সপ্তম অধ্যায়
সংস্কৃত কলেজে শিক্ষাসংস্কার – বিলিতি তলোয়ারের খাপে দিশি খাঁড়া ভরবার কসরত
‘সংস্কার’ কথাটির মূল অর্থ মনের ওপর ছাপ বা দাগ। ছাপহীন বা দাগহীন মন অসম্ভব এবং অবাঞ্ছনীয়। এই ভাবে বুঝলে সংস্কারহীন মানুষ জড়বুদ্ধি বা মুক্তপুরুষ হতে পারে, সভ্য হতে পারে না। ধর্ম সংস্কারক বা সমাজসংস্কারক তাই শুধু পুরাতন, জড়ীভূত কালের অনুপযোগী সংস্কারগুলিকে ধ্বংস করেই ক্ষান্ত হন না, বিচার ও বিবেকের দ্বারা পরীক্ষিত, যুগের বৈপরীত্যগুলির মধ্যে সমন্বয়কারী একগুচ্ছ নতুন ভাবনা ও আচরণের অভ্যাস বা সংস্কার তিনি প্রবর্তনও করেন।
— অরিন্দম চক্রবর্তী, মননের মধু
কর্মজীবনে তিন-তিনবার চাকরি বদলের পরে, সংস্কৃত কলেজে অধ্যক্ষের পদে থিতু হন বিদ্যাসাগর। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে প্রথমে প্রায় সাড়ে চার বছর ও পরে প্রায় পৌনে দু-বছর সময়কালে, তাঁর শিক্ষাসংস্কারের কোনও সংবাদ পাওয়া যায় না। অবশ্য সে সুযোগও তাঁর ছিল না। মধ্যবর্তী সময়ে তিনি সংস্কৃত কলেজের জন্য শিক্ষা পরিকল্পনা পেশ করলেও, তা গৃহীত হয়নি। সম্পাদক ও সহকারী সম্পাদকের পদ রাতারাতি বিলোপের ফলে অধ্যক্ষরূপে অবাধ দাপট, অসীম কর্তৃত্ব ও একক ক্ষমতা লাভ করে, তিনি মনোযোগী হন কলেজটিকে ঢেলে সাজানোর কাজে। বস্তুতপক্ষে সংস্কৃত কলেজে বিদ্যাসাগরের ‘শিক্ষাসংস্কার’-এর বিষয়টি নিয়ে ভক্ত গবেষকরা এতটাই গদগদ যে, তাঁদের সমবেত ভক্তির আড়ালে চাপা পড়ে গেছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। হয় সেই অপ্রিয় বিষয়গুলো তাঁরা আড়াল করতে চেয়েছেন, নতুবা সম্পূর্ণ এড়িয়ে গেছেন।
এ বিষয়ে সর্বপ্রথম পরিশ্রমী গবেষণা করেন ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। বিদ্যাসাগর-প্রসঙ্গ (১৩৩৮) গ্রন্থে তিনি সংস্কৃত কলেজে বিদ্যাসাগরের শিক্ষাসংস্কারের যে বিষয়গুলিকে তুলে ধরেন, সেগুলি যথাক্রমে এই — ১) কলেজে ব্রাহ্মণ ও বৈদ্য ছাড়াও কায়স্থদের ভর্তি হওয়া, ২) প্রচলিত অষ্টমী ও প্রতিপদের পরিবর্তে কলেজ কেবল রবিবার বন্ধ রাখা, ৩) ব্রাহ্মণ, বৈদ্য ও কায়স্থদের পাশাপাশি সমস্ত সম্ভ্রান্ত হিন্দুসন্তানের কলেজে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাওয়া, ৪) হিন্দু কলেজ ও কলকাতা মাদ্রাসার ছাত্রদের মতো সংস্কৃত কলেজের ছাত্রদের জন্যও ডেপুটিগিরির সুযোগ করে দেওয়া, ৫) ছাত্রদের জন্য বেতন চালু করা, ৬) ব্যাকরণ শ্রেণিতে মুগ্ধবোধ পড়ানোর বিলুপ্তি, ৭) পাঠ্যক্রমে ইংরেজি আবশ্যিক করা এবং ৮) দর্শনের পাঠ্যসূচী নিয়ে ব্যালান্টাইনের সঙ্গে তাঁর বিতর্ক। ব্রজেন্দ্রনাথের গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার ৮৯ বছর পরেও, এ বিষয়ে আপামর বাঙালির ভক্তির প্রাবল্য এতটুকু কমেনি! আমরা বিদ্যাসাগরের এই আটটি শিক্ষাসংস্কার মূল্যায়ন করার যথাসাধ্য চেষ্টা করব, যদিও আলোচনার সাযুজ্যের কারণে ব্রজেন্দ্রনাথের ক্রমটি লঙ্ঘিত হবে।
১৮৩৫-এ দেশে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রচলনের পর থেকেই, সংস্কৃত কলেজের আর্থিক হাল ক্রমে খারাপ হতে থাকে। ১৮৩২-৩৪ সালে কলেজে বার্ষিক ব্যয়বরাদ্দ ছিল গড়ে ২৪ হাজার টাকা, ১৮৩৫ থেকে ১৮৫১ পর্যন্ত তা কমে হয় বার্ষিক গড়ে সাড়ে ১৬ হাজার টাকা।১ ১৮৩৫-এ কলেজে ছাত্রপিছু সরকারের ব্যয় ছিল প্রায় ১৬২ টাকা, ১৮৫১-তে তা কমে হয় মাত্র ৬২ টাকা।২ মেকলে তাঁর বিখ্যাত প্রস্তাবে বলেন, কলকাতার মাদ্রাসা আর সংস্কৃত কলেজ – দুটোই তুলে দেওয়া হোক। প্রাচ্যভাষা চর্চার জন্য দিল্লির মাদ্রাসা আর কাশীর সংস্কৃত কলেজ রাখাই যথেষ্ট। এমনকি সেখানেও ছাত্রদের বৃত্তি হিসেবে নগদ টাকা দেওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই। ওসব ভাষাচর্চা করার ইচ্ছে থাকলে, ছাত্রদের পকেটের কড়ি খসিয়ে শেখাই বরং ভালো। বৃত্তির প্রলোভন দেখিয়ে দেশীয় ভাষাচর্চার প্রতিষ্ঠানগুলিতে ছাত্রদের ভর্তি করার প্রথাকে মেকলে ‘bribe’৩ বলতেও দ্বিধা করেননি।
ইংরেজি শিক্ষার প্রতি চাহিদা বৃদ্ধির প্রমাণ পেশ করে মেকলের দোসর ট্রেভেলিয়ান বলেন, ১৮৩৬ সালের ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে হিন্দু কলেজের ছাত্রদের থেকে বেতন বাবদ সরকারের আয় হয়েছে ১৩২৫ টাকা, অথচ সংস্কৃত কলেজে ৩০ জন ছাত্রকে মাসে ৮ টাকা ও ৭০ জনকে মাসে ৫ টাকা করে বৃত্তি দেওয়া বাবদ সরকারের খরচ হচ্ছে মাসিক ৫৯০ টাকা।৪ ১৮৩৫-এর মার্চে দেশে ফিরে যাওয়ার আগে, বেন্টিঙ্ক অবশ্য এই ধরণের প্রাচ্যশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির ওপর এতটা নির্দয় হতে পারেননি। তিনি আশ্বাস দিয়ে বলেন, এ যাবৎ প্রতিষ্ঠিত কোনও সরকারি প্রাচ্যবিদ্যার প্রতিষ্ঠানকে বিলুপ্ত করা হবে না, তবে নতুন ভর্তি হওয়া ছাত্রদের জন্য বৃত্তিপ্রথা তুলে দেওয়া হবে।৫ এই প্রথা ফিরিয়ে আনতে চেয়ে ১৮৩৬-এর ৯ অগস্ট সংস্কৃত কলেজের ৭০ জন ছাত্র একটি লিখিত আবেদন পেশ করেন,৬ যদিও তাতে লাভ হয়নি। ১৮৩৮-৩৯ সালের বার্ষিক পরীক্ষায় দ্বিতীয় হয়ে যে ঈশ্বর নগদ ৮০ টাকা পুরস্কার পান, সংস্কৃত কলেজের অস্থায়ী সম্পাদকের পদে আসীন হওয়ার পরে, তিনিই ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ১৮৫১-এর ১৩ জানুয়ারি শিক্ষা সংদের কার্যকারী সম্পাদককে চিঠিতে জানান – ‘…Book prizes are to be substituted instead of Money prizes heretofore given to the best students of the Grammar Department ’।৭
বলা বাহুল্য, এই উদ্দেশ্যেই তিনি সংস্কৃত কলেজে বেতন প্রথা চালু করেছিলেন। কলেজের জন্মলগ্ন থেকেই ছাত্ররা বিনা বেতনে কলেজে পড়ত, ভর্তি হতেও কোনও টাকাপয়সা লাগত না। এই কলেজ প্রতিষ্ঠা করার সময়ে প্রাচ্যবিদ্যার চর্চাকে উৎসাহদান নয়, বরং সরকারের মূল লক্ষ্য ছিল আদালতের কাজে সহায়তা করার জন্য কিছু সস্তা পণ্ডিতের যোগান অব্যাহত রাখা। ফলে তাদের স্বার্থেই এই ব্যবস্থার প্রচলন হয়েছিল। কিন্তু দেশে পাশ্চাত্য শিক্ষা পুরোদমে চালু হওয়ার পরে, এই প্রতিষ্ঠানগুলি তাদের বোঝাস্বরূপ হয়ে ওঠে। ফলে তখন তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য হয়ে ওঠে, যে কোনও উপায়ে প্রতিষ্ঠানগুলির জন্য ব্যয়বরাদ্দ হ্রাস করা।
সরকারের এই মানসিকতার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে, ১৮৫২ সালের ১৯ অগস্ট বিদ্যাসাগর সম্পাদক মোয়াটকে যে চিঠি লেখেন, তাতে তিনি কলেজে বেতন প্রথা চালু করার দুটি বাহ্যিক কারণ দেখান। প্রথমত, ছাত্ররা বিনা পয়সায় এই কলেজে ভর্তি হয়ে নিয়মিত হাজিরা দেয় না। তাদের কোনও ইংরেজি স্কুলে ভর্তি হওয়ার ইচ্ছে থাকে, ফলে সেই সুযোগ পেলে তারা কলেজ ছেড়ে চলে যায়। দ্বিতীয়ত, ভর্তি হয়ে চলে যাওয়ার জন্য হাজিরা খাতায় নাম কাটা যাওয়ার পরে, কোনও কারণে আবার কলেজে ফিরে এসে ভর্তি হয়। কলেজে শৃঙ্খলা বজায় রাখার খাতিরে তিনি প্রস্তাব রাখেন, সংস্কৃত কলেজে ভর্তি হতে ২ টাকা লাগবে। হাজিরা খাতা থেকে একবার নাম কাটা গেলে, আবার ভর্তি হতে ফের ২ টাকা দিতে হবে। অথচ এই প্রস্তাব তড়িঘড়ি মঞ্জুর হওয়ার পরে, বিদ্যাসাগরের ১৮৫৩-র ১২ এপ্রিলের চিঠি থেকে জানা যায়, সব মিলিয়ে এ বাবদ আদায় হয়েছিল মাত্র ৪০ টাকা!৮ আর কলেজের জন্মলগ্ন থেকে ১৮৫১ সাল পর্যন্ত বিদ্যাসাগর যে ছাত্রতালিকা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে দেন, তাতে দেখা যায় দীর্ঘ ২৮ বছরে ভর্তি হওয়া একটি ছাত্রও পড়া ছেড়ে দিয়ে অন্য কোথাও চলে যায়নি!!৯
যে চিঠিতে তিনি ভর্তি ফি বাবদ ২ টাকা নেওয়ার প্রস্তাব জানান, সেই চিঠির একদম শেষ বাক্যে তিনি লেখেন:
This measure, if adopted, will, it may be hoped, pave the way for the introduction of the pay system.১০
কলেজের বিভিন্ন পরিসংখ্যান থেকে এ কথা স্পষ্ট – কলেজে বেতন প্রথা চালু করার ক্ষেত্রে তাঁর প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল, সরকারি ব্যয়সংকোচ নীতির সঙ্গে সাযুজ্য বজায় রাখা। ১৮৫৪-র জুন মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে ছাত্রপিছু মাসিক এক টাকা বেতন নেওয়া শুরু হলে, কলেজে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার বিষয়টি যে বিশুদ্ধ বাহানা ছিল, তা আরও স্পষ্ট হয়। কারণ, ওই বছরের ২৪ জুন শিক্ষা সংসদের নতুন সম্পাদক উড্রো (H.Woodrow) সাহেবকে তিনি জানান –
…as the pay-system has been introduced the admission and re-admission fees produced under the order of the Council No. IV, dated the 28 August 1852, be discontinued.১১
এই তথ্যগুলি নতুনও নয়, গবেষকদের অজানাও নয়। তবুও তাঁরা এ বিষয়ে নীরবতা অবলম্বন করেন, কারণ তাতে ‘ঈশ্বর’-এর ভাবমূর্তি নির্মাণের প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়!
অনুরূপভাবে সরকারি ব্যয়সংকোচ নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রাখার কারণে, তাঁর আমলে ছাত্রদের ডেপুটিগিরির সুযোগ করে দেওয়া হয়। এই কলেজ যে অন্য আর পাঁচটা কলেজের মতো ছাত্রদের ভবিষ্যতের পেশা বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে আশাব্যঞ্জক ভূমিকা পালন করতে পারে, এই আশা দেখিয়ে অধিক সংখ্যক ছাত্র ভর্তি করাই ছিল এই তথাকথিত ‘সংস্কার’-এর মূল উদ্দেশ্য। হিন্দু কলেজ ও কলকাতা মাদ্রাসার ছাত্ররা প্রথমাবধি ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের পদ পেত। প্রাচ্যবিদ্যার প্রতিষ্ঠান হিসেবে মাদ্রাসার ছাত্ররা এ সুযোগ পেলেও, সংস্কৃত কলেজের ছাত্রদের জন্য তা ছিল না। তাঁর কলেজের ছাত্রদের জন্যও এই পদ দেওয়ার অনুরোধ করে, বিদ্যাসাগর ১৮৫২ সালের ১৩ জানুয়ারি মোয়াটকে চিঠি লেখেন। তাঁর অনুরোধ মঞ্জুর করে সংস্কৃত কলেজের ছাত্রদের ডেপুটিগিরির পরীক্ষায় বসার সুযোগ দেওয়া শুরু হয়। যদিও এই সিদ্ধান্তের ফলে সংস্কৃত কলেজের কতজন ছাত্র শেষ পর্যন্ত ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরি পেয়েছিল, সে কথা জানা যায় না। কাজেই কলেজের ছাত্রদের চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে একটি নতুন পদে আবেদন করার সুযোগ করে দেওয়ার বেশি, এই ‘সংস্কার’-এর অতিরিক্ত কোনও মূল্যই নেই।
তবে ছুটির বিষয়টি আরও মজাদার! সংস্কৃত কলেজ স্থাপিত হওয়ার পর থেকে, অষ্টমী ও প্রতিপদ তিথিতে কলেজ বন্ধ থাকত। এই ব্যবস্থার পরিবর্তে শুধু রবিবারে কলেজ বন্ধ রাখার জন্য, ১৮৫১ সালের ২৫ জুলাই বিদ্যাসাগর সংসদ সম্পাদক মোয়াটকে চিঠি লেখেন এবং তাঁর প্রস্তাব অনুমোদিত হয়। যদিও ওই চিঠিতে তিনি লেখেন, ‘the number of working days remaining the same as before’১২; আসলে কিন্তু কলেজ বন্ধ হয় ৪৮ দিনের বদলে ৫২ দিন! এহ বাহ্য, কলেজের পরীক্ষা অক্টোবর থেকে পিছিয়ে এপ্রিলে নেওয়ার জন্য, পরের বছরে ১৬ মার্চ তিনি মোয়াটের কাছে আবেদন করেন। সেই চিঠিতে তিনি দু-মাস গ্রীষ্মাবকাশের প্রস্তাব দেন। তাঁর দুটি আবেদনই সরকারিভাবে মঞ্জুর হয়। যদিও তাতে কলেজে মোট বিধিবদ্ধ ছুটির পরিমাণ ৬২ দিন থেকে বেড়ে হয় ৮৫ দিন। প্রসঙ্গত, অষ্টমী-প্রতিপদে কলেজ বন্ধ রাখার দীর্ঘ দিনের প্রচলিত রীতি বন্ধ হলেও, ‘Her Majesty’s Birthday’১৩-র জন্য বরাদ্দ ছুটির প্রচলিত রীতি কিন্তু বন্ধ হয়নি! হয়তো এই কারণেই কলেজে সব মিলিয়ে কর্মদিবস প্রায় এক মাস কমছে বুঝতে পেরেও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বিশেষ উচ্চবাচ্য করেননি!!
সংস্কৃত কলেজে ইংরেজি বিভাগ খোলার জন্য, বিদ্যাসাগর ১৮৫২ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি মোয়াটকে প্রথম চিঠিটি লেখেন। কারণ হিসেবে তিনি জানান:
তাঁর উল্লিখিত ‘utility’ শব্দটির মূল তাৎপর্য ছিল, নতুন যুগের চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের সংস্কৃত কলেজে আকৃষ্ট করা। নতুবা তদানীন্তন বাংলায় একাধিক ইংরেজি শিক্ষার প্রতিষ্ঠান থাকা সত্ত্বেও, সংস্কৃত কলেজে সংস্কৃত পাঠ্যক্রমের সঙ্গে নতুন করে একটি ইংরেজি বিভাগ খোলার অন্য কোনও কারণ থাকতে পারে না। খেয়াল করলে দেখা যাবে, কলেজের ছাত্রদের ডেপুটিগিরির আবেদন করার অনুরোধ জানিয়ে লেখা তাঁর চিঠিটির মাত্র এক মাস ব্যবধানে, তিনি এই চিঠিটি লেখেন। সরকারি ব্যয়সংকোচ নীতির সঙ্গে সাযুজ্য বজায় রাখার জন্য তিনি যেমন কলেজে বেতন প্রথা চালু করেন, তেমনই ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থাকে প্রাচ্যবিদ্যার প্রতিষ্ঠানেও চালু করার জন্য, তিনি ডেপুটিগিরির প্রলোভন দেখিয়ে কলেজে ইংরেজি বিভাগ চালু করেন।
চিঠির উত্তরে ৯ মার্চ মোয়াট বিদ্যাসাগরকে জানান ‘…your proposal has been favourably considered…’১৫। এর পরে প্রথমে ১৮৫৩-এর ১৬ জুলাই তিনি ইংরেজি বিভাগের জন্য উপযুক্ত শিক্ষক, তাঁদের বেতনক্রম ও প্রয়োজনীয় ক্লাসরুমের আবেদন জানিয়ে শিক্ষা সংসদে চিঠি লেখেন এবং ওই বছরের ২৭ অক্টোবর তিনি পাঁচ জন শিক্ষক নির্বাচন করে সংসদকে জানান। এঁদের মধ্যে ইংরেজি বিভাগের চার জন হলেন – অধ্যাপক প্রসন্নকুমার সর্বাধিকারী (বেতন মাসিক ১০০ টাকা) এবং প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় জুনিয়র শিক্ষক কালীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়, তারিণীচরণ চট্টোপাধ্যায় ও প্রসন্নকুমার রায় (বেতন যথাক্রমে মাসিক ৮০, ৫০ ও ৩০ টাকা)। আগে কলেজে অঙ্ক শেখানো হত সংস্কৃতে, পড়ানো হত ভাস্করাচার্যের লীলাবতী ও বীজগণিত। বিদ্যাসাগর তার পরিবর্তে ইংরেজিতে অঙ্ক শেখানো শুরু করেন, ১০০ টাকা মাসিক বেতনে নিযুক্ত করেন গণিতের অধ্যাপক শ্রীনাথ দাসকে।১৬ কলেজে মোট ক্লাসের এক-তৃতীয়াংশ ইংরেজি বিভাগের জন্য বরাদ্দ করে, নভেম্বর মাস থেকে তিনি কলেজে পুরোদস্তুর ইংরেজি পড়ানো শুরু করে দেন। বিদ্যাসাগরের এই পরিকল্পনায় শিক্ষা সংসদের কর্তাব্যক্তিরা খুশি হয়ে মাত্র তিন বছরে মাথায়, ১৮৫৪-র জানুয়ারি থেকে তাঁর মাইনে বাড়িয়ে দ্বিগুণ করে দেন।
তবে নিজের বেতনের এহেন বৃদ্ধিতে বিদ্যাসাগর সম্ভবত ‘লজ্জিত’ বোধ করেছিলেন। হয়তো সে কারণেই তিনি ওই বছরের ৮ এপ্রিল, সংসদ সম্পাদকের কাছে কলেজের শিক্ষকদের বেতনবৃদ্ধির জন্য আবেদন করেন। তাঁর চিঠি থেকে জানা যায়, গত বারো বছরে সংস্কৃত বিভাগের অধ্যাপক ও পণ্ডিতদের বেতন এক পয়সাও বাড়েনি। ‘মানবতাবাদী’ বিদ্যাসাগর নিতান্ত ‘দয়াপরবশ’ হয়ে সংস্কৃত বিভাগের আপামর শিক্ষকের জন্য, মাসে দশ টাকা বেতনবৃদ্ধির প্রস্তাব করেন; আর মাত্র পাঁচ মাস আগে নিযুক্ত ইংরেজি বিভাগের দুজন অধ্যাপককে মাসিক ৫০ টাকা মাইনে বাড়িয়ে দেওয়ার কথা বলেন!১৭ শুধু তাই নয়, ১৮৫৫ সালের ১৭ ডিসেম্বর নবগঠিত জনশিক্ষা অধিকর্তা (Director of Public Instruction) গর্ডন ইয়ং (W. Gordon Young) সাহেবকে লেখা বিদ্যাসাগরের চিঠি থেকে জানা যায় – সংস্কৃত বিভাগের দর্শন, ন্যায়, অলঙ্কার, সাহিত্য ও ব্যাকরণ বিভাগের সমস্ত শিক্ষকের বেতন দিতে বছরে খরচ হয় ৭,৮৬০ টাকা; অথচ ইংরেজি বিভাগের মাত্র পাঁচ জন শিক্ষকের জন্য বেতন বাবদ ব্যয় হয় বার্ষিক ৪,৩২০ টাকা।১৮ যদিও তাঁর আমলে সংস্কৃত বিভাগের শিক্ষকদের বেতন এক পয়সাও বাড়েনি। ইংরেজ আমলে ইংরেজি জানা শিক্ষকদের বেতন যে অন্যদের থেকে বেশি হবে, এ আর কী এমন নতুন কথা! সমস্ত ঘটনা থেকে স্পষ্ট, বেন্টিঙ্ক যেমন মেকলেকে চিনে নিতে ভুল করেননি; ঠিক তেমনই মার্শাল, মোয়াট ও বেথুনের জহুরির চোখ জহর চিনতে ভুল করেনি!!
কিন্তু এই বিশাল সময় ও বিপুল অর্থ ব্যয় করার পরে কলেজের ছাত্ররা কতটুকু ইংরেজি শিখেছিল? ১৮৫৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম গ্র্যাজুয়েট হন বঙ্কিমচন্দ্র ও যদুনাথ বসু এবং পরের বছরে হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৮৬০-এ যে চার জন গ্র্যাজুয়েট হন, কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য ছিলেন তাঁদের অন্যতম। তিনি বিদ্যাসাগরের অধ্যক্ষতার সময়ে সংস্কৃত কলেজের কৃতী ছাত্র ছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপনা করেন। বিদ্যাসাগরের প্রিয় ছাত্র এহেন কৃষ্ণকমল এ বিষয়ে খোলাখুলি জানিয়েছেন —
তবে বিদ্যাসাগর মহাশয় যেন কতকটা ভিতরের ব্যাপার বুঝিয়া রাখিয়া ছিলেন, কারণ তিনি একদিন আমাকে স্পষ্ট বলিলেন, ‘তোরা দুইয়ের বার হয়ে রইলি, না ইংরাজিও তেমন লিখতে পারিস, না সংস্কৃততেও পণ্ডিত হলি।’ তিনি তখন ‘বিধবা বিবাহ’ বাদানুবাদে মগ্নপ্রায় হইয়াছিলেন। তাহার অভিলাষ ছিল যে তাঁহার যুক্তিবিন্যাসগুলি ইংরাজিতে উত্তমরূপে প্রতিপাদিত হয়। কিন্তু সংস্কৃতও ভাল বুঝে, ইংরাজিও ভাল লিখিতে পারে এরূপ লোক না পাওয়ায় নিরস্ত হইয়াছিলেন।১৯
বিধবাবিবাহ প্রসঙ্গে এসে পড়ে কৃষ্ণকমলের দাদা রামকমল ভট্টাচার্যের কথা। কৃষ্ণকমল তাঁর সম্পর্কে জানিয়েছেন –
...সংস্কৃতশাস্ত্রে বিশেষ পারদর্শিতা বলিতে গেলে আমার জ্যেষ্ঠ সহোদর রামকমলের প্রকৃতপক্ষে ছিল। আমার তাহা কিছুই নাই। তিনি সংস্কৃত কলেজে যে ১০।১১ বৎসর অধ্যয়ন করিয়াছিলেন, সেই কয় বৎসরের মধ্যে সংস্কৃতশাস্ত্রের এমন কোনও অংশই নাই যাহা তিনি প্রগাঢ়রূপে এবং সুগভীর আলোচনার সহিত অনুশীলন করেন নাই, — কি সাহিত্য, কি অলঙ্কার কি দর্শন যখন যাহা পড়িয়াছিলেন, তাহাতেই এরূপ পারিপাট্য ও পারদর্শিতা লাভ করিয়াছিলেন যে তাঁহার অধ্যাপকগণ উত্তরকালের ছাত্রদিগের নিকট তাঁহাকে দৃষ্টান্তের স্বরূপ উপন্যাসিত করিতেন। আমার বেশ মনে আছে আমি যখন প্রেমচাঁদ তর্কবাগীশ মহাশয়ের শ্রেণীতে অলঙ্কার পাঠ করি তখন আমাদের পাঠশৈথিল্যের প্রতি কটাক্ষপাত করিয়া তিনি বলিতেন, ‘যথার্থ শিখিবার উদ্যম কেবল রামকলের দেখিয়াছি’।২০
রামকমল ১৮৬০ সালের ১১ জুলাই আত্মহত্যা করেন। হায়, রামকমলকে দিয়েও বিদ্যাসাগর বিধবাবিবাহ সম্পর্কে তাঁর ‘যুক্তিবিন্যাসগুলি ইংরাজিতে উত্তমরূপে প্রতিপাদিত’ করতে পারেননি!
তবে ইংরেজির বিষয়টিকেও ছাড়িয়ে গেছে, বিদ্যাসাগরের আমলে কলেজে মুগ্ধবোধ-এর বিলোপ।মুগ্ধবোধ নিয়ে প্রায় সব গবেষকই দুটি উপকারিতার কথা বলেছেন – ১) এর ফলে ছাত্রদের দুরূহ সংস্কৃত ব্যাকরণ পাঠের সময়, আগের তুলনায় অনেক কমেছিল এবং ২) ছাত্রদের ব্যাকরণে যথেষ্ট ব্যুৎপত্তি জন্মেছিল। অথচ খুঁটিয়ে বিবেচনা করলে, দুটি উপকারিতাকেই নেহাতই আচাভুয়া দাবি হিসেবে আখ্যা দেওয়া যেতে পারে। প্রথমে আমরা দেখে নিই, বিদ্যাসাগর ঠিক কী কারণে সংস্কৃত কলেজে মুগ্ধবোধ-এর পাঠ উঠিয়ে দিয়েছিলেন। ১৮৫১ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল, বিদ্যাসাগরের সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা। একই বছরে প্রকাশিত হয়েছিল ঋজুপাঠ প্রথম ও তৃতীয় ভাগ (অগ্রহায়ণ ও পৌষ, ১৯০৮ সংবৎ) আর দ্বিতীয় ভাগ প্রকাশিত হয়েছিল পরের বছরে (ফাল্গুন, ১৯০৮ সংবৎ)। ১৮৫৪-তে শিক্ষা সংসদের সম্মতিক্রমে, তিনি কলেজ থেকে মুগ্ধবোধ-এর বদলে চালু করেন উপরোক্ত চার-চারটি বই। পরে তার সঙ্গে যোগ হয় আরও একটি গ্রন্থ – ব্যাকরণ কৌমুদী। একজন কলেজের অধ্যক্ষ তাঁর নিজের লেখা পাঁচটি বই তাঁরই কলেজের পাঠ্যসূচীতে অন্তর্ভুক্ত করছেন, তৎকালীন সময়ে এমন ঘটনা সারা ভারতবর্ষে ঘটেছিল কি না সন্দেহ। অথচ একই বিদ্যাসাগর, তাঁর কলেজে ব্যালান্টাইনের বই চালু করার বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছিলেন!
সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা-র ‘বিজ্ঞাপন’-এ বিদ্যাসাগর লিখেছেন —
প্রথমেই সংস্কৃত ভাষায় লিখিত সংস্কৃত ব্যাকরণ, এবং ব্যাকরণ সমাপ্ত করিয়াই একবারে রঘুবংশ প্রভৃতি উৎকৃষ্ট কাব্য পড়িতে আরম্ভ করা কোনও ক্রমেই শ্রেয়স্কর বোধ না হওয়াতে, শিক্ষাসমাজের সম্মতিক্রমে এই নিয়ম নির্ধারিত হইয়াছে; ছাত্রেরা, প্রথমতঃ অতি সরল বাঙ্গালা ভাষায় সঙ্কলিত সংস্কৃত ব্যাকরণ, ও অতি সহজ সংস্কৃত গ্রন্থ, পাঠ করিবেক; তৎপরে সংস্কৃত ভাষায় কিঞ্চিৎ বোধাধিকার জন্মিলে, সিদ্ধান্তকৌমুদী ও রঘুবংশাদি পাঠ করিতে আরম্ভ করিবেক। তদনুসারে সরল বাঙ্গালা ভাষায় ব্যাকরণসঙ্কলন ও দুই তিনখানি সহজ সংস্কৃত পুস্তক প্রস্তুত করা অত্যাবশ্যক বোধ হওয়াতে, প্রথম পাঠার্থে সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা নামে এই পুস্তক প্রস্তুত ও প্রচারিত হইল।২১ [নজরটান সংযোজিত]
তার অর্থ ‘শিক্ষাসমাজ’ শুধু এই চারটি বই পাঠ্য করার সম্মতি দেননি, তাঁরা কী উপায়ে সংস্কৃত ব্যাকরণকে আয়ত্ত করতে হবে, তার নিয়মও নির্ধারণ করে দিয়েছেন! বটেই তো, হ্যালহেড যেমন বাঙালির চেয়েও বেশি বাংলা জানতেন; কেমন করে শুদ্ধ বাংলা লিখতে হয়, তার নিয়ম নির্ধারণ করেছিলেন; মার্শাল-মোয়াট জুটিও তেমনই সংস্কৃত ব্যাকরণের পাণিনি-পতঞ্জলি! আর সংস্কৃতজ্ঞ বিদ্যাসাগর তাঁদের হুকুমবরদার মাত্র!
তিনি জানিয়েছেন,
এই গ্রন্থে অল্প বয়স্ক বালকদিগের প্রথমশিক্ষোপযোগী স্থূল স্থূল বিষয় সকল সঙ্কলিত হইয়াছে। ইহা পাঠ করিয়া সংস্কৃত ব্যাকরণে ব্যুৎপত্তি জন্মিবেক না যথার্থ বটে; কিন্তু উপদেশসাপক্ষ হইয়া সহজ সহজ সংস্কৃত গ্রন্থ সকল সহজে অধ্যয়ন করিবার ক্ষমতা জন্মিবেক, সন্দেহ নাই; এবং ইহাই এই পুস্তক প্রস্তুত করিবার মুখ্য তাৎপর্য।...আর হিতোপদেশ, পঞ্চতন্ত্র, রামায়ণ, মহাভারত, বিষ্ণুপুরাণ, ভট্টিকাব্য, ঋতুসংহার, বেণীসংহার এই কয়েক গ্রন্থ হইতে বালকদিগের পাঠোপযোগী অংশ সকল সঙ্কলন করিয়া ঋজুপাঠ নামে তিনখানি পুস্তক প্রস্তুত হইয়ছে। এতদ্বতিরিক্ত মুগ্ধবোধ অথবা লঘুকৌমুদীতে ব্যাকরণের যত বিষয় লিখিত আছে, সেই সমুদয় বাঙ্গালা ভাষায় সঙ্কলন করিয়া অতি ত্বরায় ব্যাকরণকৌমুদী নামে আর একখানি পুস্তক প্রস্তুত করা যাইবেক।২২ [নজরটান সংযোজিত]
অর্থাৎ, ক) এই বই পড়ে ব্যাকরণে বুৎপত্তি জন্মাবে না, খ) এর সঙ্গে আরও তিনটি বই ছাত্রদের পড়তে হবে এবং গ) অতি শিগগির পঞ্চম বইটিও আসবে! তখন ছাত্রদের বোপদেবের একটি বইয়ের বদলে পড়তে হবে, বিদ্যাসাগরের পাঁচ-পাঁচটা বই!!
অথচ তার পরেও ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন —
১৮৫১ সালের নভেম্বর মাসে সংস্কৃত কলেজে এক উন্নত প্রণালীর শিক্ষা-ব্যবস্থা প্রবর্তিত হইল। ব্যাকরণ-বিভাগ সম্পূর্ণরূপে পুনর্গঠিত হইল। পূর্বে বোপদেবের ‘মুগ্ধবোধ’ ছিল ব্যাকরণের একমাত্র পাঠ্যপুস্তক। সংস্কৃত শিক্ষার গোড়াতেই সংস্কৃতে লেখা এই দুরূহ ব্যাকরণখানি ছেলেদের পড়িতে হইত। এখানি আয়ত্ত করিতে লাগিত চার-পাঁচ বৎসর; তাও ছেলেরা অর্থ না বুঝিয়াই মুখস্থ করিত। কাজেই সংস্কৃত-সাহিত্য পড়িবার সময় এই মুখস্থ বিদ্যা বিশেষ কাজে লাগিত না; দেখা যাইত, ভাষায় তাহারা আশানুরূপ অধিকার লাভ করে নাই। বিদ্যাসাগর ছেলেদের বাধাটুকু বুঝিতে পারিলেন। তিনি দেখিলেন, বাঙালী ছাত্রকে সংস্কৃত শিখাইতে হইলে বাংলায় ব্যাকরণ পড়াইতে হইবে। তিনি ‘মুগ্ধবোধ’ পড়ানো বন্ধ করিলেন এবং তাহার পরিবর্তে বাংলায় লেখা স্বরচিত ‘সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা’ ও ‘ব্যাকরণ কৌমুদী’ ধরাইলেন। এই সঙ্গে ‘ঋজুপাঠ’ও পড়ানো হইতে লাগিল। সংস্কৃত গদ্য ও কাব্য হইতে কতকগুলি নির্বাচিত অংশ ঋজুপাঠে সন্নিবেশিত হইয়াছে। এই নব ব্যবস্থার ফল ভালই হইল। সাধারণ ছাত্রদের পক্ষে এই ব্যবস্থায় সংস্কৃতে মোটামুটিরূপে ব্যুৎপত্তি লাভ করিতে তিন বৎসরের বেশী সময় লাগে না।২৩
সারা গ্রন্থে এই একটিমাত্র বিষয়ে ব্রজেন্দ্রনাথ কোনও তথ্যসূত্র না দেওয়ায় মনে হওয়া স্বাভাবিক, এটি বুঝি তাঁরই উপলব্ধি। কিন্তু ব্রজেন্দ্রনাথ তো বিদ্যাসাগরের ছাত্র নন। তিনি এত কথা লিখলেন কোন যাদুমন্ত্রে?
অবশেষে আবিষ্কৃত হয় ব্রজেন্দ্রনাথের উচ্ছ্বাসের উৎস। আসলে তিনি জনশিক্ষা দফতরের সরকারি প্রতিবেদনটির বঙ্গানুবাদ করেছিলেন মাত্র! এই সেই রিপোর্ট:
The introduction of a re-modelled system of study in the Grammar Department was noticed in the Annual Report of the Institution for the session 1852-53. Previous to November 1854, the Mugdhabodha, a Sanscrit Grammar in Sanscrit was the text-book of the Grammar Department. Pupils had to begin their study of Sanscrit with this most difficult book, and they had to spend four or five years. Young lads, on account of the extreme difficulty of this Grammar, only learnt by rote what their instructors said, without being able in almost every instance, to understand the contents of the work they read. In consequence of this, the knowledge they acquired of Grammar was very imperfect, and they had to experience great difficulty in being made, all at once, to begin with the standard works in the Sahitya or Literature Class, to which they were promoted after they have finished their course in the Grammar Department. By the adoption of the new system, a totally different course has been pursued. The study of the Mugdhabodha has been discontinued, and in its stead outlines of Sanscrit grammar compiled in Bengali, and three Sanscrit Readers, consisting of easy selections in Prose and Verse, have been introduced. To complete this course, a student of ordinary ability, and ordinary application, does not require more than three years. After finishing this course, a student is well grounded in the elements of Sanscrit Grammar and is thoroughly prepared to be introduced to the study of standard works in the Sahitya or Literature Class.২৪ [নজরটান সংযোজিত]
আগেই দেখেছি, মার্শাল-মোয়াট জুটি সংস্কৃতেও ধনুর্ধর! তাই তাঁরা কলেজের ছাত্র না হয়েও দিব্যি লিখতে পেরেছেন, কলেজের ছাত্রদের আগে যে ‘most difficult book’ টি আয়ত্ত করতে লাগত চার থেকে পাঁচ বছর, এখন লাগছে তিন বছরেরও কম সময়!!
বিদ্যাসাগর নিজে কতদিনে মুগ্ধবোধ আয়ত্ত করেছিলেন? মাত্র তিন বছরে। তিনি নিজেই লিখেছেন,
প্রথম তিন বৎসরে মুগ্ধবোধপাঠ সমাপ্ত করিয়া, শেষ ছয় মাসে অমরকোষের মনুষ্যবর্গ ও ভট্টিকাব্যের পঞ্চম সর্গ পর্যন্ত পাঠ করিয়াছিলাম।২৫
একই কথা বলেছেন শম্ভুচন্দ্রও –
[বিদ্যাসাগর] ব্যাকরণশ্রেণীতে তিন বৎসর ছয় মাস ছিলেন; কিন্তু তিন বৎসরের মধ্যেই ব্যাকরণ সমাপ্ত করেন। শেষ ছয় মাস কাল অমরকোষের মনুষ্যবর্গ ও ভট্টিকাব্যের পঞ্চম সর্গ পর্যন্ত পাঠ করিয়াছিলেন।২৬
আর যিনি বিদ্যাসাগরের আমলে সংস্কৃত কলেজের ছাত্র ছিলেন, সেই কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য স্মৃতিচারণায় বলেছেন —
তখন আমার বয়স আন্দাজ ৬।৭ বৎসর; বোধ হয় ইংরাজি ১৮৪৭ সাল [আসলে আট বৎসর, ১৮৪৮ সাল; কৃষ্ণকমলের স্মৃতিবিভ্রম] হইবে। আমি আমার দাদার সঙ্গে সংস্কৃত কলেজে যাইতাম। তিনি আমাকে একটা বেঞ্চে বসাইয়া রাখিতেন। এই রকম ২।৫ দিন যাইতে যাইতে একদিন বিদ্যাসাগর মহাশয় আমাকে বলিলেন, ‘আয় তোকে ইস্কুলে ভর্তি করে দি’। তখন কোনও ছাত্রের বেতন দিবার পদ্ধতি ছিল না; কাজেই ইস্কুলে ভর্তি হওয়ার প্রতিবন্ধক হইল না। ...ইস্কুলে ভর্তি হইয়াই আমার ‘মুগ্ধবোধ’ পড়া আরম্ভ হইল। প্রথম দুই বৎসর ৺প্রাণকৃষ্ণ বিদ্যাসাগর মহাশয়ের কাছে অধ্যয়ন করিলাম। ... তৃতীয় বৎসর ৺গোবিন্দ শিরোমণি [আসলে রামগোবিন্দ গোস্বামী (তর্করত্ন); কৃষ্ণকমলের স্মৃতিবিভ্রম] মহাশয়ের ক্লাসে ও চতুর্থ বৎসর ৺দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ মহাশয়ের কাছে ‘মুগ্ধবোধ’ অধ্যয়ন করিলাম। ... এই চারি বৎসরে ‘মুগ্ধবোধ’ পড়া শেষ হইল।২৭
অর্থাৎ বিদ্যাসাগর মুগ্ধবোধ শেষ করেছেন তিন বছরে, আর তাঁর ছাত্র কৃষ্ণকমলের ‘চারি বৎসরে’ মুগ্ধবোধ পড়া শেষ হয়েছে। তার পরেও কৃষ্ণকমলের সংস্কৃতজ্ঞান নিয়ে বিদ্যাসাগর যে সন্তুষ্ট ছিলেন না, সে বিষয়ে তিনি নিজেই উক্তি করেছেন যা আগেই আলোচিত হয়েছে। তার মানে মুগ্ধবোধের পাঁচ-পাঁচটা ‘সহায়িকা’-য় না কমেছিল সময়, না বেড়েছিল সংস্কৃততে ছাত্রদের দক্ষতা। তবুও মুগ্ধবোধ নিয়ে বাঙালির মুগ্ধতার রেশ একটুও কমেনি। সত্যিই ভক্তি অতি বিষম বস্তু!
অবশ্য মুগ্ধবোধ-এর থেকেও বাঙালি বেশি আপ্লুত তাঁর বেদান্ত বিরোধিতা প্রসঙ্গে। শিক্ষা সংসদের আমন্ত্রণে, ১৮৫৩-র ২১ মে কলকাতা সংস্কৃত কলেজ পরিদর্শনে আসেন কাশীর সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ ব্যালান্টাইন (J.R. Ballantyne)। কলেজ পরিদর্শন শেষে ব্যালান্টাইন তাঁর রিপোর্ট দাখিল করলে, সংসদ বিদ্যাসাগরের কাছে সেই রিপোর্ট পাঠিয়ে দেয় ২৯ অগস্ট। বিদ্যাসাগর ব্যালান্টাইনের মতের সমালোচনা করে ৭ সেপ্টেম্বর সংসদের সম্পাদক মোয়াটকে এক দীর্ঘ চিঠিতে জানান:
কিছু বিশেষ কারণে, যদিও এখানে সেই কারণগুলির উল্লেখ করার প্রয়োজন নেই, সংস্কৃত কলেজে আমাদের বেদান্ত ও সাংখ্য পড়াতেই হয়। কিন্তু বেদান্ত ও সাংখ্য যে ভ্রান্তদর্শন, এ বিষয়ে এখন আর কোনও বিতর্ক নেই। তবে ভ্রান্ত হলেও এই দুই দর্শনের প্রতি হিন্দুদের গভীর শ্রদ্ধা আছে। সংস্কৃত পাঠক্রমে এগুলি যখন পড়াতে হবে, তখন [এগুলি পড়ানোর সময়ে] এদের প্রভাব দূর করার জন্য ইংরেজি পাঠক্রমের খাঁটি (sound) দর্শন দিয়ে এগুলির বিরোধিতা করা উচিত।২৮
আজ অবধি সংস্কৃত কলেজে বিদ্যাসাগর-প্রবর্তিত পাশ্চাত্য দর্শনের পাঠ্যসূচীতে কোন কোন বই পড়ানো হত, তার হদিস পাওয়া যায়নি। কেবল মোয়াটকে লেখা এই চিঠিটিতে, তিনি জন স্টুয়ার্ট মিলের A System of Logic ও পরে ৫ অক্টোবরের চিঠিতে ফ্রান্সিস বেকনের Novum Organum-এর উল্লেখ করেন।
কিন্তু যেটা লক্ষণীয়, মোয়াটের কাছে বেদান্ত ও সাংখ্য সম্পর্কে বিরোধিতা করেন যে বিদ্যাসাগর, তিনিই এই ঘটনার মাত্র ১৬ মাস পরে বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব প্রথম পুস্তকটিতে স্মৃতিশাস্ত্রের চেয়ে অধিক গুরুত্ব দেন শ্রুতিশাস্ত্রকে। সেই পুস্তকে তিনি লেখেন,
যে স্থলে বেদ, স্মৃতি ও পুরাণের বিরোধ সৃষ্টি হইবেক, তথায় বেদই প্রমাণ; আর স্মৃতি ও পুরাণের পরস্পর বিরোধ হইলে, স্মৃতিই প্রমাণ।২৯
অথচ বেদান্ত নিয়ে তাঁর এই স্ববিরোধিতা তদানীন্তনকালে কিংবা পরবর্তী সময়ে কারও চোখে তো পড়েইনি, উপরন্তু তাঁর এই উক্তিটি নিয়ে বর্তমানেও প্রচুর উচ্ছ্বাস চোখে পড়ে। পাশাপাশি অনেকে এ কথাও মনে করে থাকেন যে, আসলে বিদ্যাসাগরের বেদান্ত-সাংখ্য পড়ানোর ইচ্ছে ছিল না। তিনি যেন খানিকটা দায়ে পড়েই (এ ক্ষেত্রে তিনি যেমন ‘হিন্দুদের গভীর শ্রদ্ধা’-র আড়াল নিতে চেয়েছেন, পরে অন্য ক্ষেত্রেও নেবেন), কলেজের পাঠ্যক্রমে এই দুটি দর্শনকে রাখতে বাধ্য হয়েছিলেন। এই দুটি ধারণাই যে কী মারাত্মক বিভ্রান্তিজনক, তা আমরা বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করব – যদিও সেখানে বেদান্ত-সাংখ্য ঠিক না ভুল কিংবা ভালো না মন্দ, সেই অনর্থক বিতর্কে যাব না।
উদাহরণস্বরূপ, এই উক্তি সম্পর্কে প্রমথনাথ বিশী লিখেছেন,
আমার তো মনে হয়, প্রকাশ্যে বেদান্তকে ভ্রান্ত দর্শন ঘোষণা করাই দুঃসাহসী বিদ্যাসাগরের দুঃসাহসিকতম কার্য, তুলনায় বিধবাবিবাহ-সমর্থন বা বহুবিবাহ-প্রতিকুলতা নিতান্ত ছেলেখেলা; ঐ এক উক্তির দ্বারা ভারতের বহুযুগসঞ্চিত সংস্কার ও অহম্মন্যতার মূলে আঘাত করিয়াছেন।৩০
প্রমথনাথ প্রকৃতপক্ষে আবেগের আতিশয্যে বিস্মৃত হয়েছিলেন যে, বিদ্যাসাগর আদৌ তাঁর জীবদ্দশায় এই উক্তিটি ‘প্রকাশ্যে’ ঘোষণা করেননি। তাঁর মৃত্যুর প্রায় ৩৭ বছর পরে, ১৯২৭ সালে মডার্ন রিভিউ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধে, এই চিঠিটির প্রথম উল্লেখ করেন ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। ঠিক তেমনই সংস্কৃত কলেজে অধ্যক্ষ থাকাকালীন, এমনকি অবসর নেওয়ার পরেও, বিদ্যাসাগর পাঠ্যক্রম থেকে বেদান্তকে বাদ দেওয়ার কোনও ইচ্ছা প্রকাশ করেননি। ১৮৫২ সালের ১২ এপ্রিল ‘Notes on the Sanskrit College’ নামক খসড়া পরিকল্পনার ১৬ সংখ্যক অনুচ্ছেদে বিদ্যাসাগর বলেন –
এ কথা ঠিক যে হিন্দু দর্শনের অনেক মতামত আধুনিক যুগের প্রগতিশীল ভাবধারার সঙ্গে মেলে না, তবুও এ কথা অনস্বীকার্য যে একজন ভালো সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতের এই দর্শনগুলি জানতেই হবে।৩১
ওই পরিকল্পনার ১৮ সংখ্যক অনুচ্ছেদে তিনি ছাত্রদের জন্য দর্শনের যে পাঠ্যতালিকা তৈরি করেন, তা হল: ন্যায় – গোতমের সূত্র ও কুসুমাঞ্জলি; বৈশেষিক – কণাদের সূত্র; সাংখ্য – কপিলের সূত্র এবং তত্ত্বকৌমুদী; পাতঞ্জল – পাতঞ্জলের সূত্র; বেদান্ত – বেদান্তসার এবং ব্যাসের সূত্র, অধ্যায় ১ ও ২; মীমাংসা – জৈমিনির সূত্র। এর অতিরিক্ত হিসেবে ছাত্রদের সর্বদর্শনসংগ্রহ পড়তে হবে, কারণ তার মধ্যে ভারতবর্ষের সব দর্শনের সারকথা পাওয়া যাবে।৩২ লক্ষণীয়, বিদ্যাসাগর এই পাঠ্যতালিকায় শুধু বেদান্ত ও সাংখ্য নয়, ষড়দর্শনকেই অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলেছেন।
বিদ্যাসাগরের অবসর গ্রহণের কিছু দিন পরে, ১৮৫৯ সালে জনশিক্ষা অধিকর্তা গর্ডন ইয়ং বাংলা সরকারের কাছে সংস্কৃত কলেজের দর্শন পাঠ্যক্রমের সংস্কার সংক্রান্ত এক প্রস্তাব পেশ করেন। এই প্রস্তাবের সঙ্গে তিনি উড্রো, রোয়ার (Dr. Roer) ও সংস্কৃত কলেজের নতুন অধ্যক্ষ কাওয়েল (E.B. Cowell) সাহেবের সেই সম্পর্কিত মন্তব্যগুলিও জুড়ে দেন। সরকারের তরফে ছোটলাট এ বিষয়ে বিদ্যাসাগরের পরামর্শ চাইলে, তিনি ১৮৫৯-এর ১৭ এপ্রিল লেখেন —
কাওয়েল সাহেব কলেজে স্মৃতি ও বেদান্ত পড়ানোর বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছেন। দুঃখের বিষয়, এ বিষয়ে আমি তাঁর সঙ্গে ভিন্ন মত পোষণ করি। …ভারতবর্ষে প্রচলিত দর্শনসমূহের মধ্যে বেদান্ত অন্যতম। এটি অধিবিদ্যা (metaphysical) ধরনের, [সংস্কৃত] কলেজে এর [বেদান্ত] পড়ানোর বিষয়ে কোনও যুক্তিসঙ্গত আপত্তি থাকতে পারে বলে আমি মনে করি না। এই দুটি বিষয় [স্মৃতি ও বেদান্ত] এখন যেভাবে পড়ানো হয়, ধর্মীয় ভিত্তিতে তা নিয়ে আপত্তির কিছু নেই। আমার বিনীত মতে, এই দুটি বিষয় [পড়ানো] ব্যাহত হলে কলেজের পাঠ্যক্রম খুবই ত্রুটিপূর্ণ হয়ে পড়বে।৩৩
স্বাভাবিকভাবে এই প্রশ্ন ওঠা সঙ্গত যে, তাহলে কেন বিদ্যাসাগর ব্যালান্টাইনের বিরোধিতা করেছিলেন। যদিও এ বিষয়ে নিশ্চিত কোনও প্রমাণ নেই, তবু ঘটনার পারম্পর্য বিবেচনা করা বলা যায় – এর পেছনে দুটি কারণ বিদ্যমান ছিল। প্রথমত, ব্যালান্টাইন কাশী সংস্কৃত কলেজে জন স্টুয়ার্ট মিল লিখিত A System of Logic-এর যে সংক্ষিপ্তসার রচনা করে তাঁর নিজের কলেজে পাঠ্য করেছিলেন, কলকাতার সংস্কৃত কলেজে তার প্রচলনকে প্রতিহত করা এবং দ্বিতীয়ত, যে কোনও উপায়ে ইংরেজি বিভাগ চালু করা। দুটি বিষয়েই যে বিদ্যাসাগরের যথেষ্ট ব্যক্তিস্বার্থ নিহিত ছিল, তা আমরা সংস্কৃত কলেজে শিক্ষাসংস্কার সংক্রান্ত পূর্ববর্তী আলোচনাতে দেখেছি।
তবে সংস্কৃত কলেজে বিদ্যাসাগরের ‘মানবতাবাদ’-এর সম্ভবত শ্রেষ্ঠ উদাহরণ, কলেজে ভর্তির ক্ষেত্রটি সমস্ত শ্রেণির ছাত্রের জন্য উন্মুক্ত না করা! সংস্কৃত কলেজের প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই ব্রাহ্মণ ও বৈদ্য ছাড়া, অন্য কোনও শ্রেণির ছাত্র ভর্তি হতে পারত না। এমনকি বৈদ্যরা ভর্তি হলেও তাদের বেদান্ত ও ধর্মশাস্ত্র পড়ার অধিকার ছিল না। শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন লিখেছেন –
তৎকালে সংস্কৃত-কলেজে কেবল ব্রাহ্মণ ও বৈদ্যজাতীয় সন্তানগণ অধ্যয়ন করিত। ব্রাহ্মণের সন্তানেরা সকল শ্রেণীতেই অধ্যয়ন করিত; বৈদ্যজাতীয় বালকেরা দর্শন-শাস্ত্র পর্যন্ত অধ্যয়ন করিতে পাইত, বেদান্ত ও ধর্মশাস্ত্র অধ্যয়ন করিতে পাইত না।৩৪
এই পরিস্থিতিতে ১৮৫১-এর ৭ জানুয়ারি সংসদ সম্পাদক মোয়াট, বিদ্যাসাগরের কাছে সংস্কৃত কলেজে হিন্দু অব্রাহ্মণ (বৈদ্য বাদে) ছাত্রদের ভর্তি সম্পর্কিত রিপোর্ট চান।
প্রত্যুত্তরে ২৮ মার্চ বিদ্যাসাগর সংসদের কার্যনির্বাহী (Officiating) সম্পাদক হেইজ (F.F.C. Hayes)-কে লেখা চিঠিতে, বাংলার ‘সম্ভ্রান্ত’ কায়স্থদের কলেজে ভর্তি করার বিষয়ে দুটি উদাহরণ (নাকি অজুহাত!) দেখান। নানা শাস্ত্রবচন উদ্ধৃত করা ছাড়াও চিঠিটির সপ্তম অনুচ্ছেদে তিনি জানান, ১৮২৮-১৮২৯ সালে অধ্যক্ষ উইলসন (H.H. Wilson)-এর আমলে রাজা রাধাকান্ত বাহাদুরের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় অমৃতলাল মিত্র, সংস্কৃত কলেজে পড়ার অধিকার পেয়েছিলেন। আর পঞ্চম অনুচ্ছেদে তিনি জানান, আন্দুলের প্রয়াত রাজা রাজনারায়ণ বাহাদুর সম্প্রতি গোঁড়া পণ্ডিতদের ব্যবস্থা পেয়েছেন যে কায়স্থরা শূদ্র নয়, ক্ষত্রিয়। তিনি লেখেন –
ব্রাহ্মণ ও বৈদ্য ব্যতীত অন্যান্য শূদ্রদের সংস্কৃত কলেজে ভর্তির ক্ষেত্রে আমার কোনও আপত্তি নেই। তবে আমার সুপারিশ হল, বর্তমানে কেবল কায়স্থদের ভর্তি করাই যুক্তিযুক্ত হবে।৩৫
তাঁর চিঠিতে কায়স্থদের ভর্তির অধিকার দিতে গিয়ে, বিদ্যাসাগর ভাগবতপুরাণ ও রঘুনন্দনের শুদ্ধিতত্ত্বের উদ্ধৃতি দিয়েই ক্ষান্ত হননি, তাঁর আগে এক সাহেব অধ্যক্ষ এক বড়লোকের আত্মীয়কে ভর্তি করেছিলেন জাতীয় নানা ধানাইপানাই করেন! অবশেষে প্রকারান্তরে কায়স্থরা আসলে ‘ক্ষত্রিয়’– এই অজুহাত দেখিয়ে ১৮৫১ সালের জুলাই থেকে নিয়ম করেন যে, কায়স্থরাও সংস্কৃত কলেজে ভর্তি হতে পারবে।
সমস্ত শূদ্রকে ভর্তি করতে চেয়েও কেন তিনি শুধু কায়স্থদের জন্য সুপারিশ করছেন, ওই একই চিঠিতে তার জন্য অন্য একটি অজুহাত খাড়া করে তিনি জানান:
The reason, why I recommend the exclusion of the other orders of Shudras at present, is that they, as a body, are wanting in respectability and stand lower in the scale of social consideration. Their admission, therefore, would, I fear, prejudice the interests of the Institution.৩৬ [নজরটান সংযোজিত]
তাঁর কথার সমর্থনে, তিনি প্রথমে কলেজের তিন অধ্যাপক ভরতচন্দ্র শিরোমণি, জয়নারায়ণ তর্কপঞ্চানন ও প্রেমচন্দ্র তর্কবাগীশের বক্তব্যের ‘A True Translation’ করেন এবং এ বিষয়ে তাঁদের আপত্তির বয়ানটিও তাঁর চিঠির সঙ্গে জুড়ে দেন। এই বয়ানে বিস্তর শাস্ত্রপ্রমাণের উল্লেখ ছাড়া বাংলায় লেখা ছিল —
শূদ্র সমানধর্মি কায়স্থ প্রভৃতি সঙ্করজাতিদিগের বেদাঙ্গ ব্যাকরণাদি শাস্ত্রের অধ্যয়ন এই পাঠশালায় প্রচলিত হওয়া আমারদিগের সম্মত নহে। শূদ্র কর্তৃক বেদাঙ্গশাস্ত্রের অধ্যয়ন মন্বাদি ধর্মশাস্ত্রনিষিদ্ধ এবং বোধ হয় এই জন্যই সংস্কৃতপাঠশালার সংস্থাপনাবধি এ পর্যন্ত এখানে এ ব্যবহার প্রচলিত হয় নাই ও নবদ্বীপ প্রভৃতি বিখ্যাত সমাজে এবং কাশীস্থ বিদ্যামন্দিরেও এরূপ ব্যবহার নাই।৩৭
এই বয়ানকে হাতিয়ার করে, বিদ্যাসাগর প্রকারান্তরে এক ঢিলে দু-পাখি মারেন। তিনি সর্বসমক্ষে প্রমাণ করেন – ১) তাঁর ইচ্ছে থাকলেও অধ্যাপকদের সমবেত বিরোধিতার মুখোমুখি হয়ে, আপাতত তাঁকে ‘সংস্কার’ প্রক্রিয়া স্থগিত রাখতে হচ্ছে এবং ২) শিক্ষাসংস্কারের ক্ষেত্রে ‘প্রগতিশীল’ বিদ্যাসাগরকে ‘রক্ষণশীল’ সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতদের সম্মিলিত প্রতিবাদের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। তবে এত অজুহাত খাড়া করার পরেও তিনি কিন্তু কলেজে কায়স্থদের স্মৃতি ও ধর্মশাস্ত্র পড়ার অনুমতি দেননি। কারণ,
তাঁহার [বিদ্যাসাগর] মত এই যে, শূদ্রসন্তানেরা ব্যাকরণ, সাহিত্য, অলঙ্কার, ও দর্শনশাস্ত্র অধ্যয়ন করিতে পারিবেন, শাস্ত্রে কোনও স্থানে ইহার বাধা নাই। কেবল ধর্মশাস্ত্র স্মৃতি অধ্যয়ন করিতে পারিবেন না।৩৮
ফলে কুলকৌলিন্যের সঙ্গে শিক্ষাকৌলিন্যের সহাবস্থান চমৎকার রক্ষিত হয়, যেমন অবিকল রক্ষিত হয় বিত্তের সঙ্গে বিদ্যার বিসদৃশ বসবাসও। তাই স্বাভাবিকভাবেই ‘শূদ্রসন্তানেরা’ সংস্কৃতের সমস্ত শাখায় পড়ার সুযোগ পান না। হায় শিক্ষাসংস্কারক!
হিন্দু কলেজে ভর্তির ক্ষেত্রে, ধর্মীয় বৈষম্য থাকলেও বর্ণবৈষম্য ছিল না। তাই সেখানে ব্রাহ্মণ ছাড়াও বৈদ্য, কায়স্থ, বণিক ইত্যাদি বর্ণের ছাত্ররা শিক্ষার সুযোগ পেত। শিক্ষার সুযোগ পেলে অব্রাহ্মণরাও যে সমাজে স্বীকৃতি পেতে পারে, হিন্দু কলেজের ছাত্ররা তা প্রমাণও করেছিলেন। ১৮২৮ সালে ডাক্তার টাইলার (Dr. Tyler) যখন সংস্কৃত কলেজে দেহব্যবচ্ছেদ শুরু করেন, তখন দেখা যায়:
The students not only handled the bones of the human skeleton without reluctance, but in some instances themselves performed the dissection of the softer parts of animals.৩৯
১৮৪৮-এ মাত্র ১৭ বছর বয়সে যিনি প্রধান শিক্ষিকা হয়েছিলেন, সেই সাবিত্রীবাই জ্যোতিরাও ফুলে মাত্র এক বছরের মধ্যে ‘শূদ্র’ ও ‘অতিশূদ্র’দের জন্য, প্রতিষ্ঠা করে ফেলেন ১৮টি বিদ্যালয়। তাঁর নেটিভ ফিমেল স্কুল তখন গমগম করছে ‘অস্পৃশ্য’ মাং, মাহার, মাতং ছাত্রীতে। ১৮৫২-তে সরকারি স্কুল পরিদর্শক কমিটি তাঁকে ‘Ideal Teacher Award’-এ ভূষিত করছে।৪০ সরকারি স্কুলের একটি উচ্চবর্ণের ছাত্র ১৮৫২ সালের ২৯ মে Poona Observer-এ লিখছে —
The number of girl students in Jyotirao’s school is ten times more than the number of boys studying in the government schools. This is because the system for teaching girls is far superior to what is available for boys in government schools. If this situation continues, then the girls from Jyotirao’s school will prove superior to the boys from the government schools and they feel that in the coming examinations, they can really achieve a big victory. If the Government Education Board does not do something about this soon, seeing these women outshine the men will make us hang our heads in shame.৪১
অথচ ১৮৫৪-তেও একটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, শূদ্রদের প্রবেশাধিকার দিচ্ছেন না বিদ্যাসাগর। কিংবা প্রবেশাধিকার দিলেও তাদের সমস্ত বিষয় পড়ার সুযোগ করে দিচ্ছেন না তিনি। তবুও ‘মালি’ সাবিত্রীবাই নন; চূড়ান্ত ব্রাহ্মণ্যবাদী বিদ্যাসাগরই সেরা মানবতাবাদী, শ্রেষ্ঠ শিক্ষাসংস্কারক!
১৮৫৪ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত সংস্কৃত কলেজের ৩৭৬ জন ছাত্রের মধ্যে ব্রাহ্মণ ছিল ৩০৬ জন, বৈদ্য ও কায়স্থ ছাত্র ছিল যথাক্রমে ২৮ ও ৪২ জন।৪২ ওই বছরের শেষদিকে, এই বর্ণবৈষম্যের সামান্য পরিবর্তন ঘটে। ২৩ নভেম্বর বিদ্যাসাগর সংসদ সম্পাদক উড্রোকে জানান:
I beg leave to inform the Council that in my humble opinion, the time has arrived for opening the Sanscrit College for all respectable classes of Hindoos.৪৩
বিদ্যাসাগরের প্রস্তাব অনুমোদিত হয় ১৩ ডিসেম্বর। কিন্তু এই চিঠির ‘all respectable classes of Hindoos’ অংশটিতে যে মারাত্মক প্যাঁচ লুকিয়ে আছে, তা সম্ভবত অনুমান করতে পারেননি ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। তাই তিনি লিখেছিলেন,
তিনি ১৮৫১, জুলাই মাসে প্রথমে কায়স্থ, পরে ১৮৫৪, ডিসেম্বর মাসে যে-কোনো সম্ভ্রান্ত ঘরের হিন্দুকে সংস্কৃতে কলেজে পড়িবার অবাধ অধিকার দিলেন।৪৪
অথচ প্রকৃত ঘটনা জেনে এবং এই চিঠিটিই উদ্ধৃত করে ইন্দ্রমিত্র লেখেন,
১৮৫৪ সালের ডিসেম্বরে নিয়ম হল, সকল সম্ভ্রান্ত হিন্দুসন্তান সংস্কৃত কলেজে ভর্তি হতে পারবে।৪৫
তাঁর করুণাসাগর বিদ্যাসাগর প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৯ সালে, ২০১৬-তে বইটির নবম মুদ্রণেও বাক্যটি অবিকৃত অবস্থায় আছে।
যদিও ছদ্মনামের আড়াল বর্জন করে, ১৯৭১-এ প্রকাশিত Unpublished Letters of Vidyasagar গ্রন্থে, তিনি এ বিষয়ে প্রকৃত তথ্যটি তুলে ধরেন। তাতে স্পষ্ট, বিদ্যাসাগর আদৌ কলেজের দ্বার সমস্ত ‘সম্ভ্রান্ত’ হিন্দুর জন্য উন্মুক্ত করেননি, করেছিলেন কেবল ‘নবশাখ’ শ্রেণির ছাত্রদের জন্য! ১৮৬৩ সালের সরকারি নথিপত্র থেকে জানা যায়:
In view of such sanction, Brahmins, Vaidyas, Kayasthas and the castes known as Nabasakh were admitted to the Sanscrit College. The privilege however was not extended to students belonging to castes of a lower grade than the Nabasakh.৪৬
এ প্রসঙ্গে নবশাখদের সম্পর্কে সামান্য তথ্য দেওয়া প্রয়োজন। আঠারো ও উনিশ শতকের বাঙালি সমাজে, জাতিবিন্যাসের শীর্ষে ছিল ব্রাহ্মণ। তার নীচে ছিল নানা জাতি – বৈদ্য, কায়স্থ, সদ্গোপ, কৈবর্ত, গোয়ালা, আগুরি, কুম্ভকার, তিলি, যুগি, তাঁতি, মালাকার, কলু, নাপিত, রজক, শাঁখারি, হাড়ি, মুচি, ডোম, চণ্ডাল, বাগদি, স্বর্ণকার, সুবর্ণবণিক, কর্মকার, সূত্রধর, গন্ধবণিক, জেলে, পোদ্দার, বারুই ইত্যাদি। ব্রাহ্মণরা মাত্র যে ন’টি জাতির হাত থেকে জল গ্রহণ করত, তারা ‘জল আচরণীয়’ জাতি বলে চিহ্নিত ছিল। এঁদেরই ‘নবশাখ’ বলা হত। এঁরা হচ্ছেন তিলি, তাঁতি, মালাকার, সদ্গোপ, নাপিত, বারুই, কামার, কুমোর ও ময়রা।৪৭ বিদ্যাসাগরও এই প্রথার ঊর্ধ্বে উঠতে না পেরে, ইংরেজি ভাষায় মারপ্যাঁচের আশ্রয় নিয়েছিলেন মাত্র!
তবে তাঁর ভাষার যাবতীয় কারিকুরি, ‘রক্ষণশীল’ সংস্কৃত পণ্ডিতদের আড়ালে নিজের ব্রাহ্মণ্যবাদী মানসিকতাকে গোপন করার চেষ্টা, তাঁর সযত্নলালিত ‘প্রগতিশীল’ ভাবমূর্তি নির্মাণ – সব কিছুই ঠিক তার পরের বছরে এক ঝটকায় প্রকাশিত হয়ে পড়ে। ১৮৫৫-র ১৫ অগস্ট, জাতিতে সুবর্ণবণিক শ্যামাচরণ সেন সংস্কৃত কলেজে ভর্তি হওয়ার আবেদন জানান। কলেজে সুবর্ণবণিক ছাত্রদের পাঠাধিকার সম্পর্কে জানাতে গিয়ে, ২১ নভেম্বর অধিকর্তা গর্ডন ইয়ংকে লেখা চিঠিটির প্রথম ও শেষ অংশে, আবারও বিস্তর ধানাইপানাই করেন বিদ্যাসাগর। ১৮৫১ সালে কায়স্থদের ও পরে ‘all the respectable castes of Hindoos’-দের তিনি কলেজে ভর্তি করেছেন, প্রথমে এই ইতিহাস জানান। শেষের অংশে ফের রক্ষণশীল পণ্ডিতদের প্রসঙ্গ তুলে আনেন। কিন্তু সুবর্ণবণিকদের কলেজে ভর্তি করার বিষয়ে তাঁর যে যথেষ্ট আপত্তি আছে, সে কথা স্পষ্ট জানিয়ে বিদ্যাসাগর লেখেন —
But these orders, I regret, cannot apply to people of the caste to which the Memorialist belongs, nor would it in my humble opinion be expedient at present to admit applicants of that class. It is true that some families of Sonar Baniyas of Calcutta are opulent men, but in the scale of caste the class stands very low. Admission for that class will, I am sure, not only shock the prejudices of the orthodox Pundits of the Institution, but materially injure its popularity as well as respectability.৪৮ [নজরটান সংযোজিত]
বিদ্যাসাগরের পদত্যাগের পরে ১৮৫৮-র ৪ নভেম্বর, কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব গ্রহণ করেন ই. বি. কাওয়েল। তাঁর আমলে ১৮৬৩ সালের মার্চ মাসে, জনশিক্ষা অধিকর্তা সংস্কৃত কলেজে সমস্ত সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারের ছাত্রকে ‘irrespective of the caste to which they belong’৪৯ ভর্তি করার প্রস্তাব দিলে, ছোটলাট এপ্রিল মাসে তা মঞ্জুর করেন। পরবর্তী শিক্ষাবর্ষে কাওয়েল তাঁর রিপোর্টে জানান যে কলেজে ১৩ জন সুবর্ণবণিক, ৩ জন করে তাঁতি ও গোপ এবং একজন কৈবর্ত সম্প্রদায়ের ছাত্র মিলিয়ে মোট ২০ জন ছাত্র পাঠরত, যারা তাঁর মতে ‘would have been excluded by the former rule’।৫০ বিদ্যাসাগর এবং কাওয়েলের ক্ষেত্রে সময়ের ব্যবধান ছিল মাত্র পাঁচ বছর। এই সামান্য সময়ে সামাজিক পরিস্থিতির কোনও বিশাল পরিবর্তন হয়নি, পণ্ডিতদের রক্ষণশীল মনোভাবও রাতারাতি পরিবর্তিত হয়নি। তবুও এক বিশাল সংখ্যক নিম্নবর্ণের ছাত্র অবশেষে সংস্কৃত কলেজে প্রবেশাধিকার পায়, যদিও সে সুযোগ যে বিদ্যাসাগর দেননি – এই তিক্ত সত্য স্বীকার করে নেওয়া শ্রেয়।
আরও একটি বিষয় এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন। সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে, বিদ্যাসাগর সারা জীবনে ছাত্রদের একটি ক্লাসও নেননি। কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য জানিয়েছেন –
তুমি বোধ হয় জান না, বিদ্যাসাগর মহাশয় একটু তোৎলা ছিলেন; কেহ তাহা টের পাইত না। তোৎলার প্রধান ঔষধ আস্তে কথা কহা। বিদ্যাসাগর এরূপ অভ্যাস করিয়াছিলেন যে, কখনও জোরে কথা তাঁহার মুখ দিয়া বাহির হইত না। ইহাতে কথা কহিবার সময় কখনও প্রকাশ পাইত না যে তিনি তোৎলা। সংস্কৃত কলেজের সহিত তিনি ত অনেককাল সংশ্লিষ্ট ছিলেন; কখনও ক্লাসে পড়ান নাই। একবার শুনিয়াছিলাম তিনি ‘উত্তরচরিত’ ও ‘শকুন্তলা’ ক্লাসে পড়াইবেন, কিন্তু বস্তুগত্যা তাহা ঘটে নাই। আমার বোধ হয়, পূর্বোক্ত কারণ বশতঃই তিনি ক্লাস পড়ান ব্যাপারে অগ্রসর হইতেন না।৫১
সব মিলিয়ে দেখা যায়, তিনি ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কলেজে বেতন চালু করেছিলেন; বেদান্তকে ‘ভ্রান্ত’ দর্শন বললেও কোনও দিন তা কলেজের পাঠ্যক্রম থেকে বাতিল করেননি, মনুসংহিতা পড়ানো অব্যাহত রেখেছিলেন এবং সর্বদর্শনসংগ্রহ পড়ানো চালু করতে পারেননি; কলেজে ইংরেজি বিভাগ চালু করলেও আখেরে তাতে ছাত্রদের বিশাল কিছু সুবিধা হয়েছিল এমন নজির পাওয়া যায়নি; মুগ্ধবোধ-এর পরিবর্তে নিজের পাঁচটি বই নিজেরই কলেজের পাঠ্যসূচীতে অন্তর্ভুক্ত করলেও ছাত্রদের ব্যাকরণ পাঠে সময়ও কমেনি, ভিতও পোক্ত হয়নি; সর্বোপরি সহকর্মীদের রক্ষণশীলতার দোহাই দিয়ে, নবশাখদের চেয়ে নিম্নবর্ণের ছাত্রদের কলেজে প্রবেশাধিকার দেননি।
চরম ব্রাহ্মণ্যবাদী মানসিকতার উৎকট প্রদর্শন করে ও উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে মেকলে প্রদর্শিত পথে ‘চুঁইয়ে পড়া’ নীতিকে সমর্থন করে এবং সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক হিসেবে উচ্চ পদের প্রভাব খাটিয়ে ও সাহেবদের পরম মিত্র হয়ে, তিনি নিজের গ্রন্থব্যবসার রমরমার সুবন্দোবস্ত এবং সমবয়সী ও বয়োজ্যেষ্ঠ অধ্যাপকদের তুলনায় তিন গুণ বেতন ও বিপুল ক্ষমতা লাভ করেছিলেন মাত্র। তাতে কলেজের বা ছাত্রদের কতটা উপকার হয়েছিল, তা সম্ভবত বলার দরকার নেই। তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে, বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ হয়ে যদি কোনও গঠনমূলক শিক্ষাসংস্কার করতে না-ই পারেন, তবে তা নিয়ে এত দিন পরেও মানুষ আপ্লুত কেন। এই প্রশ্নের মোক্ষম উত্তর, বহু দিন আগে দিয়ে গেছেন কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য। তিনি বলেছেন —
বিদ্যাসাগরের প্রতি এই যে ভক্তি, ইহার একমাত্র কারণ যে তাঁহার চরিত্রের উৎকর্ষ, তাহা নহে। অন্যান্য কারণের মধ্যে একটি বিশিষ্ট কারণ আছে, যাহার উল্লেখ করিলে আমাদের বাঙ্গালীর চরিত্রগত একটা দোষ প্রকটিত হইয়া পড়িবে। যে সময়ের কথা আমি বলিতেছি, সে সময়ে এটা বেশ বোঝা যাইত ‘সাহেবদের’ কাছে বিদ্যাসাগরের খুব প্রতিপত্তি ছিল বলিয়া তাঁহার স্বদেশবাসীর নিকট তিনি অত খাতির পাইয়াছিলেন। ‘সাহেবদের’ নিকট প্রতিষ্ঠাপন্ন না হইলে বাঙ্গালী মানুষের মুল্য বুঝিতে পারে না। মুখে না বলি, কিন্তু মনে মনে যাহাদের বড় বলিয়া জানি, তাঁহাদের সিল মোহরের ছাপ না পড়িলে জিনিষের মূল্য হয় না।৫২
আমাদের মনের গহনে, আজও সেই একই ঔপনিবেশিক মানসিকতা বর্তমান।
************************************************************
উল্লেখপঞ্জী:
১. Arabinda Guha (ed.), Unpublished Letters of Vidyasagar, 2nd Revised Edition, Kolkata, 2013, p. 138
২. তদেব, পৃ. ১৩৯
৩. H. Sharp (ed.), Selections from Educational Records, Part I, 1781-1839, Calcutta, 1920, p. 116
৪. C.E. Trevelyan, On the Education of the People of India, Calcutta, 1838, pp. 80-81; উদ্ধৃত Asok Sen, Iswar Chandra Vidyasagar and His Elusive Milestones, New Delhi, 2016, p.16
৫. H. Sharp (ed.), Selections from Educational Records, Part I, 1781-1839, p. 130
৬. তদেব, পৃ. ১৪৬
৭. Arabinda Guha (ed.), Unpublished Letters of Vidyasagar, p. 93
৮. তদেব, পৃ. ১৪৫
৯. তদেব, পৃ. ১৩৭
১০. তদেব, পৃ. ১৩৩
১১. তদেব, পৃ. ১৭৬
১২. তদেব, পৃ. ১১১
১৩. তদেব, পৃ. ১২৫-২৬
১৪. তদেব, পৃ. ১২২
১৫. তদেব, পৃ. ২৮৯
১৬. তদেব, পৃ. ১৫৯
১৭. তদেব, পৃ. ১৭১
১৮. তদেব, পৃ. ১৯৮
১৯. বিপিনবিহারী গুপ্ত, পুরাতন প্রসঙ্গ, কলকাতা, ১৯৫৯, পৃ. ৫৪
২০. তদেব, পৃ. ৫৩
২১. ‘বিজ্ঞাপন’, সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা; গোপাল হালদার (সম্পাদিত), বিদ্যাসাগর রচনাসংগ্রহ, তৃতীয় খণ্ড, কলকাতা, ১৯৭২, পৃ. ৫০৯
২২. তদেব, পৃ. ৫০৯
২৩. ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিদ্যাসাগর-প্রসঙ্গ, কলকাতা, ১৩৩৮, পৃ. ৯-১০
২৪. General Report on Public Instruction, in the Lower Provinces of the Bengal Presidency, from 27 January to 30 April 1855, pp. 26-27; Arabinda Guha (ed.), Unpublished Letters of Vidyasagar, p. 25
২৫. ‘বিজ্ঞাপন’, শ্লোকমঞ্জরী; উদ্ধৃত ইন্দ্রমিত্র, করুণাসাগর বিদ্যাসাগর, কলকাতা, ২০১৬, পৃ. ৯১-৯২
২৬. শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন, বিদ্যাসাগর-জীবনচরিত, কলকাতা, ১৩২১, পৃ. ২৯
২৭. বিপিনবিহারী গুপ্ত, পুরাতন প্রসঙ্গ, পৃ. ১৭-১৮
২৮. For certain reasons, which it is needless to state here, we are obliged to continue the teaching of the Vedanta and Sankhya in the Sanscrit College. That the Vedanta and Sankhya are false systems of philosophy is no more a matter of dispute. These systems, false as they are, command unbound reverence from the Hindus. Whilst teaching these in the Sanscrit course, we should oppose them by sound philosophy in the English course to counteract their influence.
বিনয় ঘোষ, বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ, কলকাতা, ২০১১, পৃ. ৫২৬
২৯. বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব, প্রথম পুস্তক; গোপাল হালদার (সম্পাদিত), বিদ্যাসাগর রচনাসংগ্রহ, দ্বিতীয় খণ্ড, তৃতীয় সংস্করণ, কলকাতা, ১৯৭৪, পৃ. ৩০
৩০. প্রমথনাথ বিশী, বিদ্যাসাগর-রচনাসম্ভার, কলকাতা, ১৩৬৭, পৃ. ছয়; উদ্ধৃত ইন্দ্রমিত্র, করুণাসাগর বিদ্যাসাগর, পৃ. ১৪৪
৩১. True it is that the most part of the Hindu Systems of Philosophy do not tally with the advanced ideas of modern times, yet it is undeniable that to a good Sanscrit Scholar their knowledge is absolutely required. Unpublished Manuscript Records, Sanskrit College, Calcutta; উদ্ধৃত বিনয় ঘোষ, বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ, পৃ. ৫১৭
৩২. তদেব, পৃ. ৫১৮
৩৩. Mr. Cowell appears to take objection to the study of the Smriti and Vedanta in the College. I am sorry that I must differ from him on this point. ...The Vedanta is one of the systems of philosophy prevalent in India. It is of a metaphysical character, and I do not think there can be any reasonable objection to its use in the college. Both the branches, as at present taught, are free from objection on religious grounds. In my humble opinion, the discontinuance of these subjects would make the college course a very defective one. ইন্দ্রমিত্র, করুণাসাগর বিদ্যাসাগর, পৃ. ৬৮৫
৩৪. শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন, বিদ্যাসাগর-জীবনচরিত, পৃ. ৯৫
৩৫. In reply I beg leave to state that I see no objection to the admission of other castes than Brahmanas and Vaidyas or, in other words, different orders of Shudras, to the Sanscrit College. But as a measure of expediency, I would suggest that at present Kayasthas only be admitted. They form a very respectable portion of the Hindu community of Bengal….
Arabinda Guha (ed.), Unpublished Letters of Vidyasagar, pp. 99-101
৩৬. তদেব, পৃ. ১০১
৩৭. তদেব, পৃ. ১০৩
৩৮. শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন, বিদ্যাসাগর-জীবনচরিত, পৃ. ৯৬
৩৯. Anathnath Basu (ed.), Reports on the State of Education in Bengal (1835 & 1838) by William Adam, Calcutta, 1941, p. 516
৪০. Renu Pandey, ‘Crusaders of Female Education in Colonial India: A case study of Savitribai Phule’; International Journal of Innovative Social Science & Humanities Research, Vol. 2, No. 1, March 2015, p. 2
৪১. Hari Narake, On Savitribai Phule: Dnyanajyoti Savitribai Phule, Savitribai Phule Lecture Series, edited by T. Sundararaman, New Delhi, 2008, pp. 14-15
৪২. Arabinda Guha (ed.), Unpublished Letters of Vidyasagar, p. 38
৪৩. তদেব, পৃ. ১৮১
৪৪. ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিদ্যাসাগর-প্রসঙ্গ, পৃ. ৮
৪৫. ইন্দ্রমিত্র, করুণাসাগর বিদ্যাসাগর, পৃ. ১৪২
৪৬. Arabinda Guha (ed.), Unpublished Letters of Vidyasagar, pp. 38-39
৪৭. অতুল সুর, আঠারো শতকের বাঙলা ও বাঙালী, কলকাতা, ১৯৫৭, পৃ. ৮৩
৪৮. Arabinda Guha (ed.), Unpublished Letters of Vidyasagar, p. 355; কিছু মুদ্রণপ্রমাদ সহ সম্পূর্ণ চিঠিটি আছে বিনয় ঘোষ, বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ, পৃ. ৫৪৫
৪৯. তদেব, পৃ. ৪০
৫০. তদেব, পৃ. ৪০
৫১. বিপিনবিহারী গুপ্ত, পুরাতন প্রসঙ্গ, পৃ. ৯৫
৫২. তদেব, পৃ. ৪৫
আমি লিখেছিলাম "অনেকে নেট ঘেঁটেই বিদ্বান। আজ্ঞে না। আপনাকে সেটাও বলছি না।" অর্থাৎ যেমন মন্তব্যের ক্ষেত্রে অরিনবাবু, রঞ্জনবাবু, এবং দ-দিকে আওতার বাইরে রেখেছিলাম, ঠিক তেমনই আপনাকেও ওই 'নেট ঘেঁটেই বিদ্বান' তালিকার বাইরে রেখেছিলাম। এখন আপনি কয়েকটি পাতার ছবি দিয়েছেন। সেগুলোর সবকটাই পড়লাম। কিন্তু এই বিষয়ে আপনার মূল প্রতিপাদ্যগুলো ১, ২ আকারে সাজিয়ে লিখলে আমার পক্ষে বোঝার বিষয়টা খানিক সুবিধাজনক হতে পারে। তবে এই স্মৃতিচারণে অনেক ভুল তথ্য আছে, এটুকু বলাই যায়।