

আমি যখন কলকাতার একটি নামী দৈনিকে কাজ করতে যাই, নয়ের দশকের মাঝামাঝি, তখন বিশিষ্ট সাংবাদিক, বর্ধমান জেলার সিপিএম সম্পর্কে জানতে চান। আমি একটি বিষয় ঠিক করে নিয়েছিলাম, আমি বর্ধমান নিয়ে কিছু বলব না, বা লিখব না।
বর্ধমান সিপিএম তখন একটা মিথ।
লালদুর্গ।
আরও দুয়েকজন সাংবাদিক ছিলেন। তাঁদেরও খুব আগ্রহ।
আমি বলতে চাই নি। পরেও বলি নি। লিখি নি। শুধু একটা বিষয় বলেছিলাম।
১৯৮৯-এ দুই শীর্ষ পার্টি নেতার সঙ্গে এক গাড়িতে আমার যাওয়ার সুযোগ হয়। এটা মাঝে মধ্যেই পরে ঘটেছে। সেদিন ছিল নতুন মারুতি গাড়ি কেনার পরের দিন। তাঁরা দু ঘন্টার পথে সদ্য কেনা মারুতি গাড়ি ও তাতে কী ধরনের তোয়ালে কেনা হবে সে নিয়ে আলোচনা করে গেলেন। এবং বলেন ড্রাইভার ছাড়া তিন জনের বেশি তোলা ঠিক হবে না। সেটিই তখন অ্যাম্বাসেডরের বাইরে প্রথম মারুতি।
আমাকে বিশিষ্ট সাংবাদিক জিজ্ঞেস করেছিলেন, তুমি এটাকে এতো গুরুত্ব দিচ্ছ কেন?
আমি বললাম, তখন টিভিতে হিটলার পূর্ব জার্মানির অপেরা নাটকের মতো রামায়ণ মহাভারত হচ্ছে, ওঁরা, তাঁদের মধ্যে একজন বড় তাত্ত্বিক বলে পরিচিত সেটা ধরতে পারছেন না কেন, উদ্বিগ্ন নন কেন, বম্বে ডাইংয়ের তোয়ালে ভালো, না, অন্যদের, সে নিয়ে ভাবিত-- এইটা আমাকে খুব ভাবায়। অবাক হই।
রাজনৈতিক পরিপক্বতা নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়ি।
আমি আর কিছু বলি নি।
তাঁদের বেশ কিছু কাজের জন্য আমি আজও শ্রদ্ধা করি।
কিন্তু একটা বিষয় বুঝতে পারি নি, দলের অন্যতম তাত্ত্বিক বলে পরিচিত নেতা কেন টিভিতে রামায়ণ মহাভারত দেখানোর বিপদটা ধরতেই পারলেন না!
পরে প্রবুদ্ধ বাগচী র একটি লেখা পড়ে পুরাতন প্রসঙ্গ লিখতে ইচ্ছে হল।
অশোক মিত্র তখন রামায়ণ, মহাভারত টিভিতে দেখানো নিয়ে বারবার উদ্বেগ প্রকাশ করছেন, ওগুলো টিভিতে দেখানোর সময় রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে, অনেকে ধূপ নিয়ে বসে পড়ছেন।
আর পার্টি জিবিগুলোতে বাবরি মসজিদের ইতিহাস বলা হচ্ছে, সম্প্রীতির কথা বলা হচ্ছে, রাম যে ঐতিহাসিক পুরুষ নন, মহাকাব্যের চরিত্র মাত্র-- তা অনেকেই বলছেন না।
নেতা তো তিনিই যে দূর দেখতে পান।
দূরকে দেখতে পাই নি, ১৯৮৭ তে যেদিন, কমিউনিস্ট পার্টির কাছেও মুচলেকা নেওয়া হল, নির্বাচনে অংশ নিতে হলে, সংবিধান মানি, এটা বলতে হবে।
বলা হল।
বিপ্লবী রাজনীতি থেকে পাকা হয়ে গেল সংসদীয় পথে যাত্রা।
কেরল এখনও আর এস এস ঠেকাতে পারছে কারণ শুধু বক্তৃতা নয়, সশস্ত্র আর এস এস ঠেকাতে যা তা করা দরকার করছে।
আমরা এখানে সব আমলেই আর এস এসকে বাড়তে দিয়েছি।
কলকাতার বহু নামী স্কুল চালায় আর এস এস।
নামগুলো শুনলে আঁতকে উঠতে পারেন। মনে রাখবেন, ভবন নামের বেশিরভাগ বিদ্যালয় সংঘ পরিবারের মতাদর্শের।
আর এস এস ট্রেনিং আগেও হতো। এখনও হচ্ছে। বেশি সংখ্যায়। বেশি শক্তিশালী হয়ে। অস্ত্র প্রশিক্ষণ দিচ্ছে।
আর হোয়াটসঅ্যাপে চলছে মানসিক অস্ত্রচালনা। দাঙ্গার ঘোরতর পরিবেশ।
লেবানন বেইরুট নিয়ে পোস্ট পাবেন না। ।বেইরুট ধ্বংস প্রায়।। ক্ষতিগ্রস্ত বেশিরভাগ মুসলিম। কিন্তু
মুসলিমদের দোষ সব-- শেখানো হচ্ছে সেখানে।
আমরা একটা ফ্যান ক্লাবের বিরুদ্ধে হাওয়া দিয়ে চলেছি।
যুদ্ধপ্রবণ মৃত্যু চিন্তক মন হয়ে গেছে।
করোনা কালে মানুষের অমানবিকতা আকাশ থেকে তৈরি হয় না।
আপনি বাঁচলে বাপের নাম-- মানসিকতা এর জন্য দায়ী।
আসুন ঘুরে দাঁড়াই।
আসুন এক সঙ্গে পা ফেলি।
মানবিকতা বাঁচিয়ে তুলি।
স্ত্রী ভাই সহ মানব সমাজ আমার পরিবার-- এই বোধ জাগাই।
দ্বিপাক্ষিকতা থেকে বের হই।
মহাভারত একটা পারিবারিক বিরোধের সম্পত্তিগত বিরোধ-- তাতে দুপক্ষই অনৈতিক। বুঝি। বোঝাই। এটা কোন ন্যায় অন্যায়ের যুদ্ধ নয়।
রাম রাজ্য মানে স্ত্রী ভাইকে বিনা দোষে ত্যাগ। এস সি এস টি হত্যার আয়োজন--বুঝি। একজন অন্যজনের বোনের নাক কেটে দিচ্ছে। প্রতিশোধ নিতে আরেকজন তাঁর বউকে তুলে নিয়ে পালাচ্ছে। দুটোই অন্যায়। অপরাধ।
পুরুষের বিরুদ্ধে লড়া কঠিন। নারীর ওপর প্রতিশোধ।
দু পক্ষের অপমানের প্রতিশোধের সহজ অস্ত্র নারীকে অপমান। নারী এবং ভূমি দখল-- অস্ত্র, অস্ত্র। বীরভোগ্যা নারী বীরভোগ্যা বসুন্ধরা-- এইসব কথা তো ভয়ঙ্কর মানবতাবিরোধী।
এটা আমরা বুঝি নি। গৌরবান্বিত করেছি।
স্বধর্মে নিধনং শ্রেয় পরধর্ম ভয়াবহ-- এই ভুল দর্শনকে মাথায় তুলে নেচেছি।
তোমার ধর্ম তোমার কাছে আমার ধর্ম আমার কাছে--,বলি নি।
বিধর্মী, কাফের, মুনাফেক, উঁচু জাত, নীচুজাত-- লিখেছি। বলেছি।
আজ বুঝি চলুন।
এবং বোঝাই।
অকারণ মহত্ত্ব আরোপ ভালো নয়।
যে মহত্ত্ব আরোপ করেছিলাম আদবানি বাজপেয়ির ওপর, ইন্দিরা বিদ্বেষে।
মারুতি গাড়ি নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সঞ্জয় গান্ধি। ইন্দিরা গান্ধির বিরুদ্ধে যে-সব দুর্নীতির অভিযোগে আকাশ বাতাস মুখর করে তোলা হয়েছিল, তার একটি মারুতি কেলেঙ্কারি।
আর দুটি নাগরওয়ালা কেলেঙ্কারি ও মুন্দ্রা কেলেঙ্কারি।
১৯৮০ তে ইন্দিরা গান্ধি আবার ক্ষমতায় ফেরার পর কাউকে এই দুর্নীতি নিয়ে একটা কথাও বলতে শুনিনি। যেমন রাজীব গান্ধির বোফর্স কেলেঙ্কারি নিয়ে শোর মাচিয়ে তাকে ভোটে হারিয়ে আদবানি বাজপেয়ির দলের আসন ২ থেকে ৮৯ করে ক্ষমতায় আসার পথে এগিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
আদবানি তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তরের মন্ত্রী থাকার সুবাদে নিজেদের বহু মানুষকে ভালো পদ দেন। অনেককে কাছে টানেন।
এঁরাই ১৯৮৭র ২৫ জানুয়ারি থেকে ১৯৮৮-র ৩১ জুলাই পর্যন্ত 'রামায়ণ' ধারাবাহিক চলায় মদত দেন।
আর প্রধানমন্ত্রী পদে থাকা অপরিণামদর্শী শাসক রাজীব গান্ধি একটার একটা ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
রাজীব ব্রিগেড বলে একটা ইয়াং ব্রিগেড তৈরি হয় দলে।
কথায় আছে, পৃথিবীতে সুপরামর্শের চেয়ে ভালো কিছু নেই, কুপরামর্শের চেয়ে ক্ষতিকর কিছু নেই।
রাজীব গান্ধির কাছের সবকটি লোক পরে বিজেপির লোক হন।
সুরিন্দর সিং আলুওয়ালিয়া এখন দুর্গাপুর বর্ধমানের সাংসদ। আরিফ মহম্মদ খান কেরালার রাজ্যপাল। সিপিএম সরকারের বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত।
অরুণ নেহরু বিজেপির নেতা হন।
রাজীব গান্ধির প্রথম ভুল শাহবানু মামলায় হেরে গিয়ে তাঁর স্বামী খোরপোশ দিতে বাধ্য বলে আদালত রায় দিলে তাকে ঠেকাতে মুসলিম মৌলবাদীদের খুশি করতে মুসলিম মহিলা বিল আনা।
এবার হিন্দু মৌলবাদীদের খুশি করতে বাবরি মসজিদের মধ্যে ১৯৪৯-এ রাতের অন্ধকারে রেখে যাওয়া রামলালার মন্দিরের তালা খুলে দেওয়া।
হিন্দু মৌলবাদীদের পোয়া বারো হল।
শুয়ে পড়া আদবানি বাজপেয়ি চাঙ্গা হয়ে উঠলেন।
রামজন্মভূমি ন্যাস কমিটি গড়ে উঠল। মাথায় রইলেন রামচন্দ্র পরমহংস। পিছনে অশোক সিঙ্ঘল, প্রবীণ তোগাড়িয়া। আর তাঁদের প্রধান মুখ তখন আদবানি। বাজপেয়ীকে ছাপিয়ে উঠতে চাইছেন। এরমধ্যেই ধুয়ো উঠল বোফর্স কেলেঙ্কারির । রাজীব গান্ধির অর্থমন্ত্রী মান্ডির রাজা বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং মন্ত্রিসভা থেকে বের হয়ে এলেন। বের হলেন আরিফ মহম্মদ খান এবং অরুণ নেহরু।
ভিপি সিং এবং আরিফ মহম্মদ খান তখন বামপন্থীদের নতুন নায়ক।
আরিফ মহম্মদ খান আগেই পদত্যাগ করেছিলেন মুসলিম মহিলা বিলের বিরোধিতা করে।
তিনি বলতে বলে এলেন সিপিএমের বর্ধমান জেলা কমিটির ডাকে। বর্ধমান টাউন হলে। হইহই করে সবাই গেলাম।
এরমাঝে এসেছে জাতীয় শিক্ষানীতি ১৯৮৬।
রাজীব গান্ধির পরামর্শদাতারা বোঝাচ্ছেন, দেশে নতুন কিছু করতে হবে।
তুমুল ছাত্র ও শিক্ষক অধ্যাপক আন্দোলন।
পড়াশোনা বন্ধ করে রাতদিন বলে চলেছি সভায় সভায় গ্যাট ডাঙ্কেল জাতীয় শিক্ষানীতি মুসলিম মহিলা বিল বোফর্স নিয়ে।
ওদিকে গ্রামে শহরে তাবলিগ জামাতের প্রভাব বাড়তে লাগলো।
আগে গ্রামের দুয়েকজন যেতেন এক চিল্লা বা দু চিল্লায় এখন সংখ্যা বাড়ল।
এক চিল্লা মানে চল্লিশ দিন ধরে ঘুরে ঘুরে ধর্মপ্রচারকের কাজ করা।
নিজের খরচে নিজের মালপত্র নিজে বয়ে মসজিদে থেকে সবাই একসঙ্গে এক বড় খাঞ্চায় খেয়ে গ্রামে শহরে ঘোরা।
এবং সবাই সমান।
বিচারপতি বা আইনজীবী বা প্রধান শিক্ষক বা চাষি কোনও ভেদাভেদ নেই।
সমতার ভিত্তিতে চলা।
ওদিকে কমিউনিস্ট পার্টিতে সমতা কমছে। নেতাদের আলাদা থাকার জায়গা। খাওয়ার জায়গাও সম্মেলনে আলাদা হচ্ছে। মঞ্চে নেতাদের জন্য আলাদা কাপে একাধিকবার চা। বাকি কমরেডদের মাটির ভাঁড়।
মুসলিমদের একটা অংশ তাবলিগ জামায়াতের ভিড়তে লাগলেন আদর্শগতভাবে।
আগে বর্ধমানে বা অন্যত্র দেখেছি, শিক্ষিত মুসলিম মানেই বামপন্থী। আগে হয়তো নামাজ রোজা করতেন এসএফআইয়ের সংস্পর্শে এসে সেসব বাতিল। ১৯৮৯-এর পর উলটপুরাণ শুরু হল।
কেন?
১৯৮০ থেকেই আর এস এস নানা নামে কাজ করতে শুরু করে।
ভারত সেবাশ্রম ইত্যাদি সংগঠন ছিলই।
তরুণ প্রজন্ম এবং শিক্ষিত সমাজের মানুষের কাছে পৌঁছাতে আকাশবাণীর প্রণবেশ চক্রবর্তী সামনে এলেন। গড়ে তুললেন বিবেকানন্দ ভাবানুরাগী সমিতি।
জেলায় জেলায় ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে বিতর্ক তাৎক্ষণিক বক্তৃতা শুরু হল। বামপন্থীদের কায়দায়।
আমিও এইভাবে জুটলাম বিবেকানন্দ ভাবানুরাগী সমিতিতে।১৯৮২তে। বর্ধমান টাউন হলে হল বিরাট বিতর্ক তাৎক্ষণিক আলোচনা।
আমি প্রতিযোগিতায় সফল হলাম। 'যুগান্তর' কাগজে আমার নাম ছাপলেন সাংবাদিক নিরুপম চৌধুরী। স্বভাবতই খুব উত্তেজিত। যে কাগজ ছোট থেকে পড়ছি, সেখানে নাম।
আমার মতো এই ঘটনা নিশ্চয়ই আরও কিছুজনের ঘটেছে।
আমার সঙ্গে আমাদের পাশের গ্রাম পলাশনের একজন বর্ধমান মিউনিসিপ্যাল স্কুলে পড়তেন। এক ক্লাস আগে। তাঁকে দলে ভেড়ালাম। দুয়েকটি সভায় গেলাম একসঙ্গে।
এর কিছুদিন পর দেখি, সে আমাকে এড়িয়ে চলছে। বৈঠকে তাঁর ডাক পড়ছে। আমার নয়। অথচ বিবেকানন্দ নিয়ে তাঁর চেয়ে আমি অনেক বেশি পড়েছি। সে তো প্রতিযোগিতায় কিছুই হয়নি।
আর কিছুদিন পর যেখানে কমিউনিস্ট পার্টি ও নকশালদের বিরাট বিরাট দেওয়াল লিখন হতো, সেই জিটি রোডের ধারে বর্ধমান মিউনিসিপ্যাল স্কুলের চারশো ফুট লম্বা ১৫ ফুট উঁচু দেওয়ালে বিরাট বিরাট করে কালো কালিতে পেশাদারি লেখা-- গর্বের সঙ্গে বলো আমি হিন্দু।
তলায় লেখা বিবেকানন্দ।
এবং নতুন নাম শুনলাম বিশ্বহিন্দু পরিষদ।
স্কুলের দারোয়ান বললেন, দেওয়াল লেখার তদারকি করেছেন অনেকের সঙ্গে আমার চেনা পলাশনের সেই নিরীহ দাদাটি।
r2h | 208.127.***.*** | ০৬ এপ্রিল ২০২৪ ২০:১৫530300
b | 117.194.***.*** | ০৬ এপ্রিল ২০২৪ ২০:৩৮530301
Guruchandali | ০৬ এপ্রিল ২০২৪ ২০:৪২530302
r2h | 208.127.***.*** | ০৭ এপ্রিল ২০২৪ ০২:৫০530322
r2h | 208.127.***.*** | ০৭ এপ্রিল ২০২৪ ০২:৫৯530324
&/ | 151.14.***.*** | ০৭ এপ্রিল ২০২৪ ০৩:১২530326
অরিন | 119.224.***.*** | ০৭ এপ্রিল ২০২৪ ০৩:৫১530328
অরিন | 119.224.***.*** | ০৭ এপ্রিল ২০২৪ ০৪:০৪530329
&/ | 151.14.***.*** | ০৭ এপ্রিল ২০২৪ ০৪:১৬530330
r2h | 165.***.*** | ০৭ এপ্রিল ২০২৪ ০৪:২০530331
&/ | 151.14.***.*** | ০৭ এপ্রিল ২০২৪ ০৪:৩৩530332
অরিন | 119.224.***.*** | ০৭ এপ্রিল ২০২৪ ০৫:১৩530333