এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  প্রবন্ধ

  • ইতিহাসের তথ্য বিকৃতি এবং মিথ নির্মাণ

    Ranjan Roy লেখকের গ্রাহক হোন
    প্রবন্ধ | ২৬ অক্টোবর ২০২৫ | ৫৮ বার পঠিত
  •  ইতিহাসের তথ্য বিকৃতি এবং মিথ নির্মাণ

    সমসাময়িক ভারতে দুটো জিনিস বড্ড চোখে পড়ছে—রাজনৈতিক প্রয়োজনে ধর্ম ও ইতিহাসের ব্যবহার। যেহেতু বিশেষ প্রয়োজনে ব্যবহার, তাই দর্জির জামা সেলাইয়ের মত কাটছাঁট এবং ডিজাইন করা হচ্ছে। এর ফলে যা হচ্ছে সেটা হল তথ্যের বিকৃতি।
     
    বিকৃতি ঘটছে দু’ভাবে।

    এক, যা ঘটেনি তাকে ঘটেছে বলে দাবি করা। কোন তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই, বা যাচাই না করে সন্দেহজনক সূত্র থেকে উদ্ধৃতি দেয়া।
    দুই, অতিকথন বা মিথনির্মাণ। যতটুকু ঘটেছে সেটাকে তার প্রেক্ষিত থেকে বিচ্ছিন্ন করে বলা যাতে অর্থের অনর্থ ঘটে। এবং ঘটনাটির গুরুত্ব বা ওজন অনেক বাড়িয়ে বলা।
     
     
    আমার প্রতিপাদ্য বিষয় হল দুটো।
     
    এক, এগুলো আকস্মিক কোন ঘটনা বা ভুল নয়, বরং সুপরিকল্পিত ভাবে একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পা ফেলা।

    দুই, এই ইতিহাসের এই কথিত সংশোধন আসলে সাভারকরের গত শতাব্দীর লিখিত নির্দেশের অনুপালন মাত্র।
    প্রথমে আমরা দ্বিতীয় বিন্দুটি—ইতিহাসের পুনর্লিখনে সাভারকরের নির্দেশ নিয়ে কথা বলব।
     
    সাভারকরের ‘মেড টু অর্ডার হিস্ট্রি’[1]
    সাভারকরের রচনাবলীর সম্পাদকেরা তাঁকে ‘হিন্দু রাষ্ট্রপতি সাভারকর’ বলে অভিহিত করেছেন[2]। 
     
    উনি তাঁর “হিন্দু সংগঠনকর্তা নিজের রাষ্ট্রের ইতিহাস কীভাবে লিখবে ও পড়বে” প্রবন্ধে নির্দেশ দিচ্ছেন “ আমাদের  ইতিহাসকে এমন কিছু খন্ডে ভাগ করতে হবে যাতে পাঠক সহজেই হিন্দু জাতির ঐক্য, তার বিস্তার, সম্মান, এবং প্রভাব কীভাবে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেল সেটা বুঝতে পারে”।
     
    আরও আছে, “ যে মুহুর্তে আমরা ইতিহাসের বই হাতে নেই তক্ষুণি যেন আমাদের মনে এই আবেগ জেগে ওঠে যে এটা অখিল হিন্দু জাতির ইতিহাস। ---- ছোট ছোট রাজ্যগুলো মিলে শুধু একত্র হয় নি, বরং এক জীবন হয়েছে এবং একটি “হিন্দু রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে”[3]। 
     
    উনি মানছেন যে  নিশ্চয়ই সব দেশের মত এখানেও বিভিন্ন রাজা ও রাজ্যের মধ্যে সংঘর্ষ , যুদ্ধ ইত্যাদি হয়েছিল। কিন্তু সেসব ঘেঁটে কী লাভ? কেবল কবর খুঁড়ে মৃতদেহ তুলে আনা!
    আবার একই সঙ্গে বলছেন—ইতিহাস লেখন সত্য হতে হবে। সে যতই অপ্রীতিকর হোক, বা বর্তমান পরিস্থিতির উপর তার প্রভাব যাই হোক!
     
    কিন্তু এটা একটা বিচ্ছিন্ন আপ্তবাক্য মাত্র। সাভারকরের গোটা ইতিহাসচর্চা এর বিপরীত।
    সাভারকরের শেষ জীবনে লেখা Six Glorious Epochs of Indian History থেকে দুটো উদাহরণ দিলে ওঁর ইতিহাসের পুনর্নির্মাণ প্রোজেক্টের প্রেক্ষিত স্পষ্ট হবে।

     দুটো ঐতিহাসিক চরিত্র—চাণক্য এবং শিবাজী। এঁদের যুদ্ধে নামার পেছনে কোন ঘটনা পলতেয় আগুন লাগার মত কাজ করেছিল?
     
    এক,
    আমরা উপলব্ধ লোকগাথা , গ্রন্থ এবং দস্তাবেজ থেকে জানি যে মহাপদ্মনন্দ তাঁর দরবার থেকে প্রৌঢ় চাণক্যকে অপমান করে বের করে দিলে চাণক্য প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে তিনি এই শিখা মহাপদ্মনন্দের ধ্বংসের পর বাঁধবেন। চাণক্যের প্রচেষ্টায় নন্দবংশ ধ্বংস হয় এবং তাঁর শিষ্য চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য মগধ সাম্রাজ্যের ক্ষমতায় বসেন।

     কিন্তু সাভারকরের মতে এই ঘটনার এরকম বর্ণনা হলে জনমানস কী শিখবে? 
    নন্দবংশ ধ্বংসের পেছনে চাণক্যের ব্যক্তিগত অপমান প্রেরণার কাজ করেছিল?
     মহান হিন্দু সাম্রাজ্যস্থাপনের স্বপ্ন নয়?

    কাজেই বলতে হবে মহাপদ্মনন্দ টের পেয়েছিলেন যে চাণক্য ওঁকে ক্ষমতাচ্যুত করতে ষড়যন্ত্র করছেন।
     তাই তাঁকে অপমান করেন এবং চাণক্য শপথ  নেন যে ‘যদি আমি সত্যিকারের চাণক্য হই
     তবে তোমার স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের অন্ত হবে এবং ভারত এগিয়ে যাবে’।
     
    এর পক্ষে সাভারকরের যুক্তি এবং প্রমাণ হল কৌটিল্য অর্থশাস্ত্রের পাদটীকায় নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে লিখেছেন উনি নাকি ‘ভারতভূমি উদ্ধার’ এবং জাতীয় শস্ত্রবল’ ও জাতীয় প্রগতির জন্য নন্দবংশকে ধ্বংস করেছিলেন![4]

    কিন্তু অর্থশাস্ত্রের সবচেয়ে প্রামাণ্য ইংরেজি অনুবাদ দেখুন।
    “This Shastra has been made by him who from intolerance (of misrule)  quickly rescued the scriptures and the science of weapons and the earth which had passed to the Nanda King.” শ্লোক ৪৩১, অর্থশাস্ত্রের অন্তিম শ্লোক। [5]

    না। কোথাও সাভারকর কথিত “ভারতভূমি’  বা ‘জাতীয়’ শব্দদুটো নেই। এভাবেই সাভারকর নিজেদের মনের মাধুরী মিশিয়ে ইতিহাসের পুনর্লিখন করে থাকেন।

    দুই, সাভারকরের এই ‘মেড টু অর্ডার’ ইতিহাসের পুনর্লিখনের পক্ষে যুক্তি হল নইলে ঔরংজেবের দরবারে মনসবদার হতে হাজির শিবাজীর ব্যক্তিগত অপমানকেই ওঁর ঔরংজেব এবং মুঘল সাম্রাজ্য ধ্বংসের পেছনে চালিকা শক্তি বলে মেনে নিতে হয়।
     
    অথচ যদুনাথ সরকার তাঁর "শিবাজী অ্যান্ড হিজ টাইমস," গ্রন্থে  বলছেনঃ
     শিবাজী নিজে পুরন্দর দুর্গের যুদ্ধে মোগল সেনাপতি জয় সিংহের কাছে পরাজিত হয়ে শর্ত মেনে মোগল পক্ষে যোগ দিয়ে বড় ছেলে এবং কিছু নজরানা নিয়ে ঔরংজেবের দরবারে হাজির হন। 
    কিন্তু অপেক্ষাকৃত সম্মান না পেয়ে দরবার ছেড়ে চলে আসেন, এবং কিছুদিন পরে প্রাণদণ্ডের আশংকায়  পালিয়ে বিজাপুরে চলে আসেন। 
    সেই বিদ্রোহের শুরু। শিবাজী মোগলদের বিরুদ্ধে অনেকবার বিজাপুরের সুলতানের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। [6]
    সাভারকরের মতে এধরণের ইতিহাস লিখন হল ‘perverted’! [7]

    এই ধরণের যুক্তি-পরম্পরায় চলতে চলতে সাভারকর আশ্রয় নেন “ভবিষ্যপুরাণে”—যার প্রতিসর্গ পর্বে কলিযুগে একদিন ভারতবর্ষে মহারাণী ভিক্টোরিয়ার শাসন হবে, নগরীর নাম দেহলি ও কলিকাতা হবে এমন ভবিষ্যবাণীও আছে![8]

    আরও দেখুনঃ
    ‘রবিবারে চ সন্ডে চ ফাল্গুনে চৈব ফর্বরী।
    ষষ্টিশ্চ সিক্সটি জ্ঞেয়া তদুদাহারমীদৃশম্‌’।।( প্রতিসর্গ পর্ব, ৫ম ভাগ, ৩৭)।
    অর্থাৎ ম্লেচ্ছদের ভাষায় রবিবার হয় ‘সানডে’, ফাল্গুন হয় ‘ফেব্রুয়ারি’ এবং ষষ্টি বা ষাট হয় ‘সিক্সটি’। এসব নাকি বেদব্যাস ৫০০০ বর্ষ আগে দিব্যদৃষ্টিতে দেখে লিখে গেছেন।
     
    এই ধারার ইতিহাসের পুনর্লিখনে বিকৃত হচ্ছে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস এবং পাঠ্যবই থেকে মুঘল যুগকে মুছে ফেলা।  
    আকবর নাকি কোন সেকুলার ধর্মপ্রচার করেন নি। দ্বীন -ই -ইলাহী কোন সমন্বয়বাদী ধর্মদর্শন নয়।
     
    ইতিহাসবিদ যদুনাথ সরকার তাঁর ‘Shivaji and His Times’ বইয়ে শিবাজীর জিজিয়া করের বিরুদ্ধে লেখা দীর্ঘ প্রতিবাদী পত্রের ইংরেজি অনুবাদ পুরো প্রকাশ করেছেন। তাতে দেখছি শিবাজী স্বয়ং আকবরকে উদারচেতা সমন্বয়বাদী এবং “বিশ্ববন্দিত” বলে সার্টিফিকেট দিচ্ছেন!

    মহামহিম বিবেচনা করে দেখুন, সাম্রাজ্যের ভিত গেড়েছেন জালালুদ্দিন আকবর পাদশাহ। তিনি ৫২ চান্দ্র বছর পর্য্যন্ত পূর্ণ বিক্রমে রাজত্ব করে গেছেন। উনি সমস্ত ধার্মিক সম্প্রদায়ের জন্যে——সর্বধর্মসমন্বয়ের প্রশংসনীয় নীতি গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর উদার-হৃদয়ের লক্ষ্য ছিল সমস্ত মানুষের আদর এবং সুরক্ষা। তাই তিনি “জগতগুরু” নামে (বিশ্বের আধ্যাত্মিক গুরু) প্রসিদ্ধ হয়েছিলেন”। 
     
    কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে –ওঁরা তো ইতিহাস-পুরুষ। ওঁদের কি ভুল নেই?
     যদি থাকে, সেগুলো নিয়ে বলা  যাবে না? তাঁদের ভূমিকার পুনর্মূল্যায়ন করা যাবে না?
    নিশ্চয়ই যাবে এবং করা উচিত। 
    কিন্তু  সময়ের পরিবর্তনে নতুন তথ্যের আলোকে সেই মূল্যায়ন হওয়া উচিত, না কি গুজব, এবং ভুল তথ্যের ভিত্তিতে।
     
     
    দ্বিতীয় ভাগ
    এইভাবেই দুটো কাজ একসঙ্গে হচ্ছে-- সাভারকরের বীরত্ব নিয়ে অনেক মিথ ও গল্পকথা প্রচার করা। 
    এবং এর বিপরীতে গান্ধীজি ও নেহরুকে ভীরু, ইংরেজ ও মুসলিমদের স্বার্থরক্ষাকারী প্রতিপন্ন করা। 
    আর নেতাজি সুভাষচন্দ্রকে সাভারকরের অনুগামী এবং তাঁরই নির্দেশে গোপনে দেশত্যাগ করা ইত্যাদি প্রচার করা।
    আমরা এক এক করে কয়েকটি মিথের সত্যতা যাচাই করব।

    মিথ ১
    উনি নাকি ফ্রান্সের কাছে  উত্তাল সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ে সারারাত সাঁতার কেটে শেষে মার্সাই বন্দরে তীরে উঠে ধরা পড়ে যান। 
    অন্যদের কথা ছাড়ুন, প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী অটলবেহারী বাজপেয়ী সাভারকরের স্মরণসভায় বললেন—উনি স্বাধীনতার জন্যে ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্দ উত্তাল সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। অসীম সমুদ্রে ঢেউয়ের সঙ্গে পাঞ্জা কষার সাহস দেখিয়েছিলেন। [9]

    সত্যিটা কী?
    এস এস মোরিয়া স্টিমার, কোন বড় জাহাজ নয়,  সাভারকরকে নিয়ে ভারত আসার পথে মার্সাই বন্দরে ৭ জুলাই, ১৯১০ তারিখে কয়লা ভরার তাগিদে নোঙর গেড়ে জেটির পাশে দাঁড়িয়েছিল। 
    তীরের থেকে তার দূরত্ব ছিল দশ থেকে বারো ফুট। সাভারকরের প্রহরায় ছিল দুই বৃটিশ পুলিশ অফিসার এবং দু’জন ভারতীয় পুলিশের সেপাই।
    সকালবেলা কেবিনের পায়খানায় গিয়ে পোর্টহোল দিয়ে ঘষটে সমুদ্রে নেমে সাঁতার কেটে জেটিতে উঠে দৌড়তে থাকেন। সঙ্গের বৃটিশ পুলিশের দুই সেপাই টের পেয়ে চোর! চোর! বলে তাড়া করে। 
    সামনের ফ্রেঞ্চ পুলিশ জাপটে ধরে এবং সাভারকর ফের বন্দী হন। 
    জেটির পাশের স্থির জলে, পুলিশ রেকর্ড অনুযায়ী, তাঁকে আন্দাজ ৩২ ফুটের মত সাঁতরাতে হয়।[10]
     

     কতক্ষণ সাঁতরেছিলেন?  
    আন্দামান থেকে কোলকাতায় আলিপুর জেলে ফেরার পর জেলের প্রহরী কত রাত কত দিন সাঁতরে ছিলেন জানতে চাওয়ায় সাভারকর উত্তর দিলেন—আন্দাজ দশ মিনিট, তার বেশি নয়। [11] 
     
    অরুণ শোরি লিখছেন—দশ বারো ফুট সাঁতরাতে দশ মিনিটও লাগে না। আর জেটিতে তাড়া খেয়ে দৌড়তে হয়েছিল ২০০  গজ। কিন্তু এই কাহিনীটি সাভারকরের চিত্রগুপ্ত ছদ্মনামে লেখা ‘Life of Barrister Savarkar’ এ ফেলেফুঁপে দাঁড়ালো – দশজন বাছাবাছা সশস্ত্র অফিসার এবং শত শত ইউরোপীয় যাত্রী সাভারকরকে ঘিরে রেখেছিল।---- সাভারকর প্রাণ বাঁচাতে সাঁতার কাটছেন, এই ডুবছেন, এই ভেসে উঠছেন! তারপর তীরে উঠেও এক মাইলের মত দৌড়তে হল[12]
     

    মিথ ২
     লণ্ডনে আমিষ খাওয়া নিয়ে গান্ধীজিকে সাভারকরের ব্যঙ্গ
    সাভারকর জুলাই মাসের গোড়ায় ইণ্ডিয়া হাউসের বাসিন্দে হয়েছেন, তখন তিনি ২৩ বছরের আইনের ছাত্র। তাঁর সঙ্গে কি ৩৭ বছরের ওই  ব্যারিস্টারটির স্বল্প সময়ের মধ্যে কোন আলাপ পরিচয় হয়েহিল?
     
    বিক্রম সম্পত বলছেন যে দুজনের সাক্ষাতকার বা কথাবার্তার কোন রেকর্ড পাওয়া যায় নি, তবু তাঁর গ্রন্থে উনি  হরীন্দ্র শ্রীবাস্তবের সাম্প্রতিক লেখা থেকে একটি আখ্যান (anecdote) উদ্ধৃত  করেছেন[13]।  
    সাভারকর তখন রান্না করতে ব্যস্ত, একজন চিৎপাবন ব্রাহ্মণকে চিংড়িমাছ রান্না করতে দেখে গান্ধীজি বিচলিত হলেন এবং নিজে নিরামিষাশী হওয়ায় সেই রান্না খেতে পারবেন না বলে জানিয়ে দিলেন।

    সাভারকর তখন ব্যঙ্গ করে বললেন—বেশ, আমাদের সঙ্গে বসে যদি খেতে না পারেন তাহলে একসংগে কাজ করবেন কী করে! আর এটা তো সেদ্ধ মাছ, আমরা তো ব্রিটিশদের কাঁচা চিবিয়ে খেতে চাই[14]!
    মজার ব্যাপার হল, এ’নিয়ে সাভারকর কোথাও কিছু বলেন নি। অথচ, ভারতে হিন্দুত্ব রাজনীতির উত্থান নিয়ে কাটাছেঁড়া করা আরেকজন লেখক নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায়ও ওই প্রসঙ্গ তুলেছেন।[15] তাঁর তথ্যসূত্র হল  The Economist পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ[16]। কিন্তু সেই প্রবন্ধেও কোন সূত্র দেওয়া নেই।
     
    এ’ব্যাপারে গান্ধীজি নিজে কী বলছেন?
    উনি শংকররাও দেবকে লেখা একটি চিঠিতে স্পষ্ট করেছেন যে সাভারকরের সঙ্গে ওনার লন্ডনে একবারই দেখা হয়েছিল, সেটা ১৯০৯ সালে[17]
    কিন্তু সম্পত এবং হরীন্দ্র যে একজন বয়স্ক বিপ্লবী ঝাঁসিওয়ালে পণ্ডিত পরমানন্দের প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ানের উল্লেখ করছেন!
    খুঁটিয়ে দেখলে পাওয়া যাচ্ছে যে ঝাঁসিওয়ালে পণ্ডিত পরমানন্দ অনেক কমবয়েসি বিপ্লবী যিনি কখনই লণ্ডন যান নি।
    অথচ ওঁর নামে লণ্ডনে ১৯০৬ সালে কোন ঘটনায় প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ ছাপা হচ্ছে। এটা কী ধরণের ইতিহাস চর্চা সে বিচার পাঠকেরা করবেন।

     ইতিহাসের গবেষক ও সাভারকরের জীবনী লেখক বৈভব পুরন্দরে  বলছেন যে সাভারকরের সঙ্গে গান্ধীজির লণ্ডনে যে প্রথম এবং একমাত্র দেখা হয়েছিল সেটা অক্টোবর ১৯০৯ সালের বিজয়া দশমী উৎসবে লণ্ডনের বেইজওয়াটার এলাকায় নিজামুদ্দিন নামের ভারতীয় রেস্তোরাঁয় ভোজসভায় ।[18]

    সাভারকর সেই সময় পুণের ‘কাল’ পত্রিকায় (মারাঠি) পাঠানো ডেসপ্যাচে  ঘটনাটির উল্লেখ করে গান্ধীজি সম্বন্ধে বলেছিলেন—দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যারিস্টার নেতাটি একজন খাঁটি দেশভক্ত।[19]

    মিথ ৩
     সাভারকরের আশ্রয়ে লেনিন!
      বলা হয় সাভারকরের লণ্ডনে আইন পড়ার সময় লেনিন স্বয়ং ১৯০৯ সালের মার্চ মাসে ইন্ডিয়া হাউসে তিনদিন বা চারদিনের জন্যে শেল্টার নিয়েছিলেন এবং তাঁর সঙ্গে বিপ্লব নিয়ে আলোচনা করেছিলেন।
    সাভারকরের জীবন ও কাজের সাম্প্রতিক ব্যাখ্যাকার ইতিহাসবিদ বিক্রম সম্পত ও লেনিনের ইন্ডিয়া হাউসে এসে সাভারকরের সঙ্গে দেখা করার গল্পটি ফের আউড়ে দিলেন, কিন্তু কোন তথ্যসূত্র ছাড়াই। [20]  

    লেনিন তখন কোথায় ছিলেন?
    লেনিন ১৯০৮ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্য্যন্ত জেনেভায় বসে “Materialism & Empirio Criticism—Critical Comments on a Reactionary Philosophy” নামের দার্শনিক বিতর্কের বইটি লেখেন। তাতে পদার্থবিদ্যার দার্শনিক ব্যাখ্যা নিয়ে একটি অধ্যায় যোগ করার উদ্দেশ্যে নভেম্বরে লণ্ডন গিয়ে একমাস ব্রিটিশ মিউজিয়াম লাইব্রেরিতে পড়াশুনো করেন।
     
     তারপর ডিসেম্বরে প্যারিস গিয়ে এপ্রিল ১৯০৯ পর্য্যন্ত ওখানে বসে প্রুফ দেখেন। বইটি ১৯০৯ সালের মে মাসে রাশিয়ায় প্রকাশিত হয়।[21]
    তাহলে ১৯০৯ সালের মার্চ মাসে লেনিন ইন্ডিয়া হাউস যান কী করে?
     
    এছাড়া ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ এবং রাশিয়া বিশেষজ্ঞ ডঃ হেলেন র‍্যাপাপোর্টের লেখা থেকে জানতে পারছিঃ
     
    বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে জারের পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে লেনিনের দলের  নেতৃস্থানীয়রা অনেকেই লন্ডনে আসতেন। লেনিন ও তাঁর স্ত্রী নাদেঝদা স্ক্রুপস্কায়া ইস্ক্রা (স্ফুলিঙ্গ) পত্রিকা প্রকাশের জন্য ১৯০২ সালের এপ্রিল মাসে লণ্ডনে চলে আসেন।
    ১৯০৫ সালে লন্ডনে লেনিনের দলের তৃতীয় পার্টি কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। তখন লেনিন ১৬ পারসি সার্কাস ঠিকানায় যে বাড়িটায়  ভাড়াটে ছিলেন সেখানে এখনও একটি নীল ফলক লাগানো আছে।
    তৃতীয়বার লন্ডনে এলেন  ১৯০৭ সালে—১৩ মে থেকে ১ জুন।
    • চতুর্থবার, ১৯০৮ সালে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে পড়াশুনো করতে-- ১৬ মে থেকে ১০ জুন।
    • শেষবার, ১৯১১ সালে—৮ থেকে ২০ নভেম্বর।[22]
    বলতে চাইছি তখন লেনিনের দলের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আইনের ভারতীয় ছাত্র সাভারকরের থেকে অনেক বেশি। থাকার জায়গাও যথেষ্ট। ইন্ডিয়া হাউসে আশ্রয় নেবার কোন দরকারই ছিল না।
    সাভারকর নিজে কোনদিন এমন দাবি করেননি।

    মিথ ৪
    স্বাধীনতা আন্দোলনে মুসলমানেরা বিশেষ অংশগ্রহণ করেনি, কালাপানি যায় নি।  

    -সাভারকরের মতে ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ হল ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম মহাসংগ্রাম।   
    সিপাহী বিদ্রোহের পর প্রথম রাজবন্দীদের যখন আন্দামানে আনা হল (যাদের ৯০ প্রতিশত ছিলেন মুসলমান)- তখন সেলুলার জেল তৈরি হয়নি। ফলে খোলা জায়গায় রাখা হত। বন্দীদের চোখে এ ছিল দস্তুরমত কালাপানি।  রেকর্ড অনুযায়ী প্রায় ২৩৮ জন বন্দী এখান থেকে পালাতে চেষ্টা করে মার্চ ১৮৬৮ নাগাদ ধরা পড়ে এবং তাদের মধ্যে ৮৭ জনকে ফাঁসিকাঠে লটকে দেওয়া হয়
    আর ৮ ফেব্রুয়ারি, ১৮৭২ সালে আন্দামান পরিদর্শনের সময় ভারতের ভাইসরয় লর্ড মেয়োকে শের আলি নামের যাবজ্জীবন সাজা প্রাপ্ত কয়েদি ছুরির আঘাতে হত্যা করে ফাঁসিকাঠে ঝোলে। ঔপনিবেশিক ভারতে বড়লাট হত্যার এটাই একমাত্র ঘটনা।
     
    সাভারকরের প্রশংসক ইতিহাসবিদ ডঃ রমেশ চন্দ্র মজুমদারের মতেঃ
    সেলুলার জেল তৈরির আগে যে বিরাট সংখ্যক সিপাহী বিদ্রোহের বন্দীরা (১৮৫৭) আন্দামানে ছিলেন তাঁদের মধ্যে দুজন নেতা তাঁদের বিদ্যাবত্তা এবং উচ্চ নৈতিক চরিত্রের জন্য খ্যাতিমান—আলামা ফজলি হক খৈরাবাদী এবং মৌলানা লিয়াকত আলি। ওদের জীবন ওখানেই শেষ হয়ে যায়। আরেকজন –মীর জাফর আলি থানেশ্বরী—কুড়ি বছর আন্দামানেই ছিলেন[23]
     
    এছাড়া পরবর্তী সময়ে কাকোরি ষড়যন্ত্র মামলায় রামপ্রসাদ বিসমিল, রাজেন লাহিড়ীদের সঙ্গে আসফাকউল্লা খানেরও ফাঁসি হয়। 
     
    মিথ ৫
    সাভারকর কোন মার্জনা ভিক্ষা করে চিঠি লেখেন নি, অথবা লিখলেও সবাই যেমন লিখেছে তেমনই বাঁধাগতের টেমপ্লেটে লিখেছেন।
    --২০১৮ সালে মুম্বাইয়ের মারাঠি খবরের কাগজ লোকসত্তায়[24] লেখা হয় সাভারকর আদৌ কোন পিটিশন পাঠান নি, আর যদি পাঠিয়েও থাকেন, তাতে কোন মার্জনা ভিক্ষা (ask for clemency) করেন নি । এর দেড় দশক আগে, ওয়াই ডি ফড়কে লেখেন – মহান স্বাধীনতা সংগ্রামী সাভারকর কখনও ব্রিটিশ শাসকের সঙ্গে সহযোগিতা করেন নি[25]

    --কথাগুলো সত্যি নয়।  সাভারকর নিজেই অস্বীকার করেন নি। শুধু বলেছেন শিবাজী এবং শ্রীকৃষ্ণের মতন শাসকদের ধোঁকা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে ফের সংগ্রাম করার কথা। অন্যেরা এক বা দুই চিঠি লিখেছেন। সাভারকর ক’টি?
     
    এ নিয়ে অনেকে বলছেন ৬টি, কিন্তু  জীবনী লেখক বৈভব পুরন্দরে বলছেন ৭টি। পুরন্দরে তারিখগুলো নিয়েছেন সাভারকরের জেল হিস্ট্রি টিকেট থেকে। উনি যে তারিখগুলো দিয়েছেন সে হিসেবে দেখলে নীচের ছবিটা পাই।
    সাভারকর প্রথম পিটিশন লেখেন আন্দামানে আসার দু’মাসের মাথায়, ৩০ অগাস্ট ১৯১১ তারিখে। ওটা চারদিনের মাথায় খারিজ হয়ে যায়।
    দ্বিতীয় পিটিশন পাঠান চোদ্দমাস পরে, ২৯ অক্টোবর, ১৯১২ তারিখে। তাতে বলেন যে ওঁর আচার আচরণ এখন অনেক ভাল, কাজেই জেল থেকে ছেড়ে দেওয়ার কথা বিবেচনা করা হোক।

    তৃতীয় এবং চতুর্থ পিটিশন পাঠান হয় যথাক্রমে, নভেম্বর ১৯১৩ এবং সেপ্টেম্বর ১৯১৪ তারিখে। 
     
    তৃতীয়টি সাভারকর পোর্ট ব্লেয়ারে জেল পরিদর্শনে আসা  হোম সেক্রেটারি স্যার ক্র্যাডকের সঙ্গে দেখা করে হাতে দেন এবং  সাক্ষাতকারে নিজের চিন্তায় পরিবর্তনের কথা বলে সশস্ত্র বিপ্লবের ভুল পথ ছেড়ে সাংবিধানিক পথে সহযোগিতার রাজনীতি করার আশ্বাস দেন।

    সাভারকর ভাইসরয়ের কাছে মার্জনা চেয়ে পঞ্চম এবং ষষ্ঠ পিটিশন পাঠান ১৯১৫ এবং ১৯১৭ সালে।
    সপ্তম এবং শেষবারের মত আপিল করেন ৩০ মার্চ, ১৯২০ তারিখে।[26]

    মিথ ৬
    ভারতীয় রাজবন্দীদের মধ্যে সাভারকরকে সবচেয়ে বেশি সময় কালাপানিতে এবং ইংরেজের জেলে কাটাতে হয়েছে।
    ---এটাও সত্যি নয়। নিঃসন্দেহে দুই ইংরেজ রাজপুরুষের হত্যার ষড়যন্ত্রে মুখ্য নেতা হিসেবে সাভারকরকে পঁচিশ পঁচিশ বছর, মোট পঞ্চাশ বছর কালাপানির শাস্তি দেয়া হয়েছিল। এতবড় শাস্তি আর কোন ভারতীয় বিপ্লবীকে দেয়া হয় নি। কিন্তু বাস্তবে সাভারকর কতদিন ইংরেজের জেলে ছিলেন? কালাপানির ৯ বছর দশমাস ধরে মোট ১৪ বছর।
                                                                              
      মিথ ৭
    সাভারকরকে সেলুলার জেলে দশবছর ধরে রোজ তেলঘানিতে অমানুষিক পরিশ্রম করতে হয়েছে।
    --সত্যি নয়।
     
    লক্ষণীয়, সাভারকর ১৯১১ থেকে ১৯১৪ পর্য্যন্ত কাজ করতে অস্বীকার করা এবং নিষিদ্ধ কাগজপত্র রাখার অপরাধে আটবার শাস্তি পেয়েছিলেন। কিন্তু পরের সাতবছর (১৯১৪-১৯২১) তাঁর আচার-আচরণ ছিল তাঁর নিজের কথায় 'ভেরি গুড'।

    বারীন্দ্র ঘোষ এবং উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধায়ের সে’সময়ের স্মৃতিকথা থেকে জানা যায় এমন শাস্তি অনেক রাজবন্দীকেই ভোগ করতে হয়েছে।  সাভারকর কোন ব্যতিক্রম নন।
     
     ত্রৈলোক্য মহারাজের আন্দামানের স্মৃতিকথায় পাই বিনায়ক সাভারকরের নেতৃত্ব দেবার এবং মেধার প্রশংসা। কিন্তু তারপরই উনি লিখেছেন যে পাঁচবছর কারাবাসের পর সাভারকররা ‘নরমপন্থী’ হয়ে জেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আপোষ করে চলছেন, প্রতিবাদের থেকে দূরে থাকছেন এবং আন্দামান কর্তৃপক্ষের সুনজরে রয়েছেন। [27]

    ইতিহাসবিদ রমেশ চন্দ্র মজুমদার বলছেনঃ
    “নিঃসন্দেহে এটা বলা যায় যে আন্দামানের বন্দীজীবন মহান বিপ্লবী নেতাদের ব্রিটিশ শাসকের প্রতি তাঁদের দৃষ্টিকোণ বদলে গেছল। আর গুপ্ত ষড়যন্ত্র বা বিপ্লবের মাধ্যমে শাসকদের নির্মূল করার ভাবনায় মৌলিক পরিবর্তন এসেছিল”।[28]

    সাভারকর ছাড়া পেলেন না । তবে ১৯২০ সালের মাঝামাঝি সময়ে সেলুলার জেলের তেলঘানির ফোরম্যান নিযুক্ত হলেন, মাসিক একটাকা মাইনে।[29]

    মিথ ৮
    একটা কথা বলা হয় যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ বিজয়ের আনন্দে সম্রাটের রাজকীয় ক্ষমাদানে ১৯১৯-২০ নাগাদ সাভারকর ভাইদের ছাড়া সবাইকে ফেরত পাঠানো হয়।

    -- এটা ভুল।
    সাভারকর ভাইদের ফেরত পাঠানো হয় ১৯২১ সালের মে মাসে। তখনও ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী, ঝাঁসিওয়ালে পণ্ডিত পরমানন্দ এবং বাকিরা সেলুলার জেলেই বন্দী। এঁদের ফেরত পাঠানো হয় ১৯২১ সালের শেষের দিকে।
    ত্রৈলোক্য চক্রবর্তীর জেল হিস্ট্রি টিকিটে অন্য সব মন্তব্যের সঙ্গে লেখা ছিল ‘১৪টি খুন এবং ডাকাতির ব্যাপারে লিপ্ত থাকার সন্দেহ। অস্ত্রসংগ্রহ এবং রাষ্ট্রদ্রোহ,  ভেরি ডেঞ্জারাস।[30] 

    মিথ ৯
    সাভারকর বৃটিশ কারাগারে ২৭ বছর কাটিয়েছেন

    --ভুল তথ্য।
    বিনায়ক সাভারকর ২ মে, ১৯২১ তারিখে দাদা গণেশের সঙ্গে  আন্দামান ফেরত ভারতগামী জাহাজে চড়লেন। এইভাবে বিনায়ক সাভারকরের ৫০ বছরের দ্বীপান্তরের শাস্তি ৯ বছর দশমাসে শেষ হল। 
    কিন্তু ব্রিটিশের কারাগার থেকে মুক্তি তখনও অধরা।
    কিন্তু বৃটিশ সরকার সাভারকরকে পরীক্ষা করতে আরও দুটো শর্ত মানতে বলল এবং স্পষ্ট করে দিল-- শর্ত মানলেই যে মুক্তি দেওয়া হবে এমন নয়। 
     
     এক, সাভারকরকে ‘স্বীকার’ করতে হবে যে উনি ‘ন্যায়-বিচার’ পেয়েছেন এবং ওঁকে ‘উচিত’ শাস্তি দেওয়া হয়েছে। দুই, ‘সহিংস পদ্ধতি’র নিন্দা করে বিবৃতি দিতে হবে।[31]
    সাভারকর এসব শর্তও মেনে নিলেন।
     
    অবশেষে  ৬ জানুয়ারি, ১৯২৪ উনি পাকাপাকি ভাবে জেলের বাইরে খোলা হাওয়ায় শ্বাস নিলেন। কিন্তু থানায় হাজিরা দেওয়া, এবং রাজনৈতিক কাজকর্মের প্রতি নিষেধাজ্ঞা বলবৎ রইল ।
    সরকার বলল আগামী আদেশ না পাওয়া পর্যন্ত উনি রত্নগিরি জেলার বাইরে যেতে পারবেন না । সাভারকর এই শর্তটিও মেনে নিয়ে রত্নাগিরি জেলায় একটি বাড়িতে স্ত্রী-পুত্রকন্যা নিয়ে সংসার করতে এবং ভগ্নস্বাস্থ্য উদ্ধারে মগ্ন রইলেন।
       তাহলে লন্ডনে গ্রেফতারির দিন থেকে ধরলে ওঁর কারাবাস হল প্রায় ১৪ বছর।

    মিথ ১০
    সমর্থকেরা বলেন সাভারকর ২৭ বছর ইংরেজের জেলে বন্দী ছিলেন। সত্যিটা কী?

    --হিসেবটা দেখা যাক।
    প্রথম গ্রেফতার, লণ্ডন, ১৩ মার্চ, ১৯১০।
     ভারতে মোকদ্দমা চালানোর উদ্দেশ্যে ১ জুলাই ১৯১০ বোম্বাই রওনা।
     বোম্বাইয়ের দুটি স্বতন্ত্র আদালত দ্বারা, ক্রমশঃ,  ২৩ ডিসেম্বর ১৯১০ এবং ৩০ জানুয়ারি, ১৯১১ তারিখে, দুটি আলাদা মামলায় যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের (কালাপানির) শাস্তি ঘোষণা। দুটো শাস্তিই একের পর এক (consecutively) ক্রিয়াশীল  হবে, একসঙ্গে (simultaneously)  নয় । তখনকার হিসেবে এর নীট ফল ৫০ বছর কালাপানি।

    আন্দামানে গেলেন ৪ জুলাই, ১৯১১।
    আন্দামান থেকে ছাড়া পেলেন ২ মে, ১৯২১। অর্থাৎ নয় বছর দশ মাস পরে।
    যারবেদা জেল থেকে ছাড়া পেলেন ৬ জানুয়ারি, ১৯২৪।
    অর্থাৎ , ব্রিটিশ জেলে রইলেন মোট ১৩ বছর ১০ মাস মতন।
    তারপর উনি রাজনীতি না করার এবং বিনা অনুমতি জেলার বাইরে না যাওয়ার শর্ত মেনে রত্নাগিরিতে একটি ভাড়াবাড়িতে স্ত্রীপুত্র নিয়ে মে’ ১৯৩৭ অব্দি সংসার করছিলেন।
     সেই সময়ে তাঁর তিন সন্তানের জন্ম হয়। তিনি প্রচুর লেখালিখিও করছিলেন। সাময়িক পত্রিকাতেও লিখতেন।
     
    বাড়ি ভাড়া ছিল ১৫ টাকা। সরকারের থেকে পেনশন পেতেন ৬০ টাকা। ডাক্তার ভাই নারায়ণ রাও সাভারকর প্রতিমাসে ৭০ টাকা পাঠাতেন[32]। এইভাবে ১৩ বছর চলার পর ১৯৩৭ সালে তাঁর উপর চলাফেরা নিয়ে এবং রাজনৈতিক কাজকর্ম নিয়ে চাপিয়ে দেয়া সব শর্ত বোম্বে সরকার তুলে নিল।
    সমর্থকেরা সেই ১৩ বছর ৪ মাসকে যোগ করে একুনে ২৭ বছর জেলখাটার মিথ তৈরি করেছেন।

    মিথ ১১
    একা সাভারকর নয়, গান্ধীজিও ভারত সরকার থেকে পেনশন পেতেন।
    --সত্যি নয়।
     
    এই সময়ে ব্রিটিশ সরকার সাভারকরকে ১ অগস্ট, ১৯২৯ থেকে কাছ থেকে মাসিক ৬০ টাকা পেনশন দেয়া শুরু করল। উনি চেয়েছিলেন ১০০ টাকা[33]। 
    অধিকৃত ওয়েবসাইট[34] থেকে জানা যাচ্ছে যে সাভারকর সাথীদের সুদে টাকা ধার দেয়া শুরু করেছিলেন, কিন্তু অনেকে সেই টাকা ফেরত না দেওয়ায় সুদের কারবার বন্ধ হয়ে গেল।
        এই তথ্যটি জনসমক্ষে আসায় সাভারকরের  ‘আপোষহীন স্বাধীনতা সংগ্রামী’ ছবিতে আরেকটু দাগ লাগল। 
    ফলে আসরে নামলেন সাভারকরের জীবনী লেখক বিক্রম সম্পত।  জাতীয় অভিলেখাগারে( ন্যাশনাল আর্কাইভ) রক্ষিত একটি চিঠির ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় অক্টোবর ২০২২ থেকে ঘুরে বেড়াতে লাগল।
     ‘Finally the letter was found in the #national archives---# Gandhi used to get Rs. 100 per month from the British to cover personal expenses in 1930’.
    বলা হল, এই তো! গান্ধীও ইংরেজের থেকে নিজের খরচাপাতির জন্য মাসে ১০০ টাকা করে পেতেন। এই পেনশন কেন? নিশ্চয়ই ইংরেজের স্বার্থে কিছু কাজ করার জন্য!
       সত্যিটা কী? 
     
     
    চিঠিটা ভারত সরকারের INDIAN CULTURE আর্কাইভের গান্ধীজির বন্দী থাকাকালীন জেলের খরচপত্রের বিষয়ে দস্তাবেজের ৫১ নং পাতায় আছে। লিংক দেয়া হল। http://indianculture.gov.in/archives/papers-regarding-mr-mk-gandhis-treatment-jail-while-confined-under-bombay-regulation-xxv
    যে কেউ খুলে দেখতে পারেন, মোট ৬২ পাতা।

    চিঠিতে কী আছে?
     
    গান্ধীজি যখন লবণ সত্যাগ্রহের জন্যে পুণের যারবেদা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী, তখন ওই চিঠিটি ((নম্বরঃ ৭৩৭৪/২সি ৫৪ তারিখ ১৫ জুন, ১৯৩০) বোম্বে গভর্নমেন্টের হোম ডিপার্টমেন্টের সেক্রেটারি জি এফ এস কলিন্স লিখছেন গভর্নমেন্ট অফ ইন্ডিয়ার হোম সেক্রেটারি (পলিটিক্যাল)কে,  উদ্দেশ্য—রাজবন্দী  মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর জেলে  থাকাকালীন তার খাইখরচা , ওষুধপত্র এবং খবরের কাগজ বাবদ (maintenance cost) ১০০ টাকা ডেবিট করার অনুমতি চাওয়া। এটাও বলা হয়েছে যে খরচ ডেবিট হবে ভারত সরকারের “29 -Political Central- Refugees and State Prisoners”  Regulation XXV of 1827 নীতি অনুযায়ী ।
    আর চিঠির শেষ লাইনে উল্লেখ করা হয়েছে বম্বে সরকারের আরেকটি চিঠির (১৩৫৩/২সি, তারিখ ৭ জুন, ১৯২৭); কারণ তাতে রাজবন্দী বাংলার বিপ্লবী সতীশ পাকড়াশীর জন্যেও অনুরূপ খরচের স্বীকৃতির নিদর্শন দেখা যাচ্ছে। [35]
      অর্থাৎ  গান্ধীজির  জন্য এই খরচ কোন ব্যতিক্রম নয়। অনেক রাজবন্দীর জন্য জেল কর্তৃপক্ষকে এই খরচা করতে হত।
    দ্বিতীয় লাইনে জি এফ কলিন্স বলছেন যে এম কে গান্ধীর খাইখরচ বাবদ ১০০ টাকা নিয়মানুসার কেন্দ্রীয় সরকারের রাজবন্দীদের জন্য খরচার খাতে ডেবিট করে জেল সুপারিন্টেন্ডেন্টকে পেমেন্ট করা হবে।
    1. “Sanctioning an allowance of Rs. 100 per mensem d for the maintenance of Mr. M. K. Gandhi, who has been detained as a State prisoner in the Yarveda Central Prison”.[36]
    (ছবি দেখুন) 
    অর্থাৎ, টাকা আদৌ গান্ধীজিকে দেয়া হচ্ছে না। জেলের সুপারিন্টেন্ডেন্টকে খরচ করার জন্য দেয়া হচ্ছে।
    পাঠকদের মনে করিয়ে দিতে চাই যে স্বাধীন ভারতেও ষাট-সত্তরের দশকে যেসব গুরুত্বপূর্ণ রাজবন্দী ‘এ’ ক্লাস পেতেন, এমনকি কুখ্যাত প্রিভেন্টিভ ডিটেনশন অ্যাক্টে বন্দী হলেও যাঁরা  প্রথম শ্রেণীর বন্দী হিসেবে গণ্য হতেন তাঁদের সবাইকে জেলের ভেতর খরচ দেয়া হত। এটা কোন পেনশন নয়। 
               এ
    আচ্ছা, গান্ধীজি এই খরচকে কীভাবে দেখতেন?
    ঐতিহাসিক রামচন্দ্র গুহ বলছেন—গান্ধীজির   Collected Works, Vol. 43, page 401 পাতায় একটি চিঠি রয়েছে, (No. G. M. K. /H/ 12th May, 1930), ভারত সরকারের হোম সেক্রেটারি (স্পেশাল) মেজর ডয়েলকে লেখা।
    নীচে সেই পাতার ছবিটি দেয়া হল। 



    তাতে গান্ধীজি বলছেন আমি সরকারের থেকে বিশেষ সুবিধে যত কম নিতে পারি সেটাই ঠিক। মানছি, আমার স্বাস্থ্যের কারণে বিশেষ খাওয়ার ব্যাপারটা কিঞ্চিৎ ব্যয়সাধ্য। ---মনে হয় , আমার জন্য স্বীকৃত ১০০  টাকা অনেক বেশি।
    শেষে বলছেন, আমার দৃঢ় বিশ্বাস  যে জেলে বন্দীদের মধ্যে আলাদা ভাগ থাকা অনুচিত। সবার জন্য সরকারের খরচ সমান হওয়া কাম্য।  
     

    কিন্তু সাভারকর যে ৬০ টাকা পেনশন পেতেন সেটা জেলে বন্দী থাকাকালীন নয়, মুক্তি পেয়ে স্ত্রী-পুত্র নিয়ে রত্নাগিরি জেলায় ভাড়াবাড়িতে সংসার করার সময়। সেটা সোজা তাঁর হাতে আসত। তার জন্য তাঁকে দুটো শর্ত মেনে চলতে হত—বিনা অনুমতি রত্নাগিরি জেলার বাইরে পা ফেলবেন না। আর কোন সক্রিয় রাজনীতিতে অংশ নেবেন না[37]

    মিথ ১২
    অনেক নামজাদা স্বাধীনতা সংগ্রামীরা নাকি কৌশল হিসেবে মার্সি পিটিশন দিয়েছিলেন!
    --ঠিক নয়।
    কিন্তু ভগত সিং ও তাঁর সাথীরা ফাঁসির আদেশ হলেও প্রাণভিক্ষা চান নি, বরং বলেছিলেন --ওরা যুদ্ধবন্দী, অতএব ফাঁসি না দিয়ে গুলি করা হোক[38]

    সাভারকর তাঁর লেখায় আত্মপক্ষ সমর্থনে বারীন ঘোষ এবং হেমচন্দ্রের মাফিনামা দিয়ে বেরিয়ে আসার উল্লেখ করেন, কাকোরি ষড়যন্ত্র মামলায় রামপ্রসাদ বিসমিল এবং শচীন্দ্রনাথ সান্যালের[39] মার্সি পিটিশনের উল্লেখ করেন এবং বলেন লড়াই না করে জেলে পচে মরার বীরত্বে ওঁর বিশ্বাস নেই । যেভাবে হোক বেরিয়ে এস, তারপরে আবার লড়াই কর।[40]

    ঘটনা হলঃ রামপ্রসাদ বিসমিলের ফাঁসি রদ হয়নি আর শচীন্দ্রনাথ কোনও মার্সি পিটিশন দেননি। বরং দুদুবার কালাপানি পেরিয়ে সেলুলার জেলে গেছেন। কখনও ব্রিটিশের বিরুদ্ধে সংগ্রাম বন্ধ করেননি। এভাবেই টিবি হয়ে মারা যান।
    আর ত্রৈলোক্য মহারাজ ইংরেজের জেলে তিরিশ বছর থাকা সত্ত্বেও মার্সি পিটিশনের প্রস্তাব অগ্রাহ্য করেছেন।
    এবং গান্ধী ও নেহেরু কখনই মাফিনামা দেননি, উলটে জেল ভরো আন্দোলনে বারবার শরিক হয়েছেন।  
    কিন্তু সাভারকর?

    গান্ধীরা বরং এগিয়ে গেছেন। জেলে যাচ্ছেন কালাকানুনের প্রতিবাদে; গণ- সমাবেশ সংগঠিত করছেন, সত্যাগ্রহ শুরু করছেন। সাভারকর পিছিয়ে গেছেন তিরিশ বছর বা আরও বেশি।  কারণ তাঁর শত্রু বদলে গেছে। খুঁজে পেয়েছেন তাঁর নতুন শত্রুমুসলমান!
    এটাও উল্লেখনীয় যে আর যারা তাঁর মত মাফিনামা দিয়ে বেরিয়ে এসেছিলেন, যেমন বারীন ঘোষ, হেমচন্দ্র ইত্যাদি, তাঁরা কেউ আর পরবর্তী জীবনে স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেননি।
    অর্থাৎ কৌশল হিসেবেও মাফিনামা একেবারে অচল সিকি।


    মিথ ১৩
    ভারত থেকে অন্তর্ধানের আগে নেতাজী সুভাষ সাভারকরের বাড়িতে দেখা করে তাঁর পরামর্শে জার্মানি গিয়েছিলেন।
    • মিথ্যে প্রচার। সত্যিটা একেবারে আলাদা।
    বোম্বাইয়ের সাভারকর ভবনে ২২শে জুন ১৯৪০ তারিখে নেতাজি সাভারকরের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। সাভারকরের ভক্ত জীবনীলেখক ধনঞ্জয় কীর লিখেছেনঃ
    “আলোচনা চলাকালীন ভারতীয় মাজ্জিনি সাভারকর ভারতীয় গ্যারিবল্ডি সুভাষ বোসকে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্যে দেশের বাইরে থেকে সশস্ত্র বিদ্রোহের জন্যে প্রেরণা যোগান”।[41]

     কিন্তু জার্মানি যাবার পর ওই সাক্ষাতকার নিয়ে সুভাষ লিখেছেন, ‘ দেখা গেল সাভারকর আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি নিয়ে অবহিত নন। ওঁর একটাই চিন্তা—কী করে হিন্দুদের ভারতের ব্রিটিশ ফৌজে ঢুকিয়ে সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া যায়’।[42] 
    সুভাষ চন্দ্র সেই সময়ে জিন্নার সঙ্গে দেখা করেও একই রকম হতাশ হয়েছিলেন।  দেখলেন জিন্নারও একটাই চিন্তা – কী করে আলাদা একটা পাকিস্তান বানানো যায়।[43]

    তাই সুভাষ চন্দ্রের ক্ষোভ ও দুশ্চিন্তা  ফুটে বেরোল জার্মানী থেকে অগাস্ট ১৯৪২ এর বেতার ঘোষণায়।
    উনি জিন্নাহ্‌ এবং সাভারকরকে একাসনে বসিয়ে প্রকারান্তরে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের দালাল বললেন।
    ওনার নিজের কথায়ঃ
    “I would request Mr Jinnah, Mr Savarkar and all those leaders who still think of a compromise with the British to realize once and for all that in the world of tomorrow there will be no British Empire. ------- The supporters of British Imperialism will naturally become non-entities in a free India.[44]
     

    মিথ ১৪
    সাভারকর সুভাষ চন্দ্রের চিন্তাধারার প্রশংসক ছিলেন?  
    --ঠিক নয়।
    ১৯৩৯ সালে পুণের জনসভায় সাভারকর  সুভাষের সমালোচনা করে বললেন, “Bose did not differ very much from Mahatma Gandhi, except that he went further to woo the Muslims”.[45]
     বেশ বোঝা যায় যে নেতাজির আজাদ হিন্দ ফৌজের চারটে ব্রিগ্রেডের নাম কেন গান্ধী  ব্রিগ্রেড, নেহেরু ব্রিগ্রেড ‌ মৌলানা আজাদ ব্রিগ্রেড এবং সুভাষ ব্রিগ্রেড ছিল, কিন্তু কোন সাভারকর ব্রিগ্রেড বা শিবাজী ব্রিগ্রেড ছিল না।
     
     
    মিথ ১৫
    সাভারকরের উপর থেকে ১৯৩৭ সালে নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলে উনি বৃটিশ বিরোধী সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন।
     --- বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার মুখে।
    জাপান থেকে রাসবেহারী বসু ১৯৩৮ সালে সাভারকরকে একটি চিঠি লিখলেন[46]
    চিঠির মূল কথা হচ্ছে—এখন ব্রিটিশ দুর্বল হয়েছে। তাই ভারতবাসীকে যুদ্ধে সমর্থন পেতে অনেক প্রলোভন দেবে, এমনকি স্বাধীন করার আশ্বাসও দিতে পারে। কিন্তু আপনি ওদের কথায় না ভুলে আমাদের সঙ্গে হাত মেলান। আমরা জাপানের সহায়তায় ইংরেজ শাসন থেকে ভারতকে মুক্ত করার পরিকল্পনা করছি।

    সাভারকর কী করলেন?  
    তিনি  অক্টোবর ৯, ১৯৩৯ তারিখে ভারতের বড়লাট বা ভাইসরয় লর্ড লিনলিথগো’র সঙ্গে বোম্বেতে দেখা করলেন এবং তাঁকে জাপানের বিরুদ্ধে সবরকম সহযোগিতার আশ্বাস দিলেন। লিনলিথগো তখন  ব্রিটিশ ভারতের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি অফ স্টেট লর্ড জেটল্যান্ডকে রিপোর্ট করলেনঃ
    সাভারকর বলেছেন যে হিজ ম্যাজেস্টি’জ গভর্নমেন্টকে এখন অতি অবশ্যই হিন্দুদের উপর নির্ভর করে তাদের সমর্থন নিয়ে কাজ করতে হবে। --- আমি জানি যে উনি একসময় বিপ্লবী ছিলেন। কিন্তু হিন্দুইজম এবং ব্রিটেন এখন ঘনিষ্ঠ বন্ধু, আগের শত্রুতা অপ্রাসংগিক হয়ে গেছে[47]
     
    কারণ, সুভাষচন্দ্র এবং রাসবিহারী বসুর বিপরীতে সাভারকর বিশ্বাস করেননি যে বিশ্বযুদ্ধের ধাক্কায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ভেঙে পড়বে।
    ১৯৪০ সালে হিন্দু মহাসভার ২২তম অধিবেশনে (মাদুরাই) সভাপতির অভিভাষণে তিনি যুক্তি দিলেনঃ
    It is altogether improbable that England will be defeated in this war”.[48]
    আরও বললেন যে এখন বৃটিশের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহের চিন্তা অবাস্তব। হিন্দু মহাসভা এসবের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে না।[49]

    মিথ ১৬
    সাভারকর স্বাধীন ভারতে কখনও মুচলেকা দেন নি

    ---ভুল
    গান্ধী হত্যার ষড়যন্ত্রের অভিযোগে গ্রেফতার হওয়ার ১৭ দিনের মাথায় উনি ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ তারিখে আর্থার রোড জেল থেকে বোম্বাইয়ের পুলিশ কমিশনারকে এক পত্র লিখলেন। তাতে মাফিনামা দিয়ে মুক্তি পাওয়ার আবেদন পাঠালেন। 
    উনি বললেন যে ‘আমি সরকারকে এই মর্মে মুচলেকা দিতে রাজি যে সরকার যতদিন চাইবেন ততদিন আমি কোন সাম্প্রদায়িক বা প্রকাশ্য রাজনৈতিক কাজকর্মে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকব—যদি আমাকে ওই শর্তে মুক্তি দেয়া হয়। [50]
     

    এই আবেদনে সরকার সাড়া দিল না। দিল্লি পুলিশ দেশদ্রোহ এবং হত্যার ষড়যন্ত্রের চার্জ লাগিয়ে লালকেল্লায় মামলা শুরু করল। তবে সাভারকর একবছর জেলে থাকার পর পর্যাপ্ত প্রমাণের অভাবে ছাড়া পেলেন।
     
     
    সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার সম্ভাবনায় ভারত সরকার সাভারকর সমেত হিন্দু মহাসভার কয়েকজন নেতাকে প্রিভেন্টিভ ডিটেনশন অ্যাক্ট, ১৯৫০ এর অধীনে ৪ এপ্রিল, ১৯৫০ তারিখে আটক করে। 
    সাভারকর ২৬ এপ্রিল, ১৯৫০ তারিখে ছাড়া পাবার জন্যে আবেদন পেশ করলেন। জীবনীকার ধনঞ্জয় কীর লিখছেন, পাছে সরকার তাঁকে নিঃশর্ত মুক্তি না দেয়, তাই সাভারকর নিবেদন করলেন সরকার তাঁকে বর্তমান রাজনীতিতে কোন  অংশগ্রহণ না করার শর্তে মুক্তি দিক। এর জন্য সরকার যতদিন ইচ্ছে সময় বেঁধে দিক।
    সাভারকর আরও জুড়ে দিলেন যে এটা এখন সবাই জানে যে উনি সক্রিয় রাজনীতির ক্ষেত্র থেকে বিদায় নেবার কথা ভাবছেন[51]
     
     বোম্বে হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি এম সি চাগলা এবং বিচারপতি গজেন্দ্র গড়করের বেঞ্চের  ১৩ জুলাইয়ের আদেশে বলা হল সাভারকরকে নিম্ন দুই শর্ত পালনের প্রতিশ্রুতিতে মুক্তি দেয়া হচ্ছেঃ
      এক, উনি সক্রিয় রাজনীতি থেকে দূরে থাকবেন।
      দুই, উনি বোম্বেতে ওঁর বাড়িতেই থাকবেন।
    এই নিষেধাজ্ঞা আগামী এক বছর, অথবা আগামী নির্বাচন অথবা  ভারতে কোন যুদ্ধ লাগলে, যেটা আগে হবে সেই পর্য্যন্ত জারি থাকবে[52]

     

    [1] অরুণ শোরি, “দ্য নিউ আইকন, সাভারকর অ্যান্ড দ্য ফ্যাক্টস”, পেঙ্গুইন ভাইকিং, ২০২৫ ‘মেড টু অর্ডার’, পৃঃ ২৮৩-৩০৮।

    [2] সাভারকর সমগ্র, খন্ড ৮; পৃঃ ৫৪৫,

    [3] সাভারকর সমগ্র, খন্ড ৫, পৃঃ ৪৪৩-৫২।

    [4] Arun Shourie, The New Icon: Savarkar and the Facts, 2025.

    [5] Dr. R. Shyama Shastri. Kautilya’s Arthashastra, 4th edition, 1951. Internet Library.

    [6] Jadunath Sarkar, Shivaji and his times (1919).

    [7] Shourie, page 286, quoted from “Six Golden Epochs of Indian History” by Savarkar.

    [8] ভবিষ্যপুরাণম্‌ঃ বাংলা অনুবাদ—স্বামী পরমাত্মানন্দনাথ ভৈরবগিরি, নবভারত পাবলিশার্স, কলিকাতা।

    [9] Arun Shourie, The New Icon: Savarkar and the Facts, 2025. P. 56.

    [10] Bombay Government Records, Vol. II, 1885—1920. and India Today, 17th July, 2023.

    [11] Savarkar, My Transportation for Life, p. 515, Abhishek Publication, 2022.

    [12] Chitragupta, “Life of Barrister Savarkar”, Bombay, 1987. Pp. 95-100, 104-05.

    [13] Vikram Sampat, ‘Savarkar, Echoes from a Forgotten Past’, 1883-1924;  P-133, Penguin , digital version, 2019.

    [14] Harindra Srivastava; Five Stormy Years: Savarkar in London, p- 29.

    [15] Nilanjan Mukhopadhyay, The RSS: Icons of The Indian Right, Chennai, 2019. Pp-53-54.

    [16] The Economist, Christmas Special issue, 17 December, 2014.

    [17] Collected Works of Mahatma Gandhi, Vol. 50, p. 50, published by Gandhi Ashram, Sewagram.

    [18] Purandare, “Savarkar, The True Story of The Father of Hindutva”, p. 87.

    [19] সাভারকর, ‘লণ্ডনচি বাতমিপত্রে’, পৃঃ ১৪০-৪১-৪৩।                                                                           

    [20] Vikram Sampat, “Echoes from a Distant Past”, Penguin (2019), p. 149

    [21] Lenin, Collected Works, Vol.14, Progress Publishers, Moscow. 1972. Pp-17-362 & Marxist.org

    [22] Dr Helen Rappaport D.Litt., “Lenin in London”. https://helenrappaport.com

    [23]  Dr R C Majumdar, “The Penal Settlements of Andaman & Nicobar”, 1975, p. 143.              

    [24]  লোকসত্তা, ২৭ মে, ২০১৮।

    [25]   A Complex Hero, Indian Express, 31st August, 2004, New Delhi.

    [26] ibid p. 159

    [27] ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী (মহারাজ);“জেলে তিরিশ বছর”, পৃঃ ১২৪, ১২৬। এবং Purandare, “Savarkar, The True Story of The Father of Hindutva”, p. 146

    [28] ibid. p. 198.

    [29]   Keer, Dhananjay, “Veer Savarkar”, Popular Prakashan, Mumbai, 1988. P. 155                                                                          

    [30] ত্রৈলোক্য চক্রবর্তী , “জেলে তিরিশ বছর”,  পৃঃ ১২৩ ।

    [31] Bombay Chronicle, 21st February, 1924.

    [32]  Keer, Dhananjay Veer Savarkar p. 216  Popular Prakashan, Bombay, 1966.

    [33]  অশোক  পান্ডেয়,“কালাপানী ঔর উসকে বাদ”,পৃঃ ১২০; রাজকমল পেপারব্যাকস্‌,দিল্লি, প্রথম সংস্করণ, ২০২২। এবং অধিকৃত ওয়েবসাইট http://savarkar.org/en/encyc/2017/5/29/Q--As.html

    [34]  অশোক পান্ডেয়, ঐ, পৃঃ ১২০।

    [35]  The quint.com/ 18 August, 2023 http://indianculture.gov.in/archives/papers-regarding-mr-mk-gandhis- treatment-jail-while-confined-under-bombay-regulation-xxv

    [36] Ibid and Indian Culture/screenshot.

    [37]  Vaibhav Purandare, “Savarkar, The True Story of The Father of Hindutva”, p. 237.

    [38]  ভগত সিং, পাঞ্জাব গভর্ণরকে ফাঁসির আগে লেখা শেষ চিঠি,

    [39] শচীন্দ্রনাথ সান্যাল মার্সি পিটিশন দেন নি। ওঁর স্মৃতিকথা “বন্দী জীবন” অথবা এই অধ্যায়ের শেষে ‘মিথ’ অংশের আলোচনা দ্রষ্টব্য।

    [40] Purandare, “Savarkar”, p. 170-71.

    [41] Keer, Dhananjay ‘Veer Savarkar’ p. 260.  Popular Prakashan, Bombay, 1966.

    [42] Bose, “The Indian Struggle”, pp-34.

    [43] Ishtiaq Ahmed, The Print, September 17, 2020.  And Dar, Farooq Ahmed “Jinnah’s Pakistan: Formation and Challenges of a State”.

    [44] Bose, Testament of Subhash Bose, pp 21-24. Also quoted in Vaibhav Purandare’s Savarkar. Pp—272.

    [45] Bombay Chronicle, 4th August, 1939. Also quoted in Vaibhav Purandare’s Savarkar. Pp—257.

    [46]  Rath & Chatterjee, “Rasbehari Bose”, p. 171-74 and Purandare, “Savarkar, The True Story of The Father of Hindutva”, p. 287

    [47]  India Office (IO) MSS EMF 125/8 1939, Letters to the Secretary of India. Margia Casleri’s paper in Economic and Political Weekly, January 22 , 2000 , p-226. And also quoted in A G Noorani’s “Savarkar and His Hindutva”, p. 2 and 3.   

    [48] ভি ডি সাভারকর,  “সমগ্র সাভারকর বাঙ্ময়ঃ হিন্দু রাষ্ট্র দর্শন, খন্ড ৬, প্রকাশক মহারাষ্ট্র প্রান্তিক হিন্দুসভা, পুণা, ১৯৬৩ , পৃঃ ৪১৯।

    [49] ঐ পৃঃ ৪২১।

    [50]  সম্পূর্ণ চিঠিটি দেখতে হলে Noorani, A G “Savarkar and Hindutva”. Appendix 3, P. 146. LeftWord Books, New Delhi, 2002.

    [51]  Keer, Dhananjay “Veer Savarkar” (1966) Popular Prakashan, Bombay, p. 431

    [52] ibid, p. 432.
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কৌতূহলী | 115.187.***.*** | ২৬ অক্টোবর ২০২৫ ২২:৫৩746042
  • উরিব্বাস , এ তো পুরো বমশেল!! তাঁর মানে যা বোঝা গেল , লেনিনের সাথে সাভারকরের আদৌ দেখাই হয়নি! 
    এরকম মিথব্লাস্টিং আরও চলুক , প্লিজ। 
  • ~ | 103.27.***.*** | ২৬ অক্টোবর ২০২৫ ২৩:২৫746043
  • এখানে ছবি তোলার সুবিধে আছে যখন রেফারেন্সগুলো থেকে সব স্ক্রিনশটই দিয়ে দিতে পারতেন। সব নাম্বার লেখা ফুটনোটগুলোর সাথেই থাকত।
  • Ranjan Roy | ২৬ অক্টোবর ২০২৫ ২৩:৩১746044
  • পরের বার চেষটা করব।
    তবে আমি বই ও পৃষ্ঠা সংখ্যা দিয়েছি।
  • হীরেন সিংহরায় | ২৬ অক্টোবর ২০২৫ ২৩:৪৬746045
  • সত‍্যের আকাল এখন। অন্ধকারকে অন্ধকার বলে চিনিয়ে দাও। 
  • অরিন | 119.224.***.*** | ২৭ অক্টোবর ২০২৫ ০১:৩২746048
  • রঞ্জনবাবু এখানে সাংঘাতিক ভাল কাজ করেছেন। 
    তবে আজকাল misinformation যে আকার ধারণ করেছে এবং এর প্রেক্ষিতে রঞ্জনবাবুর প্রয়াস, শতমুখে প্রশংসা করেও জয়দেবের দশাবতার স্তোত্রের কথা মনে পড়িয়ে দেয়, "প্রলয়পয়োধিজলে ধৃতবানসি বেদং", মহাপ্রলয়ের মুখে জ্ঞানরূপী নৌকো ভাসিয়েছেন। আপনার জয় হোক মশাই |
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যুদ্ধ চেয়ে প্রতিক্রিয়া দিন