স্কুইড গেম শেষ হয়ে গেল। কোরিয়ান কোন সিরিজ সারা দুনিয়ায় এমন করে আলোড়ন তৈরি করবে এইটা নির্মাতারাও সম্ভবত ভাবে নাই। কিন্তু গল্প, নির্মাণ, অভিনয় সব মিলিয়ে স্কুইড গেম অন্য এক মাত্রায় চলে গেছে। মাত্র তিন সিজনে বহুদিন মনে রাখার মত একটা সিরিজ হয়ে গেছে স্কুইড গেম।
গল্পটাই এর মূল শক্তি। সাথে যুক্ত হয়েছে অভিনয় আর পরিচালনা। যখন প্রথম পর্ব দেখি তখন, একদম শুরুতেই হুক করে গল্পটা। আরে কী হচ্ছে এইসব! বাচ্চাদের সব খেলা নিয়ে কোটি টাকা খেলার গল্প! সব বিধ্বস্ত লোকজন, সমাজে সব হারিয়েছে, সম্মান, টাকা পয়সা সব। এমনই অবস্থা যে টাকার জন্য এরা সব করতে রাজি। কিন্তু 'সব' বলতে আমরা কী বুঝি? এই সবের ফাঁদে পড়ে সব খেলোয়াড়রা। টানটান উত্তেজনা প্রতিটা পর্বে এবং প্রথম সিজনের প্রথম পর্ব থেকেই। ২২ পর্বের মধ্যে এমন একটা পর্বও হয়ত পাওয়া যাবে না যেখানে মানুষ একটুর জন্য স্বস্তি নিয়ে বসেছে। আর শেষ সিজনে সব উজাড় করে দিয়েছে।
গল্পটা গেম খেলার হলেও মূলত পরিচালক বর্তমান দুনিয়ার অর্থনৈতিক অবস্থাই দেখিয়েছে। এবং কী দুর্দান্ত ভাবেই না দেখিয়েছে। মানুষ টাকার কাছে বন্দি, টাকার জন্য করতে পারে না এমন কোন কাজ নাই। আর সাধারণ এই মানুষকে এমন কাজে বাধ্য করছে কে? যাদেরকে দেখা যায় না, ছোঁয়া যায় না, পর্দার অন্তরালেই থেকে যায় তারা। আমরা মনে করছি আমরা টাকার জন্য লড়ছি, আমাদের সমাজ ব্যবস্থা এমন করে রেখেছে যে আমরা বাধ্য এই সমাজে টাকার জন্য জীবন দিয়ে দিতে। যারা এমন একটা সিস্টেম দাঁড় করিয়ে রেখেছে তারা কারা? যারা আমাদের ভাগ্য নির্ধারণ করছে, যারা নিজদের স্বার্থে শিশুকে পর্যন্ত ছাড় দিচ্ছে না, দুধের শিশু পর্যন্ত তাদের খেলার গুটি! বিলিয়ন বিলিয়ন টাকা দিবে, মানুষের চেহারা পরিবর্তন হয়ে যাবে, বাবা শিশু সন্তান চিনবে না! যারা শোষকের পক্ষে কাজ করছে তারাও এক সময় শোষিতই ছিল, শাসকের হাত হিসেবে কাজ করছে কিন্তু জানেই না কেন করছে, কাদের উপকার করছে কেন করছে!
মানুষ কী একেবারেই শেষ? মানুষের মনুষ্যত্ব টাকার কাছে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে? সবাই একই? না, কেউ কেউ আছে যারা সব কিছুর ঊর্ধ্বে মনুষ্যত্বকে আগলে রাখে, জীবন দিয়ে হলেও। পরিচালক যেমন এইটা দেখিয়েছে তেমনই আবার দেখিয়েছে যে এক জায়গায় শেষ হলেও সমাজের এই গেম সারা দুনিয়া জুড়েই আছে। শেষ দৃশ্যে দেখায় আমেরিকার এক গলিতে কেট ব্লানচেট গেমের জন্য শিকার ধরছে, বাজির ফাঁদে ফেলছে একজনকে। এই দৃশ্য দেখে আমি ভাবছি যে এইটাই হয়ত শেষ সিজন না, সমানে হয়ত গেম আমেরিকায় দেখাবে। পরে পরিচালক হওয়াং ডং-হিউকের এক সাক্ষাৎকারে দেখলাম যে না সিরিজ শেষ। তিনি সমাজের অবস্থা যে সব জায়গাই একই, গেম যে চলছে কোথাও না কোথাও এইটাই দেখাতে চেয়েছেন।
অভিনেতাদেরকে চিনি না। কিন্তু সবাই অসাধারণ অভিনয় করেছে। বিশেষ করে প্রধান যে কয়টা চরিত্র ছিল তারা প্রত্যেকেই দুর্দান্ত ছিল। সিনেমাটোগ্রাফিতে কে কাজ করছে জানি না কিন্তু মুগ্ধ করে রেখেছিল প্রতিটা পর্বে। সব রেখে আমার আবার গল্পের গল্পই করতে ইচ্ছা করছে শুধু। বর্তমান পুঁজিবাদ সমাজ ব্যবস্থাকে এমন নগ্ন করে আর কেউ দেখিয়েছে কি না জানি না আমি। যে গেম গুলো জীবন মরণ হয়ে উঠে সেই গেম গুলোরও প্রতিটা জীবনের সাথে সম্পৃক্ত। জীবন একেকজনের জন্যে একেক রকম, জীবনে শত্রুর সাথে জীবনের জন্য এক হতে হচ্ছে, একটু ভুল করলেই জীবন নিয়ে নিচ্ছে। এদিক সেদিক করার কোন সুযোগ নাই।
তিন সিজনে ছয়টা এমি জেতা এই সিরিজের আগে সর্বশেষ কোন সিরিজ দেখে এমন অনুভূতি হয়েছে আমার মনে নাই। ব্রেকিং ব্যাড? ডার্ক? জানি না। স্কুইড গেমের কথা লম্বা সময় মনে থাকবে এইটাই হচ্ছে কথা।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।