দেখা না দেখায় মেশাঃ পর্ব ১০
রহস্যময়ী রমণী ! নন-বায়োলজিক্যাল?
ওসি সিনহার কথা শুনে আমাদের বাকশক্তির পক্ষাঘাত !
এসব কী বলছেন উনি? “স্ত্রীর অবর্তমানে মহিলা”? আমার ঘরে ‘জাঁকিয়ে বসা’!
আমাদের দশা দেখে থানাদারের চেহারার একটা চাপা বিজয়ীর হাসি।
-- কী বলছেন? আমার ঘরে মহিলা?
--ঠিকই শুনেছেন। স্ত্রীর অবর্তমানে যে মহিলা এখন আপনার বাড়িতে আছেন তাঁর সঙ্গে একটু কথাবার্তা বলা দরকার।
আর বলছি তো, আপনার বাড়িতে গিয়ে হবে, আপনাদের উপস্থিতিতে। চলুন, যাওয়া যাক।
আমার ভেতরে একটা চণ্ডাল রাগ পাকিয়ে ওঠে। এরা ভেবেছে কি? পুলিশ অফিসার বলে যা খুশি তাই বলবে?
আমার মরিয়া ভাব আমাকে শক্তি দেয়। গলার আওয়াজ পালটে যায়।
আমি এবার কেটে কেটে বলি—অফিসার! আপনার কোথাও একটা মারাত্মক ভুল হয়েছে।
শুনুন। স্ত্রী বিয়োগের পর থেকে আমার ঘরে আমি একা। নিজের হাতে ঘর সামলাই। কোন মহিলা আমার ঘরে থাকেন না।
আর আপনার ভাষা সংযত না হলে আমি—
ওসি সিনহার মুখ বিদ্রূপে বেঁকে যায়।
--আচ্ছা, আচ্ছা। আপনার কথাই ঠিক। স্ত্রীর পরিবর্তে কোন মহিলা আপনার ঘরে রাত কাটায় না। সব কাজ আপনি নিজের হাতে করেন।
কিন্তু ইদানীং যে মহিলাকে রান্নাঘরে দেখা যাচ্ছে, উনি কে? আপনারা বাংলায় কী যেন বলেন—কাজের মাসি?
বেশ, না হয় ওই কাজের মাসিকে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করব। যেমন ও কোত্থেকে এসেছে? আধার কার্ড আছে কিনা। কোথাকার ভোটার?
এখানে কার রেফারন্সে এসেছে? রাত্তিরে বাড়ি ফিরে যায়, নাকি এখানেই রান্নাঘরে ঘুমোয়?
--মিঃ সিনহা, আমি শেষবারের মত বলছি, আমার বাড়িতে আমি একা। কোন কাজের মাসি নেই।
কোন মহিলা রাতে আমার বাড়িতে থাকে না।
--আপনি ডিনাই করতে পারেন। কিন্তু আমাদের কাছে। আপনার প্রতিবেশি তিনজন বিশিষ্ট ভদ্রলোকের স্টেটমেন্ট আছে ।
ওঁরা কোন মহিলাকে আপনার রান্নাঘরে কাজ করতে দেখেছেন।
--কী করে দেখলেন? কোন প্রতিবেশি আমার বাড়িতে পা রাখেন নি। আমিও কাউকে চিনি না। তাহলে?
--রেগে না গিয়ে সবটা শুনুন। ওঁরা রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করার সময় দেখতে পেয়েছেন। আপনার রান্নাঘরে কোন পর্দা নেই যে। এটাই আপনার ভুল।
--কিসের ভুল? আমার বাড়িতে কোন মহিলা বা মেয়ে নেই, তাই পর্দা টাঙাই নি। এবার আপনি কিন্তু সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছেন ।
সুপ্রিয় হাসে। এবার ওনার ভ্যাবাচাকা খাওয়ার পালা।
--এরমধ্যে হাসির কী হোল? আপনাদের কাজের যে মেয়েটাকে ছাড়িয়ে দিয়ে অন্য কাউকে এনেছেন—সেই মেয়েটিরও স্টেটমেন্ট আছে।
পুলিশকে এত বোকা ভাবেন কেন? এবার আমি ফোর্স এনে আপনার বাড়ির তল্লাসি নিতে বাধ্য হব মিঃ সমাদ্দার।
আমার যে কোত্থেকে বেয়াড়া হাসি পেল, থামতেই চায় না।
সুপ্রিয় বলে—কোদাল বেলচাও নিয়ে আসবেন।
--মানে?
--অবিনাশের বাড়ির পেছনের বাগানে একটা বড় গর্ত বোজানো আছে। দেখলে বোঝা যায় –বছরখানেকের পুরনো।
খুব গভীর নয়, খুঁড়লে কিছু পেয়ে যেতে পারেন।
--মিঃ দাস, আমি আপনাদের ইয়ার নই। নিজের ডিউটি করছি। এসব মজাক পরে মাহাঙ্গা হতে পারে।
আমিও আপনাদের একটা ফাইনাল কোশ্চেন করছি। যদি আপনার কাবার্ডে কোন স্কেলিটন না থাকে তাহলে আপনার ভয় কিসের?
কোন সার্চ ওয়ারেন্ট নয়, এমনি আপনাদের সঙ্গে গিয়ে দেখে শুনে এক কাপ চা খেয়ে আসব।
আর কাল সকালে রিপোর্ট জমা দেব যে অ্যালিগেশনগুলো বেসলেস।
কী রাজি? তাহলে চলুন, যাওয়া যাক।
--তাহলে কাল সকালেই চা খেতে আসুন।
সুপ্রিয় আচমকা বলে। আমি অবাক, ভাবছিলাম আজ রাতেই সব চুকেবুকে গেলে ভাল হয়। ওরা যাক আমার বাড়িতে।
ক্যামেরা এবং রেকর্ডার নিয়ে যাক। একেবারে চক্ষুকর্ণের বিবাদ ভঞ্জন করে আসুক। কিন্তু সুপ্রিয় কি অন্য কিছু ভাবছে?
সিনহার চোখ কুঁচকে ছোট, চেহারায় নীরব প্রশ্ন। সুপ্রিয়ের চেহারা সহজ, কোন বিকার নেই।
--বলছিলাম কি, রাত কত হল সেটা দেখুন। ঘড়ির কাঁটা দশটা ছাড়িয়েছে। খুব খিদে পেয়েছে। এছাড়া ঘুমনো দরকার।
আমরা সিনিয়র সিটিজেন। আচমকা লাশ গায়েব করার চার্জ এবং রীমা বৌদির মৃত্যু নিয়ে বেশ খোলাখুলি অভিযোগ—
এগুলো শুধু আমার ক্লায়েন্ট শ্রী অবিনাশ সমাদ্দারের শরীরের কত ক্ষতি করতে পারে সেটা ভেবে দেখুন। উনি কোন দাগী অপরাধী নন।
কিছু উড়ো কমেন্ট এবং স্টেটমেন্টের ভিত্তিতে আপনি ওনাকে ভাবে হ্যারাস করতে পারেন না।
--তাহলে আপনারা আমাদের তদন্তে সহযোগিতা করতে চান না? মিঃ সমাদ্দার শুধু আপনার ক্লায়েন্ট নন, ছোটবেলার বন্ধু।
তাই বলছি—এই অসহযোগিতার অ্যাডভাইস দিয়ে কি ভাল করলেন? এর কনসিকোয়েন্স ভেবে দেখেছেন?
--আপনি আমাদের ভুল বুঝছেন। কারণ আপনার বায়াস। আমরা কখনই বলিনি সহযোগিতা করব না, বরং সম্পূর্ণ সহযোগিতার পক্ষে।
আপনি বিশ্বাস করছেন না যে ক্লায়েন্টের বাড়িতে কোন মহিলা , আপনার ভাষায় ‘জাঁকিয়ে’ বসে নেই—রাত্রিবাস তো দূর।
তাই সরেজমিনে ভেরিফাই করতে চান, উত্তম প্রস্তাব।
এখানে দুটো পয়েন্ট।
এক, যদি আপনার কথা সত্যি হয় তাহলে সেই অচেনা অনামা মহিলাকে আপনি রাতের বেলায় গিয়ে জেরা করতে পারেন না।
এটা ক্রিমিনাল প্রসিডিওর কোডের বিরুদ্ধে যায়। তাই বলছি, কাল সকালে চা খেতে আসুন।
রথ দেখা, কলা বেচা দুটোই হবে। আমরাও নিশ্চিন্তে খেয়েদেয়ে একটু ঘুমিয়ে নেব।
দুই, যদি আপনার কথা ভুল হয়, তাহলে আপনি সহজে মানবেন না। ভাল করে আনাচে কানাচে দেখবেন –সেই মহিলা কোথায় লুকিয়ে আছেন।
বাগানে যাবেন, হয়ত বেলচা কোদাল নিয়ে। চারদিকে পাড়াপড়শির দল জেগে উঠে ভীড় করবে। গুজব ছড়াবে, নানান মুখরোচক গল্প তৈরি হবে।
ফলে অবিনাশের ওই পাড়ায় বাস করা কঠিন হবে।
মিঃ সিনহা কিছু ভাবছেন।
আমার মাথায় টিউব লাইট জ্বলে।
--শুনুন মিঃ সিনহা। আমাদের আপনার অফিসার কিছু না বলে এখানে নিয়ে এসেছেন। আমি ওনার সামনে ঘরে তালা ঝুলিয়েছি।
আর ঘরে যদি কোন মহিলা থেকে থাকে তাহলে তাকে কোন গোপন নির্দেশ দিইনি। এখানে এসেও কোন ফোন করিনি।
স্টেনো মেয়েটি আচমকা মুখ খোলে।
--আপনি মোবাইল থেকে সমানে মেসেজ পাঠাচ্ছিলেন।
আমি হেসে ফেলি।
--ভুল। সময় কাটাতে সুদোকু খেলছিলাম। এই নিন আমার মোবাইল। চেক করুন।
দেখবেন ঘর থেকে বেরোনোর পরে কোন মেসেজ করেছি কিনা।
মিঃ সিনহা ক্রুদ্ধ চোখে স্টেনোকে দেখেন। যার নির্বাক কম্যান্ড—তোমাকে কে কথা বলার পারমিশন দিয়েছে?
মরেছে! শান্ত সুশ্রী মেয়েটির ছুটি মঞ্জুর হবে তো!
আমি ছিঁড়ে যাওয়া সূতোর খেই ধরে বলি—আমার অনুরোধ, আমাদের বাড়ি গিয়ে খেয়ে নিয়ে একটু শুতে দিন। ঘুম আসবে কিনা জানিনা।
সারারাত আমার বাড়ির সামনে পেছনে সাদাপোষাকের ওয়াচম্যান বসিয়ে দিন। আমরা পালাবো না, কেন পালাবো?
আর আপনি আপনার অফিসারকে নিয়ে সকাল ছ’টা নাগাদ চা খেতে আসুন। তন্ন তন্ন করে সব খুঁজে দেখুন।
সব কিছু একেবারে সেই যে হিন্দিতে বলে না—‘দুধ কা দুধ, পানি কা পানি’ হয়ে যাবে।
আর প্লীজ, আপনারা আপনার প্রাইভেট গাড়িতে সাধারণ পোষাকে আসুন। এটা আমার একান্ত অনুরোধ।
এগারোটার নাগাদ খেতে বসেছি।
মোহিনীকে বলেছি রান্নাঘরের আলো না জ্বালিয়ে দুপুরের বিরিয়ানি এবং আর যা বেঁচে আছে নিয়ে এসে খাবার টেবিলে সার্ভ করতে।
এই জায়গাটা রাস্তা থেকে দেখা যায় না।
ঘুম সহজে আসেনি। সকালের নাটক কেমন হবে তা নিয়ে সুপ্রিয়র সঙ্গে পরামর্শ করি। ও বেশ উত্তেজিত এবং মজা পেয়েছে।
--হ্যাঁ শালা! কারও পৌষমাস, কারও সর্বনাশ। তোর কী, যা হবার তা আমার হবে।
সুপ্রিয় হাসে।
--দেখ না, কাল মোহিনীর সঙ্গে পরিচয় হয়ে ওই খোট্টা সিনহার কেমন বিশ হাজার ভোল্টের শক্ লাগে!
তুই খালি আমি যেমন যেমন বলছি মোহিনীকে ঠিক ওইরকম কম্যাণ্ড দিবি।
তারপর ও ধোঁয়া গেলার জন্যে বারান্দায় যায়। খানিকক্ষণ পরে ঘরে আসে গম্ভীর চেহারা করে।
--পুলিশ কারও আপন হয় না। ব্যাটা ঠিক পাহারা বসিয়েছে।
--সে কী?
--হ্যাঁ, যেই বারান্দায় গিয়ে সিগ্রেট ধরিয়েছি অমনই দেখলাম। রাস্তার ওপারে মোড়ের ওখান থেকে, যেদিকে আলো নেই—একটা চেহারা ভেসে উঠল।
তারপর অলস ভঙ্গিতে হাঁটতে হাঁটতে আমাদের বাড়ি ছাড়িয়ে একটু এগিয়ে গেল।
--পুলিশ হবে কী করে বুঝলি?
--আমি ইচ্ছে করে বাগানের গেট খুলে দাঁড়ালাম। অমনই দেখি সেই ছায়ামূর্তি দ্রুত ফিরে আসছে।
তুই যদি বাড়ির পেছনের বাগানে গিয়ে দাঁড়ালে ওইরকম আরেক জনকে দেখতে পাবি। আমার ষষ্ঠেন্দ্রিয় সিগন্যাল দিচ্ছে।
যাকগে রাত্তিরে আর ওসব করে দরকার নেই। সাপখোপ বিচ্ছুর ভয় আছে। শুয়ে পড়। আমিও লম্বা হচ্ছি।
মনে রাখিস, সকাল পাঁচটা নাগাদ উঠে থাইরয়েডের ওষুধ ইত্যাদি সেরে আমরা ছ’টা নাগাদ চায়ের কাপ নিয়ে আরাম করে লিভিংরুমে বসে আড্ডা দেব।
ওরা ওদের মত আসুক। তারপর সিনহার শেষমেশ মোহিনীর হাতের চা খাওয়ার মত মনের অবস্থা থাকবে কিনা সেটাই দেখার।
সকাল ছ’টা বেজে পনের মিনিট! নাঃ কেউ আসে নি। না আসুক গে, আমাদের কী?
আমরা দিব্যি লুঙি পরে চায়ের কাপ হাতে সোফায় বসে পুরনো দিনের গল্পে মজে আছি। কিন্তু আসলে ভেতরে ভেতরে চাপা উত্তেজনা।
লুঙি পরেছি সুপ্রিয়ের বুদ্ধিতে। প্রথম দর্শনেই শ্রীমান সিনহা বুঝে যাবেন আমাদের পালাবার কোন অভিসন্ধি নেই।
সাড়ে ছ’টা বাজে।
বাইরে একটা মারুতি অল্টো থেমেছে। দু’জন ভদ্রলোক নেমে বাগানের গেট খুলে বারান্দায় উঠে বেল টিপতে যাবে এমন সময় দরজা খুলে গেল।
একগাল হেসে সুপ্রিয় বলল—আসুন, আসুন।
সিনহা সেই আগের দিনের টু-স্টারকে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন।
ওরা কেউ বসছেন না। সিনহার মুখে একটা আলগা হাসি। দেখলাম দুজনের চোখ এদিক থেকে ওদিকে ঘুরছে।
দেয়াল কার্পেট আসবাব কিছুই বাদ যাচ্ছে না। যেন বাড়ির রেকি করছেন।
আমি হেসে বলি, --আরে বসুন তো। চা কফি কী খাবেন বলুন।
--আগে কাজটাজ সেরে নিই। তারপর না হয়—
--সে কী, আমরা তো চা খাওয়া শুরু করে দিয়েছি। একসঙ্গে সবাই চা খেয়ে নিই। তারপর কাজ হবে’খন।
সিনহা কিন্তু কিন্তু করে আলগোছে উলটো দিকের সোফায় বসে পড়েন। অন্যজন এখনও দাঁড়িয়ে।
--আচ্ছা মিঃ সমাদ্দার। দুজনের কথাই থাকুক। আমরা চা খাব। দুধ এবং চিনি ছাড়া। কে বানাবে? আপনি? চা ভিজিয়ে দিন।
ততক্ষণ আমরা ঘরগুলো একটু দেখে নিতে চাই। সময় বাঁচবে। আপনি পাতা ভিজিয়ে চলে আসুন। কাজ শুরু হোক।
আমি ওনার কথার উত্তর না দিয়ে একটু গলা চড়িয়ে বলি—শোন, মোহিনী! আমার দুই বন্ধু এসেছেন। দু’কাপ লাল ফ্লেভার চা আর কিছু স্ন্যাক্স নিয়ে এস।
আমার এই কথায় দুই পুলিশ অফিসারের মধ্যে অদ্ভূত প্রতিক্রিয়া হয়। ওরা নিজেদের মধ্যে চোখ চাওয়াচাওয়ি করেন।
আমাকে ও সুপ্রিয়কে দেখেন। আমি ওদিকে দেখেও দেখি না। রান্নাঘরের দিকে তাকিয়ে থাকি। বোধহয় দুই থেকে আড়াই মিনিট কাটল।
এবার দ্বিতীয় জন সিনিয়রের কানের কাছে কিছু ফিসফিস করে। সিনহা কিছু বলবেন বলে গলা খাঁকরে মুখ খুলেছেন কি হঠাৎ যেন স্ট্যাচু হয়ে গেলেন।
রান্নাঘর থেকে লিভিংরুমে ঢুকছে মোহিনী। ওর পরনে সবুজরঙের কুর্তা আর সাদা সালোয়ার।
হাতে একটি ট্রে, তাতে দু’কাপ ধূমায়িত চায়ের কাপ এবং একটি ছোট ডিশে কিছু বিস্কিট।
না, ও ওড়নায় বুক ঢাকে নি। ফলটা দুই আগন্তুকের পক্ষে একেবারে ঘায়েল করে দেয়ার মত।
আমার মনে পড়ল ছত্তিশগড়ের সরকারি কলেজে ম্যাথসের প্রফেসর শ্রীবাস্তব বলেছিলেন—
ছেলেরা যখন কোন মেয়ের দিকে তাকায় তখন প্রথমেই ওদের চোখ নীচে নামে, বুক দেখে। তারপর দৃষ্টি ওপরে উঠে চোখমুখ দেখে ফের নীচে নেমে থেমে যায়।
আমি স্মিত মুখে ওদের নাজেহাল অবস্থা উপভোগ করি।
শালা, কাল আমাকে খুব নাচিয়েছ, আজ দেখ।
কিন্তু মোহিনীও যে স্ট্যাচু, আমাদের সোফার কাছে এসে ট্রে নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। স্থির দৃষ্টিতে আগন্তুকদের দেখেছে। তারপর মুখটা একটু ওপরের দিকে তুলল –যেন কোন কুকুর গন্ধ শুঁকছে। অবিকল সেই দৃষ্টি, সেই ভঙ্গী। তারপর ঘুরে আমার দিকে তাকায়, স্বাভাবিক গলায় বলেঃ
--অবিনাশ স্যার। কোন কফি খাবেন? নেসক্যাফে না দেক্যাফ?
সুপ্রিয় অবাক হয়ে বলে—আমাদের চা তো এখনও শেষ হয় নি। এখন কফি?
মোহিনী পাত্তা না দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। যেন আমার উত্তর শোনার পরে ট্রে কফি টেবলে নামিয়ে রাখবে, তার আগে নয়।
ও অমন করছে কেন? আশ্চর্য তো!
কিন্তু আমার স্মৃতি থেকে ভেসে উঠল কিছু নির্দেশ। আরে , ও বিপদের গন্ধ পেয়েছে।এটা ত সেই কোড! তবে ফার্স্ট ওয়ার্নিং।
আমি ইশারা করলে গিয়ে ৯১১ ফোন করবে।
আমার ফের হাসি পেল।
বললাম—শোন মোহিনী, এঁরা আমার ভাল বন্ধু। আমি পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি। এঁরা পুলিস অফিসার। যদি কখনও ৯১১ ফোন কর, এঁদের অফিসেই অ্যালার্ম বাজবে।
আর এ হচ্ছে মোহিনী, আমার ফিমেল ম্যান-ফ্রাইডে বলতে পারেন।
মোহিনী ভাবলেশহীন মুখে হাত জোড় করে, কেবল চোখের পাতা কিঞ্চিৎ ফরফর করল।
পুলিশ অফিসারদের চোখ বড় বড়, হাত ওঠেনি। তবে দ্বিতীয় অফিসার বলল—নমস্কার ম্যাডাম!
না, মোহিনী আগের মতন ভাবলেশহীন।
আমি বলি—শোন মোহিনী, এখন এই চা আর বিস্কুট এনাদের দিয়ে আরও নাস্তা নিয়ে এস। আমাদের সবার জন্যে।
মোহিনী রান্নাঘরে গেলে লাফিয়ে উঠলেন সিনহা।
==য়ু আর এ ড্যাম লায়ার, মিঃ সমাদ্দার।
সুপ্রিয় হাত নেড়ে কিছু বলতে যায়, কিন্তু গর্জে উঠলেন থানেদার সাহাব, একেবারে আসল মূর্তি।
--আপ দোনো একই থলিকে চাট্টে বাট্টে। কিঁউ কাল ঝুঠ বলে থে? ঘর মেঁ কোই আওরত নহী হ্যায়?
--নেই তো। আমরা মিথ্যে বলি নি—কাল হোক বা আজ।
আমার গলার স্বরে আহত ভাবনা এবং রাগের সঠিক অনুপাত ফুটে ওঠে।
মিঃ সিনহা অবাক। ওঁর কথায় অবিশ্বাসের সুর—আচ্ছা! এখনও ডিনায়াল মোডে? আপনি পাগল কি আমরা পাগল?
ঘরে মহিলা নেই। তবে উনি কে? মোহিনী না সোহিনী দেবী?
--না, উনি কোন মহিলা নন।
এবার টু-স্টার অফিসার—কাল যার বুকে লেখা ছিল মণীন্দ্র হালদার, মুখ খোলে— শালোয়ার কুর্তা পরে আমাদের চা সার্ভ করা দেবী মহিলা নন? তবে কি হিজড়ে?
কাম অন অবিনাশবাবু। ধরা পড়ে আপনার মাথাটা গেছে, যা খুশি বলছেন।
আমি ওকে অগ্রাহ্য করে সোজা ওসি’র দিকে তাকিয়ে বলি—উনি সত্যি নারী নন। বলতে চাই উনি ঠিক মানুষ নন; কিছু কিছু আচার ব্যবহার মানুষের সঙ্গে মেলে, এইটুকুই।
উনি নন-বায়োলজিক্যাল, তাই নারী, পুরুষ বা উভলিঙ্গ ইত্যাদি পরিচিত অভিধায় ওনার পরিচয় দেয়া যায় না।
ওনার কোন জন্মদাতা বাবা মা নেই থাকতে পারে না। তাই আধার কার্ড বা ভোটার কার্ড থাকার প্রশ্ন অবান্তর।
--হেঁয়ালি ছেড়ে সোজা কথায় বলুন। উনি নন-বায়োলজিক্যাল? কথাটার মানে কি? উনি কি ভগবান?
-- বলতে চাইছি, ওনার জন্ম হয়েছে বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায়, আধুনিক কৃৎকৌশলের মাধ্যমে। ওনার জন্ম নার্সিং হোমে নয়, ল্যাবরেটরিতে।
তাই বংশ পরিচয়, নাম গোত্র, জাতপাত, জন্মভূমি, নাগরিকতা –এসব ওনার জন্য অর্থহীন।
সোজা কোথায় বললে উনি একজন রোবো, যন্ত্রমানব বা মানবী। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের জিতা জাগতা উদাহরণ।
এবার দ্বিতীয় অফিসার মুখ খোলে।
--অ! উনি নারী নন , রোবো! যেমন নেটফ্লিক্সে দেখি?
তা এই বৃহৎ খেলনাটি আপনার বাড়িতে কী করছে? আপনার সঙ্গে কীসের সম্পর্ক? আপনার চাকরাণী?
-- এভাবে কথা বলবেন না। মানছি, ও যন্ত্র; কোন সেন্টিমেন্ট নেই। মান-অপমান বোধ নেই। কিন্তু আমার আছে।
মোহিনী আমার সঙ্গী, আমার সহকারী। বুড়ো হয়েছি। একা একা কাজ করতে ক্লান্তি লাগে। ও আমার ঘর সামলায়। কেমন সামলাচ্ছে দেখতেই পাচ্ছেন।
এছাড়া ও আমার সঙ্গে খালি সময়ে গল্প করে, বই পড়ে শোনায়। ওষুধ খাইয়ে দেয়।
অসুস্থ হলে নার্সিং করে, ডাক্তার ডাকে। আর ও আমার বডিগার্ডও বটে।
হালদার হো হো করে হেসে ওঠে।
--গাঁজাখুরি গল্পের একটা সীমা আছে। এই তন্বী -শ্যামা-শিখরিদশনা-পক্কবিম্বাধরোষ্ঠী আপনার বডিগার্ড?
--হালদার বাবু, সীমার কথা ছাড়ুন। বুঝেছি, আপনি বঙ্কিম পড়েছেন। কিন্তু বিজ্ঞান পড়েন নি।
তারপর গলা চড়িয়ে ডাকি—মোহিনী, একটু এদিকে এস।
মোহিনী এসে দাঁড়ায়, চেহারায় কোন অভিব্যক্তি নেই। কিন্তু ওর নাকের পাটা ফুলে উঠছে।
--শোন মোহিনী, ইনি মিঃ হালদার। আমাদের থানার অফিসার, বিপদে আপদে এনার কাছে সাহায্য পাওয়া যাবে।
উনি তোমার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করতে চাইছেন। একবার হ্যান্ডশেক করে নাও। উনি আমার বন্ধুব্যক্তি।
সিনহার ভুরু কুঁচকে উঠেছে—এ আবার কী?
--কিছু না, হালদার আমার বডিগার্ডের যোগ্যতা মাপতে চাইছেন।
নিন, হালদার বাবু। মোহিনীর সঙ্গে হাত মেলান, বেশ শক্ত করে চেপে ধরুন। কোন চিন্তা নেই।
হালদারের মুখে একটা বোকাবোকা হাসি। এই খেলাটা ওনার হিসেবের বাইরে। একটা মেয়ের সঙ্গে হাতের জোর! ছ্যা ছ্যা।
হালদার এগিয়ে এসে ইতস্ততঃ করছিলেন। মোহিনী খপ করে ধরে নেয় ওনার হাতের পাঞ্জা তারপর নির্বিকার মুখে চাপ বাড়িয়ে চলে।
হালদার প্রথমে অবাক, তারপরে সতর্ক, ফের নিরুপায় হয়ে উনিও চাপ বাড়াতে থাকেন।
কিন্তু মোহিনীর নকল চামড়ায় ঢাকা স্টিলের আঙুল ও কবজি অনায়াসে চাপ অগ্রাহ্য করে ওনার আঙুলগুলো পিষে ফেলতে থাকে।
হালদারের কপালে ঘাম। ক্রমশঃ মুখ যন্ত্রণায় বেঁকে যায়। মুখ দিয়ে একটা অস্পষ্ট শব্দ। করুণ মুখে আমার দিকে দেখেন।
--ব্যস, মোহিনী। স্টপ ইট। ছেড়ে দাও।
মোহিনী হাত ছেড়ে দিয়ে সরে দাঁড়ায়। হালদারের চেহারায় আতংক। উনি দু’পা পিছিয়ে সোফায় ধপ করে বসে পড়েন। হাতটা লাল হয়ে ফুলে উঠেছে।
--একী করেছ মোহিনী? উনি আমার বন্ধু ব্যক্তি। ছি ছি; সে সরি টু মিঃ হালদার।
মোহিনীর যান্ত্রিক আওয়াজে আমার কথার প্রতিধ্বনি—সরি, মিঃ হালদার।
--শোন মোহিনী, যাও ফ্রিজ থেকে আইস প্যাক বের করে মিঃ হালদারের হাতে লাগিয়ে দাও। ওটা ওনার ডানহাত।
মোহিনী আইস প্যাক এনে হালদারের কাছে আসতেই উনি সভয়ে লাফিয়ে সরে যাচ্ছিলেন—আমি, আমি ঠিক আছি।
কিন্তু মোহিনী ফের খপ করে ওনার কাঁধ চেপে ধরে সোফায় বসিয়ে দেয়। তারপর হালদারের হাতে আইস প্যাক লাগাতে থাকে। হালদার চোখ বুঁজে ফেলেন। একটা মহিলা রোবো তাঁর হাতে বরফ ডলছে!
--শোন মোহিনী, চা ঠান্ডা হয়ে গেছে। যাও একবার সবার জন্যে ফ্রেশ বানিয়ে আনো।
মোহিনী চোখের পলকে রান্নাঘরে। হালদার চোখ খুলে এদিক ওদিক দেখছেন।
সিনহা গলা খাঁকারি দিলেন।
--শুনুন, মিঃ সমাদ্দার। এতক্ষণ যা দেখলাম তা এককথায় ইনক্রেডিবল। যেন পি সি সরকারের ম্যাজিক, অবশ্য আপনারা বাঙালীরা সবাই ম্যাজিশিয়ান।
কিন্তু একজন এ আই বা রোবো আমাকে চা বানিয়ে খাওয়াচ্ছে বা আমার অফিসারের হাত মুচড়ে দিয়ে তাতে আইস প্যাক লাগাচ্ছে—দু’দিন আগে আমাকে কেউ হাতে তামা -তুলসী -গঙ্গাজল নিয়ে বললেও বিশ্বাস করতাম না। কিন্তু আজ নিজের চোখকে অবিশ্বাস করি কী করে!
তবে একটা কথা। আমাকে প্রসিডিওর পুরো করতে হবে। তবে রিপোর্ট তৈরি হবে।
যেমন,
এক, চা খাওয়ার পরে আমি শ্রীমতী মোহিনীর এজাহার নেব। অবশ্যই আপনার সাহায্যে, নইলে হয়ত উনি উত্তর দেবেন না।
দুই, ওনার ছবি তুলব, যা আমার রিপোর্টে অ্যাটাচড্ হবে নইলে আমার ডিপার্টমেন্ট আমাকে পাগলা গারদে পাঠাবে।
তিন, আপনাদের সঙ্গে সবগুলো ঘর এবং বাগান ঘুরে দেখব। আশা করি, আপনারা সহযোগিতা করবেন।
(চলবে)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।