বহুদিন ধরেই জ্যোতির নামের পাশে অদ্বিতীয় শব্দটা বসে ছিল। এইটা অনেকের যে পছন্দ না তাও বুঝা যাচ্ছিল। কিন্তু জ্যোতি এমনই একজন যে সব সময়ই মাঠে পারফর্ম করে গেছে। যার কারণে বিরোধী পক্ষ খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি। এবার এসে গেল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ! জ্যোতি এবং বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দল বিশ্বকাপে খুব একটা জুত করতে পারনি। তিনটা খুব ক্লোজ ম্যাচ হেরে গেছে। জিতলে হিসাব অন্য রকম হত। বন্ধুবেশি মানুষজন মুখ খোলার সুযোগ পেল। আমরাও মুখোসের আড়ালের প্রকৃত মানুষদের দেখতে পেলাম।
জাহানারা আলম, যিনি এক সময় বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দলকে নেতৃত্ব দিয়েছে সে একটা সাক্ষাতকার দিলেন মানবজমিন পত্রিকায়। বলা চলে প্রথম বোমটা ফেললেন তিনি। সোজাসুজি জ্যোতিকে দোষারোপ করে, জ্যোতি সিন্ডিকেট করে দল বানিয়ে খেলে। তাদেরকে জ্যোতিই বাদ দিয়েছে। জ্যোতির প্রতি তার তীব্র ক্ষোভ। জ্যোতি মাঠে মেয়েদেরকে গালিগালাজ করে, জ্যোতির গিয়ার ব্যাগ জুনিয়রদেরকে দিয়ে টানায়, জ্যোতি জুনিয়রদের দিয়ে মাথায় তেল দেওয়ায়! এমন হাস্যকর সব কথাবার্তা। মানুষ খুব মজা পেল এবং তাকে কেউ পাত্তা দিল না। বিসিবি থেকে জানানো হল এই সব উড়া অভিযোগ নিয়ে তারা সময় নষ্ট করতে রাজি না, তাঁদের আরও জরুরি কাজ আছে করার।
এবার জাহানারা ফেললেন এটম বোমা! বললেন সাবেক নারী দলের ম্যানেজার মঞ্জুরুল ইসলাম তাকে যৌন হয়রানি করেছে! তাকে জিজ্ঞাস করেছে তার পিরিয়ড কবে শেষ হবে, শেষ হলে যেন দেখা করে! মঞ্জুরুল তাকে কাঁধে হাত দেয় ইত্যাদি। এবার সবাই নড়েচড়ে বসল। এইটাকে তো হালকা করে নেওয়ার উপায় নাই। তাই তদন্ত করা হবে জানানো হল। এর মধ্যে রুমানা আহমেদ নামের আরেক প্রাক্তন অধিনায়ক সাক্ষাৎকার দিয়ে বললেন মঞ্জুরুলের এমন অভিযোগ তিনিও শুনেছেন! খেলা যমে গেল।
এবার আসেন বাংলাদেশের ঐতিহাসিক জনগণ, যাদের বুদ্ধিমাত্তা প্রমাণিত যে দুনিয়ার মধ্যে সবচেয়ে কম। তারা ঝাঁপিয়ে পড়ল জ্যোতির উপরে। কেন? তারা এক গভীর যোগসূত্র আবিষ্কার করল। জ্যোতি সিন্ডিকেট করে দল বানায়, জ্যোতি দলে থাকে কীভাবে? জ্যোতি দলে থাকে হচ্ছে মঞ্জুরুলকে সাহায্য করে! জ্যোতি তার খাটে উঠেই তো অধিনায়ক হয়েছে, এই করেই তো দল চালাচ্ছে! এই দুইটা লাইন লিখতে আমার আঙুল থেমে থেমে যাচ্ছিল কিন্তু সত্যটা কতটা কুৎসিত তা এমন করে না লিখলে বুঝা যাবে না বলেই এমন করে লিখলাম।
যারা জানেন না তাঁদের জন্য জানিয়ে রাখি বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দলের অধিনায়ক নিগার সুলতানা জ্যোতি আমার খালাত বোন। খালাত বোন বললে যেমন মনে হয় তেমন না কিন্তু আমাদের সম্পর্ক। জ্যোতির বড় হওয়া আমাদের উঠানে। খালা তখন আমাদের বাড়িতেই থাকে। আমাদের সাথে খেলতে খেলতেই জ্যোতি আজকের তারকা। আক্ষরিক অর্থেই আমাদের কোলেপিঠে করেই ওর বেড়ে উঠা। বাড়িতে মেয়ে শিশু আর না থাকায় জ্যোতির বড় হওয়াটা হয় আমাদের সাথে ক্রিকেট খেলে। আমাদেরও একটা বল বয় দরকার ছিল, বল মেরে কারো বাড়িতে পাঠিয়ে দিছি, জ্যোতি দৌড়… বলার আগেই জ্যোতি তুফান বেগে ছুটে যেত। সবার শেষ ব্যাট দিতাম, ওইটার জন্যই বসে থাকত। লাস্ট ব্যাটার হিসেবে ওকে বলা হত তুই শুধু দাঁড়ায় থাকবি, উইকেট পড়তে দিবি না। ও দাঁত চেপে দাঁড়ায় থাকত। পায়ে বল লাগলেও একটু উশ আস করে আবার দাঁড়ায় থাকত। ব্যথায় যদি কান্না করে তাহলে তো আর আমরা ওকে খেলায় নিব না, তাই ব্যথা চেপে দাঁড়ায় থাকত। এই হল ওর শুরু। এরপরে বিকেএসপিতে ক্যাম্প, এরপরে ধীরে ধীরে শুধু ওর উত্থান। জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়া, এশিয়া কাপের ফাইনালে জ্যোতির দারুণ সেই ইনিংস, যাতে ভর করে প্রথম কোন বড় টুর্নামেন্ট জেতার স্বাদ পায় বাংলাদেশ। এর আগে পরে এখন পর্যন্ত নারী পুরুষ দল মিলিয়ে আর কোন কাপ জিততে পারে নাই। এরপরে অধিনায়কত্ব। প্রথম বিশ্বকাপ খেলতে যাওয়া, প্রথম বিশ্বকাপেই নজরকারা পারফর্ম করা, এরপরে বিশ্বকাপ স্কোয়াডে সুযোগ পাওয়া। দেশের মাটিতে সিরিজ জেতা পাকিস্তানের সাথে, ভারতের সাথে সমতায় সিরিজ শেষ করা, দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়ে তাদেরকে হারানো, ওয়েস্ট ইন্ডিজকে তাদের মাটিতে হারানো এমন কত কত অর্জন। সবগুলার পিছনে জ্যোতির অবদান অস্বীকার করার সুযোগ নাই। এমন করে জ্যোতি নিজেকে নিয়ে গেছে আলাদা উচ্চতায়। এবার ওর তারকা খ্যাতির বিপরীত চিত্র দেখার সুযোগ আসছে। দেখছে কত কুৎসিত হতে পারে দুর্বল বুদ্ধিমত্তার মানুষের হাতে প্রযুক্তি থাকলে কী করতে পারে তারা!
জ্যোতির আপন বড় ভাই, সম্রাট ভাই একটা পোস্ট দিয়েছিল বোনকে সমর্থন করে। এই বরহ শাবকেরা সেখানেও এসে নিজেদের নোংরা মানসিকতার ছাপ রেখে যেতে থাকল। একজন ভাইয়ের জন্য নিজের বোন সম্পর্কে এমন কুৎসিত মন্তব্য সহ্য করা সম্ভব? আমি জ্যোতির ফেসবুক পেজটা খুলেছিলাম। এরপরে কয়েকজন মিলে পেজটা চালাই। বাকিরা আসলে শুধু শুধু, আমি আর জ্যোতিই এইটা দেখি। আমি এডমিন হিসেবে ওর পেজের আবর্জনা পরিষ্কার করা শুরু করলাম। ব্লক আর ডিলিট করতে শুরু করলাম ছাগলদের। এত এত কমেন্ট আর এত এত ছাগলের পাল যে একটা সময় অসুস্থ বোধ করতে লাগলাম। মনে হচ্ছিল আমার নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়ে যাবে! এবং তখন পর্যন্ত আমি জানি না এডমিন হিসেবে এই যুদ্ধ কীভাবে সামলাব। চারপাশে তাকিয়ে দেখি জ্যোতি একলা। কেউ একটা শব্দ করছে না। ওর পরিচিত লোকজন পর্যন্ত চুপ। সবাই ভাবছে দেখি আগে কোথাকার পানি কোথায় গিয়ে থামে! ঠিক তখন শেরপুরের একজন ক্রিকেটার বড় ভাই জ্যোতির সমর্থনে একটা পোস্ট করে, আমাকে ট্যাগ করে। এতক্ষণের মানসিক চাপের পরে এই পোস্টটা দেখে আমি কান্না করে দিলাম। এবং তখন বুঝলাম যে আমার আসলে মানসিক অবস্থা কোন পর্যায়ে চলে গেছিল। এখনও একই অবস্থা চলমান। তবে কালকে বুদ্ধি করে কমেন্ট অপশনে শুধু মাত্র ফোলোয়ারদের জন্য ওপেন রেখে বাকি বন্ধ করে দিয়েছি। এরপরে একটু শান্তি পাওয়া যাচ্ছে। অন্তত ওর যারা ফোলোয়ার তারা এত কুৎসিত আচারন করতে পারে না বলেই আমার বিশ্বাস ছিল। তা অমূলক ছিল না।
<a href="
https://freeimage.host/i/KpbURG2"><img src="

alt="KpbURG2.md.jpg" border="0"></a>
অন্যদিকে মুখরোচক এমন একটা খবর সামনে চলে আসছে আর কী চাই? নানা পেজে নানা গ্রুপে জ্যোতিকে নিয়ে চলছে রসাল আলাপ। যারা নারী ক্রিকেটের বিন্দুমাত্র খোঁজ রাখে না তারা প্রশ্ন তুলছে জ্যোতি কেমনে দলে সুযোগ পায়? ম্যানেজারের সাথে অনৈতিক সম্পর্ক ছাড়া সম্ভব? অথচ এই দলটার একমাত্র নির্ভরযোগ্য পারফর্মার একজনই সে হচ্ছে জ্যোতি! শত শত, হাজার হাজার কমেন্ট, পোস্ট এখন পর্যন্ত চলমান যেখানে উইচ হান্টিং চলছে। এতে রসদ জুগাচ্ছে এতদিন যাদের ক্ষোভ ছিল জ্যোতির প্রতি তারা। একটা বড় পর্যায়ে যেতে পারলে কিছু মানুষের শত্রু তো হতেই হবে আপনাকে। এর তো বিকল্প নাই। বিশেষ করে এমন ক্ষেত্রে। দলে সুযোগ পায় নাই, মনে ক্ষোভ নিয়ে বসে আছে। এমন একটা কেস দেখলাম চোখের সামনে। এই মেয়ে বিশ্বকাপ দলে সুযোগ পায় নাই। সে রিয়াসাদ আজিম নামের যে সাংবাদিক নামের অপভ্রংশ আছে একজন তাকে সাক্ষাৎকার দিল এই বলে যে জ্যোতি ওকে ধরে মারছে, মাঠের মধ্যে বাপ মা তুলে গালি দিছে! মানুষ যথারীতি এখন জ্যোতির বিপক্ষে যে যাই বলছে তাই অবলীলায় বিশ্বাস করে বসে থাকছে। কিন্তু আমি জানি এই মেয়েকে। ও জ্যোতির দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য করে নাই এমন কোন কাজ নাই! জ্যোতি শেরপুরে আসতেছে, ও ওর সাথে চলে আসত। একবার ঘুরতে আসছে স্বাভাবিক মনে হত। কিন্তু যখন দেখতাম প্রায়ই এই কাজ করে তখন কোনটা এমনেই ঘুরতে আসা আর কোনটা তেল মারতে আসা তা বুঝতে সমস্যা হত না। এমনও হয়েছে জ্যোতি পরেরদিন ভোরে ঢাকা ফিরবে, এই মেয়ে রাতে এসে হাজির! এক সাথে ঢাকায় ফিরবে। আমি জ্যোতি একবার এক সাথে ঢাকা ফিরব, দেখি ভোরে এই মেয়ে গাড়িতে বসে আছে! ও কখন আসল? জ্যোতি শুধু হাসল। আরেকদিন আমি জ্যোতি আর খালা ঢাকা থেকে শেরপুরে ফিরব। সেবার বাসে ফেরা হচ্ছে। আমি বাসস্ট্যান্ডে এসে দেখি এই মেয়ে হাজির! ও যাবে! আরে এইটা কেমন কথা? জ্যোতি এগুলা ভালোই বুঝত। ও সহ্য করত কিন্তু পাত্তা দিত না। আর ও আরও পাত্তা পাওয়ার জন্য আরও এমন কাজ করত। আমি রোমানিয়া থেকে ফেরার পরে আমাকে বলল ভাই এখন কী করবেন? চাকরি ব্যবস্থা করে দিব! আমি আকাশ থেকে পড়লাম। পরে বুঝছি জ্যোতি হয়ত আমাকে নিয়ে ওর টেনশন শেয়ার করছে যে এখন আমি কী করব, কী হবে আমার। এইটা শুনে ও এখানেও এসে বাটার লাগানো শুরু করেছে! তো এমন এক চরিত্র এখন হুট করেই জ্যোতি এত খারাপ যে ওকে ধরে মারত বলা শুরু করে দিল!
মানুষের ছাগলামি কিন্তু শেষ হয় নাই এখনও। নতুন মাত্রা আসল। বেশ কয়েকজন বছর আগে জাহানারার এক চিঠি কবর থেকে তুলে আনা হয়েছে। সেখানে এক আজব বিষয় নিয়ে অভিযোগ করেছে সে। সে বলছে দলের অনেকেই লেসবিয়ানের মত। এদের একটা গ্রুপ আছে, চার পাঁচ জনের। এদের মধ্যের সম্পর্ক নিয়ে ঝগড়া হয়, দলের ক্ষতি হয়। হ্যাঁ, এখানেও জ্যোতি আছে! জ্যোতি লেসবিয়ান এইটাও অভিযোগ! জ্যোতি লেসবিয়ান না কী এইটার প্রসঙ্গ কেন এখানে আসবে তাই তো আমি বুঝছি না! হলেই কী না হলেই কী? এর সাথে তার কী সমস্যা? তখন এমন উদ্ভট অভিযোগ শুনেই তাকে কঠোর ভাষায় সতর্ক করে। দলের মধ্যে এমন অবান্তর অভিযোগ এনে দলের অবস্থা খারাপ করার কোন মানে হয় না। এইটাই ছিল তখনকার সিদ্ধান্ত।
ছাগলেরা আরেকটা অস্ত্র পেয়ে গেল। এখন জ্যোতি হল লেসবিয়ান। মেয়েদের নষ্ট করছে! রংধনু রঙে জ্যোতি ছবি ফেসবুকে ছেয়ে গেল। ওর দলকেই রাঙিয়ে দিল কেউ কেউ! সবাই ভালো, জাহানারা পীর এখন। যা বলছে তাই সঠিক, বাকি সব মিথ্যা। অথচ সে যে একটা ভয়ংকর অভিযোগ করেছে তা নিয়ে অবশ্যই সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া উচিত। বিসিবি তদন্ত কমিটি করেছে, কাজ চলছে। এদিকে অভিযোগ থামছেই না। মঞ্জুরুলের পরে আরও বেশ কয়েকজন সিনিয়র লোকের নাম এসেছে। বোর্ড পরিচালকের নাম আসছে। তো এগুলা তদন্ত হোক। এর সাথে জ্যোতির কী সম্পর্ক? আমার বোন খেলে, আমার ভাস্তি ইতোমধ্যে ঢাকায় প্রথম শ্রেণির টুর্নামেন্ট খেলে আসছে। ও একদিন জাতীয় দলে খেলবে। সেখানে যৌন হয়রানি করে এমন কেউ থাকবে আর আমরা তা মেনে নিব? কখনই না। কিন্তু এর সাথে জ্যোতিকে কেন জড়ানো হচ্ছে? যখন জোর করেই ওকে এতে তানা হচ্ছে তখন আমার সন্দেহ তৈরি হবেই যে তোমরা প্রতিটা অভিযোগই মিথ্যা করেছে। যেমন রোমানা বলল সে জানত মঞ্জুরুলের এমন স্বভাব সম্পর্কে। কীভাবে জানত? সে দেখছে? না দেখে নাই। তার সাথে এমন কিছু করছে? না তার সাথেও এমন কিছু করে নাই! তাহলে? এমন সাক্ষী দিয়ে দুনিয়ার কোন আদালতে কাওকে শাস্তি দিতে পারবেন? এদের অভিযোগ নিয়ে আরও কথা বলাই যায়, ম্যাচ শেষ হলে জড়ায় ধরে এইটাও অভিযোগ তাদের! তবুও যেহেতু স্পর্শকাতর বিষয়, সঠিক তদন্ত হওয়া প্রয়োজন, হোক। কিন্তু এর সাথে জ্যোতির নাম আনা, অকারণে কুৎসিত মন্তব্য করা এগুলা তো সহ্য করব না।
একটু ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করে দেখেন। যদি একই অভিযোগ পুরুষ দলের ক্ষেত্রে উঠত তাহলে কী হত? মানে সিন্ডিকেট করে দল বানানোর বিষয়টা। এবং এরপরে পুরুষ দলের কোন সাবেক কোচিং স্টাফের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ। দুইটার সাথে কোনভাবেই কী কোন যোগ সূত্র আবিষ্কার করত কেউ? না। কিন্তু এখানে বিষয়টা যেহেতু নারীকে ঘিরে, সেহেতু ব্যাপারটা খুব সহজ, - নারী আবার এমনে এমনেই সফল হয় নাকি? নারী সফল হয় একমাত্র পুরুষের ভোগে লাগলে!
ক্রীড়াঙ্গন আর নারী ক্রীড়াঙ্গন বলে আমি প্রথমে বেশ বড় ধাক্কা খেয়েছি। বিশেষ করে যখন জ্যোতির ভাবমূর্তি পুরো ক্রীড়াঙ্গন জুড়েই অসাধারণ ছিল। তাই ধাক্কাটা বেশিই খেয়েছি। কিন্তু ধীরে ধীরে বুঝলাম এইটা এই দেশে বহু নারী বহু বছর ধরে সহ্য করে আসছে। তাদের অবদানকে খাটো করা হয়েছে তাদের লিঙ্গ দিয়ে। নারী? তাহলে একটাই অর্থ তা হচ্ছে নিশ্চয়ই তলে তলে কিছু একটা আছে! কেউ বাদ নাই এই তালিকা থেকে। শিক্ষক, সাংবাদিক, নার্স, পুলিশ, সামরিক বাহিনী… আপনি বলে জান যে কোন পেশা, দেখেন পুত পবিত্র কাওকে পান কি না! সবাই শোয়! শুয়ে শুয়েই নারী এতদূর আসছে, আর কোন ভাবেই সম্ভব?
বরঞ্চ ক্রীড়া ক্ষেত্রেই এইগুলা ছিল না, কারণ এখানে আপনাকে সুযোগ করে দেওয়ার উপায় নাই। আপনাকে প্রতি নিয়ত প্রমাণ কর যেতে হয় আপনার জায়গা, এইটা এমন জায়গা যেখানে ভিতরে কিছু না থাকলে হাওয়া বাতাস দিয়া কাজ হয় না। মাঠে নামতে হবে, দুনিয়ার মানুষ নিবিড় দৃষ্টিতে দেখছে আপনাকে, ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ নাই, চুল পরিমাণ সুযোগও নাই। যদি ধরে নেই যে তবুও দিল কেউ কাওকে সেই সুযোগ, তো? সে মাঠে খেলে দিয়ে আসবে?
একজন কণ্ঠ শিল্পীর ভিতরে কিছু না থাকলে তাকে বিশাল বড় ব্রেক দিলেই লাভ কী? তার তো গাইতে হবে। ফাঁকির সুযোগ কই এখনে? ছোট বেলা থেকে দেখে আসছি কত স্টার কিডকে সিনেমায় আনা হয়। যারা যোগ্য তারা টিকে গেছে ঠিকই, বাকিরা? কই হারিয়ে গেছে কেউ খবরও জানে না। অন্য পেশার নারীদেরকে আমি ছোট করছি না, বলতে চাচ্ছি যে পেশা গুলোতে সরাসরি প্রমাণের বিষয় থাকে সেখানে ফাকিঝুকি চলে না। কিন্তু এখানে সেটাও প্রমাণ করতে ব্যস্ত সবাই।
এই কাতারে সবাই আছে, আমি দাঁড়ি টুপিওয়ালা থেকে শুরু করে সব শ্রেণির মানুষকে দেখছি কুৎসিত মন্তব্য করতে, অশ্লীল শব্দবানে আমাদেরকে জর্জরিত করতে। দেখছি উচ্চ শিক্ষিত কিছু প্রাণীকে, বিদেশে পড়াশোনা করছে এমন উন্নত ছাগলকে। সবাই আছে, নারীকে হেয় করতে পারলে যে সুখ তা আর অন্য কোথাও কই? একটা অশ্লীল শব্দ বলে মুখের যে খাওজানি মিটে তা আর কিসে মিটে? জগতের সকল অন্ধকার এদের মনে ভিতরে। তা উগ্রে দিতে এরা প্রস্তুত। কোথায় কী বলছে তাও জানে না। জানে শুধু এই করলে কুৎসিত সুখ মিলে। তাই ভাইয়ের পোস্টের নিচে এসে নিজের কদর্য ঢেলে দিতে এদের বাঁধে না। দুইজনের একজনকেও কেউ চিনে না অথচ মন্তব্য করছে দেধারছে! আমি ভুলেই গেছিলাম এরাই সাকিবের ছোট্ট মেয়েকেও ছাড়ে নাই কুৎসিত মন্তব্য করতে, নিয়ম করে সাকিবের স্ত্রীকে নছিহত দিত এরাই।
এগুলা এতদিন দেখছি নাটক সিনেমায়। মুহূর্তের মধ্যে কোন কারণ ছাড়াই ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে মানুষের জীবন। এই বঙ্গভূমিতে ফেসবুক নামক মাধ্যম কী করতে পারে তা এই কয় বছরে বহুবার দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। তবে সম্ভবত সেই শিক্ষা বাকি ছিল কিছু, তা পূরণ হচ্ছে এবার। ভালো না?
জ্যোতির প্রতি প্রধান যে অভিযোগ, জ্যোতি সিন্ডিকেট করে সবাইকে বাদ দিয়েছে, তাকে বাদ দিয়েছে, নিজের পছন্দ মত খেলোয়াড় নিয়েছে! সিন্ডিকেট বিষয়ে নিচে শ্রীলংকান হাসান তিলকরত্নে বিদায় বেলায় যে সাক্ষাৎকার দিয়ে গেছিলেন প্রথম আলোতে তার লিংক দিচ্ছি, একটু পড়ে দেখবেন। কারা সিন্ডিকেটের আব্বা আম্মা সব বুঝা যাবে। জ্যোতিকে তাদের সিন্ডিকেট ভেঙে ঢুকতে হয়েছে। এই সিন্ডিকেটের কারণে দল একটা বৃত্তেই আবদ্ধ থেকেছে। কিন্তু সেই দিন আর থাকে নাই যার ফলে এত যন্ত্রণা। এই সাক্ষাৎকারে তিলকরত্নে পরিষ্কার করে বলেছেন তিনি এই সিন্ডিকেট ভেঙ্গেছেন। এতে জ্যোতির ভূমিকা কী ছিল এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছেন, - " সে খুবই ভালো অধিনায়ক। পরিস্থিতি খুব ভালো বোঝে। ও নিজেও চাইছিল এটা (গ্রুপিং) বদলাতে।" আচ্ছা, এতে লাভ হয়েছে না ক্ষতি হয়েছিল দলের?
অধিনায়কের সাথে পরামর্শ করে কবে দল গঠন করেছে বাংলাদেশ? এইটা নিয়ে কি কম আক্ষেপ আমাদের? নারী ক্রিকেটের আলাপ বাদ, পুরুষ দলেরই কতবার আমরা শুনেছি না যে অধিনায়ক জানেই না দলে কে আসছে বা যাচ্ছে? বছর কয়েক আগে সাকিব কিছুটা ভূমিকা রাখা শুরু করে। এর আগ পর্যন্ত নির্বাচকেরাই সব ঠিক করত। এতে আর কারো ভূমিকা রাখার সুযোগ খুব কমই থাকত। যেখানে পুরুষ দলেই এই অবস্থা সেখানে নারী দলে জ্যোতি এত বড় বড় সিনিয়র খেলোয়াড়দেরকে বাদ দিয়ে দিল? বিসিবি তা মেনে রাজিও হয়ে গেলে? এমনও হয়?
জাহানারার বাদ পড়ার মূল কারণ জ্যোতি না, মারুফা নামের এক বিশ্বময় বালিকার আগমন। আমাদের দল তৈরি হয় স্পিন নির্ভর। একজনের জায়গা থাকে পেসারের জন্য। এখন আমাকে বলেন দুনিয়ার কোন নির্বাচক মারুফাকে রেখে জাহানারাকে দলে রাখবে? শুরুতে তবুও তাকে টানা হয়েছে। পরে বুঝা গেছে মারুফাকে অতিক্রম করা তার পক্ষে সম্ভব না। তাই স্থায়ী ভাবেই বাদ। এখন কেন এক পেসার, কেন স্পিন নির্ভর দল এগুলা নিয়ে তর্ক হতে পারে কিন্তু তা ভিন্ন তর্ক। আলোচনা তা নিয়ে হচ্ছে না আজকে।
জাহানারার আরেক বিস্ফোরক অভিযোগ জুনিয়রদেরকে জ্যোতি চাপে রাখে। মারধর করে, নিজের ব্যক্তিগত কাজে খাটায়! এইটা আরেকটা ঢাহা মিথ্যা কথা না? জ্যোতির জুনিয়রদের প্রতি আলাদা সম্পর্ক দেখে এর আগে নিউজ হয় নাই? ও কত চমৎকার ভাবে জুনিয়রদেরকে আগলে রাখে তা নিয়ে কত প্রশংসা আমরা দেখি নাই? মাশরাফির সাথে তুলনা করে আলোচনা হয় নাই? এবং এটা তো মিথ্যা না, আসলেই তো আগলে রাখে প্রতিটা বাচ্চাকে। আমার যতবার জ্যোতির দলের কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ হয়েছে, যতবার এই জুনিয়রদের দেখার সুযোগ হয়েছে ততবারই আমার মনে হয়েছে এরা জ্যোতিকে মাথায় নিয়ে রাখে। মুগ্ধতা ছাড়া আর কিছু দেখি নাই। এই ভালোবাসা মারধর করে পাওয়া যায় না আমার বলেই আমার বিশ্বাস। উল্টো জ্যোতি এই জুনিয়রদের তৈরি করতে কী পরিমাণ মেধা, শ্রম খাটায় তা যারা না দেখছে তারা বললে বিশ্বাস করবে কি না তা আমার জানা নাই। সত্য হচ্ছে আমার কাছে বেশি বেশিই মনে হত। কিন্তু আমি এটাও জানি আমি জ্যোতি না, জ্যোতি জ্যোতিই। ওর চিন্তা ভাবনা গতানুগতিক না। এই জন্যই ও আলাদা, এই জন্যই ও ক্যাপ্টেন।
সিনিয়রদের যখন বিদায় নিতে হয় তখন আমাদের উপমহাদেশে প্রায় সব সময়ই একটা সিনেমা তৈরি হয়। গাঙ্গুলিকে বাদ দেওয়া নিয়ে ধোনির সাথে গণ্ডগোল, পরে ধোনির বাদ পড়া নিয়ে রোহিত শর্মা, এখন যেমন রোহিত শর্মাকে নকিং করা শুরু করে দিয়েছে পিছন থেকে। পাকিস্তানের অবস্থা তো আরও খারাপ। ওয়াসিম আকরামের মত লিজেন্ড অবসরটা স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারে নাই। আরও খেলবে আরও খেলবে বলে শেষ শেষ খেলাটাই আর খেলতে পারে নাই! এখন আমাদের নারী ক্রিকেটাররাও সেই রোগে আক্রান্ত। তারা আল্লাই জানে কতদিন খেলতে চায় আরও। হাসান তিলকারত্নে বিদায়ই সাক্ষাৎকারে সিনিয়রদের বাদ দেওয়ার প্রসঙ্গে বলছে আমার যে রেকর্ড আমিও তো তাহলে এখনও শ্রীলংকা দলে খেলতে চাইতে পারি! কিন্তু তা তো আর সম্ভব না।
জ্যোতি সিনিয়রদের বাদ দিয়ে দল নিজের মত গুছাতে চেয়েছে? হয়ত চেয়েছে। আমাদের এখানে তার ক্ষমতা কতটুকু তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। মানুষ এমন ভাবে মন্তব্য করছে যে ও বিসিবির প্রেসিডেন্ট। ও নিজেই দল বানাচ্ছে, দল নিয়ে খেলতে যাচ্ছে! কোন কোচ নাই, ম্যানেজার নাই, নির্বাচকেরা কেউ নাই! আশ্চর্য। তারপরেও জ্যোতি যদি এমন করে থাকে তাহলে তা ভবিষ্যতের কথা ভেবেই করেছে। তা না হলে এখনও রোমানাই তার সেই বল করে যেত, রাবেয়ার মত অসাধারণ লেগ স্পিনারের আগমন ঘটত না। স্বর্ণার মত প্রতিভা আমরা দেখতাম না। এই বাচ্চা মেয়ে গুলোকে জ্যোতি একেবারে হাতে ধরে তুলে আনছে। এরা যতদিন সার্ভিস দিবে তা আর কেউ দিতে পারবে না। আজকে রেজাল্ট নাই বলে এত কথা হচ্ছে, আমি লিখে দিচ্ছি এখানে যে জ্যোতির এই সিদ্ধান্তের ফলাফল বাংলাদেশ পাবে, এরা একেকজন লড়াকু হিসেবে সামনে আসবে। নেতৃত্ব দিবে ক্রিকেট বিশ্বকে। জ্যোতি এই কাজটাই করে গেছে।
আমাদের উপর দিয়ে এমন একটা ঝড় বয়ে যাবে তা আমরা কোনদিন চিন্তাও করি নাই। কিন্তু এতে একটা কাজ হয়ে গেছে, আমরা এখন জানি কার চেহারা কেমন, কার ভূমিকা কোন সময় কেমন হবে। এইটাই বড় শিক্ষা। বাকি এই ভূখণ্ডের ছাগলদের নিয়ে আর কিছু বলার নাই। এই জনগোষ্ঠীর উপরে শ্রদ্ধাবোধ হারায় গেছে ম্যালা আগেই। এখন আরও বেশি করে তা উপলব্ধি করছি। এরা একজন নারীর যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করতে গিয়ে আরেকজন নারীর কাপড় খোলায় ব্যস্ত হয়ে গেছে, এবং এইটা নিয়া বিন্দুমাত্র চিন্তা ভাবনা নাই তাদের! সারাদিনে হাজার খানেক কমেন্ট ডিলিট আর ব্লক মেরেছি, কিন্তু নর্দমার কীটের অভাব এই দেশে নাই, আসতেই আছে। ঠিকমত জানেও না কী ঘটনা, একটু গালি দিয়া যাই নিয়তে এসে যাচ্ছে। জ্যোতির পেজ সামলানো খুব সহজ ছিল। টক্সিক লোকজন ছিল না বললেই চলে। এতদিন যারা ঘাপটি মেরে ছিল তারা সুযোগ পাইছে, এবং নিজেদের দুর্গন্ধে চারপাশের পরিবেশ নষ্ট করে চলছে। জ্যোতি আমার মত এত দ্রুত ভেঙে পড়ার মেয়ে না। ফোন দিয়ে কথা বললাম, ও দেখলাম পরিষ্কার জানে এরপরে কী করতে হবে! ও জানে, ও লড়াই করেই শীর্ষ পর্যন্ত গেছে। ছাগল মার্কা কোন সাংবাদিক আবোলতাবোল বকে যোদ্ধাকে হারিয়ে দিবে? অসম্ভব!
( যেহেতু জাতীয় ইস্যু তাই দুই একটা কথা যোগ না করে থাকতে পারছি না। এখানে এক ভাই বোনের পক্ষ নিয়ে লিখছে। এখানেও দয়া করে ফেসবুকের নোংরামি হাজির করবেন না। এখানে যুক্তি যা আছে তা আছে, আবেগ আছে দুই হাজার ভাগ)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।