আজকে দুপুরে হুট করেই শেরপুর সরকারি গ্রন্থাগারে গিয়ে ছিলাম। আমার সদস্য কার্ডটার মেয়াদ শেষ, ভুলে যাই শুধু, আজকে মনে পড়তেই গেলাম। তমিজ ভাইকে টাকা দিয়ে ভিতরে ঢুকলাম। এই গ্রন্থাগারের কাছে আমি যে কত ঋণী তা বলে প্রকাশ করার মত না। ভিতরে ঢুকে দেখি ক্লাসিক সব ইংরেজি বই গুলো আছে। কার নাম নিবেন? হ্যারি পটার থেকে শুরু করে ডেভিড কপারফিল্ড সবাই আছে। ব্রাম স্টোকারের ড্রাকুলা হাতে তুলে নিয়ে কিছুক্ষণ পড়লাম। বইটা হাতে নিয়েই আমার মনে হয়েছে রকিব হাসানের কথা। এই সব বিশ্ব সাহিত্যের ধ্রুপদী লেখা আমাদের জন্য নিয়ে আসছিল সেবা প্রকাশনী, যারা এই অসাধ্য সাধন করে ছিল তাঁদের মধ্যে জ্বলজ্বল করছে রকিব হাসান। বাড়ি ফিরে ফেসবুকে ঢুকেই দেখি রকিব হাসান আর নাই!
সেবার লেখকদের কেন জানি মূল ধারার সাহিত্যিকেরা কখনই সাহিত্যিক মর্যাদা দিতে চায় নাই। তারা যেন থেকেও নাই, তারা যেন সব সময়ই ব্রাত হয়ে রইলেন! কিন্তু বাংলাদেশের প্রতি একশ জন পাঠকের মধ্যে ৮০/৯০ জন সেবার কাছে ঋণী। সেবা যাদের মধ্যমে এই পর্যায় পৌছাল তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে রকিব হাসান। কিংবদন্তি কাজী আনোয়ার হোসেনের পরে যদি একটা নাম নিতে হয় এই সারিতে তাহলে তিনি রকিব হাসান। সেই লিজেন্ড চলে গেল আজকে।
আমরা তিন গোয়েন্দা পড়ছি পাগলের মত। আমার বয়সই প্রত্যেকটা বই পড়ুয়া কিশোরের স্বপ্ন ছিল তিন গোয়েন্দা। আমাদের বয়সই তিন গোয়েন্দা পাঠকেরা নিজেরা একটা গোয়েন্দা সংস্থা বানাতে চায় নাই এমন সম্ভবত একজনও নাই। না বানাতে চাইলেও তিন গোয়েন্দা থেকে একটা চরিত্র নিজের মধ্যে ধারণ করে নাই এমন নাই। কেউ নিজেকে কিশোর মনে করত, কেউ রবিন কেউ মুসা আমান। নিজেকে একটা ধরে নিয়ে এবার ঝাপ দাও মহাসমুদ্রে, হারিয়ে যাও আমাজন বনে, কিংবা আড্ডায় মাত রকি বিচে। আমাদের অভিযান চলতেই থাকে। আমরা স্বর্গ পাতাল এক করে ঘুরতাম রকিব হাসানের হাত ধরে। স্যালভিজ ইয়ার্ড, মেরি চাচি, রাশেদ পাশা আমাদের অতি পরিচিত। আমাদের রোমাঞ্চ ভরা কৈশোর, আমাদের রঙ্গিন সব স্বপ্নের কারিগর রকিব হাসান।
১৯৭৭ সালে ঢাকার এক পুরাতন বইয়ের দোকানে ইংরেজি বই খুঁজতে খুঁজতে দেখা হয়ে যায় সেবার আরেক কিংবদন্তি শেখ আব্দুল হাকিমের সাথে। তিনি ধরে নিয়ে জান সেবার অফিসে, কাজীদার সাথে দেখা করাতে। কাজীদার নামে মাসুদ রানা দিয়ে শুরু। এরপরে কাজীদার আরেক ছদ্মনাম শামসুদ্দিন নওয়াব নামে জুলভার্নের অনুবাদ। এবং এরপরে ক্যানেথ অ্যান্ডারসনের শিকার কাহিনী নিয়ে বই জঙ্গল, যা প্রকাশ নিজের নামে রকিব হাসান। রবার্ট আর্থারের লেখা থ্রি ইনভেস্টিগেটরস সিরিজের বই পড়ে তাঁর মনে হল ছোটদের জন্য এই বই বের করা যায়। জন্ম হল প্রথম আলো জরিপে শিশু কিশোরদের পড়া সবচেয়ে জনপ্রিয় সিরিজ তিন গোয়েন্দা। লিখলেন প্রথম বই তিন গোয়েন্দা। এরপরে একে একে লিখলেন কঙ্কাল দ্বীপ, রুপালি মাকড়সা। এবং এখনও মনে হয় এরপরে আরও দারুণ বই পড়লেও এই তিনটাই হচ্ছে সেরা তিন গোয়েন্দা। কিংবা বলা চলে যেহেতু এগুলাই প্রতম পড়া হয়েছিল তাই হয়ত এরচেয়ে ভালো আর কিছুই মনে হয় না আর। ১৯৮৫ সালে শুরু হয় তিন গোয়েন্দার পথচলা। তা চলতেই থাকে, রকিব হাসন লিখেছেন প্রায় দেড়শ বই! যা এখন পর্যন্ত তুমুল জনপ্রিয়। তিন গোয়েন্দার পরিচিতি লেখাটাও এখন পর্যন্ত আইকনিক হয়ে আছে। পুরোটা এখন আর মনে নাই, কপি করে দিলাম উইকিপিডিয়া থেকে-
"হ্যাল্লো কিশোর বন্ধুরা—
আমি কিশোর পাশা বলছি অ্যামিরিকার রকি বীচ থেকে। জায়গাটা লস অ্যাঞ্জেলসে, প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে। হলিউড থেকে মাত্র কয়েক মাইল দূরে। যারা এখনও আমাদের পরিচয় জানো না, তাদের বলছি আমরা তিন বন্ধু একটা গোয়েন্দা সংস্থা খুলেছি। নাম
তিন গোয়েন্দা।
আমি বাঙালি, থাকি চাচা-চাচীর কাছে। দুই বন্ধুর একজনের নাম মুসা আমান। ব্যায়ামবীর, আমেরিকান নিগ্রো; অন্যজন আইরিশ আমেরিকান, রবিন মিলফোর্ড, বইয়ের পোকা।
একই ক্লাসে পড়ি আমরা।
পাশা স্যালভিজ ইয়ার্ডে লোহা-লক্কড়ের জঞ্জালের নিচে পুরান এক মোবাইল হোম-এ আমাদের হেডকোয়ার্টার।
তিনটি রহস্যের সমাধান করতে চলেছি—
এসো না, চলে এসো আমাদের দলে।"
শুধু এইটুকু পড়েই কতবার যে কত যে শিহরিত হয়েছি তার কোন ইয়ত্তা নেই।
তিন গোয়েন্দার বাহিরেও যেহেতু আমার পড়ার অভ্যাস ছিল তাই রকিব হাসানকে আমি আরও বেশি করে পেলাম। দেখি এই লোক এডগার রাইজ বারোজের টারজান অনুবাদ করেন! টারজান নিজেও জানে না রকিব হাসানের টারজান কত দুর্দান্ত ছিল! বাংলা ভাষায় অনুবাদকে অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছে সেবা প্রকাশনী। কাজীদা এর রূপকার, রকিব হাসান ছিলেন তাঁর যোগ্য শিষ্য। আরও একটু বড় হয়ে পড়লাম আরব্য রজনী। আরব্য রজনী যে বাচ্চাদের বই না তা এর আগ পর্যন্ত আমার জানা ছিল না। রহস্য উপন্যাস লিখেছেন, লিখেছেন রহস্য পত্রিকায়। সব জায়গায় তিনি অনন্য। লেখার কী অসাধারণ ভঙ্গি! এক টানে হারিয়ে যাচ্ছে পাঠক গল্পের ভিতরে।
সেই রকিব হাসান আজকে চলে গেলেন! দুই একদিন আগে ফেসবুকেই দেখিছিলাম যে তিনি অসুস্থ। কাজীদার পুত্রবধূ তাঁর ফেসবুকওয়ালে ছবি দিয়েছিলেন রকিব হাসানের। অসুস্থ রুগ্ন আমাদের কৈশোরকে রঙ্গিন করে দেওয়া লেখকটা, দেখে একটুও ভালো লাগেনি। একটু আগে তাঁর ওয়ালেই দেখলাম মৃত্যু সংবাদটা। আহ! যার নাম শুনলে, পড়লেই কানে ভেসে আসে হ্যালো হ্যাল্লো কিশোর বন্ধুরা…
সেবার তিন উজ্জ্বল নক্ষত্র হারিয়ে গেল আমাদের মাঝ থেকে। কাজী আনোয়ার হোসেন, শেখ আব্দুল হাকিম আর আজকে রকিব হাসান! চির বিদায় প্রিয় লেখক আবুল কাশেম মোহাম্মদ আবদুর রকিব হাসান!
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।