এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক

  • পলাশীর ষড়যন্ত্র ও সেকালের সমাজ –রজতকান্ত রায় : আনাড়ির উপলব্ধি (২)

    upal mukhopadhyay লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | ১৯ অক্টোবর ২০২৫ | ১৩৭ বার পঠিত
  • | 2
    Palashir Sharajantra O Sekaler Samaj
     
     
    ব্রিটিশ মাফিয়ারা সরকারী ভাবে হিন্দুস্থানে যা লুটপাট করেছে তাতে ইংল্যান্ড আর তাদের সাধের কলোনি আমেরিকা সেজে ওঠে । শিল্প বিপ্লবের প্রকল্প টাকার জোগান পায় । মাফিয়ার  দঙ্গল নিজেরাও পকেটে কম টাকা পুরতো না,  যথারীতি তারা দেশের সাহেবদেরও ভাগ দিতো । এই নিয়ে হাউস অফ কমনসে মাঝেমাঝে কিছু কান্নার রোলও উঠেছিল আর ক্লাইভের মতো কিছু পাক্কা চোর  ছ্যাঁচোড়ের বেইজ্জতিও  হয় । অধ্যাপক রজতকান্ত রায় দেখিয়েছেন এইসব চোরাই  টাকা কোম্পানির কত্তাদের নজর এড়িয়ে কেমনভাবে বিলেতে সঞ্চালিত হতো ।ব্রিটিশরা সব ক্ষীর খাবে আর ওলন্দাজ ,  দিনেমার , আলিমান বা অস্ট্রিয়ান , প্রাসিয়ান বা জার্মানরা কি বুড়ো আঙ্গুল চুষবে ? এব্যাপারে সব টুপিওলা সাহেবদের সাটগাঁট হয়ে গেলো ! দেখা গেলো ইংরেজদের বাঁ হাতে কামানো টাকা ধার নিচ্ছে অন্য নানা ইউরোপীয়রা আর সে টাকার রপ্তানি যোগ্য মাল কিনে লাভও করছে তারা  ।সুদে মূলে ধার করা চুরির টাকা তারা শোধ করতে লাগে  হুন্ডির মারফৎ যা সহজেই ভাঙানো যেত  ইউরোপের বাজারে । এই চুরির , লুটের টাকা  সঞ্চালনের   নতুন রুট তৈরি হওয়ার ফলে ব্রিটিশ ইস্ট  ইন্ডিয়া কোম্পানির ভাঁড়ারেও রুপোর পরিমাণ অনেক কম মাত্রায় সঞ্চিত হতে থাকে কারণ রুপোর জায়গা নেয় কালো টাকার বিপুল হুন্ডি যার ওপর  কোম্পানির কত্তাদের নিয়ন্ত্রণ নেই , পুরোটাই লুটের টাকার ওপর বাটপাড়ি।  
    ইতিহাসকার রণজিৎ গুহ ব্রিটিশ দস্তাবেজের ধূলিধুসরিত আবরণ ভেদ করে ঔপনিবেশিক শাসনের আইন শৃঙ্খলার সমস্যা নয়,  কৃষক বিদ্রোহের প্রাণ সত্তা হিসেবে  কৃষকের চেতনাকে প্রাধান্য দিয়েছেন।  অধ্যাপক রায়ও একই ভাবে পীড়িত জনতার মর্মপ্রকাশ দেখেন রামপ্রসাদের গানে , নাটোরের রাণী ভবানীর দত্তক পুত্র আরেক শাক্ত সাধক রাজা রামকৃষ্ণের পদাবলীতে :

    জয় কালী জয় কালী বলে যদি আমার প্রাণ যায় ,
    শিবত্ব হইব প্রাপ্ত , কাজ কি বারাণসী তায়।
    অনন্তরূপিণী কালী , কালীর অন্ত কেবা পায় ?
    কিঞ্চিৎ মাহাত্ম্য জেনে শিব পড়েছেন রাঙা পায়।


    সেসময় নাটোরের ওই রাজা, ইংরেজের স্থির করা চড়া  খাজনা আদায়ে জোরজুলুম করতে অপারগ ওই ‘অপদার্থ রাজার’  একের পর এক মহাল লাটে উঠছিল আর  সেটাকে ঔপনিবেশিকরা মিসকন্ডাক্ট বা অকর্মণ্য বেয়াড়াপনা বলছে। যত জমিদারী লাটে  ওঠে ততই রামকৃষ্ণ কালী পুজোর ধূম লাগিয়ে দেন , বলেন ,'' ,ভালোই হলো একটি একটি করে বিষয় বন্ধন ছিন্ন হচ্ছে। ''
    এখনো কি ব্রহ্মময়ি , হয়নি মা তোর মনের মত ?
    আকৃতি সন্তানের প্রতি বঞ্চনা কর মা কত।
    দম দিয়ে ভবে আনিলি , বিষয় বিষ খাওয়াইলি
    সংসার বিষে যত জ্বলি , দুর্গা দূর্গা বলি তত ,
    বিষয় হর মা বিষহরি মৃত্যুঞ্জয়ের মৃত্যু হত।
    জ্ঞানরত্ন দিয়েছিলি , মসিল দে তসিল করিলি ,
    হিসাব করে দেখ মা তারা , দুঃখের ফাজিল বাকি কত।

    অধ্যাপক রায় বলছেন ,'' রাজা যেমন প্রজার ওপর মহসিল( রাজস্ব সংগ্রাহক কর্মচারী ,তহসীলদার –বঙ্গীয় শব্দকোষ )  বসিয়ে জোর করে খাজনা তহসিল ( খাজনা আদায় তহসীলদারের অধিকারের অন্তর্গত স্থান - বঙ্গীয় শব্দকোষ , আমার মতে জুরিসডিকশন )  করেন , কালী জ্ঞানরত্ন দিয়ে তেমন তা হরণ করে নিলেন -সংসার বিষে জ্ঞান হারাল। '' ইংরেজরা দরবারকে সামনে রেখে নাটোরের মতো সব বড় বড় জমিদারীরকে ধরে ধরে নিলাম করে অস্থায়ী বন্দোবস্ত বা তাহুদ করে উচ্চতম হারে  খাজনা আদায় নিশ্চিত করে।এটার জন্য দেবোত্তর , চারণভূমি সহ নানা ধরণের সম্প্রদায়গত নিষ্কর  জমির  ওপরও খাজনা চাপানো শুরু হয়।  বিপরীতে  উৎপন্ন ফসলের দশ বছরি গড়ের নিরিখে মোঘল আমলে রাজস্বের সম্ভাব্যতা ধার্য হতো বটে কিন্তু হাসিল বা আদায় অর্থাৎ মানিটাই জেশন হতো তারও কম । আর জমির মালিকানা ছিল যেখানে যে অবস্থায় আছে তেমন অর্থাৎ প্রথাগত জমিদারদের অধীনে যে গ্রাম ব্যবস্থা তাতে নস্ত্য । সে ব্যবস্থাতেও স্বৈরাচার ছিল বটে তবে তা ছিল পুরোনো চতুর্বর্ণ নির্ভর প্রাচ্য ধরণের আর ইংরেজ  লুঠেরা জামানায় সব জমির মালিক বনতে চায় সরকার বাহাদুর । যেখানে যত আছে সব  জমির ওপর চড়া হারে কর বসিয়ে মানিটাই জেশন শুরু করে মাক্কিচুস ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ।  যারা তাহুদ নিতো সেই নব্য মাতব্বরা পড়তি মোঘল জমিদারদের ওপর চাপ দিতে   জমিদারীতে আমিল নিয়োগ করতো   আর তাদের অধীনে  থাকে ইজারাদাররা। আমিলদের অত্যাচরের ফরিয়াদ বা নালিশ  দরবারে পেশ হলে একই রকম অত্যাচারী ইংরেজ সুপারভাইজারদের  নিয়োগ হয় । কিছুদিন পরে তারাও বাড়াবাড়ি  শুরু করলে তাদের তুলে নিয়ে আবার আমিলদের বসানো হল  । হলে কি হবে ব্যবসা বাণিজ্য লাটে উঠলে,  রায়ত জমি ছেড়ে পালিয়ে বা মরে গেলে জমি খাঁখাঁ করে । এভাবে রাজস্বও যে আদায় সম্ভব নয় এ কথা রেজা খানও পরের দিকে বোঝেন কিন্তু ইংরেজরা এতোই লুটপাটে মত্ত যে তাঁর কথায় কান দেয় না । সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয় পুরোনো মোঘল জমিদারদের প্রশাসনিক কাঠামো।মীর কাশেমের পর নায়েব রেজা খানকে সামনে রেখে  অত্যাচারী দেবী সিংহের ইজারাদারীর ত্রাসে বাংলার গ্রাম ছারখার হতে থাকে।সব ঝামেলায় যাদের সবচেয়ে  জ্বলে পুড়তে হয় সেই বাংলার নারীরা যথারীতি মরে মানে আর প্রাণে ।   শ্যামা সংগীতের ছত্রে ছত্রে মন্বন্তর বা ইরেজের অত্যাচারের সমালোচনামূলক ন্যারেটিভের সন্ধান দিয়েছেন অধ্যাপক রায়। তাঁর বইটা শেষ হচ্ছেও দেশ জোড়া এক উথালপাথাল,  যাকে  সিয়ার উল মুতাখিরীনের লেখক তারিখকার সৈয়দ গুলাম হুসেন তাবাতাবাই অনিষ্টকর  অর্থে  বলছেন ইনকিলাব , যখন দুর্ভিক্ষে ফুলি জেলেনীরা মরেছিল আর রানী ভবানী আর রাজা কৃষ্ণচন্দ্র  সবারই জমিদারী লাটে উঠে নতুন সম্পত্তির আইন চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু হয়েছিল , সেই সকরুণ প্রেক্ষিতে রামপ্রসাদী গানের উল্লেখে :
    মা , খেলবি বলে , ফাঁকি দিয়ে নাবালে ভূতলে ।
    এবার যে খেলা খেলালে মাগো , আশা না পূরিল ।।
    রামপ্রসাদ বলে , ভবের খেলায় , যা হবার তা হ ল।
    এখন সন্ধ্যাবেলায় , কোলের ছেলে , ঘরে নিয়ে চলো ।।


     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
    | 2
  • ধারাবাহিক | ১৯ অক্টোবর ২০২৫ | ১৩৭ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    বাবর - upal mukhopadhyay
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। বুদ্ধি করে মতামত দিন