এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক

  • পলাশীর ষড়যন্ত্র ও সেকালের সমাজ – রজতকান্ত রায় : আনাড়ির উপলব্ধি (১)

    upal mukhopadhyay লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | ১৭ অক্টোবর ২০২৫ | ৯১৩ বার পঠিত
  • | 2
     
    Palashir Sharajantra O Sekaler Samaj
     
    প্রাক জাতীয়তাবাদী পর্যায়ে ব্রিটিশ বিরোধী মোঘল প্রতিরোধ সম্পর্কে অনুসন্ধান করতে গিয়ে রজতকান্ত রায় যখন লিখতে বসলেন তাঁর সেই লেখার একটা পরিচ্ছেদ হয়ে দাঁড়ালো এ বইটা যার কেন্দ্রে আছে পলাশী ঘটনা। পলাশী বলতে এখন আমরা নজরুল বুঝি। সেই :
    কান্ডারী! তব সম্মুখে ঐ পলাশীর প্রান্তর,
    বাঙ্গালীর খুনে লাল হ’ল যেথা ক্লাইভের খঞ্জর!

    এই কবিতাটা আবৃত্তি করে শুনিয়েছিলেন নজরুল উনিশশো ছাব্বিশে কংগ্রেসের কৃষ্ণনগর অধিবেশনে। যা ইতিহাসের জাতীয়তাবাদী ন্যারেটিভের অন্যতম দিকচিহ্ন হয়ে আছে। তবে পলাশী বাস্তবে যখন ঘটে সেই সতেরোশো সাতান্ন সালে বাঙালী জাতীয়তাবাদী হয় নি একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। তবে সিরাজের পতনের সময় কেমন ছিল তার মানসিকতা সেটা অধ্যাপক রায়ের এই যুগান্তকারী বইটা পড়লে জানা যাবে। আর এটা অধ্যাপক রায় মোঘল আমির, মনসবদার,শেঠ-সওদাগর আর হিন্দু জমিদারদের চক্রের সঙ্গে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নামক মাফিয়া দঙ্গলের যড়যন্ত্রের ফল হিসেবে দেখিয়েছেন সেসময়ের সামাজিক-রাজনৈতিক-আর্থিক বন্দোবস্তের প্রেক্ষিতে। সেজন্য শুধু ষড়যন্ত্র নয় সমাজ চিত্রণও তাঁকে করতে হচ্ছে। সে সময়ে গোটা বাঙালি সমাজ বলতে সুবে বাংলার সমাজকেই বোঝাতো যা নজরুলের সময়ের বাঙালি সমাজের থেকে আলাদা কারণ সে এলাকার মধ্যে বিহার আর ওডিশাও ছিল। সেই সমাজে মোঘল প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনায় বাংলার সুবেদারের রাজধানী ছিল মুর্শিদাবাদ আর তাঁর দুজন নায়েব নাজিম বা ডেপুটির অধিষ্ঠান ছিল ওড়িশা আর বিহারে।

    দরবারী ষড়যন্ত্রে বাংলার নবাব পরিবর্তন এই বৃহত্তর বাংলার মানুষ পলাশীর আগেও দেখেছে। পলাশীর সতেরো বছর আগে যখন মুর্শিদকুলি খানের নাতি আর সুজাউদ্দিন খানের ছেলে তৎকালীন নবাব সরফরাজ খানকে জঙ্গিপুরের দশ কিলোমিটার দূরে গঙ্গার ধারে গিরিয়ার যুদ্ধে হারিয়ে নবাবী তখতে বসেছিলেন সেসময় আজিমাবাদ বা পাটনার নায়েব নাজিম আলিবর্দী খান। সতেরোশো চল্লিশে সেও ছিল এক দরবারী ষড়যন্ত্রের ফল। নবাব সরফরাজ খানকে বাঙালি রায়তরা তাঁর আচরণের জন্য পছন্দ করতো তাই তারা তাঁর পরাজয় ও মৃত্যুতে দুঃখে গান বেঁধেছিল। পলাশীর পরাজয়ে আর সিরাজের মৃত্যুর ঘটনায় মুর্শিদাবাদের মুসলমান গ্রামের লোকে একইভাবে দুঃখ পেয়ে গান বাঁধে। সবাই ভাবলো এটার ফলাফল গিরিয়ার প্রথম যুদ্ধের মতোই হবে। সুবে বাংলার মোঘল শাসন আর সওদাগরী ব্যবস্থা একই রকম থাকবে। যে মনসবদার, শেঠ -সওদাগর আর হিন্দু জমিদারদের জোট সিরাজকে পটকে দিতে ব্রিটিশদের সঙ্গে হাত মেলালো তারাও বিন্দুমাত্র কল্পনা করতে পারেনি যে এর ফল কী ভয়াবহ হবে, এমনকি ভাবতে পারেনি ব্রিটিশরাও ।

    ইংরেজ মাফিয়ারা ক্রমে নবাবকে দেয় খাজনাকে তাদের ইনভেস্টমেন্ট ধরে সেই খাজনার পরিমাণ বহুগুণে বাড়িয়ে সেই টাকাতেই ধান চাল সুপুরি, বস্ত্র, সোরা, অন্যান্য ধাতু সহ সবকিছুর ওপর একচেটিয়া বাণিজ্যের অধিকার কায়েম  করে গোটা আর্থিক আর সামাজিক কাঠামোকে তছনছ করে দিলো। আগে বিদেশীদের তাদের দেশ থেকে আনা রুপোর বিনিময়ে এমনকি সুরাট বন্দর আগত দেশী সওদাগরদেরও  রুপো জমা রেখে সিক্কা টাকায় বাণিজ্য করতে হতো আর সেটা নিয়ন্ত্রণ করতো জগৎ শেঠরা। সেসময় বাংলায় বত্তিরিশ রকমের মুদ্রা চালু ছিল বলছেন ইতিহাসকার সুবোধ কুমার  মুখোপাধ্যায় তাঁর  প্রাক -পলাশী বাংলা (সামাজিক ও আর্থিক জীবন ১৭০০ -১৭৫৭ ) বইতে আর সেসবের বিনিময় মূল্য নিয়ন্ত্রণ করতো জগৎ শেঠরা যারা ছিল আজকের সেন্ট্রাল ব্যাংকার তুল্য। তাদের কোষাগার আর নবাবী কোষাগার এক ও অভিন্ন ছিল।পলাশীর পর ইংরেজরা তিন কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়েছিল নবাবদের কাছ থেকে।  সেটা দিতে গিয়ে ফতুর হয়ে ভাংখোরে পরিণত হলেন মীর জাফর ।তাঁর জামাই মীর কাশিমকে বসিয়ে ইংরেজরা সব সওদা কুক্ষিগত করে দেশী সওদাগরের ওপর কর বসিয়ে ।নতুন নবাব চুপ না থেকে সব সওদাগরদের  কর থেকে অব্যাহতি দিলেন ।লেগে গেলো লড়াই , মীর কাশিমকে গিরিয়ার দ্বিতীয় যুদ্ধে পরাজিত করে ইংরেজরা । শেষ স্বাধীন নবাব মীর কাশিম অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌলার শরণাপন্ন হলেন। এবার বাংলার টাকায় স্ফীত এই মাফিয়ারা মোঘল অযোধ্যা আর বাংলার  সম্মিলিত ফৌজকে বক্সারের যুদ্ধে হারিয়ে দিল্লীর দরবার থেকে সুবে বাংলার দেওয়ানির অধিকার অর্জন করে। এবার বাংলার পুরো রাজস্বটাই তাদের ইনভেস্টমেন্টে পরিণত হয় আর দিল্লির দরবার বুড়ো আঙ্গুল চোষে। অন্যের রাজত্বে বসে, অন্যের রাজস্ব অপহরণ করে ইংরেজ মাফিয়ারা এরপর পলাশীর ষড়যন্ত্রে তাদের সহযোগীদেরও উৎখাত করে কর্পোরেট শোষণতন্ত্র চালু করে। যারা দরবারী ষড়যন্ত্রী ছিল আর যারা সাধারণ মানুষ তারা কেউই সিরাজকে হটিয়ে দিয়ে এই সর্বনাশ হবে তা ভাবতে পারেননি। আর বাংলায় নেমে এলো মন্বন্তরের অভিশাপ। মারা গেলো সুবে বাংলার এক তৃতীয়াংশ মানুষ।

    ইউরোপীয়দের আর  অন্যদের আনা রুপোর বিনিময়ে বাণিজ্য হেতু মোঘল আমলে যে দেশীয় ধনভাণ্ডার গড়ে উঠেছিল তা ততো দিনে তছনছ হয়ে সমৃদ্ধশালী সুবে বাংলা নিঃস্ব হয়ে গেছে। মাফিয়া ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এখানকার রাজস্বকে তাদের কর্পোরেট ব্যবসায়ে নিয়োগ করে, চীনে আফিং চালানের একচেটিয়া বাণিজ্য করে চীনের চা আমদানী করার ব্যবস্থাপনা চালু করে আর সেখানেও আফিমের কৃত্রিম চাহিদা সৃষ্টি হয়ে একসময়ে চীনা ধনভাণ্ডারে রুপো জমা রেখে স্থানীয় মুদ্রায় বিনিময় প্রথা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায় । পুরোটাই বাংলার কৃষকের নৃশংস শোষণের মাধ্যমে পুঁজির আদিম সঞ্চয়ের নেটওয়ার্ক তৈরির ঔপনিবেশিক মাফিয়াগিরি, আফ্রিকার দাস ব্যবসার ক্ষেত্রেও এই একই ভাবে ঔপনিবেশিক শোষণ আর হোয়াইট ম্যানস বার্ডেনের নৈতিকতার ঢক্কানিনাদ চলতে থাকে। অধ্যাপক রায়ের অপূর্ব কাব্যময় ভাষায়, ‘‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অদ্ভুত বৈষয়িক রসায়নে বাংলা বিহারের চাষির রক্ত চীনেদের নিঃশ্বাসে আফিমের বিষ হয়ে ঢুকে শেষে ইংরাজদের চায়ের কাপে ধূমায়িত হতে লাগলো।”
     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
    | 2
  • ধারাবাহিক | ১৭ অক্টোবর ২০২৫ | ৯১৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • পাঠক | 2600:1002:b1a6:5612:5531:739f:df17:***:*** | ১৮ অক্টোবর ২০২৫ ২০:৪৮735032
  •  উপলবাবুকে ধন্যবাদ 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। হাত মক্সো করতে মতামত দিন