হিমালয়ের হাহাকার – এক বিয়োগান্তক ইতিবৃত্ত।
সাতসকালে ভেসে আসা কিছু পরিসংখ্যানে চোখ বোলাতেই রীতিমতো আৎকে উঠতে হলো। বিগত এক মাস ধরে মৌসুমী বর্ষণের দাপটে দেশের উত্তর - উত্তর পশ্চিমে হিমালয়ের কোলে থাকা তিন পার্বত্য রাজ্য উত্তরাখণ্ড, হিমাচল প্রদেশ ও জম্মু ও কাশ্মীরের একেবারে নাজেহাল অবস্থা। রণক্ষেত্রে যেমন একের পর এক মিসাইল দেগে প্রতিপক্ষের ঘুম ছুটিয়ে দেওয়া হয়, ঠিক একই ভাবে একের পর এক মেঘ ভাঙার ঘটনা ঘটেছে পাহাড়তলির এই তিন রাজ্যে। এর পরিণতি দেখে রীতিমতো শিউরে উঠেছি আমরা সবাই। বিপর্যয়ের কারণে কতগুলো স্বল্প পরিচিত জনপদ যেমন ধারালি, রামপুর,মান্ডি, মানালি,চাম্বা, কিস্তোয়ার,কাঠুয়া এবং অতি পরিচিত দেরাদুনের নাম এখন লোকজনের মুখে মুখে ফিরছে।
ক্লাউড বার্স্ট বা মেঘ ভাঙার মতো ঘটনা একেবারেই নতুন বা বিরল নয়, তবে বিগত কয়েক বছরে পশ্চিম হিমালয়ের বুকে তার পৌনঃপুনিকতা বা তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে লক্ষণীয় মাত্রায়। প্রশ্ন হলো, কেন বারংবার এমন ঘটনার ঘনঘটা? কী বলছেন গবেষক বিজ্ঞানীরা? রিলে রেসের ব্যাটন বদলের মতো একটা পর একটা বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটেছে এই এলাকায়। এক ঘটনা থেকে আরেক ঘটনার উৎপত্তি। মেঘ ভাঙ্গা বৃষ্টি, হড়পা বান, শিলা- হিমবাহ সম্প্রপাত , গ্লফ বা হিমবাহ হ্রদের বিস্ফোরণ – ঠিক যেন চেইন রিঅ্যাকশন বা শৃঙ্খলিত বিক্রিয়া।ঘটেই চলেছে একের পর এক। আর এসবের পেছনে অনুঘটকের কাজ করছে বিশ্ব উষ্ণায়ন। বিজ্ঞানীরা এই বিষয়ে সহমত পোষণ করে জানিয়েছেন যে, বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়ে যাওয়ায় বাতাসের জল ধারণের ক্ষমতা অনেকটাই বেড়ে গেছে। বাতাস এখন আগের থেকে অনেক বেশি জল তার বাষ্পীয় শরীরে বয়ে নিয়ে আসছে। সেই জলভরা মেঘ পাহাড়ের গা বেয়ে উপরে উঠে তৈরি করছে জলে টইটম্বুর বাদল মেঘ। একসময় তাইই আছড়ে পড়ছে পাহাড়ের আনাচে কানাচে। প্রবল গতিতে নেমে আসা জলের ধারার আকস্মিক অভিঘাতে হাহাকার রব উঠেছে পশ্চিম হিমালয়ের সর্বত্র। বিশিষ্ট বিজ্ঞানী অনিল কুলকার্নির মতে – তাপ বাড়লে বাতাসের তৃষ্ণা বেড়ে যায়। আর তা মেটাতে অনেকটাই বেশি জল ধরে নেয় সে নিজের শরীরে। পর্বতের ঢালে ধাক্কা খেয়ে সেই ভারি বাতাস সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠার মতো করে আরও উঁচুতে উঠে যায়। ততক্ষণে নিজের শরীরে বয়ে আনা বাষ্প কণাগুলো বড়ো বড়ো জলবিন্দুতে পরিবর্তিত হয়েছে।
এই অবস্থায় আর ভেসে থাকতে না পেরে এক সময় তারা আছড়ে পড়ে আকস্মিক বৃষ্টিপাতের আকারে। এখন যার পরিচয় হড়পা বান নামে। অবশ্য অতি ব্যবহারে এই শব্দবন্ধের গুরুত্ব অনেকটাই কমেছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
হেমবতী নন্দন বহুগুণা গাড়োয়াল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক যশপাল সুন্দ্রিয়ালের নেতৃত্বাধীন গবেষণা প্রকল্পের বিজ্ঞানীরা ১৯৮২ সাল থেকে ২০২০ পর্যন্ত সময়সীমার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে একাধিক প্রাকৃতিক কারণে ১৯৯৮- ২০০৯ সালের মধ্যবর্তী সময়ে উষ্ণতা বাড়লেও কমেছে বৃষ্টিপাত ও পৃষ্ঠীয় প্রবাহের পরিমাণ। ২০২৫ সালে Springer Nature পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, ১৯৭০ সাল থেকে ২০২৪ সালের মধ্যবর্তী সময়ে ক্লাউড বার্স্টের সংখ্যা উল্লেখনীয় ভাবে বেড়ে গেছে। বলাবাহুল্য এরসঙ্গে তালমিলিয়ে পশ্চিম হিমালয়ের কোলে থাকা চারটি এলাকায় বেড়েছে বিভিন্ন ধরনের বিপর্যয়ের সংখ্যা ; মৃত্যু হয়েছে সাধারণ মানুষের, নষ্ট হয়ে গেছে স্থাবর সম্পত্তি। এই ক্ষয়ক্ষতি আজও পরিপূরণ করা সম্ভব হয়নি। বিপর্যয়ের সঙ্গেই সহবাসী হয়ে থাকতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে ঐসব এলাকার সাধারণ পাহাড়িয়া মানুষজন।
উত্তরাখণ্ডের উত্তরকাশী জেলার ধারালির বিপর্যয় এই মুহূর্তে সকলের নজর কেড়েছে সন্দেহ নেই, কিন্তু পাশের রাজ্য হিমাচল প্রদেশও এক প্রলয়ঙ্কর বিপর্যয়ের সম্মুখীন । এ বছরের বর্ষা এই রাজ্যের মানুষের কাছে কালান্তক শমনের রূপ ধরে এসেছে। এরমধ্যেই এই রাজ্যে ৩৬টি ক্লাউড বার্স্ট এবং ৭৪টি হড়পা বানের ঘটনা ঘটেছে যার ফলে রাজ্যের ৬ টি জেলা ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। একমাত্র মান্ডি জেলাতেই ঘটেছে ১৬ টি ক্লাউড বার্স্টের ঘটনা, প্রাণহানি হয়েছে ১৬ জনের –যা রাজ্যের মধ্যে সর্বাধিক সংখ্যক।
গত রবিবার ( আগস্ট ১৭, ২০২৫ ) রাজ্যের কুল্লু এবং মান্ডি জেলার মণিকরণে নতুন করে বিপর্যয়কর মেঘ ভাঙার ঘটনা ঘটেছে। প্রাণহানির ঘটনা না ঘটলেও সবমিলিয়ে এই এলাকায় প্রায় ২০০০ কোটি টাকার সম্পদ ও পরিকাঠামোর বিপুল ক্ষতি হয়েছে। বিপদ তো কখনও একলা আসেনা। প্রবল বৃষ্টির স্যাঙাৎ হয়ে এসেছে ভয়ঙ্কর ভূমি ধস। মান্ডি জেলায় মোট ৬৩ টি ধসের ঘটনা ঘটেছে। মেঘ ভাঙ্গা বৃষ্টি এবং সহযোগী ধসের ঘটনায় ৩৫ জনের জীবন হানি হয়েছে।
হিমাচল প্রদেশের এমন অবস্থার পেছনে অশান্ত প্রকৃতির পাশাপাশি মানুষের অপরিণামদর্শী কার্যকলাপকেও কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে দ্বিধা করেননি বিজ্ঞানী ও পরিবেশবিদরা। তাঁরা বহুবার সচেতন করার চেষ্টা করেছেন প্রশাসনের কর্মকর্তাদের, বলেছেন উন্নয়নের নামে পরিবেশের ওপর যথেচ্ছাচার বন্ধ করতে কিন্তু কেউ তাঁদের সাবধানবাণীর প্রতি কর্ণপাত করার সৌজন্য পর্যন্ত দেখায়নি। তাঁরা জানিয়েছেন নির্বিচারে অরণ্যচ্ছেদন , উন্নয়নের নামে পরিবেশের ওপর কংক্রিটের আস্ফালন এবং বৈশ্বিক জলবায়ুর আচরণের অভূতপূর্ব পরিবর্তন – এই ত্রিফলা আক্রমণের কারণেই আজকের হিমালয় তথা হিমাচল প্রদেশের এমন করুণ পরিণতি। প্রকৃতিকে ক্ষেপিয়ে তোলার যে ভয়ঙ্কর পরিণতি , আজকের হিমালয় তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। প্রখ্যাত পরিবেশবিদ OP Bhuraita ক্ষোভের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন যে – প্রশাসনের কর্মকর্তাদের প্রকৃতি পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখার বিষয়ে সামান্য সচেতনতা নেই। না হলে দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলে কেউ চার লেনের রাস্তা তৈরির পরিকল্পনা করে? এসব করতে গিয়ে নির্বিচারে কেটে ফেলা হয়েছে গাছ, দুর্বল ভূমিভাগের ওপর যথেচ্ছভাবে খোঁড়াখুঁড়ি এবং কংক্রিটের স্ট্রাকচার নির্মাণ, পাহাড়ের বুক চিরে টানেল বা সুরঙ্গ তৈরি করতে গিয়ে প্রকৃতিকে ধ্বস্ত করা হয়েছে অবিবেচকের মতো। অথচ এমন একটা সংবেদনশীল গাঠনিক অঞ্চলে মানুষের যে কোনো রকম হস্তক্ষেপ না হওয়াই বাঞ্ছনীয়।
পরিবেশ বিশেষজ্ঞ সৌম দত্তের মতে – “এই ধ্বংসলীলার এখানেই ইতি,এমনটা কখনোই নয়। দক্ষিণের গরম হয়ে ওঠা সমুদ্র প্রতিনিয়ত বাতাসে মিশিয়ে দিচ্ছে বিপুল জলীয় বাষ্প যা আগামীদিনেও এমন বিপর্যয় ডেকে আনবে। আমাদের এসব নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা ভাবনা করতে হবে। রাজ্যওয়াড়ি নয় , ভাবতে হবে গোটা হিমালয়কে নিয়ে”।
এসব নিয়ে আন্তরিকভাবে ভেবে চলেছেন, মাঠে নেমে পরিবেশ প্রকৃতির সঙ্গে মানুষকে একাত্ম অনুভবে বাঁধতে চেয়ে নিরলসভাবে কাজ করে চলেছেন এমন একজন মানুষ হলেন শ্রী রবি চোপড়া। হিমালয়ের পরিবেশকে আগলে রাখতে অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন এই বর্ষীয়ান মানুষটি। গত জুন মাসের ৩০ তারিখ থেকে শুরু করে গত ১৪ আগস্ট – এই তিনমাস সময়কালের ব্যবধানে পশ্চিম হিমালয়ের ওপরে প্রকৃতির যে অভূতপূর্ব অভিঘাত নেমে এসেছে তা দেখে চোপড়াজী অত্যন্ত ব্যথিত। খুব সম্প্রতি বিখ্যাত ডাউন টু আর্থ পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি নির্দ্বিধায় খোলামেলাভাবে জানিয়েছেন তাঁর মনের একান্ত অনুভব আর বেদনার কথা। –”এই সময়ের বুকে দাঁড়িয়ে বলতে পারি যে সেরাজ (হিমাচল প্রদেশ ), ধারালি ( উত্তরাখণ্ড ) এবং কিস্তোয়ার ( জম্মু ও কাশ্মীর) বিধ্বস্ত ও বিপন্নতার স্মারক হয়ে উঠেছে। উত্তরকাশীর অবস্থান হিমালয়ের প্রধান কেন্দ্রীয় থ্রার্স্ট বা main central thrust এর ওপর। ফলে গাঠনিক দিক থেকে অতি ভঙ্গুর এই অঞ্চলে মানুষ যথেচ্ছাচার করলে তার প্রতিফল ভয়াবহ হতে বাধ্য। জলবায়ুর এই অনিশ্চিয়তার মধ্যে পরিকাঠামোর উন্নয়নের নামে পরিবেশের ওপর যথেচ্ছাচার বন্ধ না করলে আগামী দিনে আরও বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হবে আমাদের।”
আরও একটা বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন রবি চোপড়া মশাই আর তা হলো উন্নয়ন পরিকল্পনার তথাকথিত রূপরেখা নিয়ে। বিপর্যয়ের সময় তোলা ভিডিও ফুটেজ থেকে এটা স্পষ্টতই প্রমাণিত হয়েছে যে বাড়িঘর হোটেল চটি ইত্যাদি নির্মাণের কাজ করা হয়েছে পরিবেশের বাস্তবতাকে একেবারেই মান্যতা না দিয়ে। হিমালয় পর্বতের ওপর এমন দুর্বল পরিকল্পনার ফল যা হওয়ার তাই হয়েছে। এজন্যই বলা হয় “ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না।”
এক সময় প্রকৃতি পরিবেশের সঙ্গে মানুষের জীবনের নিবিড় সংযোগ ছিল। সহাবস্থানের আদর্শকে আঁকড়ে ধরেই মানুষের জীবন বিকশিত হয়েছে ফুলে ফলে, নানারূপে। এই নিমগ্ন আত্মসমর্পণের মধ্যে সামান্যতম মালিন্য ছিলোনা,পরাভবের গ্লানি ছিলোনা । এক অদৃশ্য গণ্ডির সীমারেখায় পরস্পর বাঁধা ছিলাম সকলে। গোল বাঁধলো সেদিন, যেদিন আপন সামর্থ্যের গৌরবে গরীয়ান হয়ে মানুষ চাইলো সেই বেড়া ভেঙে নিজের ইচ্ছেমতো বেড়ে উঠতে। এই ইচ্ছের ওপর ভর করেই সবকিছুকে অস্বীকার করার ঔদ্ধত্য জন্ম নিয়েছে আমাদের মধ্যে। যার আশ্রয়ে মানুষের বেড়ে ওঠা, বেঁচে বর্তে থাকা, সেই আশ্রয়টাকেই নষ্ট করে ফেলেছি আমরা।একাজের জন্য কিছু খেসারত তো দিতেই হবে। তাইনা!
হিমালয়ের হাহাকার যেন সেই বিয়োগান্তক কাহিনির করুণ পরিণতির আর্তনাদ।
উৎসর্গ::
হিমালয়বাসী বিপন্ন মানুষদের উদ্দেশ্যে।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।