এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক  স্মৃতিকথা  শনিবারবেলা

  • সেই দিন সেই মন - পর্ব পাঁচ

    অমলেন্দু বিশ্বাস
    ধারাবাহিক | স্মৃতিকথা | ২৬ এপ্রিল ২০২৫ | ৬৩ বার পঠিত | রেটিং ৪ (২ জন)
  • ছবি - রমিত



     

    … সেদিন আমার দ্বিতীয় সত্তার সঙ্গে আমি মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ছিলাম ---

    : অমলেন্দু বিশ্বাস, বি প্রাক্টিক্যাল, তোমার ও সব সস্তা ভাবালুতা ছাড়ো, অবস্থার সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নাও।
    : মনিয়ে তো নিয়েছি । আর কি করে মানিয়ে নেব?
    : তবে এখনো অভিযোগ কেন? এখনো ক্ষোভ কেন? একটুতে কেন বিরক্ত হও? 
    : কই অভিযোগ করি না তো? ক্ষোভ তো নেই আর।
    : নিশ্চয়ই আছে। তোমার ধারণা তোমার এই অবস্থার কোন দায়ভাগই তোমার প্রাপ্য নয়। সংসারের যে দায়িত্ব তোমার উপর পড়েছে তাকে তুমি কর্তব্য ভাব না, ভাবো বোঝা। তুমি আবার আদর্শের বড়াই কর? আর সত্যি কথা বলতে কি তুমি সংসারের জন্য ভাই বোনের জন্য মায়ের জন্য কতটুকুই বা করেছ, করছো? এটাকে সহজভাবে নিতে পারো না কেন? হোয়াই ডোন্ট ইউ টেক ইট স্পোটিংলি?
    : সহজভাবেই তো নিয়েছি।
    : মিথ্যে কথা। তা যদি নিতে তাহলে তুমি এটাকে বোঝা বলে ভাবতে না। তা যদি নিতে তাহলে তুমি নিজের ভবিষ্যৎকে নিজের স্বাচ্ছন্দ্যকে অত বড় করে দেখতে না। তা যদি নিতে তাহলে মাঝে মাঝে শরীর কাঁপিয়ে ওরকম দীর্ঘশ্বাস ফেলতে না। “আমার কিছু হলো না, নিজের জন্য কিছু করতে পারলাম না।” নির্লজ্জ স্বার্থপর কোথাকার।

    আমার আর কিছু বলার ছিল না। আমি চুপ করে রইলাম। একটু থেমে ও আবার শুরু করল।

    : তাছাড়া তোমার নিজের উন্নতির জন্য তুমি চেষ্টাই বা কি করেছো? একটার পর একটা শুধু পরিকল্পনা করেছ। সেগুলো যাতে রূপ পায় তার জন্য তোমার উদ্দ্যম কোথায়? জার্নালিজম, ডব্লু বি সি এস, মেটালার্জি। তোমার অজুহাত তোমার টাকা নেই। মানি, উনিভার্সিটিতে জার্নালিজম পড়ার সুযোগ পেয়েছিলে, অনেকগুলো ক্লাসও করেছিলে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত অর্থাভাবেই ছেড়ে দিতে হলো। কিন্তু পরে অন্য কিছু করনি কেন? আরে তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে বলো যে শুধুমাত্র টাকার জন্য তোমার পড়াশোনা হয়নি । আর অন্য গুলো? পড়াশুনা ভালবাস অস্বীকার করি। মানছি, সময় পেলেই তুমি পড়। কিন্তু ও সব পড়ে কিচ্ছু হবে না। ও সব অর্থকরি বিদ্যা নয় । কেরিয়ারের জন্য পড়। পরীক্ষা দিতে হবে। সার্টিফিকেট চাই। তার জন্য তোমার ইচ্ছা আছে কি? উদ্দ্যম, অধ্যাবসায়, দৃঢ় সংকল্প প্রত্যয়, সর্বোপরি আত্মবিশ্বাস। ভেবে দেখো এর কোন একটা যদি পুরো মাত্রায় তোমার থাকতো তবে শুধুমাত্র টাকার জন্য তোমার পড়াশোনা আটকাত না । পৃথিবীতে তোমার থেকে অনেক গরিব ছেলে এর থেকে প্রতিকূল অবস্থার সঙ্গে যুদ্ধ করে বড় হয়েছে। অর্থহীনতা এক্ষেত্রে বাধা বটে কিন্তু অনতিক্রম্য অন্তরায় নয় কোনমতেই। 

    : তোমার কথা সত্য। তোমার কথায় জ্বালা আছে। মানতেই হবে পুরোপুরি না হলেও তোমার বিশ্লেষণের কিছুটা যুক্তিগ্রাহ্য। তবে তোমার সমালোচনায় সহানুভূতি নেই। তুমি কখনোই আমার মানসিক গঠনের সঙ্গে আমার সাম্প্রতিক অবস্থা এক করে দেখছ না। দুটোই হয়ত দেখছ, কিন্তু দুটোই তোমার প্রয়োজন মত গুরুত্ব আরোপ করে দেখছ। ফলে কখনো আমি বড় হয়েছি কখনো অবস্থা বড় হয়েছে। এক হলে আমার কি দশা তা তোমার দৃষ্টি এড়িয়েছে । ভয় নেই, অভাবের কথা সাতকাহন শোনাবো না আর। শুধু জেনে রাখো এবং এটা সত্যি যে, এমন সাংঘাতিক সাংসারিক বিপর্যয়ের জন্য আমার মানসিক প্রস্তুতি ছিল না একেবারেই। সেজন্য হঠাৎ এমন অবস্থার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দিশাহারা হয়ে পড়েছিলাম। 

    এই দিশাহারা ভাবটা কাটাতে অন্যের কত সময় লাগতো জানিনা কিন্তু আমার প্রায় চার পাঁচ বছর কেটে গেল‌ এর জের সামলাতে। সেই দিশাহারা ভাবটা আমার এখনো কাটেনি অর্থাৎ সেই পথটা আমি এখনো পাইনি, যে পথ পেলে আমি সার্থক হব। তাই এখনো আমি অস্থির। একটার পর একটা ধরছি পরক্ষণেই সেটা ছেড়ে অন্যটা। দোহাই, এখনই তোমার মুখ খুলো না, বোলো না “বি প্রাক্টিক্যাল“। অন্তত এই একটা ব্যাপারে আমি ভবালুতাকে প্রশ্রয় দিইনি। আমার কি মনে হয় জানো? মনে হয় আমি একটা নিকষ অন্ধকার ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়েছি। যে ঘরে অনেক দরজা, কতগুলো জানিনা। তবে তার সবগুলো বাইরে থেকে বন্ধ। শুধু মাত্র একটা দরজা খোলা আছে, একটি মাত্র বাইরে বাহির হবার পথ --- বাইরে আলো হাওয়ার পৃথিবী, বাইরে মুক্তি। অন্ধকারে আমি প্রত্যেক দরজায় ঘা দিচ্ছি। কিন্তু দুর্ভাগ্য এখনো সেই খোলা দরজাটা পাইনি। আমি বিশ্বাস করি সেই দরজা আমি খুঁজে পাবোই। আবার আমি অবাধ আলো পাব – স্বচ্ছন্দ জীবন। 

    : তাহলে শেষ পর্যন্ত তুমি স্বচ্ছন্দ জীবন চাও?
    : স্বচ্ছন্দ জীবন কে না চায়?
    : কিন্তু তুমি যে বড়াই করে বল,তুমি সাধারণের মত বাঁচতে চাও না। স্বচ্ছন্দ জীবন তো সাধারণে চায়। স্বচ্ছন্দ জীবনে যন্ত্রণা কোথায়? আর যন্ত্রণা না হলে সৃষ্টি আসবে কেমন করে?

    এর পর আমি আর মুখোমুখি আমি, দুজনেই চুপ করে গেলাম।

    … ... ... 

    সু মানে অনুর সঙ্গে দেখা হয়েছিল ১৯৫৯ সালে, আসানসোলে। ওর নাম আগে শুনেছিলাম কিন্তু পরিচয় হয় নি। ওর স্বভাব ও ব্যবহারের জন্য আত্মীয় স্বজন সবাই ওকে ভালবাসে ও প্রশংসা করে। আমি তাই ওর বিষয়ে কৌতূহলী ছিলাম। 
     



    সেই সময় অনুকে যেমন দেখেছিলাম 
     


    চাকুরীর সন্ধানে আসানসোলে গিয়েছিলাম। তখন আলাপ হল। এই পাঁচ বছরে সম্বন্ধটা আরো গভীর হয়েছে, সহজ হয়েছে। অনেকদিন থেকে ভেবেছি ওর কথা লিখে রাখবো। কেননা আমার জীবনের অনেকখানি, বিশেষ করে চরমতম ট্রাজেডি ও হতাশার সেই দিনগুলোতে ও আমাকে জুগিয়েছে অনেক কিছু --- সাহসের মতো দুর্লভ কিছু, সাহচর্যের মতো ভরাট কিছু এবং অত্যন্ত স্থুল কিন্তু সেকালে নিতান্ত প্রয়োজনীয় যা সেই-- অভাবে অর্থ সাহায্য। লিখবো লিখবো করেও লেখা হয়নি। প্রত্যেকবার ভেবেছি ধীরে সুস্থে, প্রচুর সময় নিয়ে খুঁটিনাটি সবকিছু লিখে রাখবো। শুধু ঘটনা নয় আমার মানসিক চিন্তার সব আলোড়ন, স্থিতি এবং টানাপড়েন। কিন্তু লেখা হয়ে ওঠেনি। যেহেতু সেই সুস্থতা ও সময় কখনো পাইনি। আজও লেখা হবে না সবটুকু। তবু সূচনাটুকু লিখে রাখি, কি জানি আর যদি কখনো সময় না পাই, তবে হয়তো লেখাই হবে না কোনদিন। অন্তত এই মুখবন্ধ টুকুই আমাদের পরিচয়ের অভিজ্ঞান হয়ে থাকবে, ভবিষ্যতে যদি কখনো লেখা নাই হয় আর।

    ভরসা ছিল সে যুগে আমার মানসিক প্রতিফলন গুলো খুঁজে পাব ওকে লেখা চিঠিগুলো থেকে। কিন্তু অতি সম্প্রতি জানতে পেরেছি ও আমার প্রায় সব চিঠি হারিয়ে ফেলেছে। সেই সঙ্গে হারিয়েছে আমার সেই সময়ের চিন্তাগুলো, চিন্তা আমার জীবন ঘিরে --আমার বাবা মা ভাই বোনের ভবিষ্যৎ ঘিরে, আমার দায়িত্ব ঘিরে আর সেই অদ্ভুত আশ্চর্য ঘটনা ঘিরে। কি করে একটা সুস্থ, শিক্ষিতা, চিরদিন-অর্থনৈতিক-স্বাচ্ছন্দ্যের-মধ্যে-মানুষ-হওয়া মেয়ে একটা বেকার, অর্থনৈতিক দিক থেকে বিপর্যস্ত পরিবারের হতাশ যুবকের জীবনের সঙ্গে স্বেচ্ছায় নিজের জীবন জড়াতে পারে। আজকে এতদিন পরে ৪০০ টাকা আয় করা অমলেন্দু বিশ্বাস সে যুগের সেই যুবকের হতাশ চিন্তা, মানসিক যন্ত্রণা ও উত্তাপ, প্রেমের অভিষেকে নিজের মূল্যায়নে সচেতনা, দায়িত্ববোধ ও পৌরুষ --- কিছুই ঠিক খুঁজে পাবে না। তবুও এখনো অবশিষ্ট আছে যেহেতু। পরে আরো পরে, নয় নয়।

    সাধারণত যেমন ঘটে তেমন যদি ঘটতো তবে সবকিছু লেখার এমন আন্তরিক তাগিদ পেতাম না। অসাধারণ বলবো এমন সাহস নেই তবু মামুলি যে নয় এমন কথা ভাবতে ভালো লাগে। আমার মনে হয় কোনো দিক থেকেই আমরা একে অন্যর সমকক্ষ নই , একমাত্র মনের কয়েকটা বিশেষ গঠন এবং আশ্চর্য রুচির সাদৃশ্য ছাড়া। তবুও আমরা কাছে এলাম, মিশলাম, সহজ হলাম, গভীর হলাম এবং একদিন অবাক হয়ে আবিষ্কার করলাম যে আমরা একে অন্যের কাছে নিতান্তই প্রয়োজনীয়।

    আমি ওর কাছে কেমন কতখানি তা জানি না। আর জানলেও তা জোর গলায় বলতে পারি এমন প্রত্যয় নেই। ও আমার কাছে কেমন সেটা বলি। ও রূপসী নয় তন্বী নয় বিম্বধরা তরুণীও নয়, তবুও সাধারণ নয়। ওর আকৃতিতে মৃদু কমনীয়তা প্রছন্ন ব্যক্তিত্বের সঙ্গে মিশে এমন একটা রূপ দিয়েছে যা ওকে সাধারণের থেকে আলাদা করে রাখে। এছাড়া আমার কাছে ওর আরো একটা আকর্ষণ আছে। এবং সেটাই প্রধান ও অন্যতম। ও আমাকে মাতাল করেছে। এমন কড়া মদ খাইয়েছে যে পৃথিবীর তাবৎ নেশা আমার কাছে ফিকে হয়ে গেছে। এবং এতদিনেও সেই নেশাতুর ভাবটা এতোটুকুও কমেনি। আমার মননের সহচরী হতে পারে এমন মেয়ে কোথায় ও ছাড়া? 

    ভাবছি শেষ পর্যন্ত ওকে যদি না পাই অন্য কাউকে দিয়ে কি শূন্যস্থান পূর্ণ হবে? 

    দক্ষিণেশ্বর ২৫-১-৬৪ 

    দারুণ কল্পনা বিলাসী হয়েও কোনদিন ভাবিনি যে এমন একজন গুণী মেয়ে আমাকে আকাঙ্ক্ষা করবে। তার সবকিছু আমাকে সমর্পণ করে বসে থাকবে। এখন শুধু নেওয়ার অপেক্ষা। সাহস করে নিতে পারলেই হলো।

    যেমন চাইতাম --- যে আসবে সে গান জানবে, সে শিক্ষিতা হবে। সে জীবন চাইবে জীবনের জন্য, শুধুমাত্র দিনগত পাপক্ষয়ের গ্লানি নিয়ে সে বাঁচতে চাইবে না। সে সংগ্রামী হবে, সে শরীরে ও মনে সম্পূর্ণ সুস্থ হবে। কোন রকম বিকারকেই সে প্রশ্রয় দেবে না। সে যদি রূপসী হয় তবে উপরি পাওনা কিন্তু তা আকাঙ্ক্ষিত প্রাপ্তব্যের মধ্যে নয়। আশ্চর্য বিষয় এর সব গুণগুলোই ওর আছে।

    গত চার বছর ধরে এই একটি মাত্র চিন্তা আমাকে উত্ত্যক্ত করেছে । ওকে গ্রহণ করবো কি করবো না। আগের মত আর সেই দৈন্য নেই। অর্থনৈতিক অবস্থার সমাধান প্রায় হয়ে গিয়েছে। এখন ওকে ঘরে আনার মতো সংগতির অভাব নেই। আজও মনস্থির করতে পারিনি, যদিও এই চার বছর ধরে ওর বন্ধুত্বকে আমি জিইয়ে রেখেছি এই অঙ্গীকার দিয়ে যে আমি ওকে চিরাচরিত সেই স্বীকৃতি দিয়ে ঘরে তুলবো। আমি যদি আজ ফিরে আসি ও কি করবে ভাবতেও ভয় লাগে।

    ছি ছি, একি ভাবছি আমি। এ অন্যায়, এ পাপ! যা সত্য তাকে গ্রহণ করতেই হবে। তা সে যেমন অবস্থাতেই আসুক না কেন। এমন একটা চ্যালেঞ্জ আমি কি নেব না?

    তবু সব কিছুই সমাধান হয়ে যায় যদি মা রাজি থাকে। পৃথিবীর তাবৎ মানুষ, শুভাকাঙ্ক্ষী আত্মীয়-স্বজনদের সব ভ্রূকুটি সহনীয় হবে যদি মা স্বপক্ষে থাকে। এমন কাজ কল্পনা করা আমার পক্ষে সত্যিই কঠিন যে কাজে মায়ের সম্মতি নেই। তবু এমন দিন যদি আসে যেদিন মায়ের সম্মতি ব্যতিরেকেই …
    ওহ, ঈশ্বর, যদি থাকো, আমাকে ক্ষমা করো। 

    দক্ষিণেশ্বর ৬-২-৬৪ 

    কাল রাত্রে মাকে সব কথা বললাম। অবশ্য মা-ই জোর করে নামটা জেনে নিলো এবং ওর নামটা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই মা রাজি হলো। শুধু রাজি হলো না, সানন্দে মত দিলো। মা যে রাজী হবে এবং শুনে আনন্দ পাবে একথা আমি ভাবতেই পারিনি। অন্তত এ ব্যাপারে মা যে কষ্ট পেলো না এটাই আমার সান্ত্বনা। মা অনুর (সু-র) খুব প্রশংসা করল। বোঝা গেল মা সত্যিই খুব খুশি হয়েছে । অবশ্য মেয়েটা সত্যিই ভাল। একটুও অত্যুক্তি না করে বলা যায় সু-কে স্ত্রী রূপে পাওয়া দারুণ সৌভাগ্যের কথা। সাধারণতঃ কোন মেয়ে সম্বন্ধেই আমি উচ্ছ্বসিত হই না। বরং বাংলাদেশের তথাকথিত ব্যক্তিত্বহীন লতানে গাছের মতো গিন্নি মেয়ে গুলো সম্বন্ধে আমার চিরকালের অনীহা। দারুন ভয় ছিল ঐরকম কোন একটা মেয়ে হয়তো – পতি পরম গুরু -- বলে ঝুলে পড়বে। অথবা এমন কেউ যার রুচি সংস্কৃতি ভাল-লাগা মন্দ-লাগার সঙ্গে আমার কোনো মিল নেই। উফ তাই যদি হত! সু আমাকে সেই ভয় থেকে বাঁচিয়েছে। ওকে প্রাণ ভরে ভালোবাসা যায়। 

    অবশ্য সত্যি সত্যি বাঁচিয়েছে মা।

    দক্ষিণেশ্বর ১১-২-৬৩ 

    আমার কোন কল্পনাই যে বাস্তবে রূপ নেবে তা ভাবিনি। অন্ততঃ এই সাতাশ বছরের জীবনে কোন কিছুই আমার ইচ্ছে মতো হয়নি দেখে এই ধারনটাই বদ্ধমূল হয়েছিল যে আমার জীবনে সেই সমস্তই ঘটবে যা আমি কখনো চাইনি। এই ব্যতিক্রম দেখে আশ্চর্য হচ্ছি। সু আমার ঘরে আসবে, আমার হবে, একান্তই আমার, শুধু আমার হবে, ভাবতেই অনুভূতিটা কেমন আয়েসী হয়ে ওঠে। ওর নাম শুনতেই মা খুশি হয়ে মত দিল এবং স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে একটা চিঠিও লিখে দিল। কি লিখল তা অবশ্য জানি না। বিশ শতকের প্রথম দশকে জন্মে অল্প শিক্ষিতা মধ্যবিত্ত কোন নারী যে এত প্রগ্রেসিভ হতে পারে -- মাকে না দেখলে ভাবা যায় না। মা আমার গর্ব। 

    জানিনা শেষ পর্যন্ত কি হবে --- অন্তত আমার দিক থেকে আর কোনো বাধা নেই। আশা করা যায় যে কোন অঘটন না ঘটলে সু আমার ঘরনী হয়ে আসছে।
    … … …

    প্রায়ই ভাবতাম আমি একটা সাদা বিছানায় আধ শোয়া হয়ে আছি। হাতে ধরা একটা বই, শুধুই ধরা, বইয়ে মন নেই। ঘরের অন্য কোনে সে বসে, হাতে তানপুরা, সারা ঘরে দরবারীর মৃদু আলাপে অন্য কোন জগতের আমেজ। অথবা বাইরে ঝমঝম বৃষ্টি, ঘরে মল্লারের তান, আমি সমস্ত সমস্যা ভুলেছি, আমার সব আকাঙ্ক্ষা, যত কিছু না-পাওয়া, যত ক্ষোভ সব ভুলে তন্ময় হয়েছি। কিংবা সারাদিন অফিস করে বাড়ি এসেছি, ঘরে ঢুকে জামা ছাড়ছি -- সে বিছানার চাদরটা টান টান করতে করতে গুনগুন করছে আমার কোন প্রিয় রবীন্দ্রনাথ বা ডি এল রায়। 

    সে যে কে, কোথায় আছে, আদৌ তেমন কেউ আমার জীবনে আসবে কিনা কিছুই জানতাম না। অন্তত: জীবনের এতগুলো হতাশ বছর পেরিয়ে এমন ধারণাই বদ্ধমূল হয়েছিল যে এ শুধুই কল্পনা এবং অলীক স্বপ্ন। শুধু ভাবতাম, ভাবতে ভালো লাগতো তাই। তারপর সু-র সঙ্গে যখন দেখা হল, আলাপ হল, ঘনিষ্ট হলাম, তখন ভয়ে ভয়ে সেই ভাবনাটা প্রশ্রয় পেয়েছিল। এবং আজ মায়ের সম্মতি পাওয়ার পর মনে হচ্ছে এমন একটা ছবি আমার ঘরে ফুটে উঠলেও উঠতে পারে ।

    দক্ষিণেশ্বর ১৩-২-৬৪ 

    দুদিন ধরে মনটা বড় খারাপ ছিল। অফিসে এমন একটা ঘটনা ঘটে গেল যা আমাকে অত্যন্ত বিচলিত করে রেখেছিল। ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে লাভ নেই। কোন একটা কাজে ফ্যাক্টরির Personnel Officer চিৎকার করে আমাকে এমন কতগুলো কথা বলে যা আমার অত্যন্ত অপমানজনক বলে মনে হয়। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি তখন এতই বিমূঢ় হয়ে গিয়েছিলাম যে পি-ও র মুখের উপর কোন কথা বলতে পারিনি সঙ্গে সঙ্গে। ঘটনাটা ঘটে যাওয়ার পর থেকেই নিজেকে দারুণ ভাবে অপমানিত মনে হল। খুব বড় চাকরি করি না বলেই বোধ হয় লোকটা এমন ব্যবহার করতে সাহস পেল। আর শুধু চাকরি করি বলেই কি সহ্য করতে হবে এমন অপমান? তাছাড়া কাজের দিক থেকে ওর সঙ্গে আমার কোন সম্বন্ধ নেই। লোকটার কোন অধিকার নেই আমাকে কিছু বলার। কিছু একটা করতেই হবে এবং করা উচিত। অন্তত প্রতিবাদ।

    কিন্তু প্রতিবাদ করতে গেলে অনেক ঝুঁকি নিতে হয়। চাকরি যেতে পারে। আর চাকরি গেলে কি হবে ভাবতেই ভয় হয়। সমস্ত সংসার আমার উপর নির্ভর করে আছে। আমি শুধু আমার একার জন্য নই। এবং চাকরি যদি নাও যায় তবু সাপের লেজে পা দেওয়ার বিপদ আছে। কুমিরের সঙ্গে ঝগড়া করে জলে বাস করা কঠিন তা যারা চাকরি করে তারা জানে। তবু আমাকে কিছু করতেই হবে। এ আমার মনুষ্যত্বের অপমান। তাছাড়া অন্যায়ের প্রতিবাদ না করা পাপ। যতদিন বাঁচবো মাথা উঁচু করে বাঁচবো। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের একটা কথা মনে পড়ছে, অনুরূপ ঘটনায় বলেছিলেন ---- "প্রয়োজন হইলে আলু বেচিয়া খাইবো, তবু তোমার গোলামি করিব না।“ 

    … অত জোর আমার নেই। তবু কিছু একটা না করলে যে শান্তি পাব না তা বুঝতে পারছি। নইলে নিজের কাছে নিজে ছোট হয়ে যাব। সারারাত ঘুমাতে পারলাম না। আমার গর্বিত আমিটা কুঁকড়ে ছোট হয়ে গেছে। যন্ত্রণায় ছটফট করলাম। যা হয় হবে। মনে মনে আওড়াতে লাগলাম গুরুদেবকে --- “ ভালো মন্দ যাহাই আসুক সত্যরে লও সহজে।“

    পরদিন সকালেই সমস্ত ঘটনা বিবৃত করে একটু কড়া করে চিঠি লিখলাম। আমাদের স্টাফ অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারিকে কপি পাঠালাম আর পাঠালাম আমার ‘বস’ টেকনিক্যাল ম্যানেজার মিস্টার রবিনসকে ও এডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসারকে । জানিনা কি হবে। তবে সারা ফ্যাক্টরিতে বেশ সাড়া পড়ে গিয়েছে। রবিন সাহেব বেশ কড়া একটা চিঠি দিয়েছে আমার স্বপক্ষে ব্যাপারটা মিটিয়ে নিতে। পি-ও আমাকে 26 2 64 তে দেখা করার জন্য অনুরোধ জানিয়েছে। দেখা যাক কি হয়।
     

    দক্ষিনেশ্বর ২৩-২-৬৪

    ঘটনার পরিণতিটা শেষ পর্যন্ত আমার অনুকূলেই ঘটে । পি-ও আমার কাছে ওই ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে ও ক্ষমা চায়।
     

    দক্ষিনেশ্বর ২৭-২-৬৪ 

    নতুন জীবন নতুন স্বাদ। ভাবতে ভালো লাগছে আমি একটা সংসারের মধ্যমণি। আমাকে ঘিরে এতগুলো প্রাণের চাঞ্চল্য। না কোন গর্ব নেই, কারণ জানি এতে কোনো কৃতিত্ব আমার নেই। চাকরি পেয়েছি, টাকা আয় করার সুযোগ পেয়েছি তাই এই গৌরবের অংশীদার হতে পারছি। নইলে আমার সামর্থ্য কোথায়? চাকরি না পেলে কি করতাম?

    প্রায় দশ বছর পরে মাকে কাছে পেলাম। সেই যে স্কুল ফাইনাল পাশ করে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েছিলাম তারপর আর মার কাছে একটানা থাকার অবসর হয় নি। দক্ষিণেশ্বরে অবশেষে বাসা ভাড়া নিলাম -- মাসিক ৭৫ টাকার বিনিময়ে। তিনখানা ঘর, সবচেয়ে বড় ঘরটা আমি একা থাকি। অন্য ঘর দুটোয় আর সকলে --- মা-খোকন-খুকু-নিমু আর এক চাকর। এ কথা শুনে সু বলেছিল, আমি বড় স্বার্থপর। হাঁদু চিমু এখনো মামার বাড়িতে। ওদের আনতে এখনো সাহস হচ্ছে না। দেখি পরের মাসে আনা যায় কিনা।

    বেশ আছি, মস্ত পরিচ্ছন্ন ঘরে আমি একা। সংসারের কর্তৃত্বের আমেজ আর মায়ের আদর যত্ন। না এবার সত্যি সত্যি গোল্লায় যাব। গেঞ্জি আন্ডারওয়ার পর্যন্ত নিজেকে কাচতে হয় না। হাত বাড়ালেই পরিষ্কার সবকিছু। স্বাচ্ছন্দ্যে আছি এ কথা মানতেই হবে। তবু সু-কে না আনা পর্যন্ত স্বস্তি পাচ্ছি না। কবে যে আসবে? নিকুচি করেছে ওর পড়াশোনা। আশায় আশায় আর কতদিন থাকা যায়। পড়াশোনা কি আমার বাড়িতে হবে না? 

    সু-র কথা মনে হতেই উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠতে ইচ্ছে করছে। আর এতদিন পরে হঠাৎ উচ্ছ্বসিত হতে দেখে নিজেরই কেমন যেন অবাক লাগছে। একটু রোমান্টিক অনুভূতি, একটু ছেলেমানুষি। পরিচয়ের এতদিন পরে এবং এই বয়সে আর যাই হোক উচ্ছ্বাস মানায় না। তবু কেমন যেন নাবালকের মত ‘হৃদয় আমার নাচেরে’ বলে উদ্বাহু হয়ে নাচতে ইচ্ছে করছে। মনটা হঠাৎ এত পুলকিত হয়ে উঠল কেন ভাবতে গিয়ে আকাশের দিকে তাকালাম। কই চাঁদ তো নেই, তারাও নয়। একটু আগে বৃষ্টি হয়েছিল। আকাশটা এখনো গুমোট, মেঘলা মেঘলা। তাহলে বাইরের কোনো কারণে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেনি। ভিতরে কারণটা এক এবং অকৃত্রিম। সমস্ত চেতনা ঘিরে শুধু সু। এখনই সু-কে একটা চিঠি লিখতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু সরঞ্জাম কিছু নেই। ঘুমে চোখ বুজে আসছে। 

    কাল চ্যাপলিনের গোল্ডরাশ দেখতে যাব দুজনে। দুটো টিকিট কাটিয়ে রেখেছি খোকনকে দিয়ে।

    দক্ষিণেশ্বর ২৩ -২-৬৪

    জীবনের কাছে আর কিছুই চাওয়ার নেই। কেমন যেন স্থিতি এসেছে, যেন কোন স্রোত নেই। শুধু চাকরি করছি আর চাকরি করছি। এই চাকরিতে কোন আকর্ষণ নেই আমার। কোন উৎসাহ বোধ করি না কাজে। লেখাও প্রায় বন্ধ। অবশ্য এখনো চঞ্চলতা আছে, এখনো অস্থিরতা আছে। এখনো আকাঙ্ক্ষা অবশিষ্ট আছে কিছু । এবং এখনো যা কিছু প্রাণ আছে তার সবকিছুই সু-কে ঘিরে। এখনও ওকে পাইনি বলে অস্থিরতা আকাঙ্ক্ষা প্রবল আছে। আজকে যখন এ কথা লিখছি সে সময় সু-কে এক কঠিন জীবনের মুখোমুখি দাঁড়াতে হচ্ছে। তিন দিন আগে ওর সঙ্গে যখন দেখা হয়েছিল তখন বলেছিল পিতৃদেবের জরুরী তলবে ওকে বাড়ি যেতে হচ্ছে পরের দিন। আভাষে সে জানতে পেরেছে কোন এক এফ আর সি এস পাত্রের সঙ্গে ওর বিয়ের ব্যবস্থা প্রায় পাকা। লড়াইটা সাংঘাতিক হবে নিঃসন্দেহে । ওর পিতৃদেবকে আমি চিনি --- ডাক্তার রাখাল চন্দ্র দাস আত্মমভরী গর্বিত মানুষ। 

     


    ডঃ রাখাল চন্দ্র দাস, অনুর পিতা 


    নিজের ইচ্ছা ও সামাজিক মান বজায় রাখতে তিনি সবকিছু করতে পারেন। জানিনা শেষ পর্যন্ত কি হবে, সু হেরে যাবে না পিতৃদেবকে হার মানাবে। সবকিছু সু-র বুদ্ধি ও মানসিক জোরের উপর নির্ভর করছে। অবশ্য ও যদি হেরেই যায় এবং বাবার মনোনীত পাত্রকেই বিয়ে করে তবে খুব বেশি আশ্চর্য হব না। অন্ততঃ তাতে ও ওর বাবাকে খুশি করতে পারবে। 

     



    কিরণ সুধা, অনুর মা 


    আবার এটা ভাবতে অত্যন্ত খারাপ লাগে যে সু অন্য কাউকে বরণ করেছে। কিন্তু এ কথা ভেবে সু-কে আমি ছোট করছি -- যেহেতু সু-র যে পরিচয় আমি জানি তা যদি সত্যি হয় তবে পৃথিবীর কোন প্রলোভনই, সম্ভাব্য কোন ঘটনাই সু-কে সংকল্পচ্যুত করতে পারবে না। সু-কে চিনতে আমি ভুল করিনি এ গর্ব আমার অটুট থাকলে আমি খুশি হব সবচেয়ে বেশি। মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ। তবু কল্পনাতীত কোনো কারণে যদি ও পিতৃদেবকেই খুশি করতে চায় কখনো, তবে আমি জানব সু দুর্বল, অথবা ইচ্ছে করে হৃদয়ের থেকে বুদ্ধির দাম দিয়েছে বেশী। এ কথা নির্মমভাবে সত্যি যে এখন আমার যা অবস্থা তাতে আমি ওকে অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য দিতে পারব না। … এখনো পর্যন্ত ঠিক আছে যে আমরা ২৮ মার্চ রেজিস্ট্রেসন করব। আমি অপেক্ষা করে আছি কি হয় দেখার জন্য। 

    তথাপি অনেক কিন্তু-যদির প্রশ্ন এড়িয়ে ধরে নিলাম যে সু-কে আমি পাচ্ছি। তারপর সু-কে পাওয়ার পর আমি কি চাইবো? অর্থ,যশ, প্রতিষ্ঠা? আজকে যে অবস্থায় আছি সে অবস্থায় দাঁড়িয়ে নিশ্চয়ই করে বলা যায় যে এগুলোর কোনটাই আমার জন্য নয় । একমাত্র মিরাকেল ছাড়া ঐ সমস্ত কিছু ভাবা যায় না। অভাবনীয় কিছু যদি না ঘটে তাহলে কি হবে ভাবতে ভয় লাগে। ভবিষ্যতের ছবিটা তাহলে অনেকটা এরকম --- ইন্ডিয়া ফয়েলসে মধ্য ধরনের চাকরি, ৩২৫ এ শুরু সাতশয় শেষ। আট হাজার টাকার জীবন বীমা, তিরিশ হাজার টাকার প্রভিডেন্ড ফান্ড। এটা হল অর্থনৈতিক দিক। অন্য দিকটা ভাবা যাক--- আমি পূর্ণ গৃহী, স্থুল স্বামী, অতৃপ্ত পিতা, কুঞ্চিত কপোল আশাহত মানুষ। অর্ধ সুখী মধ্যবিত্ত পরিবার। মধ্যবিত্ত সংসারে জটিল গিঁট পাকানো নানা সমস্যায় চিন্তাকুল প্রৌড় ঈষৎ ন্যুব্জ হয়ে অফিস যাচ্ছে। নিজের পঞ্চাশ বছরের এই ছবিটা ভাবতেও শিউরে উঠি।

    এমন যদি না হয় তাহলে হয়তো হব আত্মসুখী মানুষ। বাড়ি করেছি, গাড়ি কিনেছি, অবসরের আলস্য ভালো লাগে। ঘরে আমার আধুনিক স্ত্রী, স্বাস্থ্যবান সন্তানের মা। আমি--- সুখী উর্ত্তীন-যৌবন আকাঙ্ক্ষাস্তিমিত পুরুষ। অফিস করি, টাকা জমাই, হিসেবী সংসারী । কিন্তু আমি কি মনে প্রাণে এই চাই --- আমার আকাশের রং কি গাঢ় সবুজ? 

    পরিত্রাণের একটিমাত্র পথ খোলা আছে -- সেটা আমার শিল্পের পৃথিবী। আবার আমি যদি লিখি। একমাত্র ওই জগতে যদি যেতে পারি তবে রেহাই পাব। আর কিছু না হোক অন্ততঃ শান্তি পাব। নিজেকে খুঁজে পাব, সেটাই আমার একমদ্বিতীয়ম নিজস্ব জগত। কিন্তু আকাঙ্ক্ষিত সেই স্বর্গে পৌঁছতে গেলে যে ধৈর্য শ্রম ও নিষ্ঠা দরকার তা এখনো আয়ত্তে আসেনি। আসবে কিনা জানিনা, তবে ধৈর্য ও শ্রমের অভাব থাকলেও নিষ্ঠার অভাব নেই আমার। 

    মাভৈ:, সরস্বতী তোমাকে আমার চাই।

    দক্ষিণেস্বর ৫-৩-৬৪ 

    জীবনের এত বড় একটা ঘটনা যে এত সাধারণ ও সহজভাবে, এত অনাড়ম্বরে শেষ হবে ভাবা যায়নি। নতুন জীবনের শপথ নিলাম, নতুন দায়িত্বের শপথ নিলাম। আমি বিবাহিত, সু আমার স্ত্রী। ১৬ ই মার্চ ১৯৬৪ আমার জীবনের স্মরণীয় দিন। সু-র হাতে হাত রেখে উচ্চারণ করলাম --অরুন্ধতী দাস তোমাকে আমি আমার স্ত্রী রূপে গ্রহণ করলাম। … আইন আমাদের অধিকার দিল স্বামী-স্ত্রী রূপে বসবাস করার। তবুও সু-কে আমার ঘরে আনতে পারলাম না। অন্য দিনের মতো যথারীতি ওকে আমি হোস্টেলে পৌঁছে দিয়ে এলাম। সত্যিই ভাবিনি শেষ পর্যন্ত আমরা যথেষ্ট সাহসী হয়ে রেজেস্ট্রি করে বিয়ে করব। সই করবার পর সু অবশ্য অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে পড়েছে দেখলাম। অথচ আমার কিছু করার নেই। শুধু যতক্ষণ কাছে থাকি সাহস দিই । বেশ বুঝতে পারছি ওর অন্দরমহলে দারুণ যুদ্ধ হচ্ছে। এবং অত্যন্ত ভেঙে পড়ছে। সেই ভেঙ্গে পড়ার ভাবটা কখনো কখনো এত বেশি প্রকট হয়ে পড়ছে যে ওকে দেখে আমার রীতিমত করুণা হচ্ছে।

    পিতার অনুমতি না নিয়ে এত বড় একটা মহাযজ্ঞ সাঙ্গ করার জন্য ভালোবাসা-জাত অপরাধবোধ ওকে পীড়িত করছে, অথচ পিতাকে সব কথা বলার সাহসও নেই। কিন্তু আমার ভয় হচ্ছে এ অবস্থায় বেশিদিন থাকলে ওর মনের ওপর যে প্রচণ্ড প্রতিক্রিয়া হবে তার থেকে না কোনদিন সাংঘাতিক কোন অসুখের সূত্রপাত হয় । আমার ইচ্ছা নয় বেশি দিন ও এ অবস্থায় থাকে। অন্ধকার মুখ আমাকে বড় কষ্ট দেয়। আমি হাসিখুশি প্রাণ চাই।

    চার বছর আগে সু-কে একবার লিখেছিলাম--- পৃথিবীর কোন শক্তি নেই যা আমাদের আলাদা করে রাখে। আজ আবার লিখলাম, “মনে রেখো আজ আমরা যে চ্যালেঞ্জকে গ্রহণ করলাম তার জের টানতে আমাদের অনেক যুদ্ধ করতে হবে। এবং সেই পর্বের এই শুরু। শপথ করো, আমরা হেরে যাবো না। আমরা সুস্থ সুন্দর জীবন চাই। এবং পৃথিবীর এমন কোন শক্তি নেই যে আমাদের সেই জীবন থেকে দূরে সরিয়ে রাখে।“

    লিখলাম, … ভাবতে পারো সু, বিবাহিত নারী পুরুষ তুচ্ছ সামাজিক অনুশাসনের ভয়ে নিজেদের আলাদা করে রেখেছে। তারা চোরের মত লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা করে। খুশী মত পেতে পারেনা একে অন্যকে। সু, এভাবে থাকা যায় না। তুমি উত্তর মেরুতে আর আমি দক্ষিণ মেরুতে, আর দুজনে ভাববো আমরা স্বামী-স্ত্রী। এ অসম্ভব। তুমি কি করে আছো জানিনা কিন্তু আমার পক্ষে এভাবে থাকা নিতান্তই অসম্ভব বোধ হচ্ছে।

    দক্ষিণেশ্বর ২০-৩- ৬৪

    নতুন পরিচয়ে নতুন অধিকারে আজ প্রথম সু-র সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। কিন্তু দেখা হলো না। কথা ছিল আজ আমাদের দেখা হবে। অথচ ও আসেনি। এমন কখন হয় না, এমন কখনো হয়নি। সু কথা দিয়েছে অথচ সে কথা রাখেনি, এমন কখনো হয়নি। ওকে আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি। না-আসার একমাত্র কারণ নিশ্চয়ই ও কোনো বিপদে পড়েছে। মনটা অত্যন্ত খারাপ হয়ে গেল। আমাদের নিয়মিত সাক্ষাৎস্থানে পুরো এক ঘন্টা অপেক্ষা করেও যখন ওর দেখা পেলাম না তখন অত্যন্ত বিচলিত হয়ে উঠলাম। অত্যন্ত অধৈর্য হয়ে তখনই ফোন করলাম হোস্টেলে। 

    শুনে অবাক হলাম যে ও আসানসোলে গিয়েছে। আশ্চর্য! যাওয়ার আগে অন্তত একটা চিঠি দেওয়া উচিত ছিল। না কোন অজুহাতই তুমি দেখাতে পারো না। যত তাড়াতাড়ি যাওনা কেন যেমন অবস্থাতেই যাওনা কেন চিঠি দেওয়া তোমার উচিত ছিল নিশ্চয়ই। এবং যখন আজকের তারিখের সঙ্গে তোমার যাওয়ার তারিখের ফারাক ছিল তিন চার দিন। অর্থাৎ চিঠি দিলে ঠিক সময় আমি চিঠি পেতাম। ক্লান্তি, ভীষণ ক্লান্তি আচ্ছন্ন করেছে আমায়। কি দারুণ উৎকন্ঠা নিয়ে যে সারা সপ্তাহ কেটেছে আমার! কি অসম্ভব নতুন আশা নিয়ে যে আজ তোমার প্রতীক্ষা করেছিলাম তা যদি জানতে, সু। সারা সপ্তাহ ধরে কত নতুন প্রশ্ন তৈরি করে যে রেখেছিলাম, কত কিছু জানবার ছিল আজই। 

    আমাদের নতুন পরিচয়ের নতুন জীবনের প্রথম সাক্ষাত-লগ্ন এমন করে ভেঙ্গে দিলে!

    দক্ষিণেশ্বর সোমবার ২৩-৩-৬৪

    আজও কোন খবর নেই সু-র। কি যে করছে জানিনা। আমাকে এমন উৎকন্ঠায় রেখে, আমার সঙ্গে কোন পরামর্শ না করে ওর কোন কাজ করা উচিত নয় সেটা কেন ও বুঝে না। উদাসীন বা অবিবেচক কিছুই ওকে বলা যায় না। ও বুদ্ধিমতী ও শিক্ষিতা, ওর কাছ থেকে এমন কাজ কখনোই আশা করা যায় না, যা ওর উপর আমার এতদিনের ধারণা পাল্টে দেবে। নাকি বিয়ের পর ওর রূপ পরিবর্তন হলো। অত্যন্ত উতলা হয়ে পড়েছি। ওর সঙ্গে দেখা করার ও নতুন কতগুলো পরামর্শ করার দারুন প্রয়োজন ছিল ঠিক এই সময়ে। ঠিক এই সময়ে ও যদি এসে পড়ত আমার কাছে! 

    বুঝতে পারছি ওর মনের অবস্থা অত্যন্ত আন্দোলিত। তবু ও কি করছে না করছে তার খুঁটিনাটি সবকিছু আমাকে জানানো ওর কর্তব্য। এমন করে চুপ করে যাওয়ার মধ্যে কোন যুক্তি নেই। ওর সমস্যা জটিল নিঃসন্দেহে কিন্তু তাই নিয়ে ও এতই বিচলিত যে আমার কথা প্রায় ভুলেই গেল। সু-র কাছ থেকে এমন মৌনতা কখনই আশা করা যায় না। 

    দক্ষিণেশ্বর ২৫- ৩- ১৯৬৪

    অবশেষে কাল সু-র চিঠি পেলাম। লিখেছে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় আসানসোলে যেতে বাধ্য হয়েছিল এবং সে খবর জানিয়ে আমাকে নাকি চিঠি দিয়েছিল। কিন্তু কোন অজ্ঞাত কারণে সে চিঠি আমি পাইনি। ওর চিঠি পড়ার পর আর রাগ করতে পারি না। ও আমার কথা শোনে এবং আমাকে প্রাণ ভরে ভালোবাসে। ও যদি এমনি থাকে তবে ওকে নিয়ে যে আমি খুশী হব তা প্রায় সুনিশ্চিত।

    সু সত্যি অসম্ভব রকমের ভালো। আমার ঘরে এলে আমার একান্ত নিজস্ব হয়ে কাছাকাছি এলে ওর কি রূপ দেখব জানিনা। সমস্ত রকম অবস্থা যদি হাসিমুখে মেনে নিতে পারে তবেই ও সুখ পাবে, আমি খুশী হব। একমাত্র ভয় আমার ও অত্যন্ত বেশি সেন্টিমেন্টাল। কোনরকম আঘাত সহ্য করতে পারে না। ও যদি শক্ত ও প্রাকটিকাল হতে না পারে তবে অবশ্য ওকে কষ্ট পেতেই হবে। এমন অনেক ঘটনাই ঘটতে পারে যা আমার আয়ত্বের বাইরে। এবং তেমন কিছু থেকে ও যদি কষ্ট পায় তাহলে আমার কিছু করার নেই। আমি শুধু এইটুকু বলতে পারি আমার দিক থেকে কখনোই এমন কিছু ঘটবে না যা ওকে আঘাত দেবে। আমার বাড়ির সকলে যদি ওকে ভালোবাসে এবং নিজের গুণে ও যদি সকলকে আপন করে নিতে পারে তবেই ও স্বার্থক হবে।

    অবশ্য সামান্য ভুল বোঝাবুঝি, একটু উঁচু স্বরে কথা, রাগ ও কলহ কখনো কখনো বেশ উত্তেজক ও মধুর। এবং তাই মাঝে মাঝে একঘেয়েমি উত্তরণের চেষ্টায় এবম্বিধ বস্তু সাদর অভ্যর্থিত।

    দক্ষিণেশ্বর ২৮-৩-৬৪

     





    ক্রমশঃ 

     


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ২৬ এপ্রিল ২০২৫ | ৬৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা খুশি মতামত দিন