ঘরের বাইরে থাকা জীবনের শুরু পৌষের রাতে।
তখন কী জানতাম, আর পাকাপাকিভাবে গ্রামে আর বাস করা হবে না।
আগে বহুবার বহু জায়গায় রাত কাটিয়েছি। বাড়িতে বলে বা না বলে। আজ রাতে ঘুম আসতে একটু সমস্যা হল।
মনে হল কী যেন নেই!
ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, জোনাকির আলো হারিয়ে গেছে।
ঘরে জ্বলছে বিদ্যুতের আলো।
তখন তো খুব লোডশেডিং হতো। তাই ঘরে হ্যারিকেন এবং পড়ার জন্য শখে কেনা টেবিল ল্যাম্প আছে।
গ্রামের ছেলে তাই টর্চ তো থাকবেই। আর সঙ্গে দেশলাই যদি না থাকে তাহলে তো আরও মুশকিল।
হ্যারিকেন ধরাতে হবে। টেবিল ল্যাম্প জ্বালাতে হবে। সেই লেগে দেশলাই খুব জরুরি। এই যে লেগে বললাম, এই 'লেগে' মানে জন্যে। দক্ষিণ দামোদর এলাকায় আমরা লেগে বলতাম।
অনেকেই সেই সময় দেশলাইকে শলাই বা মাচিস বলতেন।
আমাদের এক বন্ধু তো যাত্রা শুনতে গিয়ে পরেশ চক্রবর্তীর মতো বিখ্যাত মাস্টারমশাইকে বিড়ি খাওয়ার নেশার টানে চিনতে না পেরে বলেছিল-- একটু মাচিস হবে।
মাচিস বলা মানে পড়ালেখা শেখার লক্ষণ।
'কে রে' বলে স্যার ঘাড় ঘোরাতেই সহপাঠীটি হাওয়া।
আজ দুপুরে বর্ধমানের শিক্ষক ও সম্পাদক শ্যামাপ্রসাদ কুণ্ডুর একটা ভিডিও দেখছিলাম, তাতেই বহুদিন পর ইংরেজি শিখতে আসা সহজ সরল ছেলেটির মুখে লেগে শুনে মনে পড়ল, দু-একজন মুখ টিপে হাসতো।
একটু আড়াল করে, অবশ্যই।
এদের একজন ছিল, পার্থ, লেগে কী বে!
তুই যে বে বললি, সেটা কী?
ওটা কথার মাত্রা।
আমারও তাই। যা সর।
তখনও কিংবা পরেও 'যা ফোট' বলা শিখিনি।
প্রথম যে-দিন শহরে এলাম দুপুরে গৃহস্বামীর ঘরেই খেলাম।
রাতে রান্না চাপালাম।
পৃথিবীর সব বাঙালির প্রথম রান্না শুনেছি, ডিম আলুর ঝোল।
কৃষ্ণনগর সরকারি কলেজে পড়ানোর সময় ফেরার কোনও ঠিক ঠিকানা থাকতো। বিশেষ করে পাঁচটায় পরীক্ষা শেষ করে সন্ধ্যা ছটা চোদ্দয় কৃষ্ণনগর লোকাল ধরলে।
নব্বই দশকের মাঝামাঝি সেটা। প্রায়ই ট্রেনের গণ্ডগোল। আজ কলা পাতা ফেলেছে, কাল লাইনে গণ্ডগোল।
কোনও স্টেশনে নয়, বেশিরভাগ সময় ফাঁকা জায়গায় বীরনগরের কাছে দাঁড়িয়ে থাকতো ট্রেন।
বসে বসে অন্ধকারে মশা মারো আর গল্প করো।
খিদে পেটে খাওয়ার গল্পই বেশি হতো।
শঙ্খ ঘোষের ভাই এখন 'পরিচয়' পত্রিকার সম্পাদক অভ্র ঘোষ একদিন জিজ্ঞেস করলেন, বলো তো, জীবনের প্রথম রান্না কী?.
দেখা গেল, সবাই প্রথমে একা থাকার শুরুতে ডিমের ঝোল বানিয়েছেন।
আমার ডিমের ঝোলে অবশ্য টমেটো আর কালো জিরে এবং একটু রসুন দিয়েছিলাম।
খেয়ে মনে হলো, অমৃত রান্না করেছি।
একটু টক টক।
সে যে কী স্বাদ-- মুখে লেগে আছে। আর বোধহয় চেষ্টা করলেও পারবো না।
কারণ নিজের জন্য প্রথম রান্না পৃথিবীর সব মানুষই অসাধারণ বানান। নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ান।
কাউকে ডেকে খাওয়াতে ইচ্ছে করলেও যখন লোক থাকে না, তখনই আসল অমৃত অমৃত ভাবটা জাগে।
আমারও জাগল।
শীতের রাত।
কনকনে শীত।
ভাত এবং তরকারি দুই রইল। পরের দিন আর কে রাঁধে।
জীবনের প্রথম একার জন্য এটা রান্না হলেও সেটাই প্রথম রান্না আমার নয়।
প্রথম রান্না দ্বিতীয় শ্রেণিতে।
আমাদের বৈঠকখানায় থাকা শিক্ষকের জন্য (লেগে)।
আমাদের বৈঠকখানায় থাকতে আসেন শম্ভুনাথ থান্দার ও পরেশনাথ দত্ত। গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়ে আসা।
থাকবেন কোথায়?
আমাদের এক বড় বৈঠকখানা ছিল। সে-নিয়ে প্রথম খণ্ডে কিছুটা লিখেছি। পরেশবাবু ও শম্ভুনাথ বাবু রান্না করে খেতেন। একবার পরেশবাবু বাড়ি গেছেন। শম্ভুনাথ বাবু একাই আছেন। তার ধুম জ্বর। আমাদের ঘর থেকে খাবার আনি বললুম। রাজি হলেন না। এখন কারণটা বুঝি। তখন বুঝিনি।
স্যার রান্না করতেন কেরোসিন স্টোভে। পাম্প দেওয়া। তখন তিন রকম কেরোসিন স্টোভ পাওয়া যেতো।
দুটো পাম্প দেওয়া। একটা সলতে দেওয়া।
বেশিরভাগ জনতা স্টোভ চলতো।
তো, স্যারেদের ছিল পাম্প দেওয়া পেতলের স্টোভ।
স্যারের খুব জ্বর দেখে আমি ভাত চাপিয়ে নামিয়ে ফেললাম খুব কায়দা কম্ম করে। তাতে আলু দিয়েছি। এরপর ঘর থেকে মায়ের কাছ থেকে ডিম চেয়ে এনে ডিমের ওমলেট ( তখন বলতাম, ডিম ভাজা) বানিয়ে ফেললাম। অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। মানিকতলা খালপাড়ের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের কাছে চলুন। দেখবেন দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়া বাচ্চারা বাড়ির কত কাজ করে। ভাই বোনদের সামলায়।
রান্না করে।
আরো কত কী করে?
মধ্যবিত্তদের দুনিয়াই তো সব নয়।