্থক্য শুধু এইটুকু, যে, লুথার যে ঝাঁঝ পোপের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করেছিলেন, তা আজ তারা ধর্মনিরপেক্ষ সরকারের জন্যে বরাদ্দ রেখেছে।
সাব্জেক্টিভিটির ঘোড়া একবার ছোটালে, দম না ফুরোনো অবধি তার আর লাগাম টানা যায় না। ব্যক্তির বিবেকের ওপর প্রোটেস্টান্টরা যে গুরুত্ব চাপিয়েছিল, নৈতিকভাবে তা মূলত নৈরাজ্যবাদী। কিন্তু অভ্যাস আর পরম্পরার শেকড় এত গভীরে চারানো, যে, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যে দীক্ষিতরাও (মুন্সটার-এর মতো কিছু বিক্ষিপ্ত উদাহরণ ছাড়া), চেনাজানা ধর্মভীরুদের মতোই আচরণ করতেন। তবে এ বড়ই বিপজ্জনক সাম্যাবস্থা ছিল। অষ্টাদশ শতকের ‘সংবেদনশীল’ ধর্মসম্প্রদায় (Cult; কাল্ট)-টি এ ভারসাম্য নষ্ট করতে শুরু করে: কোনো কাজ, কোনো নীতিশাস্ত্র মেনে করা হোক বা না হোক, তার ফলাফল শুভ হোক চাই না হোক—যে আবেগ থেকে সেই কাজটি করা হয়েছে, তার ওপর ভিত্তি করে তার ভালো-মন্দ বিচার হত। এই মনোভাব থেকেই, কার্লাইল (Carlyle) ও নিচা (Nietzsche) বর্ণিত নায়ক-পূজনের কাল্ট (the cult of hero) ও পরে তীব্র আবেগ-উচ্ছ্বাসের (সে আবেগের বিষয় যা-ই হোক) বায়রন-ধর্মী কাল্ট (Byronic cult) তৈরি হয়।
শিল্প, সাহিত্য, রাজনীতিতে যে রোমান্টিক আন্দোলন শুরু হয়েছিল—তার সঙ্গে মানুষকে সাব্জেক্টিভভাবে বিচার করার এই মনোভাব ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে – মানুষ আর কোনো সমাজের অংশমাত্র নয়, নান্দনিক সৌন্দর্যের পরাকাষ্ঠা, অনুধ্যানের বিষয়। বাঘমহাশয় নিশ্চয়ই ভেড়ার থেকে অনেক বেশি সুন্দর, কিন্তু তবু তার সৌন্দর্য আমরা খাঁচার গরাদের ওপার থেকেই উপভোগ করি। একজন গড়পড়তা রোমান্টিককে সুযোগ দিলে, সে গরাদ-টরাদ সরিয়ে—কী অনবদ্য লাফ দিয়ে বাঘটি ভেড়ার ঘাড় মটকালো—দেখে আনন্দ নেবে। এরা মানুষকে, নিজেকে বাঘ কল্পনা করার পরামর্শ দেয়—সে পরামর্শ যখন সত্যিই মানা হয়, তার ফলাফল আর খুব একটা সুখকর হয় না।
সাব্জেক্টিভিজ়মের এই চূড়ান্ত চেহারার জবাবে বেশ কিছু মতবাদ বর্তমানকালে তৈরি হয়েছে। প্রথমটি হল এক আদ্ধেক আপোসের দর্শন—উদারনীতি—যা সরকার ও ব্যক্তিকে নিজ নিজ বলয়ে সীমাবদ্ধ থাকার কথা বলে। এর শুরু হয়েছিল লক (Locke)-এর থেকে, যিনি অ্যানাব্যাপ্টিস্টদের স্বাতন্ত্র্যের ধারণা (enthusiasm; এন্থুসিয়াজ়ম) বা ঐতিহ্যের কাছে পূর্ণ নতিস্বীকার – দুইয়েরই সমান বিরোধী ছিলেন। অন্য এক বড়সড় বিদ্রোহী মতবাদে, রাষ্ট্রকে সেই আসন দেওয়া হল, যা ক্যাথলিকরা চার্চকে—বা মতান্তরে ঈশ্বরকেই—দিত। এই তত্ত্বের বিভিন্ন ধরনের প্রতিনিধি ছিলেন – হবস (Hobbes), রুশো (Rousseau) বা হেগেল (Hegel)। সত্যি বলতে, ক্রমওয়েল, নেপোলিয়ন বা আধুনিক জার্মানি, এঁদের মতবাদকেই কার্যত শিরোধার্য করেছে। কম্যুনিজ়মের সঙ্গে তত্ত্বগতভাবে এই ‘রাষ্ট্রপূজা’-র কোনো মিল না থাকলেও, বাস্তবে তা এমন এক সমাজের দিকে চালিত হয়, যা আসলে রাষ্ট্রপূজারই আরেক ধরন।
৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে বর্তমান কাল অবধি এই দীর্ঘ অগ্রগতির সময়জুড়ে দার্শনিকরা স্পষ্টত দুটি দলে বিভক্ত – যাঁরা সামাজিক বাঁধন আরো শক্ত করতে চান আর যাঁরা তা আরো আলগা করার পক্ষে। এই পার্থক্যটুকু একমাত্র নয়, তার সঙ্গে জুড়েছে আরও নানা মতামত। শৃঙ্খলাপন্থীরা সবসময়েই আধুনিক বা পুরোনো কোনো এক ধরনের ডগমা-কে সমর্থন করেছেন, আর যেহেতু সেই ডগমা-র কোনো পরীক্ষামূলক প্রমাণ থাকতে পারে না, তাই তাঁরা সকলেই কমবেশি বিজ্ঞানের বিরোধিতা করতে বাধ্য হয়েছেন। প্রায় কোনো ব্যতিক্রম ছাড়াই, তাঁরা শিখিয়েছেন, যে আনন্দ নয়, ‘মহত্ত্ব’ বা ‘বীরত্ব’-ই আসলে শুভ। মানবচরিত্রের অযৌক্তিক দিকগুলির প্রতি তাঁদের সহানুভূতির কারণ, তাঁরা সকলেই সামাজিক সংহতিকে কিছুটা সন্দেহের চোখে দেখেন। অপরপক্ষে, চূড়ান্ত নৈরাজ্যবাদীদের বাদ দিলে, স্বাধীনতাপন্থীরা (libertarians) সাধারণত বিজ্ঞানমনস্ক, হিতবাদী (utilitarian), যুক্তিবাদী, অহৈতুকী আবেগের বিরোধী আর প্রায় সব প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মমতের শত্রু। প্রথাগত দর্শনের জন্মকালের আগেও, প্রাচীন গ্রিসে এই বিভাগ দেখা যেত আর সেসময়ের চিন্তাভাবনায় এই ভাগ একেবারে পরিষ্কার। অনেক রূপবদলের পরেও, আজকের যুগেও এই বিভাগ স্পষ্ট—আসন্ন বহু যুগ ধরেও তা-ই থাকবে আশা করা যায়।
যেকোনো দীর্ঘ সময় ধরে চলা বিবাদের ক্ষেত্রে যা হয়—এই বিষয়েও তার ব্যতিক্রম হয়নি—এই দুই পক্ষের উভয়েই অংশত ঠিক, অংশত ভুল। সামাজিক সংহতি এক অত্যাবশ্যক ব্যাপার আর ইতিহাসে আজ অবধি কখনো নিছক যুক্তিতর্কের মাধ্যমে তা স্থাপন করা সম্ভব হয়নি। প্রতিটি জনগোষ্ঠী এক শাঁখের করাতের মধ্যে বাস করে – একদিকে যেমন পরম্পরা আর অনুশাসনের রক্ষণশীল প্রেমে মত্ত হয়ে স্থবির, প্রগতি-রুদ্ধ হয়ে যাওয়ার ভয়, অন্যদিকে তেমনই, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের বাড়াবাড়ি সামাজিক সহযোগিতার অন্তরায় হয়ে দাঁড়ানোর ফলে, হয় সমাজের অবক্ষয়, নয়তো বহিরাগত শত্রুর অধীনস্থ হওয়ার ভয়। যেকোনো মহান সভ্যতার ইতিহাস শুরু হয় এক কঠোর, কুসংস্কারাচ্ছন্ন অধ্যায়ে, যার পরে আসে এক উজ্জ্বল প্রতিভাময় সময়, যখন পুরাতন ঐতিহ্যের ভালোটুকু টিকে থাকে, আর অবক্ষয়ের বিষ মাথাচাড়া দিতে দেরি থাকে। তারপর, যত সেই বিষ ছড়ায়, আসে নৈরাজ্য, আর তারপর—অবশ্যম্ভাবী স্বৈরশাসন। এরপর আসে নতুন যুগ, পুরাতনের সঙ্গে সংশ্লেষে তৈরি হয় নতুন ডগমা। এই অনন্ত দোদুল্যমানতা থেকে মুক্তি পাওয়ার এক চেষ্টারই নাম উদারনীতি। এর মূল কথা হল – অযৌক্তিক ডগমার বশ না মেনেও সামাজিক সংহতি অর্জন করার আর প্রয়োজনাতিরিক্ত নিয়মের পাশে সমাজকে না বাঁধার চেষ্টা। এ চেষ্টা ফলপ্রসূ হবে কিনা, তা কেবল ভবিষ্যতই বলতে পারে।
— বার্ট্রান্ড রাসেল
A History of Western Philosophy বইটির ভূমিকার প্যালারাম-কৃত অনুবাদ
টীকা-টিপ্পনীর ব্র্যাকেটের মধ্যে অক্ষর থাকলে তা রাসেলের আসল ফুটনোট, সংখ্যা থাকলে তা অনুবাদকের পাকামো।