হাশাশিন ছিল মধ্যযুগের ইতিহাসের সবচেয়ে রহস্যময় এবং ভয়ংকর গুপ্তঘাতক গোষ্ঠীগুলির মধ্যে অন্যতম। মূলত তারা ছিল শিয়া ইসলামের নিজারি ইসমাইলি মতবাদের একটি শাখা, যারা একাদশ শতকে পারস্য (ইরান) এবং সিরিয়া অঞ্চলে তাদের কার্যক্রম চালাত।
এই গোষ্ঠীটি ইতিহাসে তাদের চরম গুপ্ত হত্যার কৌশল এবং অন্ধ আনুগত্যের জন্য সুপরিচিত। ইংরেজি শব্দ অ্যাসাসিন (Assassin) এই আরবি শব্দ 'হাশাশিন' থেকেই এসেছে।
উৎপত্তি ও নেতৃত্ব :
হাশাশিন গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন হাসান আল সাবাহ। ১০৯০ খ্রিস্টাব্দে তিনি উত্তর পারস্যের আলবুরজ পর্বতমালায় অবস্থিত দুর্ভেদ্য আলমুত দুর্গ দখল করেন এবং সেটিকে তাদের সদর দপ্তর হিসেবে গড়ে তোলেন।
হাসান সাবাহ তাঁর অনুসারীদের মধ্যে চরম ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক আদর্শের বীজ বপন করেন। তাঁর অনুগত গুপ্তঘাতকদের বলা হতো 'ফেদায়ীন' বা আত্মউৎসর্গকারী, যারা নিজেদের জীবনের বিনিময়েও নেতার আদেশ পালন করতে প্রস্তুত ছিল। হাসান সাবাহ এবং পরবর্তী নেতারা পশ্চিমা বিশ্বে 'শাইখুল জাবাল' বা 'পাহাড়ের বৃদ্ধ ব্যক্তি' নামে পরিচিত ছিলেন।
কার্যপদ্ধতি ও কুখ্যাতি :
হাশাশিনরা সরাসরি সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে না গিয়ে বরং তাদের শত্রুদের মধ্যে ত্রাস সৃষ্টি করতে পরিকল্পিত গুপ্তহত্যাকে প্রধান কৌশল হিসেবে বেছে নেয়। তারা মাস বা বছর ধরে তাদের লক্ষ্যের গতিবিধি অনুসরণ করত এবং অপ্রত্যাশিতভাবে দিনের আলোয় অথবা কঠিন নিরাপত্তার মধ্যেও উচ্চপদস্থ মন্ত্রী, সুলতান, খলিফা এবং ক্রুসেডার নেতাদের হত্যা করত। তাদের এই কৌশলের মূল উদ্দেশ্য ছিল মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ (Psychological Warfare) সৃষ্টি করা।
কথিত আছে, তাদের এই চরম ভক্তির পিছনে 'হাশিশ' নামক এক প্রকার মাদকের ভূমিকা ছিল। এই মাদক সেবনের কারণেই তাদের হাশাশিন (হাশিশ সেবনকারী) নামে ডাকা হতো বলে প্রচলিত আছে
পতন :
প্রায় দুই শতাব্দী ধরে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে গভীর প্রভাব বিস্তার করার পর, ত্রয়োদশ শতকে হাশাশিনরা এক বিশাল হুমকির মুখে পড়ে। ১২৫৬ খ্রিস্টাব্দে মোঙ্গল নেতা হালাকু খান তাদের আলমুত দুর্গ দখল করেন এবং তাদের শক্তিকে চূর্ণ করে দেন। এই আক্রমণের ফলেই নিজারি ইসমাইলিদের এই বিশেষ সামরিক শাখাটি বিলীন হয়ে যায়।
হাশাশিনদের ইতিহাস মধ্যযুগের এক অন্ধকার অধ্যায়কে তুলে ধরে, যেখানে ধর্মীয় বিশ্বাস, রাজনীতি এবং চরম সন্ত্রাসবাদ একে অপরের সাথে মিশে গিয়েছিল। তাদের কিংবদন্তী আজও সাহিত্য, ভিডিও গেম এবং জনশ্রুতিতে টিকে আছে।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।