স্বপ্নে সমুজ্জ্বল সমাজতন্ত্র।
এই কথাটা মিথ্যা ছিল না হাজার হাজার মানুষের কাছে। তাই অনেকে সম্পত্তি খুইয়েছেন, জেলে গেছেন, মার খেয়েছেন, কেরিয়ার গড়েননি, কেউ কেউ চাকরি করলেও পদোন্নতি নেননি, আর ছিলেন সেই সব মানুষের দল-- যাঁরা প্রাণ দিয়েছেন কিন্তু কমরেডদের নাম বলেননি।
এমন একজন ছিলেন অনিল মাইতি। বাবার বন্ধু। বাঁশা শাঁকনাড়া অঞ্চলে পার্টি করতেন। তাঁকে জীবন্ত মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়, তবু বন্দেমাতরম বলেননি। বলেছেন, ইনকিলাব জিন্দাবাদ। কমরেডদের নাম বা গোপন আস্তানার কথা বলে দেননি।
আন্তর্জালে অনিল মাইতির নাম নেই। ছোটবেলায় খুব শুনতাম, কমরেড হতে হলে অনিল মাইতির মতো। পরে আর শুনিনি তাঁর নাম। অনিল মাইতিকে নিয়ে গান বেঁধেছিলেন বাবা। ধারানের মাঠে ১৯৭৭ এ এক জনসভায় সে গান গাওয়া হয়। সেখানেই শুনি শান্তি হাটির গান।
একী গণতন্ত্র রে ভাই
একী ভোট তন্ত্র ভাই
পরে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাধারণ কর্মচারী হিসেবেই বেঁচে থাকলেন। পার্টির গণসঙ্গীত স্কোয়াডে কিছু দিন ছিলেন। পরে সেসবে ভাটা পড়ে যায়।
গণনাট্য সঙ্ঘের বর্ধমানের কর্তা ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী আন্দোলনের নেতা। স্নাতকোত্তর ডিগ্রি ছিল না। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের সব কলকাঠি তিনিই নাড়তেন। কে অধ্যাপক হবেন কে পদোন্নতি পাবেন বিশেষ করে কে চাকরি পাবেন কর্মচারী পদে অফিসার পদে-- সে সবের দণ্ড মুণ্ডের মালিক তিনিই।
উপাচার্য যিনিই হোন, তিনিই শেষ কথা।
তবে বছরে বেশ কিছু ভালো অনুষ্ঠান দেখা যেত তাঁর সৌজন্যে।
সেগুলো সব কলকেতা থেকে নিয়ে যাওয়া।
তাঁর বৃত্তের বাইরেও বেশ কিছু ভালো প্রতিষ্ঠান বর্ধমান শহরে ছিল এইটাই রক্ষা। পার্টি নিয়ন্ত্রিত সংগঠন আর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে তাঁর ক্ষেমতা কম।
ফলে ধ্রুবতারা যোশীর মতো মানুষদের বর্ধমান শহর পেয়েছে।
পার্টি বৃত্তের বাইরে শ্যামল বরণ সাহা, রাজকুমার রায়চৌধুরী, প্রকাশ দাস, তপন চক্রবর্তী, উৎপল সাহারা বাকচর্চা-র মতো মেধাবী প্রতিষ্ঠান চালিয়েছেন। রাজ্যের দ্বিতীয় বেসরকারি বইমেলা চলেছে সমীরণ চৌধুরী, শ্যামল মুখোপাধ্যায়, শ্যামাপ্রসাদ কুণ্ডু, প্রবীর চট্টোপাধ্যায়, নিরুপম চৌধুরী, গিরিধারী সরকার, অরবিন্দ সরকার, অধ্যাপক কালীপদ সিংহসহ বহু গুণী মানুষের কর্মকৃতিত্বে।
'নতুন সংস্কৃতি' বলে সিপিআই ঘেঁষা মানুষদের একটা অসাধারণ সংগঠন ছিল। সেটিও শিক্ষণীয়। এছাড়াও ছিল বর্ধমানের বেশ কিছু ছোট সংবাদপত্র। যাঁদের প্রভাব অনেকটাই ছিল।
দাশরথি তা, সদানন্দ সরকার, সমীরণ চৌধুরী, পুরুষোত্তম সামন্ত, তারকদা, সুভাষ সাঁই, চন্দ্রনাথ তেওয়ারি, গৌতম চৌধুরী, শ্যামল মুখোপাধ্যায়, প্রবীর চট্টোপাধ্যায়, Can't চৌধুরী সহ বেশ কিছু সাংবাদিক ছিলেন বর্ধমানের উজ্জ্বল আলোক। আলোবাতাস পত্রিকা আরেক সংগঠন যাঁরা খোলা বাতাস আনতেন। বর্ধমানের চলচ্চিত্র আন্দোলন ছিল সিপিএমের প্র ভাবের বাইরে। সাত ও আটের দশকে। নয়ের দশকে সেটা পার্টির আলাদা ছাতার তলায় যায়।
রূপকদা, সমর মুখোপাধ্যায়ের দল ছিলেন চলচ্চিত্র আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব।
এইসব মানুষদের নিয়ে বই হওয়া দরকার।
রবীন্দ্রভবন ঘিরে ছিল ডাক্তার সুবোধ মুখোপাধ্যায়ের সাংস্কৃতিক অনুশীলন।
এগুলো সব সিপিএম প্রভাবের বাইরে।
ডাক্তার শৈলেন মুখোপাধ্যায় পরিচিত ছিলেন বর্ধমানের বিধান রায় বলে। তাঁর চিত্র মন্দিরে ছবি এবং ফুলের মেলা বসতো। সমর মুখোপাধ্যায় তাঁর অন্যতম প্রধান কাণ্ডারি।
সমরদা যে কী ভালো আঁকতেন।
আর একজন ছিলেন ভাস্কর মানুষ। পূর্ণেন্দু দে
তাঁর স্টুডিও ছিল অবশ্য দ্রষ্টব্য।
আর ছিল অমল বন্দ্যোপাধ্যায় রুবি বন্দ্যোপাধ্যায়ের যত্নের শিশুরঙ্গন। কত কত স্মৃতি জড়িয়ে। এঁরা অবশ্য পার্টির মানুষ। কিন্তু মনের দিক থেকে উদার।
মঙ্গল চৌধুরী, ললিত কোনার অজিত ঘোষ তিন ছিলেন নাটকের দিকপাল।
রেলওয়ে রঙ্গমঞ্চে অভিনয় করতেন।
রূপমহল/ নটরাজ সিনেমা হলেও নাটক দেখেছি অজিত ঘোষের। তিনি চলচ্চিত্রেও অভিনয় করতেন। ট্রেনে ডেলি প্যাসেঞ্জারি করেই।
পরে বর্ধমানে দেবেশ ঠাকুর নিজেই একটা প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠেন।
এছাড়া ছিল তিনটি বিজ্ঞান ক্লাব, লায়ন্স ক্লাব।
সেগুলো নিয়ে পরে লিখবো।
১৯৮০ র শীতে ডিসেম্বর মাসে বর্ধমান শহরে নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের অধিবেশন হয়।
পঁচিশ টাকা করে প্রতিনিধি ফি।
আমাদের গ্রাম থেকে বাবার নেতৃত্বে আটজন যোগ দিই। প্রণব মুখোপাধ্যায়ের মদতে সদানন্দ সরকার এই অধিবেশনের মূল দায়িত্ব নেন।
তিনি তখন একটা চার পাতার বড় আকারের দৈনিক বের করতেন। এই মুহূর্তে নামটা মনে পড়ছে না।
এই অধিবেশনে গিয়ে উপলব্ধি হয় খাওয়া দাওয়া আড্ডাই প্রধান। তবে আরও তিনটি লাভ হয়।
এক, মহাশ্বেতা দেবীকে সামনাসামনি দেখা এবং তাঁর বক্তব্য শোনা।
তিনি বলেছিলেন, বামপন্থা এখন একটা ইন্ডাস্ট্রি হয়ে গেছে।
কথাটা মনে ধরে। এবং সেই সময় তাঁকে দেখে আমারও তাঁকে ওই ইন্ডাস্ট্রির অংশ মনে হয়েছিল।
মনে হয়েছিল, তাঁর লেখা পড়াই ঠিক ছিল। না দেখলেই হতো।
পরে ২০০০-এর পর বিশেষ করে গুজরাট গণহত্যার পর তাঁর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত যোগাযোগ বেড়ে ওঠে।
এবং ধারণা বদলায়। লেখা এবং লেখিকাকে মেলাতে পারি।
দুই, একজন মহিলা সাংবাদিকের দেখি খুব কদর। তৃপ্তি ব্রহ্ম নাম। পরে কলকাতায় এসে আর পাইনি দেখতে। কিন্তু সাংবাদিকতার প্রতি আকর্ষণ বাড়ে।
তিন, আমার পোস্টার লেখার হাতের কল্যাণে আমি একটু গুরুত্ব পাই।
দূরদর্শনের সাংবাদিক গেছেন কভার করতে। প্রণব মুখোপাধ্যায় তখন দেশের অর্থমন্ত্রী। সাংবাদিক চাইছেন,নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন
এবং রবীন্দ্রভবন, বর্ধমান কথাটা ভালো করে লেখা থাক।
তখন তো ফ্লেক্স যুগ নয়।
একটা কালো ব্ল্যাক বোর্ড ছিল রবীন্দ্রভবনে।
তাতেই অনুষ্ঠানের নাম লেখা হতো।
দুয়েকজন লিখলেন, কিন্তু সাংবাদিক ভদ্রলোকের পছন্দ হচ্ছে না।
আমি দেখছিলাম।
সাহস সঞ্চয় করে বললাম, আমি একবার চেষ্টা করবো?
নবম শ্রেণিতে পড়ি।
কিন্তু পোস্টার লিখি নিয়মিত।
লিখলাম চক দিয়ে।
লিখে পুলকিত। টিভিতে দেখাবে।
দেখিয়েছিল কিনা কী করে বুঝবো।
টিভি তো দেখিনি সেভাবে।
ওই অধিবেশনে কিন্তু ব্যাপক খাওয়া দাওয়া হয়েছিল।
দারুণ সুস্বাদু রান্না। প্রতি দিন রাতে খাসির মাংস।
যত খুশি খাওয়া।
আহা রে!
হচ্ছিল কমিউনিজমের কথা দেখলেন তো চলে আসতে হল কনজিউমারিজমে!