শহর আর গ্রাম যে অনেক আলাদা পদে পদে বোঝা যেত লাগল।
গ্রামের আশির দশক পর্যন্ত বৈশিষ্ট্য ছিল, যে যাকে পছন্দ করে না, তার সঙ্গে বাক্যালাপ করে না।
শহরে ব্যবহার দেখে বোঝা মুশকিল কে কাকে পছন্দ করে আর কাকে না-পসন্দ।
আমার এক কাছের মানুষ বলতেন, শহরে কোনটা সৌজন্য আর কোনটা আন্তরিকতা বুঝতেই ছয় বছর লেগে যায়।
আমার বোঝার খুব চেষ্টা সেদিনও ছিল না, আজও আছে বলে মনে হয় না। একটু ভালো করে কথা বললেই আমি ভুলে যাই। এছাড়া কার সঙ্গে কথা বলব না বলে প্রতিজ্ঞা করেছি, তাই মনে থাকে না।
ফলে লাভ লোকসান দুটোই হয়।
বর্ধমান শহরে আমার থাকাকালীন লাভের পরিমাণ বেশি। দুতিনজন ছাড়া কারও সঙ্গে আমার কথা বন্ধ থাকে নি কোনওদিন।
আমি যে বাড়িতে থাকতাম, তার মালিক, শহরের সিটু বিড়ি ইউনিয়নের দপ্তর সম্পাদক। সিটুর তিন নেতাকে আমি সব সময় নীল তথা আকাশি চাইনিজ পাঞ্জাবি পরতে দেখেছি-- একজন হারাধন রায়, কয়লা খনি অঞ্চলের বিখ্যাত শ্রমিক নেতা, দুই বর্ধমান শহরের অতি সৎ শ্রমিক নেতা কালীশঙ্কর পাল এবং ওই ভদ্রলোক।
তিনি মাসে ৫০০ টাকা করে পেতেন। ওই টাকায় ছেলে মেয়ে নিয়ে কী করে সংসার চালাতেন ভেবে পাই না।
আবার আমার থাকার জন্য কোনও পয়সাও নেননি।
একজন ছাত্র থাকবে--আবার পয়সা দেবে -- এ হয় নাকি, এই মনোভাব।
এইসব অসাধারণ মানুষরা ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির সম্পদ। খুব কম কথা বলতেন। বর্ধমান স্টেশন লাগোয়া এলাকাটি ছিল কংগ্রেসের ঘাঁটি। সেখানেই ছিল বিড়ি শ্রমিকদের দপ্তর। বর্ধমানে দুটি বিড়ির খুব খ্যাতি ছিল। একটি কলেজ বিড়ি। কলেজ ছাত্রদের জন্য বিশেষ করে তৈরি। আর একটি খেটে খাওয়া মানুষের জন্য, সিটু বিড়ি।
সিটু বিড়ি কারখানার একটু পাশেই ছিল, সর টোস্টের একটা অনবদ্য দোকান। খাঁটি দুধের সর দিয়ে তৈরি টোস্টের সন্ধান আমি আর কোথাও পাইনি।
আর ছিল শোনপাপড়ি তৈরির কারখানা। এই শোনপাপড়ি মোটেও হলদিরাম মার্কা স্থূল গ্যাদগ্যাদে ধরনের নয়। সূক্ষ্ম সব পাতলা আস্তরণ। মুখে দিলে গলে যায়। একটা অন্যরকম পাতলা কাগজের ভাঁজে ভাঁজে সেই শোনপাপড়ি মিলতো।
কলকাতায় আর্মহার্স্ট স্ট্রিটে সিটি কলেজের গলিতে ওই শোনপাপড়ির শেষ সংস্করণ দেখেছি। কেউ এইরকম শোনপাপড়ির সন্ধান দিলে বিরিয়ানি খাওয়াতে পারি।
কাছেই ছিল নটরাজ হল। নটরাজ হল অবশ্য আশির দশকের মাঝে তৈরি। বর্ধমান শহরে চারটি হল ছিল। আরতি (পরে অনীতা), বিচিত্রা, রূপমহল এবং বর্ধমান।
পরে একে একে হল, নটরাজ এবং স্টার।
নটরাজ নিজেদের জাত আলাদা বোঝাতে রবিবার সকাল নয়টায় হলিউড বা আর্ট ফিল্ম শুরু করে।
এই নটরাজ হলে ছবি দেখতে গিয়ে দেদার শোনপাপড়ি ও সর টোস্ট খেয়েছি। শোনপাপড়ির দাম ছিল ১০ পয়সা প্রতি পিস। টোস্ট ৩৫ পয়সা।
নটরাজ সিনেমার উল্টোদিকে ছিল বিখ্যাত খৈনির দোকান। এত খৈনি বিক্রি হতো কহতব্য নয়। তার থেকে একটু দূরে হলুদ মলাটের বইয়ের দোকান। সাংবাদিক জীবনে এই দোকানের বিরুদ্ধে লিখেছি। তাতে দু চারদিন বন্ধ থাকলেও আবার যে কে সেই।
কার্জন গেট তখন রামপ্রসাদের শরবত, ঠান্ডা কফি আর লস্যির জন্য প্রসিদ্ধ। কফি খাওয়া বর্ধমানে বিলাসিতা বলেই গণ্য হতো। তেমন ছিল পাইপে সিগার খাওয়া। খুব কম লোক খেতেন। চুরুট খাওয়া মানুষ বর্ধমানে দেখেছি বলে মনে পড়ছে না।
প্রমোদ দাশগুপ্তের চুরুট খাওয়া তখন খুব বিখ্যাত গল্প। আমি এগার ক্লাসে পড়তে পড়তেই সিপিএমের দোর্দণ্ডপ্রতাপ সম্পাদক প্রমোদ দাশগুপ্ত মারা গেলেন। তাঁর চিকিৎসার জন্য বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তাঁর সঙ্গে চীন গিয়েছিলেন। চীনেই মারা যান। তাঁর মরদেহ দেখবো বলে কলকাতা চলে এলাম। মৌলালিতে মাসতুতো দাদাদের কাছে থাকা। ওখানেই থাকতে এলেন খণ্ডঘোষের লড়াকু নেতা মহফুজ ভাই। বিরাট বিরাট লাইন পেরিয়ে প্রমোদ দাশগুপ্তকে দেখলাম।শেষযাত্রার মিছিলে হাঁটলাম। তারপর ব্রিগেডে শোকসভা।
সব মিলিয়ে সাতদিন কলকাতায়। পড়াশোনা লাটে।
কমরেড তুমি ঘুমাও, আমরা আছি লাখো অযুত -- লেখা ছাত্র ফেডারেশনের মুখপত্র 'ছাত্র সংগ্রাম' একাধিকবার ছাপতে হয় চাহিদার জোগান দিতে। হাজার হাজার মানুষ ঘন্টার পর ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেছেন প্রমোদ দাশগুপ্তকে দেখবেন বলে।
আমরাও তাই।
শেষকৃত্যের কয়েকদিন পর স্মরণসভা। কী করা যায়? মহফুজ ভাই বললেন, চলো কলকাতায় ঘুরি।
প্রথমদিন নিয়ে গেলেন দমদম বিমানবন্দরে। তখন পাঁচ টাকার টিকিট কেটে সারাদিন বিমানের ওঠানামা দেখা যেত। সারাদিন বসে বসে দেখলাম। নতুন একটা জগৎ। তখনই শুনলাম, ১৫ আগস্টে নাকি ৫০ টাকায় কলকাতা ঘুরিয়ে দেখায়।
এখন মনে হচ্ছে, ৫০ নাকি ৫০০?
তবে টাকাটা যাই হোক, আমার সেদিন মনে হয়েছিল, ওই টাকা জোগাড় করে একবার প্লেনে চাপতেই হবে।
সে ইচ্ছা পূরণ হল, ২৫ বছর পর।
প্রমোদ দাশগুপ্ত ছিলেন সিপিএমের দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা।
১৯৬৪তে দলের প্রতিষ্ঠা থেকে আমৃত্যু সম্পাদক। বলা হতো, জ্যোতি বসুর প্রতইদ্বন্দ্বী। জ্যোতি বসুর ঘরানা আর তাঁর ঘরানা সম্পূর্ণ আলাদা। জ্যোতি বসু রাজনীতির উত্তমকুমার হলে প্রমোদ দাশগুপ্ত হলেন কট্টর। মুখে চুরুট তাঁকে এক আলাদা মাত্রা দিয়েছিল। যদিও কমিউনিস্ট পার্টির সর্বক্ষণের কর্মীর চুরুট খাওয়ার বিলাসিতা হয় কী করে, এই প্রশ্ন কেউ করতে সাহস করেনি। নিজের জামাকাপড় নিজে কাচতেন। জ্যোতি বসুর ঘনিষ্ঠদের কাছে শুনেছি, জ্যোতি বসুও নিজের জামাকাপড় নিজেই কাচতেন। সে-নিয়ে কোনও প্রচার ছিল না। তিনি মাথাও ঘামাতেন না। কে কী বলল, লিখল, পরোয়া করতেন না জ্যোতি বসু। প্রমোদ দাশগুপ্তও ছিলেন তাই। পার্টিকে ক্ষমতায় আনার পিছনে তাঁর অবদান সবচেয়ে বেশি বলে মনে করা হতো।
আসলে সিদ্ধার্থ রায়ের জমানার ওপর লোকে এত বিরক্ত ছিল, কংগ্রেসকে হারতেই হতো। প্রমোদ দাশগুপ্ত নিজেও তাই বলতেন। পার্টির মূল্যায়নও ছিল, নেগেটিভ ভোটে জয়।
প্রমোদ দাশগুপ্তের মৃত্যুর পর একটা লেখা বহুবার মুদ্রিত হয়েছিল, অ্যাস্টাব্লিশমেটকে ব্যবহার করেই মূল অ্যাস্টাব্লিশমেন্টকে ভাঙতে হবে।
সে আর হল কই!
৩৪ বছর ক্ষমতায় থেকে নিজেরাই প্রতিষ্ঠান হয়ে গেল।
সিপিএম আগে ছিল বিপ্লবী পার্টি। ১৯৭৮ এ প্রমোদ দাশগুপ্ত বললেন, পার্টি হল বিপ্লবী গণপার্টি।
আগে পার্টি সদস্য কে, তা বাড়ির লোককেও বলা ছিল নিষেধ। আস্তে আস্তে চায়ের দোকানে বসা লোকও জেনে গেল, আজ ব্রাঞ্চের মিটিং। আর কে সিএম, কে পিএম, কে এজি।
সিএম মানে ক্যান্ডিডেট মেম্বার বা প্রার্থী সদস্য। পিএম পার্টি মেম্বার। এজি মানে সহায়ক সদস্য।
আগে বলা হতো, ১২ বছর ব্যাগ বইলে তবে পার্টির এজি মেম্বার হওয়া যায়!
আস্তে আস্তে ছাত্র নেতারা দু চার বছরেই পার্টি সদস্য হয়ে যেতে লাগলেন।
আর দলে কৃষক নেতা শ্রমিক নেতা খেতমজুর নেতাদের চেয়ে ছাত্রনেতাদের রমরমা বৃদ্ধি প্রমোদ দাশগুপ্তের ভুল নীতিতেই।
কমিউনিস্ট পার্টিতে গ্রুপবাজি একটা স্বতঃসিদ্ধ ঘটনা।
প্রমোদ দাশগুপ্ত ছিলেন গ্রুপবাজির মাস্টার। কিন্তু দলের ওপরে বিটি রণদিভে পি সুন্দরাইয়া ইএমএস নাম্বুদ্রিপাদের মতো নেতারাও ছিলেন।
আর দলে স্বাধীনতা সংগ্রাম করা জেল খাটা বহু নেতা তখন।
আসানসোলের বিজয় পাল যেমন পড়াশোনা তেমন সংগঠক। হুগলির বিজয় মোদক মেদিনীপুরের সুকুমার সেনগুপ্ত বিরাট কৃষক নেতা। নীরেন ঘোষ দাপুটে শ্রমিকনেতা। সুধাংশু দাশগুপ্ত তাত্ত্বিক। পার্টির তাত্ত্বিক মুখপত্র 'দেশহিতৈষী'র সম্পাদক। গণশক্তি-র তখন এত ক্ষমতা নয়। সান্ধ্য দৈনিক নম নম করে বের হয়। দেশহিতৈষী সাপ্তাহিক। ষাট থেকে সত্তর হাজার প্রচার সংখ্যা।
সেখানে নিয়মিত সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে লেখা বের হয়।
নীরেন ঘোষ তখনও বিপ্লব হবে বলে বিশ্বাস করেন।
বর্ধমান জেলায় হরেকৃষ্ণ কোঙারের অনুগামী কৃষক নেতা রামনারায়ণ গোস্বামী, মাহবুব জাহেদি, বিনয় কোঙার দাপুটে নেতা।
প্রমোদ দাশগুপ্ত রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীতে নিজের গ্রুপের প্রাধান্য বাড়াতে চারজনকে রাজ্য নেতৃত্বে নিয়ে এলেন। সবাই ছাত্র ও যুব আন্দোলন থেকে আসা।
বিমান বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, শ্যামল চক্রবর্তী।
সুভাষ চক্রবর্তী অবশ্য পিছনে পড়ে গেলেন। জ্যোতি বসু ভক্ত হিসেবে। আর অনিল বিশ্বাসের উত্থান ঘটল সরোজ মুখোপাধ্যায়ের হাত ধরে।
এখন তো সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সব সদস্যই ছাত্র রাজনীতি থেকে উঠে আসা।
কোনও কৃষক বা শ্রমিক আন্দোলন করে সরাসরি উঠে আসা কেউ নেই।