বাড়িতে রেডিও থাকা বিশ শতকের ষাট ও সত্তর দশকে ছিল কৌলীন্যের পরিচয়। তখন ফ্রিজ এসি ফোন মোবাইল ছিল স্বপ্ন। বাংলার আশি ভাগ গ্রামে বিদ্যুৎই ছিল না। শহর বাজার এবং হাট বা গঞ্জ এলাকায় বিদ্যুতের তার দেখা যেত। বহু এলাকায় বিদ্যুৎ থাকাটাই ছিল খবর। না থাকাটা নয়। মফস্বলে ঝড় বৃষ্টির সম্ভাবনা দেখা দিলেই বিদ্যুৎ বাবাজি উধাও। রেডিও ছিল আমাদের গ্রামে কেন সব গ্রামেই খুব কম ঘরে। রেডিওর মধ্যে বিখ্যাত তখন ফিলিপস। বুশ মারফি পরে এসেছে। ফিলিপস রেডিও ছিল আকারে বেশ বড়। কাঠের তৈরি। আমাদের আর ফনু দাদোদের বাড়িতে ছিল। পাশের বাড়িতে ছিল একটা ছোট রেডিও। কিন্তু তার আওয়াজ ছিল চমৎকার। শনিবার ও রবিবার ঘরের জানালায় লাগিয়ে দিত। খেলার মাঠ গোলামহলে একটা বড় জাম গাছ ছিল। রোদ কমে গেলে লোকে ভিড় করতো রেডিও নাটক শোনার জন্য। বুধবার সন্ধ্যা সাতটায় হতো যাত্রাপালা। সেটা শুনতেও লোকে রেডিও থাকাদের বাড়ি যেত। কিছু মানুষ জামতলায় কিছু মানুষ দুগোদার মুদির দোকানের দাওয়ায় ভিড় জমাতেন।
রেডিও চালানোর ঝকমারি ছিল অনেক। রেডিওতে অ্যান্টেনা উঠিয়ে প্রায় ২০ থেকে ৩০ ফুট একটা সোনালি রঙের জালি দেওয়া তার থাকতো, সেটা মাঝে মাঝে নাড়াতে হতো। নাহলে সিগন্যাল ভালো পাওয়া যেতো না। রেডিও চালানোর জন্য সরকারের কাছে আবেদন করে লাইসেন্স নিতে হতো। যাদের বড় রেডিও তাঁদের দিতে হতো বার্ষিক ২০ টাকা। মাঝারি রেডিওর ১২ টাকা। ডাকঘরে গিয়ে পৌষ মাস তথা জানুয়ারি মাসে জমা দিতে হতো। নাহলে ঝামেলায় পড়তে হতো। বাবা মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টি করায় নানা মিথ্যা মামলা করে বিরোধীরা। বিশেষ করে খাসজমি দখল ও বিলি করায় বেশিরভাগ মামলা।
আমাদের বাড়িতে বড় রেডিও দেখে সমর দারোগা বলেছিলেন, এ ব্যাটা মাকু নয় নকশাল। পিকিং রেডিও শোনে।
নাহলে এত বড় রেডিও কেনে?
ছোট রেডিও খুব একটা দেখিনি। মারফি ও বুশের মাঝারি আকারের রেডিও প্ল্যাস্টিকের খাপ।
ছোট মামা ও শেফালি দিদিমণির মাঝারি রেডিও ছিল। আমাদের ছোট মামি ছিলেন রেডিওর পোকা। ভোর পাঁচটা পঞ্চান্ন মিনিটে শুরু করে ঘুমোতে না যাওয়া পর্যন্ত চালাতেন। খেয়ালসমেত সব রাগপ্রধান গান শুনে যেতেন। রান্নাও করতেন রেডিও চালিয়ে। হাল্কা আওয়াজ। খালি জায়ের সঙ্গে মনোমালিন্য হলে ঝগড়া এড়াতে একটু জোরে চালাতেন।
আশির দশকের পর এল ছোট রেডিও এবং মিনি টেপ। সন্তোষ কোম্পানি বিপ্লব নিয়ে এল রেডিওর জগতে। দামে সস্তা। আওয়াজ খুব জোর। আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে শৌখিন খেতমজুররাও মাঠে রেডিও নিয়ে যাওয়া শুরু করলেন।
সুরেলা আওয়াজের সঙ্গে গলা মিলিয়ে কাজ করতেন।
আমার যতদূর মনে পড়ে সকাল ছটা থেকে বাজতো দেশাত্মবোধক সঙ্গীত। ছটা কুড়িতে খবর হতো। সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল প্রাত্যহিকী। বহু লেখক কবি হাত পাকিয়েছেন এখানে। প্রাত্যহিকীতে কারও চিঠি পড়া হলে এলাকায় তাঁর সম্মান বহুগুণ বেড়ে যেত। আমিও বহু চিঠি মকশো করেছি। লজ্জা ও সংকোচে পাঠাতে পারিনি।
সাধারণ মানুষ সাহিত্যের কতটা সমঝদার প্রাত্যহিকীর কাব্যিক ব্যঞ্জনাময় চিঠি যে আগ্রহ নিয়ে শুনতেন সেটাই প্রমাণ।
সকাল সাড়ে সাতটা থেকে খবর। ৭ টা ৪৫ থেকে আটটা স্থানীয় সংবাদ। আটটা থেকে আটটা পনের মিনিটে রবীন্দ্রসঙ্গীত। আটটা পনের থেকে নজরুল গীতির আসর। জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের সঙ্গীত শিক্ষার আসর ছিল সঙ্গীত শিক্ষার্থীদের জন্য এক চমৎকার বিষয়। সেটা সাপ্তাহিক।
আগে লোকে মাধ্যমিক উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল বের হয়েছে কিনা জানতো রেডিওর খবর শুনে। এখনকার মতো খবরের কাগজে আগাম দিন ঘোষণা থাকতো না। ডিভিসির জল ছাড়ার খবরও দিত রেডিও। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বসতো কৃষিকথার আসর। আকাশবাণীর এক সময়ের বড় কর্তা প্রিয় লেখক স্বপ্নময় চক্রবর্তী সেদিন আক্ষেপ করছিলেন, বাংলার কৃষক সমাজের এক বড় অংশ মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ। কিন্তু তাঁদের কোনও প্রতিনিধিকে রেডিওতে কেন ডাকা হয়নি।
রেডিওতে একজন মুসলিম পত্রলেখকের নাম দুয়েকবার শোনা যেত। এ এফ কামরুদ্দিন আহমেদ।
পরে একুশ শতকে দেখি আমার ভাগ্নিদের কাছে নায়ক -- মীর।
বামুনপাড়ায় মহিলাদের তাসের আসরে মহিলা মহল শোনার চল ছিল। বেলা দে ছিলেন অসম্ভব জনপ্রিয়। অন্যরকম টিফিন বানানোর জন্য বেলা দে এবং সাধনা ( পদবী মনে পড়ছে না এখন)র বই ছিল বিয়েতে উপহারের তালিকায়।
বিয়েতে যৌতুক হিসেবে রেডিও এবং সাইকেল ছিল মধ্যবিত্ত বাড়ির চাহিদা। ষাট এবং সত্তর দশকে। ১৯৭৭য় বামফ্রন্ট সরকার আসার গরিব মানুষের বিয়ে শাদিতেও রেডিও সাইকেল চাওয়ার চল হল। খেতমজুরদের বেতন বৃদ্ধির দাবিতে ১৯৭৭ - র পর আন্দোলন হয়। খেতমজুরদের আর্থিক সক্ষমতা বাড়ে।
চাহিদাও।
পণের বিবর্তন নিয়ে একটা পৃথক লেখা লিখবো।
রেডিও সিলোন শুনতেন ছেলে ছোকরারা। বিশেষ করে শহরে। বলিউডের হিন্দি গান শোনা যেত সেখানে। ডিসেম্বরের ২৫ থেকে ৩১ থেকে চলতো প্রতিযোগিতা। কার গান প্রথম হবে? মহম্মদ রফি কিশোর কুমার লতা মঙ্গেশকর মুকেশ কে প্রথম হবেন? জোর তর্কাতর্কি। মারামারিও হয়ে যেত।
আরেকটি জনপ্রিয় আসর ছিল বিবিধ ভারতী। শ্রাবন্তী মজুমদার তখন সুপার স্টারের সম্মান পেতেন।
বিবিধ ভারতীতে ভেসে আসতো-- সুরভিত অ্যান্টিসেপটিক ক্রিম বোরোলিন বোরোলিন।
বোরোলিনের পরে প্রতিদ্বন্দ্বী এলো। বোরোপ্লাস। ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি, নিভিয়া। কিন্তু বোরোলিন অপরাজেয়।
কলকাতা রেডিওর সব ছিল বাংলায়। দিল্লির তথা হিন্দির দাপট ছিল না।
সত্তরের দশকের আকাশবাণী কলকাতা থেকে প্রচারিত সংবাদ সমীক্ষা, সংবাদ পরিক্রমা, বাংলা নাটক, ফুটবল-ক্রিকেটের ধারাবিবরণী প্রভৃতি যে সব অনুষ্ঠান নিয়ে আজও বাঙালি নস্টালজিয়াতে ভোগেন, তার সবই ছিল বাংলা ভাষায়, হিন্দির প্রাদুর্ভাব ঘটেনি।
আকাশবাণীর সঙ্গে যুক্ত দুই মানুষের দুটি চিঠি পড়া যাক। হিন্দি আগেও ছিল বলে লেখায় এই আধিকারিকের তীব্র প্রতিক্রিয়া।
‘তখনও হিন্দি গানই’ (৩০-৬-২০১৯) শীর্ষক চিঠিতে হিন্দি গান ও সিনেমার প্রচারের পিছনে ষাট-সত্তর দশকের আকাশবাণী কলকাতাকে যে ভাবে দায়ী করা হয়েছে, ওই আকাশবাণীরই সত্তর দশকের এক জন প্রাক্তন কর্মী হিসাবে তা কোনও ভাবেই মেনে নিতে পারছি না। পত্রলেখক আকাশবাণী কলকাতা থেকে সেই সময় হিন্দি ভাষায় প্রচারের গল্প তুলে ধরলেও, সমগ্র অনুষ্ঠানের সেটা শতকরা কত ভাগ ছিল জানালে ভাল হত। সারা সপ্তাহে মাত্র ৫০ মিনিটের অনুরোধের আসর বা ৩০ মিনিটের ছায়াছবির গানের অনুযোগ করেছেন। পত্রলেখকের জ্ঞাতার্থে জানাই, অনেক বেশি জনপ্রিয় অনুষ্ঠান, যেমন সঙ্গীত শিক্ষার আসর, গল্পদাদুর আসর সপ্তাহে মাত্র এক দিনই হত। ইন্দিরাদির ‘ছোট্ট সোনা বন্ধু, কেমন আছো’ এখনও লোকের মুখে মুখে ঘোরে, তারও প্রচার-সময় সপ্তাহে মাত্র এক দিনই ছিল। যে কোনও আকাশবাণী থেকে এত বেশি রকমের অনুষ্ঠান প্রচার করতে হয় বলে, জনপ্রিয় হলেও বেশি সময় বরাদ্দ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না।
সত্তরের দশকের আকাশবাণী কলকাতা থেকে প্রচারিত সংবাদ সমীক্ষা, সংবাদ পরিক্রমা, বাংলা নাটক, ফুটবল-ক্রিকেটের ধারাবিবরণী প্রভৃতি যে সব অনুষ্ঠান নিয়ে আজও বাঙালি নস্টালজিয়াতে ভোগেন, তার সবই ছিল বাংলা ভাষায়, এতে হিন্দির ছায়াও ছিল না। ওই সব অনুষ্ঠান ছাড়াও, কৃষিকথার আসর, বিজ্ঞান বিষয়ে বিভিন্ন আলোচনা, এ-পার বাংলা ছাড়াও ও-পার বাংলাতেও প্রচণ্ড জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল।
বদলির চাকরির সুবাদে বিভিন্ন প্রদেশের আকাশবাণীতে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, পটনা-কটক থেকে যেমন বাংলা গান প্রচার করা হত, তেমনই আকাশবাণী কোহিমা থেকে অসমিয়া গানের প্রচার। নিজস্ব ভাষা ছাড়াও, অন্য ভাষার কিছু অনুষ্ঠান করার দায়িত্ব থাকে সব আকাশবাণীরই।
চন্দ্রশেখর লাহিড়ী
কলকাতা-৮১
আগের ঘটনা
‘তখনও হিন্দি গানই’ চিঠিটি পড়ে, কয়েকটি কথা। আমি ১৯৫৬ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত অল ইন্ডিয়া রেডিয়ো ও আকাশবাণীতে চাকরি করেছি। যাঁদের সাহচর্য পেয়েছিলাম, তাঁরা প্রত্যেকেই এক এক জন দিকপাল, বলা যায় সেটা ছিল আকাশবাণীর স্বর্ণযুগ। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, বাণীকুমার, পঙ্কজ মল্লিক, শ্রীধর ভট্টাচার্য, প্রেমেন্দ্র মিত্র, লীলা মজুমদার, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, বেলা দে, ইন্দিরা দেবী, জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, দীপালি নাগ, কাজী সব্যসাচী, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়... এ ছাড়াও বহু গুণিজনের সমাবেশ ও আনাগোনাতে আকাশবাণী (তৎকালীন অল ইন্ডিয়া রেডিয়ো) আলোকিত হয়ে থাকত। এঁরা প্রত্যেকেই বাংলার গর্ব, বাংলা ভাষাকে যথাযোগ্য মর্যাদা দিয়ে লালন-পালন করেছেন।
এই বিদগ্ধ মানুষজন ছাড়াও, এক জন সাধারণ মানুষের কথা উল্লেখ করতেই হয়, তিনি তারিণী বন্দ্যোপাধ্যায়, স্টেবলটন সাহেবের আমল থেকে পরবর্তী ডিরেক্টর ও সাধারণ কর্মচারীর কাছে তিনি ছিলেন অপরিহার্য। তাঁর মুখে শুনেছি, ’৩০ ও ’৪০-এর দশকে অল ইন্ডিয়া রেডিয়োতে সঙ্গীতশিল্পীর আকাল ছিল। ডিরেক্টরের নির্দেশে তারিণীদা অফিসের গাড়ি নিয়ে শিল্পী জোগাড় করতে যেতেন। কলকাতার অলি-গলিতে ঘুরতে ঘুরতে হয়তো কোনও একটা বাড়ি থেকে একটু গানের রেশ ভেসে এল। সঙ্গে সঙ্গে তারিণীদা সেই বাড়ির কড়া নাড়তেই, এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক দরজা খুলে বললেন ‘‘কাকে চাই?’’ ‘‘আজ্ঞে আপনার বাড়ি থেকে মিষ্টি একটা গান ভেসে আসছিল...’’ ‘‘হ্যাঁ, আমার নাতনি। তাতে কী?’’ ‘‘না, আমি অল ইন্ডিয়া রেডিয়ো থেকে আসছি, আপনার নাতনিকে যদি একটু রেডিয়োতে গান গাইতে দেন।’’ ভদ্রলোক বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘‘এটা ভদ্রলোকের বাড়ি, আপনি কী করে ভাবলেন, আমার বাড়ির মেয়ে রেডিয়োতে গাইবে?’’ দড়াম করে মুখের ওপর দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। এই ভাবে অপমানিত হতে হতে হয়তো এক জনকে পাওয়া যেত। শর্ত, গাড়ি করে নিয়ে যেতে হবে, পৌঁছে দিতে হবে। স্টুডিয়োর মধ্যে গান গাওয়ার সময় বাড়ির এক জন লোক পাশে বসে থাকবে। সব শর্ত মেনেই সেই শিল্পীকে আনা হল। তাঁর হয়তো দু’খানা গান গাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু পরের শিল্পী জোগাড় না হওয়ায়, জলসার আসরের মতো তাঁকে উৎসাহিত করে বেশ কয়েকটি গান তাঁকে দিয়ে গাওয়ানো হত। এ ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। আমার প্রশ্ন: এগুলো কি বাংলা গানের পৃষ্ঠপোষকতা ছিল না?
অজিত মুখোপাধ্যায়
কলকাতা-৯৭