এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  প্রবন্ধ

  • অসমাপ্ত বিপ্লব ও নেপালের জেন জি 

    Koushik Chatterjee লেখকের গ্রাহক হোন
    প্রবন্ধ | ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫ | ৫৮ বার পঠিত
  •  
    নেপালের জেন জি এখন জাতীয় তথা বিশ্বের সংবাদ মাধ্যমের শিরোনামে। বিশেষ করে ভারতীয় “গোদি” মিডিয়ার বিশেষ আলোচ্য বিষয়। দেশে লোকে খেতে না পেলেও, কর্মহীনতায় আত্মহত্যার পথ বেছে নিলেও তাদের কিছুই যায় আসে না। তারা মিথ্যা ও অর্ধসত্য প্রচার করে থাকে, যেমন নেপালের জনগণ তথা জেন জি নাকি হিন্দুরাষ্ট্র, রাজতন্ত্র ফেরত আনতে চায়। সেই জন্য নেপালের সমাজের অভ্যন্তরীন ওঠা পড়াকে গভীর ভাবে খতিয়ে দেখার উদ্দেশ্যে এই প্রয়াস।
     
    বর্তমানে নেপালের সেনাবাহিনী ও আন্দোলনকারী নেতৃত্বের মধ্যস্থতায় সুপ্রীম কোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি সুশীলা কার্কির নেতৃত্বে একটি সরকার গঠন করা গেছে। এবং এভাবে আপাতত পরিস্থিতিকে সামলানো হয়েছে। কিন্তু সমাজের মূল সমস্যা বেকারি, মানুষ পাচার (নারী পুরুষ উভয়ই), জমির প্রশ্ন, গণতন্ত্র ও স্বাধীন অর্থনীতি কোনও কিছুরই সমাধান বা সমাধানের সম্ভবনা নেই, ফলে ক্ষোভের আগুন এখনও নেভেনি। এই ক্ষোভের সৃষ্টি ও বিকাশ ১৯৯০ সাল থেকে। তাই বর্তমান ঘটনাবলির ব্যাখা করতে গেলে সেই ১৯৯০ এর দশকের শুরুর দিকে ফিরে যেতে হবে।
    ১৯৯০ সালে ত্রিভূবন বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্র ও জনতার নেতৃত্বে ব্যপক গন আন্দোলনের সূচনা হয়। এই আন্দোলনের মূল দাবি ছিল রাজতন্ত্রের অবসান ও একটি প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা। সামন্ততন্ত্রের – জমিদারি ব্যবস্থার অবসান করা। এখানে আমাদের মনে রাখতে হবে যে তৎকালীন নেপালে বেশির ভাগ চাষ যোগ্য জমি রাজার খাস জমি ছিল। এই আন্দোলন নেপালের জেলা সদরগুলি ও কাঠমান্ডু উপত্যকায় দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। রাজার পুলিশ ও সেনাবাহিনী চূড়ান্ত আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। জনগণও শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের বদলে জঙ্গি আন্দোলনের পথ ধরেন। রাষ্ট্রীয় দমন পীড়নের মুখেও আন্দোলন চলতে থাকে। অনেক বিচার বহির্ভূত হত্যা ও জেল ও গুম খুনের ফলে শেষ পর্যন্ত বছর দুয়েকের মধ্যে আন্দোলন স্তিমিত হয়ে এলো। কিন্তু এই লড়াই পুরোপুরি বৃথা যায় নি, শাসকরা বাধ্য হয় জনগনের কিছু দাবি দাওয়া মেনে নিতে। নেপালে সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণে বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্ম হয়। এই সময়ও নেপালের কমিউনিস্ট পার্টি ইউএমএল এর নেতা ছিল কে পি ওলি। ওলির পার্টিও এই আন্দোলনে সামিল হয়েছিল ও পরবর্তী সময়ে তিনি কখনও শাসক, কখনও বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করতেন। এই আন্দোলনে নেপালের কমিউনিস্ট পার্টি (মশাল) নামে অপর একটি পার্টিও যুক্ত ছিল। তাদের নেতারা তরুণ প্রজন্মের কাছে ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। এই পার্টিতেই মোহন বৈদ্যের নেতৃত্বে প্রচণ্ড, বাবুরাম প্রভৃতি নতুন নেতারা উঠে আসেন।
    ১৯৯০ এর জন আন্দোলন শেষ হওয়ার পর থেকেই বিতর্ক সৃষ্টি হয় যে রাজতন্ত্র নিয়ন্ত্রিত সীমিত পরিসরে গণতন্ত্র নাকি পূর্ণাঙ্গ গণতন্ত্র ও রাজতন্ত্রের মুলোচ্ছেদ? ১৯৯২ সাল নাগাদ মোহন বৈদ্যের নেতৃত্বে প্রচন্ড প্রভৃতিরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে নেপালের কমিউনিস্ট পার্টি (মাওবাদী) গঠন করেন। প্রচন্ড এই নতুন পার্টির নেতা হন। এই পার্টি পশ্চিম নেপালের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া এলাকা থেকে শুরু করে কাঠমান্ডু, পোখরা উপত্যকা ও ভারত সংলগ্ন তরাই এলাকা পর্যন্ত কার্যকলাপ গড়ে তোলে। এদের লক্ষ্য ছিল সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নেপালের রাজতন্ত্রের পূর্ণাঙ্গ উচ্ছেদ ও শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বে জনগণের গনতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা, যা অনেকটা সমাজতান্ত্রিক মডেলকে অনুসরণ করবে। এরা দ্রুত ছাত্র – যুব, শ্রমিক, কৃষক, আদিবাসী ও নারীদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। এই পার্টি ১৩ই ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬ সালে রাজতন্ত্র উচ্ছেদ করার লক্ষ্যে বিদ্রোহের সূচনা করে পশ্চিম নেপালের রোলপা ও রুকুম জেলা থেকে। রাজতান্ত্রিক শাসকরা পুলিশ ও সেনাবাহিনী মোতায়েন করে মাওবাদীদের দমন করার জন্য। সারা দেশ জুড়ে গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হয় এবং তা কাঠমান্ডু শহরের উপকন্ঠে এসে হাজির হয়। পরিস্থিতি এতটাই ভীষণ ছিল যে, দূরবর্তী গ্রামাঞ্চল ও পাহাড়ি এলাকায় সরকারি ব্যবস্থা অচল হয়ে যায়। রাজা বীরেন্দ্র চাপে পড়ে ২০০১ সাল নাগাদ মাওবাদীদের সঙ্গে একটি শান্তি চুক্তি করার জন্য আলোচনায় বসতে রাজি হন। এই প্রক্রিয়া সবে শুরু হয়ছিল, এর মধ্যেই জুন মাসে ঘটে যায় বিখ্যাত “রাজকীয় গণহত্যা”। রাজা বীরেন্দ্র সহ তার গোটা পরিবার এই গণহত্যায় মারা যান, জ্ঞানেন্দ্র ক্ষমতা দখল করে। এই বিষয়ে মাওবাদী নেতা বাবুরাম এক প্রবন্ধে ভারত সরকারকে এই ষড়যন্ত্রের জন্য দায়ী করে। জ্ঞানেন্দ্র নভেম্বর মাসে যুদ্ধবিরতি চুক্তি বাতিল করে প্রচন্ড দমনপীড়ন শুরু করে। লড়াইও তীব্র আকার ধারণ করে। জ্ঞানেন্দ্র ক্রমশ জনপ্রিয়তা হারান ও মাওবাদীরা জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। এই সময় জ্ঞানেন্দ্র সরকারকে বরখাস্ত করে ও নিজের হাতে সমস্ত ক্ষমতা কুক্ষিগত করেন। এর ফলে জনমানসে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। শুরু হয় ভীষণ জন আন্দোলন ২.০। এতে সমস্ত রাজনৈতিক দল ও মাওবাদীরা রাজতন্ত্র উচ্ছেদের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। এপ্রিল ২০০৬ এর আন্দোলন নেপালে রাজতন্ত্র উচ্ছেদের লক্ষ্যে এটি একটি বড় পদক্ষেপ। এর ফলেই নভেম্বর ২০০৬ সালে Comprehensive Peace Accord (CPA) সাক্ষরিত মাওবাদী ও নেপাল সরকারের মধ্যে। এতে অন্যান্য সরকারি দলও অংশগ্রহণ করে। রাজতন্ত্রের উচ্ছেদ হয়। ১০ বছরের গৃহযুদ্ধে নেপালে প্রায় ১৭,০০০ বেশি মানুষ মারা যান ও ৬৫,০০০ বেশি মানুষ আহত হন। এছাড়াও বহু মানুষ নিখোঁজ হয়ে যান, যাঁদের খোঁজ আজ অবধি নেই।
    ১৯৯৬-২০০৬ জনযুদ্ধ চলার সময় মানুষের মধ্যে সুশাসন ও সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা, ভূমি সংস্কার, স্বাধীন অর্থনৈতিক বিকাশের আশা তৈরি হয়। নেপালের আপামর জনসাধারণ সত্যি সত্যি এক নতুন সমাজ ব্যবস্থার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। কিন্তু বাস্তবত, এপ্রিল ২০০৬ – এর তথাকথিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা একটা ধোঁকা ও জনগণের চোখে ধুলো দেওয়ার পদক্ষেপ ছিল। এতে রাজতন্ত্রকে পিছনে ঠেলে দেওয়া হলেও সামন্ত ব্যবস্থার অবসান, ভূমি সংস্কার ও সাম্রাজ্যবাদের অধীনতা মুক্ত স্বাধীন অর্থনৈতিক বিকাশের পথের প্রশ্নটার কোনও সমাধান হল না। এরকম একটি সুবিধাবাদী ও জনগণের স্বার্থ বিসর্জনের কাজের মুল কারিগর ছিল প্রচন্ড, বাবুরামের নেতৃত্বে মাওবাদী পার্টির একটা অংশ, যারা তাদের সামন্তবাদ-সাম্রাজ্যবাদ বিরোধি আদর্শকে পরিত্যাগ করে সুবিধাবাদী পার্টিদের সাথে মিলে সরকার গঠন করে। তার পরিণাম হয় তারাও অন্যান্য পার্টির মত একবার ভারত, একবার চিন, একবার আমেরিকার সাথে মাখামাখি করা, আয়েশিবিলাসি জীবন, দুর্নীতি প্রভৃতি সমস্ত সুবিধাবাদী কার্যকলাপ শুরু করে। সেজন্য জেন-জি তাদের উপরও আক্রমণ শানিয়েছে। বেশ করেছে। সাধারণ মানুষ তাদের ভূয়ো আর্দশের মুখোশ খুলে দিয়েছে। তাদের অবস্থাটা এদেশের সি পি এমের মত বা চিনের কমিউনিষ্ট সাম্রাজ্যবাদী পার্টির মত।
    সুতরাং রাজতন্ত্রের অবসান সমস্যার সমাধান করে নি, দলিত ও মদেশীয়দের অধিকারহীনতার সমস্যা চলতেই থাকে। রাজতন্ত্র গেল কিন্তু সুশাসন অধরাই রয়েই গেল। সরকারি বাবুরা, সাংসদ ও অন্যান্য সরকারি পধাধিকারীরা ছোট খাটো “রাজা” হয়ে উঠলো। বড়লোকরা আরও বড়লোক হল। জনগণকে তাঁদের পেট চালাতে সস্তা শ্রমিক হিসেবে কখনও ভারতে কখনও মধ্যপ্রাচ্যে কাজের খোঁজে পাড়ি দিতে হচ্ছে। কাতার ফুটবল বিশ্বকাপ স্টেডিয়ামে যে দুর্ঘটনা ঘটে ছিল তাতে যাঁরা মারা গেছিলেন তাঁদের বেশির ভাগই ছিলেন নেপালি শ্রমিক। বেকারি কমা তো দূরে থাক, অভাবের তাড়নায় নিজের মেয়েকেও বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন মানুষ। এদিকে বড়লোক শ্রেণি ও তাদের প্রতিনিধি রাজনৈতিক নেতাদের সন্তানেরা বিদেশে পড়তে যাচ্ছে, দামী দামী গাড়ি, বিলাসদ্রব্য কিনে সোশ্যাল মিডিয়ায় রিল বানাচ্ছে (ভারতেও ঠিক এই ব্যাপারটাই ঘটে, নেপালিরা বোধহয় ভারত থেকেই এগুলি শিখেছে)। নেতা ও তাদের দোসরদের হিমালয়ের কোলে হোটেল বানিয়ে ব্যবসা বাণিজ্য করে বিপুল সম্পদের মালিক হয়ে গেছে। তা সে নেপালি কংগ্রেসের কৈরালাই হোক বা ভুয়ো কমিউনিষ্ট প্রচণ্ড বা ওলিই হোক সবার ক্ষেত্রেই একই কথা প্রযোজ্য। হিন্দুত্ববাদী রাজার বংশধররাও বহাল তবিয়তে আছে, তাদের সম্পত্তি রাষ্ট্র দখল করেনি। ২০১৫ সালের ২০ সেপ্টেম্বরের নতুন সংবিধান নেপালকে “Secular Federal Parliamentary Republic” (??) ঘোষণা করে। এরপর শুরু হয় সুবিধাবাদী জোটের বা গুটের যুগ। কখনও মাওবাদী-ইউএমএল জোট কখনও বা অন্য কোনো জোট। সাধারণ মানুষের মধ্যে আর রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি কোনও বিশ্বাস অবশিষ্ট রইলো না!!! তাদের গদি দখলের সুবিধাবাদী রাজনীতির মুখোশ খুলে পড়ল। প্রথমে এ গুটের প্রধানমন্ত্রী ছয়মাস তো পরের ছয়মাস অন্য গুটের। আমাদের দেশের থেকেই মনে হয় নেপালিরা এটা শিখেছে। এখানেও আমরা দেখতে পাই যে, নিতীশ একবার বিজেপির সাথে একবার কংগ্রেসের সাথে, শিবসেনা একবার বিজেপি একবার কংগ্রেসের সাথে। বামের কখনও কংগ্রেসকে প্রধান শত্রু ঘোষণা করে অটলবিহারীর হাত ধরে ব্রিগেডে দাঁড়াচ্ছে, একবার বিজেপিকে প্রধান শত্রু ঘোষণা দিয়ে রাহুলের হাত ধরে দাঁড়াচ্ছে। যদিও তাদের এই প্রধান শত্রু নির্বাচনের রহস্যটা এখনও আমাদের কাছে অধরা। তবে আমরা একটা ব্যাপারে নেপালের থেকে এগিয়ে। আমাদের এখানে ঠিক বোঝা যায় না যে কোন নেতা কোন পার্টি করে!! সকালে এক পার্টি, বিকালে আর এক!! নেপালিরা এতোটা উন্নতি দেখাতে পারে নি!!!
    যাই হোক, এর মধ্যে আসে করোনা যা মূলত পর্যটনভিত্তিক নেপালের অর্থনীতিকে তলানিতে নিয়ে যায়। ইউক্রেনে রুশ হামলা শুরু হলে লোকে সেখানে যুদ্ধে যাবার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে, যুদ্ধে মারা গেলে অন্তত সংসার চালানোর মত কিছু টাকা পাওয়া তো যাবে!! অবস্থা চূড়ান্ত খারাপ হয় ২০২২ সালের পর থেকে। মওকা বুঝে আবার দক্ষিণপন্থীরা “রাজতন্ত্র” ফিরিয়ে আনার জন্য চেঁচামেচি শুরু করে। তাদের ভাবখানা এমন যেন রাজতন্ত্র ফিরলে দেশের খুব উন্নতি হবে! কিন্তু জনগণ ভোলে নি রাজতন্ত্রের সময়কার অত্যাচার, শোষণ। তাঁরা জানেন যে নেপালের বর্তমান সমস্যার সমাধান রাজতন্ত্র নয়, বরং সমস্যা হল রাজতন্ত্র / সামন্ততন্ত্র বিরোধী সংগ্রামের সাথে দেশের সব রাজনৈতিক দল কোন না কোনভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। তারা রাজতন্ত্র, সামন্ততন্ত্রের সাথে হাত মিলিয়ে নিয়েছে এবং দেশের একটা সত্যিকারের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক রুপান্তরের কাজটাকে বাতিল করেছে। সেই অর্থে নেপালের সব রাজনৈতিক দলই শেষ বিচারে রাজতান্ত্রিক। ইতিমধ্যে আবার নেপালে চিনা সাম্রাজ্যবাদীরা অনুপ্রবেশ করতে শুরু করে। তারা ভারত, আমেরিকাকে সরিয়ে নেপালের উপর নিজেদের প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা শুরু করে। নেপালের অভ্যন্তরীণ বাজার চিনা মালে ভরে গেছে। বেল্ট এন্ড রোড ইনিটিয়েটিভের নামে চিনা পুঁজি অনুপ্রবেশ শুরু করে। লিপুলেখ থেকে লাসা হয়ে বেজিং পর্যন্ত রেলপথ তৈরি হচ্ছে। নেপালের উপর বিদেশি ঋণের বোঝা বাড়তে থাকে। আর্থিক ও রাজনৈতিক সংকট জড়িয়ে পেঁচিয়ে গিয়ে একটা বিস্ফোরক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। এরকম একটা সন্ধিক্ষণে জেন জি র বিদ্রোহ।
    মনে রাখতে হবে যে, নেপালের কোনও রাজনৈতিক দল সে নেপালি কংগ্রেস হোক বা মাওবাদী কিংবা ওলির ইউএমএল কেউই জনগণের স্বাধীনতা, কর্মসংস্থান, জমির বণ্টন ও সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে পুরোপুরি ব্যার্থ হয়েছে। পাহাড় প্রমাণ দুর্নীতি, স্বজন পোষণ, কমিশন খাওয়া ইত্যাদি জনগণের মধ্যে এক বিস্ফোরক ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। কিন্তু সঠিক দিশা না পেয়ে তা চলে গেছে NGO দের খপ্পরে। বর্তমান আন্দোলনে “হামি নেপাল” নামক এনজিওর ভূমিকা কেউই অস্বীকার করতে পারবে না। সুদান গুরুং, অযসি রাজ থাপা বা তথাকথিত "স্বাধীন রাজনৈতিক" ও কাঠমাণ্ডুর মেয়র এবং বর্তমানে মন্ত্রী বলেন শাহ সবাই কোনও না কোনও ভাবে এনজিও গুলির সঙ্গে যুক্ত। এঁদের মুখে যতই প্রগতিশীল কথা বা ক্ষমতার বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা থাকুক না কেন অন্য রাজনৈতিক দলগুলির সাথে এদের কোন ফারাক নেই। এরা এলিট শ্রেণীর পোস্ট মডার্ন আদর্শের প্রতি বিশ্বাসী। এরা ভাবতেই পারেন না যে পুঁজিবাদের কোনও বিকল্প আছে !! তারা কি করে যুব, ছাত্র, নারী, শ্রমিক, কৃষক, আদিবাসী, মদেশীয়, দলিত মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে পূরণ করবেন ও বাস্তব রূপ দেবেন? এন জি ও বা পোষ্ট মর্ডাণ নেতৃত্ব কোথাও মানুষকে মুক্তির পথ দেখাতে পারে নি। আরব স্প্রিং - এর ফল হয়েছিল আরবের বিভিন্ন দেশে আসাদ, আল সিসি - এর মত ফ্যাসিষ্টদের ক্ষমতা দখল, আই এস আই এসের মত সামন্ততান্ত্রিক মতাদর্শে বিশ্বাসী ধর্মীয় মৌলবাদী সংগঠনের উত্থান। শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশেও একই ব্যাপার হয়েছে। নেপালেও তাই হবে। আমাদের দেশেও এরকম হয়েছে – কেজরিওয়ালের ফ্রি ইলেকট্রিক পার্টি। পোষ্টমর্ডাণ, এনজিওর লোকদের নিয়ে সে ধর্ষণ ও দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলন থেকে উঠে এসেছিল, অনেক বড় বড় প্রতিশ্রুতি দিয়ে। এখন সেটা একটি ব্যর্থ, দূর্নীতিগ্রস্থ পার্টিতে পরিণত হয়ে প্রায় বিলুপ্তির পথে। ভারত বা চিন থেকে বা আই এম এফ থেকে কিছু ধার নিয়ে আপাতত কিছু সুবিধা দিয়ে নেপালের জনতাকে ঠান্ডা করা হবে। তারপর যথারীতি আগের মতই চলবে। শ্রমিক কৃষকের অবস্থার কোনও পরিবর্তন হবে না। কার্কি, বলেন, সুদান বা ঘিসিং প্রভৃতি যারা ক্ষমতায় এসেছে তাদের ক্ষমতা নেই নেপালে সত্যিকারের কোন উন্নতি করার। ভবিষ্যতে সেটা নিশ্চিতভাবে দেখা যাবে। তাছাড়া ছয় মাস পরে আবার হয়তো ওলি - প্রচন্ডরা ফিরে আসবে তথাকথিত  "Free & Fair" নির্বাচনের নাম করে। সেজন্য জেন জির লড়াইকে শ্রদ্ধা জানালেও এটা নিশ্চিত যে নেপালের অবস্থার তেমন কোন হেরফের হবে না। তবে ভালো দিক এটাই যে নেপালের আপামর জনসাধারণ লড়াইয়ের পথ ছাড়েননি, এই সংগ্রাম থেকে শিক্ষা নিয়ে আগামী দিনে তাঁরা আরও এগিয়ে যাবেন।
    সারা পৃথিবী জুড়ে, বিশেষ করে আমাদের দেশের বড় বড় বুদ্ধিজীবিরা এখন আলোচনা করছে যে, শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার, বাংলাদেশ, নাইজার বা নেপালের মত অবস্থা অন্য দেশগুলিতে হতে পারে কিনা। পোষ্ট নিওলিবারেল পর্যায়ে সারা পৃথিবীজুড়ে দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত দেশে এরকম গণ অভ্যুত্থান। এটা বর্তমান সময়ের একটা স্থায়ী বৈশিষ্ট্য হয়ে পড়েছে। অন্য দেশগুলিতেও কি এরকম হতে পারে? যেমন, ফ্রান্সে হব হব করছে। সারা পৃথিবীজুড়ে যেভাবে, বৈষম্য, দারিদ্র্য, বেকারিত্ব, মূল্যবৃদ্ধি, বঞ্চনা, অত্যাচার, অন্য ধর্ম বা জাতির প্রতি রেসিষ্ট ঘৃণা, নারীবিদ্বেষ, ইসলামবিদ্বেষ প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলির সুবিধাবাদী চরিত্রের উন্মোচিত হওয়া ইত্যাদি বাড়ছে তাতে এটা নিশ্চিত যে এরকম গণ উত্থান অন্য দেশগুলিতেও হতে পারে বা হওয়ার সম্ভবনা প্রবল। ভারত, চিন, রাশিয়া, আমেরিকা, জার্মানি, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড প্রভৃতি বড় বড় ও গুরুত্বপূর্ণ দেশে যদি এরকম ঘটনা ঘটে তবে তার প্রভাব সূদুরপ্রসারি হবে। নিশ্চিত করে না বলা গেলেও এটুকু পরিস্কার যে তারপর দুনিয়াটা আর আগের মত থাকবে না। গোটা পৃথিবী সেরকম একটা ভীষণ টালমাটাল পরিস্থিতির দিকে এগিয়ে চলেছে। প্রতিদিনই সবকিছু বদলে যাচ্ছে।
    নেপালের সংগ্রামের সবচেয়ে বড় দূর্বলতা হল শ্রমিক শ্রেণির সম্পূর্ণ অনুপস্থিতি। কিছু যুবক শ্রমিকরা হয়তো আন্দোলনে ছিল, কিন্তু শ্রমিক শ্রেণি এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল না। সেটা সম্ভব নয়। কারণ ওলিপন্থী কমিউনিষ্ট বা প্রচন্ডপন্থী মাওবাদী কমিউনিষ্ট পার্টিগুলি সরকারি তন্ত্রের অংশ হয়ে গেছে। তাদের কাজ নেপালের শোষণভিত্তিক সমাজব্যবস্থাকে রক্ষা করা। ভবিষ্যতে যদি শ্রমিকরা নিজেদের সংগঠিত করতে পারে এবং নতুন পথ ধরতে পারে তবেই সত্যিকারের পরিবর্তন সম্ভব হবে। সারসংক্ষেপে বলা যায় যে, নেপালের জেন জি ও শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা তাই অদূর ভবিষ্যতে পূরণ হবার সম্ভবনা কম। নেপালের বিপ্লব তাই এখনও বহমান বর্তমান ও একই সঙ্গে অসমাপ্ত।
     
     

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • প্রবন্ধ | ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫ | ৫৮ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • :/ | 51.75.***.*** | ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৮:৫৭734163
  • "বামের কখনও কংগ্রেসকে প্রধান শত্রু ঘোষণা করে অটলবিহারীর হাত ধরে ব্রিগেডে দাঁড়াচ্ছে, একবার বিজেপিকে প্রধান শত্রু ঘোষণা দিয়ে রাহুলের হাত ধরে দাঁড়াচ্ছে। যদিও তাদের এই প্রধান শত্রু নির্বাচনের রহস্যটা এখনও আমাদের কাছে অধরা।"
     
    ভাল করে চটি চাট আর বামেদের সমালোচনা কর। খবরদার মমতা আরএসএসের পিরীত উল্লেখ করবিনা। চটিচাটাদের সাইট এরকম বোকাচোদা লেখায় ভরিয়ে দে।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আলোচনা করতে মতামত দিন