বিমল সরকার চাকরি করেন কর্পোরেশনে, ক্লার্ক। একটা ছোট দু’কামরার বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকে্ন বেলেঘাটায়।
সংসারে আছেন বৌ প্রতিমা আর ছেলে অর্কপ্রভ, ডাকনাম অর্ক। প্রতিমা সংসারের হাজার কাজে ব্যস্ত থাকেন সারাদিন। সকাল ছ’টায় ঘুম থেকে উঠে উনুন ধরাতে হয় প্রতিমাকে, না হলে অফিস আর স্কুলের ভাত হবে না সময়মত। অর্ক পড়ে ক্লাস টেনে কাছের একটা স্কুলে। নিম্নবিত্ততা আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে সংসারে।
‘আমার টিফিনটা হল?’ বিমল হাঁকেন, সকাল ন’টা তখন।
‘নাও তোমার রুটি আলুভাজা’, ব্যস্ত হয়ে বলেন প্রতিমা।
সকাল দশটার মধ্যে বিমল আর অর্ক বেরিয়ে যায় বাড়ি থেকে। প্রতিমা তখন হয়ত কাপড় কাচতে বসেন কলতলায় না হয় কয়লার গুঁড়ো মেখে গুল দিতে বসেন উঠোনে। সেই সময় মাঝে মাঝে পাড়ার বৌরা এসে একটু সুখ দুঃখের গল্প করে যান। সবাই সবার খবর রাখে এই পাড়ায়। দুপুরে খেয়ে উঠে প্রতিমা একটু ঘুমোন একঘণ্টা। কখনো একটু রেডিওতে গান শোনেন বা একটা ম্যাগাজিন পড়েন। বিকেলে আবার চারটে বাজতেই রান্নাঘরের কাজ শুরু হয়ে যায়।
‘মা, তাড়াতাড়ি খেতে দাও, ট্যুইশনে যেতে হবে’, অর্ক তাড়া দেয় স্কুল থেকে ফিরে।
‘রুটি আর গুড় দিলাম, অর্ক। আজ আর কিছু নেই‘ প্রতিমা বলেন।
‘আজ রাতে কি চিকেন হবে মা? আজ তো মাসের এক তারিখ’।
‘দেখ, বাবা কী আনে আজ’।
সন্ধ্যায় বিমল বাড়ি ফে্রে কাঁকড়া আর কুমড়োর মিঠাই নিয়ে। বাড়িতে যেন উৎসব লেগে যায়। রাতে সবাই মিলে কাঁকড়ার ঝোল ভাত খায় তৃপ্তি করে আর কুমড়োর মিঠাই ডেজার্ট।
‘কাল পুরনো কাগজগুলো বিক্রি করতে হবে সকালে। গুছিয়ে রেখো রাতে’, বিমল বলেন প্রতিমাকে।
‘রেখেছি’।
‘কাগজওয়ালা আগের মাসে চার টাকা দিচ্ছিল কিলোতে। এবারে বলব সাড়ে চার করে দিতে। সব জিনিসের দাম বাড়ছে যখন পুরনো কাগজেরও দাম বেশি হবে না কেন? লোকটা মনে হয় ঠকাচ্ছে’ বলেন বিমল।
‘এবারে দুটো গেঞ্জি কেনো তুমি এ মাসের মাইনে দিয়ে। তোমার দুটো গেঞ্জিই ফুটো হয়ে গেছে’।
‘দুটো গেঞ্জি কিনতে শুধু শুধু তিনশ টাকা বেরিয়ে যাবে। আর কিছুদিন চলুক এভাবে’।
‘আর তিন মাস পরে পুজো। অর্কর জন্য একটা শার্ট আর প্যান্ট আর তোমার জন্য একটা ধনেখালি শাড়ী কিনতে হবে বোনাসের টাকাটা পেলে। তখন না হয় আমি দুটো গেঞ্জি কিনব’।
‘এখন বাজারে খুব ইলিশ উঠেছে। কাল রবিবার দেখি যদি দরদাম করে একটা ইলিশ কিনতে পারি’।
পরের দিন বিমল বাজারে গিয়ে দেখেন ইলিশের ছড়াছড়ি। কত বাবুলোকেরা কিনছে গোটা ইলিশ, কোনও দরদাম না করেই। বিমল দাম জিজ্ঞেস করে শোনেন দু হাজার টাকা কেজি। মনে মনে হিসেব করেন এক সপ্তাহের খাওয়ার খরচ সংসারের। ওই বড় ইলিশ আর কেনা হয়ে ওঠে না। একটা পাঁচশ গ্রামের খোকা ইলিশ সাড়ে তিনশ টাকায় কিনে বাড়ি ফেরেন।
‘ভাল করে সর্ষেবাটা দিয়ে ঝাল করো’, বিমল বলেন।
‘মা, মাছের তেল দিয়ে ভাত খাব’, অর্ক বলে।
‘এই মাছে তেল নেই রে, অর্ক। পরে তোকে আরেকদিন খাওয়াব, বাবা বড় ইলিশ আনবে যখন’, প্রতিমা লজ্জা পেয়ে বলেন।
প্রতিমা জানেন ওই দিনটা আসবে না কখনও, এই নুন আনতে পান্তা ফুরানোর সংসারে। তবু আনন্দের অভাব নেই এই তিনজনের সংসারে।
শীতকালে অর্ক আবদার করে মার কাছে ঝোলাগুড় দিয়ে সরুচাকলি খাবে। ঝোলাগুড়ের অনেক দাম। ছেলেটার আবদার রাখতে বিমল শিয়ালদার কোলে মার্কেট থেকে দরদস্তুর করে কিছুটা ঝোলাগুড় কিনে আনেন এক শনিবার।
‘কাল রাতে সরুচাকলি করো, প্রতিমা। শীতটা জমিয়ে পড়েছে। খুব মজা হবে’, বিমল বলেন।
রাতে সরুচাকলি আর ঝোলাগুড় খায় সবাই মিলে খুব আনন্দ করে। বিমলের মনটা খুশিতে ভরে ওঠে। ভাবে ছেলেটার আবদার রাখতে পারলাম আজ।
এদিকে সময় বয়ে যায়। অর্ক কলেজ, ইউনিভার্সিটির পড়া ভালভাবে শেষ করে কেমিস্ট্রিতে পিএইচডি করতে যায় আমেরিকা। উজ্জ্বল গবেষণার শেষে চাকরি পায় একটা বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানিতে সায়েন্টিস্ট হিসেবে। কিছুদিনের মধ্যে অর্ক আবিষ্কার করে একটা নতুন ওষুধ, যেটা দিগন্ত খুলে দেয় আলঝাইমার্স চিকিৎসার। অর্ক বছরে একবার কলকাতায় আসে বাবা-মাকে দেখতে। চাকরি পাওয়ার পাঁচ বছরের মধ্যে অর্ক একটা বড় ফ্ল্যাট কেনে নিউটাউনে বাবা-মার জন্য সতেরো তলায়। একটা গাড়িও কিনে দেয় ওদের অর্ক। একজন সবসময়ের জন্য ড্রাইভার রেখেছে অর্ক বাবা-মার সুবিধের জন্য, নাম তার বাবলু। এখন আর বিমলকে কাগজ বিক্রি নিয়ে দরদস্তুর করতে হয় না। বাবলু এখন পুরনো কাগজ নিয়ে যায়।
টানাটানির সংসার আর নেই বিমলের। অর্ক মাসে মাসে ডলার পাঠায় বাড়িতে। এখন প্রতিদিন আসে কাটা মাছ, চিকেন, মাঝে মাঝে বড় ইলিশ। সকালে ডিম, বাটার দিয়ে পাউরুটি, কফি খাওয়া হয়। রবিবার বিকেলে আর মুড়ি দিয়ে শসা খেতে হয় না বিমলদের। এখন চিকেন রোল, কাবাব, মোমো, বা পেস্ট্রি আসে ছুটির দিনে। অবশ্য বিমলের এখন রোজই ছুটির দিন, অবসরের পরে।
তবু বিমলের পুরনো অভ্যেস উঁকি দেয় মাঝে মাঝে। চপ্পলটার সোল ক্ষয়ে গেলেও ফেলতে পারেন না সহজে। এখনও মাঝে মাঝে বাসে চড়ে দেখা করতে যান বন্ধুদের সঙ্গে পুরনো পাড়ায়। গাড়িতে রোজ চড়তে মন চায় না।
‘বাসে চড়লে পাঁচটা সাধারণ মানুষের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ হয়, দু’টো সুখ দুঃখের গল্প হয়, মনটা ভরে যায়’, প্রতিমাকে বলেন।
অসুখ-বিসুখ হলে এখনও পুরনো পাড়ার হোমিওপ্যাথি ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে থাকেন। সহজে অ্যালোপ্যাথিক ডাক্তারের কাছে যেতে চান না। খালি মনে হয় শুধু শুধু টাকা খরচ হয়ে যাবে।
‘এত কষ্ট করার আর দরকার নেই, বাবা। পুরনো অভ্যেস বদলে ফেলো’, অর্ক বকুনি দেয় বাবাকে।
‘এতদিনের অভ্যেস কি রাতারাতি বদলে ফেলা যায় রে’, বিমল বলেন ছেলেকে।
বিমলের বড় বাধে নিজেকে বদলাতে। বড় হাউসিং সোসাইটির দামী ফ্ল্যাটে নিজেকে বড় বেমানান মনে হয়। বারবার মনে পড়ে ওই ফেলে আসা দু’কামরার ভাড়া বাড়িটার কথা যেখানে তাঁরা তিরিশ বছর ছিলেন সমমনস্ক প্রতিবেশীদের সঙ্গে মিলেমিশে। এখনকার ২০০০ স্কোয়্যার ফুটের ফ্ল্যাটে বিমলের বড় একা লাগে। মনে হয় এখানে ঐশ্বর্য আছে, নেই ভালবাসার টান। সবাই যেন এই সোসাইটিতে প্রতিযোগিতা করে চলেছে দেখানেপনার। কার কত বেশি আছে তা দেখিয়েই আনন্দ যেন অন্য প্রতিবেশীদের এখানে। থেকে থেকে যেন দমবন্ধ হয়ে আসে বিমল-প্রতিমার।
চারপাশে মানুষ থেকেও বিমল-প্রতিমা এখন বড় একা, বড় শূন্য মনে হয় জীবনটাকে। ফেলে আসা জীবনের যুদ্ধটা থেকে থেকে স্বপ্নে দেখা দেয় বিমলকে আর বলে,
‘বিমল, তুমি কি সুখী এখন? তুমি এখন আর সীমাবদ্ধ নও। প্রাচুর্য তোমার মুঠিতে ধরা। তবু তুমি আনন্দ খোঁজো তোমার অতীতে। কোন জীবনটা বেশি ভাল বল তো? চলো ফিরে যাই আবার ওই দু’কামরার বাড়িতে যেখানে সুখ ছিল না, তবু আনন্দ ছিল পরিপূর্ণ’।
ঘুম ভেঙ্গে যায় বিমলের। এক গ্লাস জল খেয়ে বাইরের ব্যালকনিতে গিয়ে বসেন। তারাভরা অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে আপন মনে বলেন বিমল, ‘এতই যদি দিলে প্রভু, আনন্দটা কেন কেড়ে নিলে? প্রতিদিনের এই কষ্ট আমাকে শেষ করে দিচ্ছে। আমার বোধ লুপ্ত করে দাও প্রভু, আমাকে দাও আলঝাইমার্স। অর্ক তোর আবিস্কার করা ওষুধটা যেন আমার ওপর প্রয়োগ করিস না। ভুলে যেতে দে আমায় এই বাস্তবটা। তোকে নিয়ে আমার অনেক গর্ব। তবু, তোর আবিস্কারের থেকে আজ আমি দূরে যেতে চাই। আমাকে ক্ষমা করিস অর্ক’।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।