রেডিও ভালো করে শোনার জন্য সোনালি রঙের যে নরম তারের বোনা লম্বা জাল থাকতো, দুই থেকে আড়াই ইঞ্চি চওড়া, যা দিয়ে রেডিও তরঙ্গ পৌঁছাতো রেডিওতে তার নাম ছিল এরিয়াল। গত শনিবার দুপুরে লেখার সময় কিছুতেই মনে পড়ছিল না।
হঠাৎ শতরূপা সান্যালের বর্ধমান শহরের বাড়ির স্মৃতিচারণে মনে পড়ল। আর একটা কথা ৩০ আগস্টের লেখায় সামান্য সংশোধনী: পাঁচটা পঞ্চান্ন মিনিটে রেডিওর অনবদ্য ভাব সঙ্গীত স্রষ্টা ওয়াল্টার কাউফম্যানের পিয়ানো বাজানোর সঙ্গে বেহালায় সঙ্গত করা শিল্পী ছিলেন জুবিন মেহতার বাবা। ইহুদি মেনুহিনের নয়। রেডিওর ভাব সঙ্গীত স্রষ্টা ওয়াল্টার কাউফম্যান সম্পর্কে আরও কিছু কথা বলা যাক। ওয়াল্টার কাউফম্যানের জন্ম কার্লসবাদে। এখন তার নাম বদলে হয়েছে কার্লোভি ভ্যারি। ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে। দেশের নাম চেকোস্লোভাকিয়া। তিনি ইহুদি। ইউরোপ জুড়ে ইহুদি বিদ্বেষ ও নির্যাতনের কারণে চলে আসেন ভারতের মুম্বাইয়ে। এখন তো উলট পুরাণ। ভারতে চলছে মুসলিম বিদ্বেষ প্রচার। ইহুদিবাদী রাষ্ট্র ইজরায়েলের ধাঁচে মুসলিম নিপীড়নের চেষ্টা হচ্ছে। ১৯৩৪-এ এলেও ১৯৩৬-এ ব্রিটিশ সরকারের অল ইন্ডিয়া রেডিওতে যোগদান। ১৯৪৬ পর্যন্ত এখানে কাজ করেন। ১৯৪৬-এ চলে যান ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সঙ্গীত অধ্যাপকের কাজ নিয়ে। ১৯৭৭-এ অবসর। মারা যান ১৯৮৪তে।
আগের সপ্তাহে যে রেডিওর অজিত মুখোপাধ্যায়ের চিঠি দিয়েছি, সেই অজিত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার আলাপ চুল কাটতে গিয়ে। করুণাময়ীতে থাকার সময় আমি একটা সেলুনে চুল কাটতে যেতাম। সেখানে বসে থাকতে থাকতে ফোন আসে শম্ভু মিত্রের শেষকৃত্য সম্পন্ন করা অধ্যাপক শিবনাথ চট্টোপাধ্যায়ের। শিবনাথ চট্টোপাধ্যায়দা খুব আড্ডাবাজ মানুষ ছিলেন। সুরসিক। পড়াশোনা করা মানুষ। চমৎকার কণ্ঠ। ভাষা ও চেতনা সমিতির শুরুতে আমাদের সঙ্গে ছিলেন। শিবনাথ চট্টোপাধ্যায়দা মাঝে মাঝে আড্ডা মারতে চলে আসতেন ফোন করে। আমিও যেতাম। আমাদের কথা শুনে অজিতবাবু বলেন, শম্ভু মিত্রকে আমি চিনতাম।
বলেন কী?
তখনই জানলাম, তিনি ছিলেন আকাশবাণীর নাট্য প্রযোজক। নামটি শোনা।
শুনলাম, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, তৃপ্তি মিত্র, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়সহ বহু নাট্যব্যক্তিত্বের কথা। উত্তমকুমারের মহালয়া করার কথা।
রেডিওতে মহালয়া শোনা ছিল একটা বড় বিষয়। কিন্তু আমাদের গ্রামে এর প্রচলন দেখিনি। সেহারাবাজার স্কুলে পড়তে গিয়ে এবং খবরের কাগজে লেখা পড়ে ও 'বেতার জগৎ' পড়ে অনুপ্রাণিত হই। আমি আর দীনু শিবু জামাইয়ের মাইক ১০ টাকা দিয়ে ভাড়া করে মহালয়ার ভোরে আমাদের বৈঠকখানায় চালিয়ে দিই।
মহালয়া আমি আজও শুনি। যদিও ইদানীং অসুরদের নানা ভাষ্য শুনে একটু দ্বিধা তৈরি হয়েছে, তবু শুনি। শুনতে খুব ভালো লাগে।
মহালয়া আমি বহু জায়গায় শুনেছি।
তবে সবচেয়ে মনে পড়ে শান্তিনিকেতনে নির্জন খোয়াইয়ে হাঁটতে হাঁটতে মহালয়া শোনা।
খোয়াইয়ে যে কত কত স্মৃতি। সব কী লিখতে পারবো কোনওদিন?
'অবিরাম পাঁউরুটি ভক্ষণ' নাটক শুনে আমি ফিদা হয়ে গিয়েছিলাম। যেমন ঘোর লেগেছিল, উৎপল দত্তের 'তুরুপের তাস' আর শাঁওলি মিত্রের 'নাথবতী অনাথবৎ' দেখে। তারপর শাঁওলি মিত্রের সব নাটক দেখতাম। 'বিতত বিতংস' দেখে একটু হতাশ হই।
তবে প্রতুল মুখোপাধ্যায়, সুমন চট্টোপাধ্যায়, বিপুল-অনুশ্রী, গণবিষাণের ক্যাসেট উপহার দেওয়ার পাশাপাশি বেশি দাম দিয়ে সুচিত্রা- আমজাদ যুগলবন্দি ও 'নাথবতী অনাথবৎ' উপহার দিয়েছিলাম সামর্থ্য অনুযায়ী।
তৃপ্তি মিত্রের নাটক শুনেছি। দেখেছি সামনাসামনি একাধিকবার। মুখে মুখে শুনে তৃপ্তি মিত্রের প্রতি বাড়তি সহানুভূতি ছিল বিচ্ছেদের কারণে। কাটোয়া শহরে প্রথম 'অপরাজিতা' একক অভিনয় দেখি (নামটা কি ভুল বললাম?) । কাটোয়া গিয়েছিলাম জেলা যুব উৎসবে। বর্ধমান শহরের পক্ষ থেকে। বিতর্ক ও কোলাজ প্রতিযোগিতায়। সেখানে তৃপ্তি মিত্রের নাটক আয়োজন করেছিল পশ্চিমবঙ্গ যুবকল্যাণ দপ্তর। আশির দশকে।
রেডিওর মানুষদের দেখা একটা বিরাট ব্যাপার ছিল তখন। রেডিওর কোনো মানুষকে প্রথম দেখি ১৯৮১-তে। সেকালে কোনও শিল্পীর পাশে বেতার খ্যাত লেখা মানে বিশাল ব্যাপার। ১৯৭৫-এ কলকাতায় টিভি এল। এর ১০ বছর পর মফস্বলে ভালো করে টিভি ছড়াল। বিশেষ করে রাজীব গান্ধীর কল্যাণে দূরদর্শনে রামায়ণ ধারাবাহিক সম্প্রচার হওয়ার পর। তার আগে টিভির গুরুত্ব ছিল বিশ্বকাপ ফুটবল ক্রিকেট ম্যাচ সংবাদ আর চিত্রহারে। মারাদোনা এবং আর্জেন্টিনা দলের জন্যও টিভি বিক্রি বেড়েছে ১৯৮৬ বিশ্বকাপের সময়।
টিভি কোম্পানিগুলোর উচিত মারাদোনার পরিবারকে পয়সা দেওয়া এবং রামানন্দ সাগরের পরিবারকে। তার চেয়েও বেশি রাজীব গান্ধীর পরিবারকে। স্যাম পিত্রোদার সহায়তায় তথ্য ও সম্প্রচার ভারতে এক উন্মাদনা সৃষ্টি করে। এর সঙ্গে যোগ দিলেন প্রণয় রায়। প্রতি শুক্রবার রাতে বিশ্ব সংবাদের এক নতুন জগৎ খুলে দিলেন। খুল যা সিম সিম। যা টিভি দেখা অন্যায় মনে করতেন সেই বামপন্থীদের পরিবারেও টিভি ঢুকল। মানে ঢোকার একটা নৈতিক মতাদর্শ খাড়া করা গেল। প্রণয় রায় দেখা দরকার-- কী ভালো যে করছে লোকটা।
ওই শুক্রবার রাতেই ক্ষুধিত যৌবনের জন্য এল একটু যৌনগন্ধী চলচ্চিত্র।
শশী কাপুরের 'হিট অ্যান্ড ডাস্ট' তো রাতের ঘুম কেড়ে নিল অনেকের। চুমু আছে ভাই
ভাবা যায়।
তখন সেই গল্পের যুগ: একজন ছবি দেখতে গেছে। দেখছে একজন সুন্দরী শাড়ি খুলছে স্নান করবে বলে। তখনই ট্রেন চলে আসছে। এবং তিনি রোজ যান, একদিন কি ট্রেন দেরি করে আসবে না?
রাজ কাপুর মন্দাকিনীকে ঝর্ণার জলে স্নান করিয়ে সিক্ত বসনা করে অতৃপ্ত আত্মাদের আরও অতৃপ্ত করবেন 'রাম তেরি গঙ্গা মইলি' বানিয়ে। গ্রামে তো তখন মহিলারা ৯৯ শতাংশ ব্লাউজ পরেন না, ঘরের মধ্যে। পুকুরে চান করেন সিক্ত বসনা হয়ে। কিন্তু সেসব দেখা তখন ঘোর নিন্দার বিষয়। গ্রামে দুই শতাংশ বাড়িতেও তখন নিজেদের নলকূপ নেই। পুকুর ভরসা। এই আশির দশকেই হামলে পড়বে ভিডিও পার্লার। 'টেন কমান্ডমেন্টস' যেমন দেখাবে তেমনি আয়োজন নীল ছবির। এমনিতে টিকিট চার আনা। ওইসব হলে আট আনা।
আমি কখনও ভিডিও হলে ছবি দেখিনি। ফলে আমার বন্ধুদেরও দেখা হয়নি।
একবার 'টেন কমান্ডমেন্টস' দেখতে গিয়ে আমার জন্য ওরাও ফিরে এল। মনে হয় এখন, ঠিক করেছি না ভুল করেছি?
চটে ঘেরা হতো ভিডিও পার্লারগুলো।
তারপর আস্তে আস্তে মধ্যবিত্ত বাড়িতে আশির দশকেই ভিডিও প্লেয়ার ঢুকে গেল।
আজ যেমন পাড়ায় বিরিয়ানি আর মোবাইলের দোকান তখন গড়ে উঠেছিল ভিডিও ক্যাসেট ভাড়া দেওয়ার দোকান।
বাংলা হিন্দি এবং নীল ছবি গোপনে-- সব পাওয়া যেত।
নব্বই দশকে কম্পিউটার এবং ফ্লপি এসে মৃত্যু ঘোষণা করল ভিডিও প্লেয়ার ও রেকর্ডারের।
বিয়ে বাড়িতে ভিডিও দেখানো ছিল একটা বিরাট আকর্ষণ।
গুরুদক্ষিণা, সাড়ে চুয়াত্তর, শত্রু এবং অঞ্জন চৌধুরীর মারকাটারি বহু ছবির ব্যাপক চাহিদা ছিল বিয়ে ও সামাজিক অনুষ্ঠানে।
গ্রামে বা বাজারে আগে সিনেমা হতো ষোল মিলিমিটার যন্ত্রে। ঘর্ঘর আওয়াজ আর চটে ঘেরা আয়োজন বদলে গেল ভিডিও ক্যাসেটে।
যাক, আবার রেডিওর কথায় ফেরা যাক।
বেতার শিল্পী হিসেবে আমাদের এলাকায় খ্যাত ছিলেন দুজন। সাধন বৈরাগী এবং শওকত আলী।
দুজনেই কমিউনিস্ট পার্টি করার সুবাদে বাবার ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
১৯৮১-তে দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় ছাত্র নেতা হিসেবে আমরা একটা ছাত্র সংসদ গড়ার দাবি আদায় করে ফেলেছি। নাম সাবকমিটি। আমি সাধারণ সম্পাদক। কার্যত সেটা ছাত্র সংসদ।
আজ বহু বিদ্যালয় দেখি নানা ধরনের দায়িত্ব ছাত্র ছাত্রীদের দিচ্ছেন।
তখন এটা বিরল ছিল।
আমরা রবীন্দ্র নজরুল সুকান্ত জয়ন্তী পালন করলাম।
সেখানে শওকত চাচা গাইলেন মূলত নজরুলের গান এবং দুয়েকটি রবীন্দ্র সঙ্গীত। বিদ্যালয়ের বন্ধুরা সে অভাব পুষিয়ে দিল। শেষে হল লালন গীতি এবং নানা ধরনের বাউল গান। সাধন বৈরাগীর।
আমরা ছাত্র ছাত্রীদের কাছে পাঁচ দশ পনের পঁচিশ পয়সা করে চাঁদা আদায় করেছিলাম।
দুই শিল্পীকে পঁচিশ টাকা করে পঞ্চাশ টাকা, মাইক পঁচিশ টাকা আর দশ টাকা পোস্টার ও হ্যান্ড বিলে।
মোট নব্বই টাকা চাঁদা তোলা বিরাট ব্যাপার তখন।
মঞ্চ সেকালের প্রথামতো নিজেরাই গড়েছিলাম। কয়েকটা চৌকি। তাতে চেয়েচিন্তে আনা শতরঞ্জি বিছানো। আর পিছনে বাঁশ বেঁধে বিছানার চাদর জুড়ে মঞ্চ। টেবিল তো স্কুলেই আছে।
এখন প্রয়াতা কামনা, গোলোকবাবুর মেয়ে, সুন্দর একটা টেবিল ক্লথ এবং ফুলদানি এনে সাজিয়ে দিলে। স্কুলের শিক্ষকদের আবাসন ছিল। ছিল ছাত্রদের থাকার জায়গা। সেখানে অশোক করবী গন্ধরাজ শিউলির রাজত্ব।
সেই দিয়ে সাজানো। বাড়ি থেকে আমি পেতলের গোলাপদানি আর গোলাপজল নিয়ে গিয়ে ছিলাম। সবার গায়ে ছড়িয়ে দিলাম।
আর একটা কথা ভুলে গিয়েছিলাম। আমার দু একজন খুব ধনী ঘরের ছেলে মেয়ে অনুরাগী ছিল। তাঁদের সৌজন্যে সবার জন্য বাতাসা ও নকুল দানার আয়োজন করা গিয়েছিল। ইচ্ছে ছিল চপ আনার। হয়নি।
তখন গ্রীষ্মকালীন সময়। সকালে স্কুল হতো। সবাই মুড়ি আনতো। সবাই মুড়ি নিয়ে এসেছিল। মুড়ি বাতাসা আর নকুল দানা-- আহা স্বর্গীয় স্বাদ। সাধন বৈরাগী এবং শওকত চাচার জন্য দানাদার ও রসগোল্লার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তাঁরা বললেন, আমরা বেতার শিল্পী হলেও কমিউনিস্ট।
আলাদা খেতে পারবোনি।
আমাদের সঙ্গে বসে জল দিয়ে মুড়ি ভিজিয়ে খেলেন। বাতাসা ও নকুল দানা কামড়ে কামড়ে।
সেইসব দিন কি একেবারেই গেছে?