

কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবের বয়স ৩১।
প্রথম বছর থেকেই দেখছি।
এবার দেখলাম কয়েকটি তথ্যচিত্র।
চমৎকার কয়েকটি। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য 'জিলিপাবালার বন্ধুরা'। এক তেঁতুল গাছকে বাঁচানোর সংগ্রাম এক শিশুর। প্রেসিডেন্সি কলেজে আমাদের ছাত্রী সমতা বিশ্বাস অন্যতম প্রযোজক। পরিচালনা দেবযানী মজুমদার। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। ১০ বছর ধরে ছবি ভিডিও তুলেছেন। গাছে আশ্রয় নেওয়া পাখি বানর কাঠবিড়ালিদের। গাছের তলায় থাকে কুকুর ও বিড়াল। তাঁদের সখ্য অভাবনীয়। জীববৈচিত্র্য নিয়ে একটি অন্যরকম ছবিও দেখলাম।
প্রজাপতি দেখেছি। শুঁয়োপোকাও। কিন্তু শুঁয়োপোকা প্রজাপতি হওয়ার আগেই তার গা শিরশির করা গায়ে যে রঙের রামধনু বোনে, তা প্রথম দেখলাম বন্ধু সুবীর মণ্ডলের তথ্যচিত্রে। ছবিটি বেশ যত্ন নিয়ে করেছেন সুবীর। সুবীরের
সঙ্গে ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এনা এবং তাঁর পিএইচডি ছাত্রী রণিতা। বিদ্যাসাগর কলেজে পড়ান।
প্রচণ্ড খিদে পেয়েছিল। পাশে বসেছিলেন রণিতা। বিস্কুট আছে? বলতেই বের করে দিলেন। কী করে যে বললাম! প্রচণ্ড খিদে। পেটে আলসার। তার সঙ্গে মধুমেহ। মাথা ঝিমঝিম।
খুব ভিড় তথ্যচিত্র দেখতে। বের হলে যদি জায়গা না পাই। যাক, পরে মুরগির রোল, আন্ডা মুরগি চাওমিন এনে ক্ষতি পূরণ করলেও রণিতা ছিলেন না বলে খাওয়ানো গেল না। বাকিরা খেলেন। আম্মো।
সুবীরের ছবির আগে ৭৫ মিনিটের মাথা ধরানো একটা পারিবারিক অ্যালবাম ছিল। 'বোরিং। সো বোরিং'।
বলছিলেন কয়েকজন। তবে এই ছবিরও দর্শক ছিল। পারিবারিক ভোজসভার মতো পারিবারিক চলচ্চিত্রসভা। অনেকে এসেছিলেন। তাঁরা মন দিয়ে দেখলেন।
পরের ছবি, ঘোড়া নিয়ে। দ্য রোস্ট্রাম।
দেখা হল কর্ণ, শান্তনুদের সঙ্গে। ছবি দেখে, আমার পুরাতন ইচ্ছে জেগে উঠল। ঘোড়া কেনার ইচ্ছে। ঘোড়া পালনের খরচ নাকি মাসে লাখ খানেক। নাহলে রাজাবাজারের ঘোড়া হয়ে যাবে!
আমার খুব ঘোড়া কেনার শখ ছিল। শৈশবে আমার জীবন বাঁচানো ডাক্তার শশধর পান মাথায় কাউবয় টুপি পরে ঘোড়ায় চাপতে দেখেই এই ইচ্ছের জম্ম।
সাইকেল চড়লে আমার ঘোড়া চড়ার মতো অনুভূতি হতো।
দুধের অভাবে ঘোলের স্বাদ। মনে হতো ঘোড়ার ওপর বসে আছি। পরে স্কুটার চালাতেও এক অভিজ্ঞতা।
তবে একটা কথা বলতেই হবে, বর্ধমান শহরে থাকতে 'রিকশ' চাপতে লজ্জা লাগতো। মনে হতো বড়লোকিপনা করছি।
তাকিয়ে এদিক ওদিক দেখতাম, কেউ দেখে ফেলল নাকি।
পরে একটা কবিতা লিখি ১৯৮৮৫/৮৬ হবে।
'ঈক্ষণিকা' পত্রিকায়। পত্রিকার প্রথম সম্পাদক ও অর্থ দাতা/ সংগ্রাহক ছিলাম আমি। পরে রাজনৈতিক কারণে অন্য একজনের নাম সম্পাদক হিসেবে দিয়ে চালাতে হতো। ১৯৯৩ পর্যন্ত বের হয়েছে বর্ধমান শহর থেকে। পরে কলকাতায় ২০০২ এ অশোক মিত্র সংখ্যা প্রকাশ করায় বেশ সাড়া পড়ে। আনন্দবাজার পত্রিকা স্বেচ্ছায় 'কড়চা'য় আমার নাম সমেত প্রকাশ করে। আমি ১৯৯৩ থেকেই সক্রিয় রাজনীতি করি না। ফলে সম্পাদক হতে সমস্যা হলো না।
হচ্ছিল কবিতার কথা। কোথায় চলে গেলাম।
শ্রেণিসংগ্রাম বিষয়ক প্রশস্তিমালা
রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় রিকশা সাইকেল বাইক গাড়ি সবার ওপর আমার ভারি রাগ হয়
সাইকেল চাপলে পথচারী আর গাড়ির ওপর
রিকশা চাপলেই আমার মনে হয়, বাকিগুলো কী ঝঞ্ঝাট
আর লাল মারুতি চাপলেই মনে হয়
পথচারী সাইকেল রিকশা --সবগুলো কেন ধ্বংস হয়ে যায় না
সে নিয়ে খুব শোরগোল হয়।
তার চেয়ে বেশি শোরগোল হয় আরও অনেক কবিতা নিয়ে। সে কবিতা সিপিএমের দলীয় মুখপত্রে ছাপা হয়।
কবিতার নাম -- গাধা মোরগ ঘোড়া আর দাঁত বিষয়ক প্রশস্তিমালা
তাতে লেখা হয়, হাতের আড়ালে ব্লেড লুকিয়ে সন্তর্পণে সবাই বন্ধুত্ব করি
কল্যাণ মণ্ডল বলে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী নেতা সিপিএমের বর্ধমান জেলা সম্মেলনে প্রশ্ন করেন, কমরেড আমরা কোনটা? গাধা মোরগ ঘোড়া না দাঁত?
এর আগে ছাপা হয়েছিল -- অধস্তনের মাংসই তো সবচেয়ে স্বাদু আর সস্তাও বটে।
অফিসিয়াল সম্পাদক ছিলেন আমার অধ্যাপক। এখনও তাঁর সঙ্গে আমার গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সম্পর্ক। তিনি এই বলে আমাকে বাঁচান, ইমানুলের আমার ওপর রাগ হলে এইসব লেখে। আর আমাকেই সেসব ছাপতে হয়।
অধ্যাপক জ্যোতির্ময় ভট্টাচার্য আমার দেখা অন্যতম শ্রেষ্ঠ মানুষ। তাঁর সঙ্গ আমাকে ঋদ্ধ করেছে। এখনও বর্ধমান গেলে তাঁকে প্রণাম না করে ফিরি না। তাঁর দাদা কল্যাণ ভট্টাচার্যও একজন গুণী অধ্যাপক। বড় মনের মানুষ। বাইরেটা কঠিন। ভিতর নরম। সিপিএমকে ভোট দিতেন কিন্তু কট্টর সমালোচক ছিলেন। পণ্ডিত ধ্রুবতারা যোশীর খুব কাছের মানুষ। দু ভাইই ভালো ধ্রুপদী সঙ্গীত জানতেন। তেমন চর্চা আর করেননি। কল্যাণ ভট্টাচার্যের ছিল বিপুল ক্যাসেট সংগ্রহ। তাঁর সংগ্রহ দেখে আমার স্বল্প আয়ের ইচ্ছে ফলবতী হয়।
আমি নানা ক্যাসেট কিনতে থাকি। আমার কিন্তু তখন টেপ রেকর্ডার ছিল না। কিন্তু ক্যাসেট কিনতাম। ক্যাসেট উপহার দিতাম।
রানিগঞ্জ মোড়ে একটা ক্যাসেট দোকান ছিল। ধারে দিত। ১৫ টাকার ক্যাসেট হলে দাম দিয়ে দিতাম। মোজার্ট, বিটোভেনদের ক্যাসেটের দাম ১০০ টাকা। চার পাঁচটা কিস্তিতে শোধ দিতাম। আমজাদ আলি খান ও সুচিত্রা মিত্রের একটা অসাধারণ ক্যাসেট। জোড়া ক্যাসেট। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানে আমজাদ আলি খানের বাদন। ছিলেন রমা মণ্ডলও।
রমা মণ্ডলের গান শুনে ফিদা হয়ে যাই।
ক্যাসেটের প্রচ্ছদ কার করা মনে নেই। এখনও চোখে ভাসে। কী অপূর্ব সে শৈলী।
১০০ টাকা দাম। সেই ক্যাসেট উপহার দিয়েছিলাম এক অধ্যাপককে।
তিনি আমার একটা উপকার করেছিলেন। রাতের বেলায় কাগজের দপ্তরে খবরের কাগজে মাথা পেতে ঘুমানোর দস্তুর। তিনি আমাকে পাকড়ালেন। বাড়ি নিয়ে গিয়ে দুটো প্লেট উপচানো পাবদা মাছ খাওয়ালেন আমাকে। নিজে খেলেন একটা। এরপর পড়লেন আমাকে নিয়ে। অনার্স পাশ করে কী করবো?
সাংবাদিকতা করি। বিপ্লবী হওয়ার ইচ্ছে ছিল। হয়নি। ভাবলাম, সাংবাদিকতা পড়ে আরও ভালো করে দেশোদ্ধার করা যাবে। তিনি প্রায় জোর করে আমাকে বুঝিয়ে ছাড়লেন, সাংবাদিকতা না পড়েও খুব ভালো সাংবাদিক হওয়া যায়। এবং তখন বিখ্যাত এন রাম, অরুণ শৌরি, কমলজিৎ সিং সান্ধু, কুলদীপ নায়ার, খুশবন্ত সিং, প্রণয় রায়, ইলাস্ট্রেটেড উইকলি-র সম্পাদক--- এদের কজন সাংবাদিকতা পড়েছেন।
তাঁর যুক্তি ছিল মন দিয়ে পড়লেই আমি নেট পাবো, এবং অধ্যাপক হয়ে লেখালেখি করতে পারবো। বা অন্য কাজ।
এই ভদ্রলোক বহু লোকের অযাচিত উপকার করেছেন। কিন্তু আমার এক অধ্যাপক কৃষ্ণরূপ চক্রবর্তী ছাড়া কাউকে তাঁর নাম করতে খুব একটা শুনিনি।
না, তিনি আমার কোনও ইন্টারভিউ বোর্ডে ছিলেন না। আর থাকলেও কিছু কাজে লাগতে পারতেন না। কারণ, ১৯৯৫ -৯৬ পর্বে 'আজকাল' পত্রিকায় এত সিপিএম বিরোধী খবর করেছি, তাতে দু একজন ছিলেন খড়্গহস্ত। বিশেষ করে শিক্ষা যিনি দেখতেন।
তাঁদের খুশি করতে অনিচ্ছা সত্ত্বেও হয়তো আমাকে খারাপ নম্বর দিতে হতো তাঁকে।
তিনি আমার বেশ কিছু কবিতা ছেপেছিলেন। ১৯৮৯-এ রাশিয়ার দশা দেখে লিখি-- ব্যঙ্গ করে--
আমরা জারের জন্য লড়ছি।
তাতে গেল গেল রব ওঠে।
আমাকে লিখিত শোকজ করার জন্য দুয়েকজন আকুল হলেও শোকজ হয়নি।
আমার একজন রক্ষাকর্তা ছিলেন। শ্রমিক নেতা রবীন সেন। আমার সমালোচনামূলক কবিতা লেখা নিয়ে হইচই হওয়ায় তিনি কৃষক নেতা সমর বাওড়াকে দায়িত্ব দেন, ছাপার আগে আমার কবিতা দেখার।
সমর বাওড়া ও রবীন সেন সিপিএমের দুই খুব ভালো গদ্যকার।
সমর বাওড়া 'রণবাউল' ছদ্মনামে চমৎকার লিখতেন। সমাজ ও চলমান রাজনীতির সূক্ষ্ম ব্যঙ্গাত্মক সমালোচনা থাকতো।
পিতার অসুস্থতায় কিচ্ছু না করা আত্মীয়রা মৃত্যুর পর শ্রাদ্ধ শান্তি, সম্পত্তি নিয়ে অশান্তি করায় চমৎকার লেখা লিখেছিলেন।
আজও মনে আছে।
সিপিএমের বেশিরভাগ নেতা, এখন তৃণমূলেরও ভালো বাংলা লিখতে পারেন না।
সিপিএমের মধ্যে ব্যতিক্রম রবীন সেন, সমর বাওড়া। দুজনেরই অসাধারণ গদ্যের হাত। সৈয়দ শাহেদুল্লাহ, বিজয় পাল, শ্যামল চক্রবর্তী, দেবাশিস চক্রবর্তী, মুর্শিদাবাদের এক সাংসদ এবং অনিরুদ্ধ চক্রবর্তীর নাম মনে এই মুহূর্তে পড়ছে। এঁদের লেখার হাত চমৎকার।
মানব মুখোপাধ্যায় লিখতেন ভালোই। তবে বড্ড আবেগ।
তৃণমূলের ব্রাত্য বসু অসাধারণ গদ্য লেখেন। আর সাংবাদিক গদ্য ভালো লেখেন কুণাল ঘোষ। বাকিদের কথা বলতে পারবো না।
রবীন সেন ভালো ছোট গল্প লিখতেন। ১৯৩৯-এ দেশ পত্রিকায় তাঁর ছোটগল্প প্রকাশ পায়। তিনি নৌবাহিনীর সদস্য ছিলেন। বর্ধমান জেলার খণ্ডঘোষ থানার বীর সন্তান বলাই দত্তের নেতৃত্বে নৌ বিদ্রোহে সামিল হন।
কথায় কথায় কোথায় চলে এসেছি। কবিতা সেন্সর প্রসঙ্গে আসি। খুব বিড়ম্বনায় পড়িনি।
সমরদা প্রথম দিকে কবিতা রেখে দিতেন। দুয়েকদিন পর ফেরৎ দিতেন। একটুও কাটাকুটি না করে। পরের দিকে বলতেন, তুই কী লিখবি আমি জানি।
পার্টির সমালোচনা দরকার। স্তাবক বেড়ে যাচ্ছে। সমালোচনা জরুরি। লেখ। কেউ কিছু বললে, বলবি, সমরদা দেখে নিয়েছেন। বাকিটা আমি বুঝে নেবো!
আরেকজনের কথা মনে পড়ছে। কৃষকনেতা বিশু সেন। বিশ্বনাথ সেন। পঞ্চাশের দশকে বিএ পাশ। কৃতী ছাত্র। বাবা বর্ধমান শহরের সবচেয়ে নামী ও দামি উকিল। বাবার ইচ্ছে ছেলেও ওকালতি করুন।
ছেলে এলেন কমিউনিস্ট পার্টি করতে।
বড়লোক বাড়ির আরামদায়ক শয্যা ও ভালোমন্দ খাবার ছেড়ে থাকতে লাগলেন পার্টি কমিউনে।
বয়স হয়েছিল। কৃষক নেতা ছিলেন। একটু ঠোঁট কাটা। ধামা ধরা ইয়েসম্যান নন। সেই বিশুদাকে এক নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা ছাত্রনেতা থেকে পার্টি নেতা হওয়া নেতা, একদিন ঠিক দুপুরে ঠিক খাওয়ার আগে বললেন, বিশুদা বাড়িতে খেতে পারেন না!
৬০ বছরের বেশি বাড়ি ছাড়া মানুষ না খেয়ে ভাতের থালা রেখে বের হয়ে গেলেন। চোখের কোনে উপছানো জল নিয়ে। তারুণ্যে ঘর ছাড়া ফিরলেন বেদনা নিয়ে বৃদ্ধ বয়সে। অকৃতদার। পার্টিই তাঁর জীবন পার্টিই মরণ।
বিশুদার কথা মনে পড়লে বুক কেঁপে ওঠে।
সিপিআইয়ের অধ্যাপক নেতা জ্যোতিপ্রকাশ চট্টোপাধ্যায় ছিলেন দারুণ বাগ্মী ও সুলেখক।
তাঁর কাছে শুনেছি রণদিভে পিরিয়ডের বিপ্লবপন্থী পার্টি নেতা ভবানী সেনের শেষ জীবনের দুর্দশার কথা। সুন্দরী ধনী ঘরের মেয়ে ছিলেন তাঁর স্ত্রী। তিনি টেলিফোন করে বলতেন, দেখো চমৎকার চাঁদ ওঠেছে। ভবানী সেন বিপ্লবের ক্ষতি হবে বলে পার্টি কমিউনেই থাকতেন। স্ত্রী পরিবারের দিকে তাকাননি। পাছে দুর্বল হয়ে পড়েন, তাই ফোন রেখে দিতেন।।তাঁর লেখা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বুর্জোয়া বলা সমালোচনা নিয়ে এখনও তোলপাড় চলে। কিন্তু সে লেখা কজন পড়ে সমালোচনা করেছেন জানা নেই। ভবানী সেন, জ্যোতিপ্রকাশদার ভাষায়, ছেঁড়া পাপোষের মতো একপাশে পড়ে থাকতেন। 'ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়' বলে আসল স্বাধীনতা যুদ্ধের ডাক দেওয়া সশস্ত্র বিপ্লববাদী কমিউনিস্ট নেতা শেষ বয়সে অচ্ছুৎ।
আমার ও গৌতম রায়ের লেখা 'কমিউন কাহিনি' বইয়ে এঁর কথা আছে। আছে শিবদাস ঘোষের কৃচ্ছ্রসাধন কথা।
সে কথা আরেকদিন।