১৬
বেহালায় দীপকদার বাড়িতে আশ্রয় জুটল। আসলে অনন্ত সিংহ এর আর-সি-সি-আই বা ম্যান-মানি-গান সংগঠনের কোর সদস্যরা সব বেহালা অঞ্চলের।
রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কর্মী দীপকদা বয়সে প্রায় ন’বছরের বড়; রমেনকে খুব স্নেহ করেন। ওর শরীর ভাঙছে, কাশি থামছে না । তাই উনি রোজ একটা করে ডিমসেদ্ধ খাওয়ানোর ব্যবস্থা করেছেন।
রমেনের লজ্জা হয়, কিন্তু খেয়ে চলে।
দুপুরে বেহালার সত্যেন রায় রোডে কিছু বন্ধু জুটিয়ে তাদের সঙ্গে আড্ডা দেয়। খেয়াল করে সবাই চাকরি খুঁজছে।
ও রবীন্দ্রনাথের কবিতার প্যারডি বানিয়ে শোনায়ঃ
“ চাকরি? ওরে চাকরি কোথায় পাবি?
চাকরি কি আর আছে?
দেশের দশের সবার টিকি বাঁধা
বিদেশি প্রভুর কাছে”।
ওরা হাসে, তারপর আনন্দবাজার পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখে দরখাস্ত লেখে। রমেনকে অনুরোধ করে যদি ইংরেজিটা শুধরে দেয়!
বদলে ও পায় আদ্দেকটা চারমিনার, বাকি আদ্দেক তিনজনে ভাগ করে টানে।
ওরা নিজেদের মধ্যে কথা কাটাকাটি করে , কেঠো রসিকতায় একে অন্যকে আঘাত করে ।
বলে—অমুক দরখাস্তের প্রাপ্তি পর্য্যন্ত আসে নি , কল পাওয়া তো দূর অস্ত! কেন জানিস?
রথীনকে একসঙ্গে পোস্ট করতে দিয়েছিলাম। ও নিঘঘাৎ আমারটা ছিঁড়ে ফেলে খালি নিজেরটা পাঠিয়েছে। একটা কম্পিটিটর তো কম হল !
সবাই হাসে। রথীন ঝাঁঝিয়ে ওঠে—বালের মত কথা বলিস না ! আমারও তো আসে নি ।
--সে তোর পার্সেন্টেজ কম বলে।
হাতাহাতি শুরু হবার মুখে অনিল চিৎকার করে স্থানীয় গণনাট্য সংঘের স্কোয়াডের নতুন গান দু’কলি গেয়ে ওঠে—
গণতন্ত্র আছে বলে রীতা ফারিয়া,
ডান্স করিল ভিয়েতনামে কোমর দুলাইয়া।
হো হো হাসি; আবহাওয়া শান্ত হয়। আরেকজন গায়—মন্ত্রীরা খায় কালিয়া পোলাও, কাঁচকলাটি জনতার।
বছর দুই আগে মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল সেন চালের দাম আগুন হওয়ায় পাব্লিককে কাঁচকলা নামক পুষ্টিকর, আয়রন ও নানান ভাইটামিন এবং মিনারেলে ভরপুর অথচ শস্তা তরকারিটি খাইতে নিদান দিয়া জনগণের উপহাস ও ক্রোধের লক্ষ্য হইয়াছিলেন।
এই সুযোগে রমেন একটা বক্তৃতা দিয়ে ফেলে।
বন্ধুদের বলে যে ভারত থেকে প্রথম একজন বিশ্বসুন্দরী হয়েছে বলে আমাদের এত উলুত-পুলুত হবার কোন মানে নেই।
এবার মাল্টিন্যাশনালের প্রসাধন বিক্রির বাজার তৈরি হবে আর কিছু নয়।
তোর আমার মত পরিবারের মেয়েরা বাপের পকেট কেটে ওইসব কিনে মুখে মেখে বিশ্ব না হোক বংগসুন্দরী হওয়ার স্বপ্ন দেখবে আর সংগ্রাম করতে ভুলে যাবে।
এসব আমেরিকান বাজার ধরার আর আমাদের ন্যাকাচৈতন বানানোর ফাঁদ। এগুলো আমাদের দেশের মেয়েদের অপমান করা।
এবার দ্যাখ, রীতা ফারিয়া বিশ্বসুন্দরী হয়ে ওদের হাতের পুতুল হয়ে গেছে। নইলে মার্কিন সৈন্যদের মনোরঞ্জন করতে ভিয়েতনামে যায়?
কথাটা সবার মনে ধরে।
অনিল বলে –তোরা তোদের ভাতিদের আবদার শুনে ওইসব কিনে দিতে পারবি?
--ভাতি?
--- না মানে আগে আমরা ‘মাল’ বলতাম, তো রমেন গতসপ্তাহে আপত্তি করল। মেয়েরা কোন বস্তু বা দ্রব্য নাকি?
মাল বলা আমাদের এই পোঁদে -গরম ঠেকে এখন স্ট্রিক্টলি নো-নো। তাই ‘ভাতি’ চলবে।
ওদিকের শ্রীহরি ঘোষ মিষ্টান্ন ভান্ডারের বেঞ্চে হঠাৎ মারপিট, কলার ধরা শুরু।
দেখতে দেখতে দু’জন শুম্ভ-নিশুম্ভের মত জাপটা জাপটি করে ধূলোয় গড়াগড়ি খায়। সবাই হেসে গড়িয়ে পড়ে।
হতভম্ব রমেন ছাড়াতে গেলে সবাই ওকে আটকে চেঁচায়—চালাও পানসি বেলঘরিয়া! আরেকজন বলে –হয়ে যাক দারা সিং বনাম ব্ল্যাক ঘোস্ট !
আরে ওরা যে রতন আর বাচ্চু! এ ‘পাড়ার জগাই-মাধাই, ন্যাংটো পোঁদের বন্ধু। রোজ ঝগড়া করে ,আবার একজন আরেকজনকে ছাড়া থাকতে পারে না ।
কিন্তু এমন হাতাহাতি আগে তো হয় নি !
সুজন খোলসা করে।
ওরা গত সপ্তাহ ধরে সমানে ক্যারম খেলছে। দিনের শেষে দেখা যাচ্ছে ফল সমান সমান, কেউ কাউকে হারাতে পারছে না ।
শেষে সবাই মিলে ঠিক করল রোববার বেস্ট অফ থ্রি ম্যাচে যে জিতবে সে বিজয়ী।
তো উইনার কী পাবে?
রবীনের প্রস্তাব—পাড়ার উঠতি সুন্দরী স্বপ্নাকে ও চুমু খেতে পাবে।
প্রবল আপত্তি, স্বপ্না কারও মাল নয় যে—
আর ও বড়লোকের মেয়ে, এই পাড়ার ছোঁড়াগুলোকে ঠিক দ্বিপদ প্রাণী বলে গণ্য করে না ।
হাই হিল খুলে দু’ঘা দিতেও পারে; তার উপর ওর দাদা বেহালা স্পোর্টিং ক্লাবের চ্যাম্পিয়ন বক্সার!
এ তো সেধে বাঁশ পোঁদে ঢোকানো ! না , না – এ চলবে না।
এবার ফচকে অনিলের মাথা থেকে বেরোয় এক অদ্ভূত প্রস্তাব।
যে জিতবে সে অন্যের বাপের বীচি হাফ বয়েল করে ঘোষের দোকানের কাঠি দিয়ে খাবে।
প্রশান্ত এক কাঠি বাড়া। ও বলে আয়, এই নতুন খাদ্যদ্রব্যগুলোর কিছু নাম দিই; ঘোষের দোকানের মিষ্টিগুলোর মত।
দুজনের বাবার নাম ক্ষীরোদপ্রসাদ ও প্রাণেশকুমার। তাই ওগুলোর নাম হবে ক্ষীরমোহন ও প্রাণহরা।
প্রবল হাস্যরোল ও করতালির মধ্যে উক্ত প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে পাশ হইল।
আজ রোববার; বেলা এগারোটা থেকে ঘোষের দোকানের পেছনের বারান্দায় ওদের খেলা চলছে। অল্পস্বল্প ভিড় ; মুকুন্দ আম্পায়ার। প্রথম দুটো গেমের ফল ১-১।
শেষ গেমের মাঝখান থেকে রতন দু’পয়েন্ট পিছিয়ে পড়ল। লাস্ট বোর্ড; যদি বাচ্চু এক পয়েন্ট পায় তাহলেই কেল্লা ফতে! বোর্ডে লাল, তিনটে সাদা ও একটা কালো।
বাচ্চু কালো নিয়ে খেলছে। একটা চমৎকার হিটে একই সঙ্গে রেড ও ব্ল্যাক দুদিকের দু’পকেটে গিয়ে পড়ল।
আওয়াজ উঠল—প্রাণহরা! বাচ্চু হেসে বলল—না ; ক্ষীরমোহন।
ব্যস, ধানীপটকায় আগুন লেগে গেল।
রমেনের হাড়পিত্তি জ্বলে যায়। এইসব অঘামার্কা ছেলেপুলে নিয়ে বিপ্লব হবে? ও দু’মাস ধরে চেষ্টা করছে। একটা রিক্রুট করতে পারে নি ।
উলটে ওরা নিজেদের মধ্যে কথা চালাচালি করে--কোন কাউন্সিলর দাদাকে ধরলে যদি ফুরনে কিছু কাজ পাওয়া যায়; অন্ততঃ হাতখরচাটা উঠে আসে ।
আর সিগ্রেট আর ঘুগনির জন্যে ঘোষের দোকানের বাকিখাতায় নাম না লেখাতে হয়।
এত ঘন ঘন ঘুগনি খাস কেন?
খিদে পায় যে!
তো বাড়ি গিয়ে ভাত খা!
তুই বুঝবি না; তোকে তোর পার্টি খাওয়াচ্ছে। আমরা রাত্তিরে পা টিপে টিপে বাড়িতে ঢুকি যাতে বাবার সামনে না পড়তে হয়।
মা বা বোন ঢাকা ভাত বেড়ে দেয়।
সকালবেলা মটকা মেরে পড়ে থাকি যতক্ষণ না বাবা বেরিয়ে যায়।
বাবা হয়ত বোঝে, তাই জোর গলায় মাকে শুনিয়ে যায়—ওকে বলে দাও যে আমি আর টানতে পারবো না । একমাসের মধ্যে কিছু একটা করুক, নয়তো রাস্তা দেখুক।
তারপর স্নান টান করে কিছু গিলে একছুটে এই ঘোষের দোকান। বাড়ি ফিরতে ফের রাত বারোটা।
এই তো জীবন কালীদা!
আমি ভাবি এই সুযোগ, লোহা গরম থাকতে থাকতে হাতুড়ি চালানো যাক। ওদের বলি বিপ্লবের কথা , গেরিলা যুদ্ধের কথা , গণফৌজে যোগ দেবার কথা ।
ওরা বিষণ্ণ হাসে। বলে সবকিছু সবার জন্যে নয় রে রমেন! সবাই গৌতম বুদ্ধ কি নিমাই হয়ে পথের ডাকে ঘর ছাড়তে পারে না ।
বাবা বুড়ো হচ্ছে, বোন বড় হচ্ছে। আমি বিপ্লব করতে গাঁয়ে গেলে ওদের কে দেখবে?
সন্ধ্যেবেলা ভবানীপুরের ইন্দ্র রায় রোডের ঠেকে গিয়ে দীপকদাকে বলি—আমি আর বেহালার ওই সত্যেন রায় রোডের ঠেকে যাব না । বেকার সময় নষ্ট।
দীপকদা হাসে। জানায় যে আমাকে বাঁশদ্রোণীর কাছে গঙ্গার ওপারে ব্রহ্মপুরের একটা নতুন ঠেকে চলে যেতে হবে।
ওখানে এপাড়ার শিবাশিস বলে একজন নতুন রিক্রুটের বাগানবাড়ি। ওরা দু’ভাই ওখানে থাকে। ওদের সঙ্গে থেকে নিয়মিত রাজনীতির পাঠ দিতে হবে।
ওরা দু’ভাই খুব লড়াকু এবং অনেস্ট, বাপের পয়সায় বখে যায় নি ।
এছাড়া আমার কাশি বেড়েই চলেছে। ওখানে পাঠানোর আগে একটা এক্স-রে ও ব্লাড টেস্ট করায় বুকে একটু ছায়া ও ইএস আর এ বৃদ্ধি চোখে পড়ছে।
ডাক্তার দেখিয়ে নিতে হবে।
আমরা অনেক রাত্তির অবধি ইন্দ্র রায় রোডের ঠেকে বন্ধ অফিসগুলোর সামনে আড্ডা মারি। রাজনীতির কথা বলি।
ইদানীং দক্ষিণ কোলকাতার দেওয়ালে দেওয়ালে একটা লেখা চোখে পড়ছেঃ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সফল করতে কমিউনের গণফৌজে দলে দলে যোগ দিন !
এখানেও স্টেট ব্যাংকের বন্ধ গেটের পাশের দেওয়ালে সেই লেখা। আমরা হাসি।
এই আবালের দল জানে না যে এটা রাশিয়া না , বরং চিনের মত কৃষিপ্রধান দেশ। এখানে ‘কৃষিবিপ্লব’ হবে—মাওয়ের গাইডলাইন মেনে।
নীলুদা গিয়ে ওর নীচে লিখে দেয়—অফিসের ঠিকানা লিখুন, যোগ দিতে ইচ্ছুক।
আমার শিবাশিসের বাড়ি যাওয়া সাতদিন পিছিয়ে গেল। ও গতকাল ভবানীপুর থানায় লক আপে ছিল। বেধড়ক ঠ্যাঙানি খেয়েছে।
আজ দীপকদা পাড়ার কিছু মুরুব্বি ও একজন উকিল বন্ধুকে নিয়ে গিয়ে বন্ড দিয়ে ছাড়িয়ে এনেছে।
কাল সকালে ওই মুরুব্বিরা গিয়ে শিবাশিসকে পাকড়াও করেন।
এ পাড়ায় একজন বিখ্যাত গায়কের তবলচির বাড়িতে একটি চোদ্দ বছরের মেয়ে কাজ করত।
ওঁর স্ত্রী দামি চায়ের কাপ ভেঙে ফেলার অপরাধে ওকে উনুনের শিক লাল করে হাতে পায়ে ছ্যাঁকা দিয়েছেন। বাচ্চাটার জ্বর এসে গেছে।
শিবাশিস মুক্তমেলার পর নতুন করে কোন ঝামেলায় জড়াতে রাজি হয় নি । বলেছে মেয়েটার মাকে নিয়ে থানায় গিয়ে কমপ্লেইন লেখাতে।
বুড়োগুলো মহা ইয়ে। ওর ইগোতে সুড়সুড়ি দিয়ে বলল –ওতে কী হবে? পুলিশ বড়পার্টির কথা শুনে পয়সা খেয়ে মেয়ের মাকেই কড়কে দেবে।
তোদের মত এমন ইয়ং ছেলে থাকতে এ পাড়ায় এসব সহ্য করতে হবে?
ব্যস, শিবাশিস বার খেয়ে ক্ষুদিরাম হয়ে গেল। তিনটে ছেলেকে নিয়ে ওই তবলচিকে ঘরে ঢুকে বেধড়ক পিটিয়ে দিল।
ওর স্ত্রী মেয়েটার চিকিৎসার খরচা ও মাকে কিছু ক্ষতিপূরণ দেবার প্রতিজ্ঞা করে রেহাই পেলেন।
কিন্তু ব্যাপারটা ওখানেই শেষ হয় নি ।
সন্ধ্যেবেলা ওকে ভবানীপুর থানায় ডেকে নিয়ে আড়ংধোলাই দেওয়া হোল। নতুন রিক্রুট; মার খেয়ে একটু দমে নি ।
ওসিকে বলল—আজ মারছেন; আমাদেরও দু’শো ছেলে তৈরি হচ্ছে। সেদিন আমরা আপনাকেও এইভাবে ঠ্যাঙাবো।
তারপর দুটো সেপাই ওকে হাত-পা বেঁধে চ্যাংদোলা করে দুটো টেবিলের ফাঁকে উলটো করে টাঙিয়ে পায়ের তলায় কিমা করার মত করে আশ মিটিয়ে পেটালো।
ওকে আজ যখন ছাড়িয়ে আনা হোল তখন সোজা হয়ে হাঁটতে পারছে না।
“এই যৌবন জলতরঙ্গ রোধিবে কে? হরে মুরারে”!
--আনন্দমঠ
এদিকে সংগঠনের মধ্যে অন্য চিন্তা দানা বাঁধছে। সবাই টের পাচ্ছে যে একটি সর্বভারতীয় পার্টি ধীরে ধীরে রূপ নিচ্ছে।
তাহলে আমরা কি বাদ পড়ে যাব?
এরা, মানে মিথিলেশ, দীপক, সুকান্ত রমেন ও আরও কয়েকটি ইউনিট বলতে শুরু করল যে আমরা ডাকাতিতে বিশ্বাস করি না । ক্যাল-আপে বিশ্বাস করি না ।
আমাদের একটি স্পষ্ট রাজনৈতিক লাইন চাই। আমরা সশস্ত্র গণ -সংগঠন গড়তে চাই । আমরা অবিনাশের বা ওল্ড গার্ডের সঙ্গে মুখোমুখি বসতে চাই ।
ওল্ড গার্ডের প্রতিনিধি বললেন—ব্যস, আর একটা ডাকাতির পরিকল্পনা তৈরি। এবার সোজা ব্যাংক। তোমরা ব্যাগড়া দিও না । তারপরে বসা হবে, আলোচনা হবে।
তখন ঠিক হোল মুখোমুখি বৈঠক হবে, একমাস পরে।
ইতিমধ্যে আমার রোজ রাত্রে জ্বর আসছে। ভোরবেলা ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ছে। আমার কি তবে টিবি হয়েছে?
যক্ষ্মা? শিবের অসাধ্য ব্যাধি! ছোটবেলায় শিশুসাথীর কোন গল্পে পড়েছিলাম। কিন্তু কমরেডরা কী করে চিকিৎসা করাবে? ওদের পয়সা কোথায়?
দেখা হোল পটারি রোডের রঘুর সঙ্গে । ওকে রিক্রুট করতে চেষ্টা করেছিলাম, পারি নি ।
ও অসীমদের প্রেসিডেন্সি কন্সোলিডেশনের সংগে কাজ করছে। আমাদের বন্ধুত্ব টিঁকে আছে।
বলল—চিন্তা করিস নি, ডাক্তার দেখা। যদি ওই অসুখ হয় তবে আমি তোকে ভিক্ষে করে হোক, বা যা হোক করে রোজ একটা আপেল খাওয়াবো; কথা দিলাম, হ্যাঁ।
আমি এখন গঙ্গার ওপারে একটা বাগানবাড়িতে থাকি। গাঁয়ের নাম কি একটা পুর, ধু -ধু মাঠের মধ্যে প্রায় চারহাজার স্কোয়ার ফুটের একটা বাগানবাড়ি, শিবাসিসের বাবা বানিয়েছেন।
একতলা বাড়ি , ছড়িয়ে ছিটিয়ে চারটে বড় বড় ঘর। রান্নাঘর, বাথরুম আর একটা বাগান। বাগানটা শিবাশিসের মায়ের হাতে তৈরি, কিন্তু অযত্নে কেমন ছন্নছাড়া চেহারা।
আর আছে কালোবরণ মানে কালোদা; কাছাকাছি কোন গাঁয়ের লোক। এবাড়ির মালী,দারোয়ান এবং খানসামা।
বাগানের এই হাল কেন?
মায়ের শখ ছিল।
এখন নেই?
গত দু’বছর হল মা বদ্ধ পাগল হয়ে গিয়েছে, রাঁচিতে থাকে। বাবা বছরে দু’বার দেখতে যায়। একটু সুস্থ হলে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়।
তখন মা নিজের হাতে রান্না করে , গান গায়। আ্মাদের দু’ভাইকে খুব আদর করে। অল্প ক’দিন।
তারপরেই অসুখ মাথাচাড়া দেয়। তখন ভায়োলেন্ট হয়ে যায়।গায়ে কাপড় রাখতে পারে না। শেকল দিয়ে বেঁধে রাখতে হয়।
তারপর বাবা একদিন আবার রাঁচিতে ছেড়ে দিয়ে আসে।
এই বাড়ি বাবা মার শখ দেখেই বানিয়েছিল। মা’র মাথাখারাপ হওয়ার পর থেকে আর এখানে আসে না । বাড়ি আছে কালোদার ভরসায়।
আমি মাসের প্রথমে খরচাপাতি দিতে এসে ক’দিন থাকি। এখন তুমি আছ।
কিন্তু আমার যে রোজ জ্বর আসছে। রাত্তিরে ঠান্ডায় আলোয়ান মুড়ি দিয়ে এবাড়ি ফিরতে আমাকে গঙ্গার পুল পেরিয়ে অন্ততঃ তিন কিলোমিটার হাঁটতে হয়।
শিবাশিস সঙ্গে থাকে, কিন্তু আমার বড় ক্লান্তি লাগে। একটু হাঁটলেই খক খক করে কাশি ওঠে। ইদানীং দু’একবার কফের সঙ্গে রক্তের ছিঁটে দেখা গেছে। ভয় করছে।
কমরেডরা ডাক্তার দেখিয়ে আনল। উনি বললেন – ব্রঙ্কাইটিস, এই লেডারমাইসিন ক্যাপসুল খাও, একমাসে সেরে যাবে।
তাই কি? দু’সপ্তাহ হয়ে গেছে।কাশি কমে নি । আমার ভয় করছে।
ভয়ের কারণ কী একটা?
রোজ মাঝরাত্তিরে ঘুম ভেঙে যায়। আমাদের দু’জনের মাঝখানে রাখা বড় পাশবালিশটা নেই। শিবাশিস জড়িয়ে ধরেছে আমাকে। খামচে খামচে অস্থির করে তুলেছে।
ভয় পাই , এই বিপ্লবী লড়াকু ছেলেটা! এ কী সমকামী?
খানিকক্ষণ পরে বুঝতে পারি যে ওর হাত, ওর গোটা শরীর আমার শরীরে একজন নারীকেই খুঁজে বেড়াচ্ছে।
কিন্তু আমি কী করি? মাঝরাত্তিরে উঠে শীতের মধ্যে কোথায় যাব? খোলা মাঠে? শরীরে জ্বর, এ এলাকায় কিছুই চিনি না যে!
সকাল বেলা ও রাত্তিরের পাগলামির জন্যে মাপ চাইল। বলল বহুদিন ধরে পাশবালিশ আঁকড়ে শোয়ার অভ্যেস থেকে এই ব্যামো শুরু হয়েছে, আর হবে না ।
নিশ্চিন্ত হলাম।
কোথায় কি! রোজরাত্তিরে একই উৎপাত; রোজ সকালে একই ক্ষমা চাওয়ার নাটক। এই শেল্টারও ছাড়তে হবে দেখছি।
কাল রাত্তিরে শিবাশিস আসে নি । কোন জরুরি কাজে ওকে কোলকাতার বাইরে পাঠানো হয়েছে। দু’দিন পরে ফিরবে।
আমি একা আর আউট হাউসে কালোদা; কোন অসুবিধে নেই । খেয়ে দেয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েছি।
সকাল বেলা চায়ে চুমুক দিতে দিতে যুগান্তর পত্রিকায় একটা খবর চোখে পড়ল, ভবানীপুরে শীতলামন্দিরে দেবীর বাহন গাধার চোখ দিয়ে অঝোরে জল পড়ছে।
গাধা কাঁদছে, কিন্তু কেন? কেউ জানে না।
অনেক শিক্ষিত ভদ্রলোক, যেমন অধ্যাপক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়র, নিজের চোখে গিয়ে দেখে এসেছেন। কিন্তু কেউ এর রহস্য ভেদ করতে পারে নি ।
জনৈক ধর্মগুরু বলেছেন যে পাপ অনেক বেড়ে গেছে, এখনও মানুষ যদি ঠিক পথে না আসে!
আরে, এই মন্দির তো আমাদের রোজকার ঠেক ইন্দ্র রায় রোডের খুব কাছে। দুটো সিঙারা আর একপ্লেট জিলিপি সাঁটিয়ে সোজা ৬নম্বর বাসে চড়ে বসলাম।
গিয়ে নিজের চোখে ব্যাপারটা দেখে আসি; আর আমার সেল ইনচার্জ দীপকদাকে বলি শেল্টার পালটে দিতে।
আজ আবার শিবাশিস ফিরে আসবে। রাত্তিরে ওই বাড়িতে শোয়া এখন আতংক বিশেষ।
ঠেকে গিয়ে পেলাম নীলুদাকে; বাকিদের দেখা পেতে সেই বিকেল। একগাল হেসে বলল- চ, গাধার রোদন দেখে আসি।
ভিড় ভেঙে পড়েছে ওই দৃশ্য দেখতে। কোন সন্দেহ নেই, গাধার চোখ দিয়ে জল পড়ছে। কিন্তু গাধা ফুঁপিয়ে কাঁদছে না, হা-হুতাশ করে বুক চাপড়ে বা হেঁচকি তুলেও না । ওর চোখ দিয়ে একেবারে ঝর ঝর ঝরিছে বারিধারা! মন্দিরের সামনে দর্শকদের নিয়ন্ত্রিত করে বাঁশ বেঁধে পুরুষ ও মহিলার লাইন আলাদা করে দেওয়া হয়েছে।
উৎসাহী ভলান্টিয়ারের দল কাজে লেগে গেছে। প্রণামী পড়ছে একটাকা, দু’টাকা, দশটাকা; সিকি-আধুলি তো অগুনতি।
স্থানীয় থানা থেকে তিনজন পুলিশ এসেছে।
--কিছু বুঝলে নীলুদা?
-- কেন বুঝব না? দেয়ালের পেছন থেকে সাইফন করে মূর্তির চোখে পাইপ লাগিয়ে দিয়েছে। কোন মানুষ কাঁদলেও অমন তোড়ে জল পড়ে না ।
--বেশ, চল এবার ঠেকে ফিরে গিয়ে সবাইকে শোনাই।
নীলুদা ইশারায় আমাকে দাঁড়াতে বলে।
কিছু একটা মতলব ভাবছে। সাধে কি পাড়ায় ওর নাম তিলে-খচ্চর-নীলু!
একটি অল্পবয়েসী ছেলে নিজের সঙ্গিনীকে বলে—দ্যাখ, দ্যাখ, গাধার চোখে জল!
কেউ কিছু বোঝার আগেই নীলুদা ওর কলার চেপে ধরেছে।
--কী বললেন মশাই? গাধার চোখে জল! সম্মান দিয়ে কথা বলুন। এ কি ধোপার গাধা?
শীতলা মায়ের বাহন, তাকে গাধাবাবা বলতে আপত্তি থাকলে অন্ততঃ গাধাদাদা বলুন। হুঁঃ, যত্তসব!
নীলুদা গজগজ করতে থাকে।
প্রাথমিক হতভম্ব ভাব কাটিয়ে ছেলেটি ও তার সঙ্গিনী হেসে ফেলে। ধীরে ধীরে সংক্রামক হাসি কিছু দর্শকদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে । একটা জটলার শুরু।
আমার চোখে পড়ে মন্দিরের এক সেবাইত কয়েকজন ভলান্টিয়রকে সঙ্গে নিয়ে এদিকেই আসছে। ওদের চোয়ালের হাড় শক্ত।
আমি নীলুদার হাত ধরে বেরিয়ে যাবার চেষ্টা করি।
ওদের একজন চেঁচায়—আবে শোন!
নীলুদা, দৌড়ও!
আমরা একছুটে ঠেকে পৌঁছে যাই। ওরা মন্দির চত্বর পেরিয়ে আর এদিকে আসে না ।
স্টেটব্যাংকের কোণায় শান্তদার চায়ের দোকান, তিনটে বাঁশের মাথায় একটা তেরপল, তার এক দিক পাশের দেয়ালে গজাল পুঁতে বেঁধে রাখা।
কয়লার উনুনে দুপুরের আঁচ পড়েছে।কাঁচের গেলাস, প্লেট ও মাটির ভাঁড় সাজিয়ে রাখা হচ্ছে।
ব্যাংক ও জীবনবীমা অফিসের লাঞ্চের ছুটি হয়ে গেছে। খদ্দেরের ভিড় বাড়ছে।
আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গরম চায়ের গেলাসে ফুঁ দিয়ে তারিয়ে তারিয়ে খেতে থাকি।
দোকানে ফাই-ফরমাশ খাটা দুই বাচ্চাছেলে কী একটা নিয়ে নিজেদের মধ্যে মারামারি করতে করতে ফুটপাতে গড়াচ্ছে।
নীলুদা ব্যস্ত সমস্ত হয়ে ওদের ছাড়িয়ে দেয়। একটা বাচ্চার একটু লেগেছে, ও কাঁদছে আর চিৎকার করে অন্যজনের চোদ্দপুরুষ উদ্ধার করছে।
সে বীরপুরুষ এতক্ষণ দাঁত বের করছিল; এবার বাপ-মা তুলে গালাগাল শুনে আবার ঝাঁপিয়ে পড়ে। আমরা দু’জন আবার অতিকষ্টে ছাড়াই।
ভিড়ের থেকে একজন টেরিলিনের শার্ট ও সিল্ক টাই পরা ভদ্রলোক ওকে বলে—অ্যাই, বেশি মারামারি করিস না । এরপরে পুলিশ আসবে।
--পুলিশ এসে কী করবে? বাপের ইয়ে করবে?
চায়ে চুমুক দিতে থাকা লোকজন খুক খুক করে হাসে।
কেউ কিছু বোঝার আগে টেরিলিন শার্ট লোকটি বাচ্চাটার চুলের মুঠি ধরে চড়-থাপ্পড় মারতে শুরু করে, মেরেই চলে।
সঙ্গে গর্জন—মেরে মুখ ভেঙে দেব, জিভ ছিঁড়ে নেব, ইত্যাদি।
আমি আর পারি না । প্রবল কাশির বেগে গেলাসের চা প্রায় সবটাই চলকে পড়ে। কাশতে কাশতে ফুটপাথে বসে পড়ি, পাশের ড্রেনে কফ উগরে দিই।
এবার আর ছিঁটে নয় , দস্তুরমত দলা দলা রক্ত। কয়েকজন আমাকে মন দিয়ে দেখে।
নীলুদা অযাচিত ব্যাখ্যা দেয়, ও কিছু না ; একটু আগে জর্দা দিয়ে পান খেয়েছিল, গলায় লেগেছে।
শান্তদা আমার প্রায় খালি গেলাসে আবার চা ঢেলে দেয়।
নীলুদা মগে করে জল এনে আমার মাথায় থাবড়ে দেয়। আমি খানিকটা জল মুখে নিয়ে কুলকুচি করি । এবারও রক্তের ছিঁটে ।
এই সুযোগে টেরিলিন টাইয়ের মুঠো আলগা হয় আর বাচ্চাটা নিরাপদ দূরত্বে সরে গিয়ে অংগভঙ্গি করে গালি দিতে থাকে।
খেপে উঠে ধাওয়া করতে উদ্যত টেরিলিন টাইকে নীলুদা নিরস্ত করে, শোনায় বাচ্চাটার জন্মের ইতিহাস।
গাঁ থেকে চিকিৎসা করাতে আসা ওর বাবা পাশের চিত্তরঞ্জন সেবাসদনে টেঁসে গেলে ওর মা চালের ব্ল্যাক শুরু করে, এই ছেলেটা তখন কোলের বাচ্চা ।
তারপর এক রাত্তিরে ওর মাকে রেপ করে এক চালধরা সেপাই। এইভাবে ওর ছোট ভাইয়ের জন্ম হয়।
ও কী করে আপনার আমার মত কুলীন ভাষা শিখবে? রবি ঠাকুরের কবিতা পড়বে?
--ফালতু জ্ঞান দেওয়া বন্ধ করুন। আপনি এই স্ট্রিট আর্চিনের কুষ্ঠি-ঠিকুজি জানলেন কী করে?
--আমি চিত্তরঞ্জন সেবাসদনের ক্যাজুয়াল স্টাফ।
(চলবে)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।