ডাক্তার ইউনুসের এলাকায় খোঁজ নিতে লোক গেল। আত্মগোপন করে আছেন। কেন?
তখন সব দলেই সবার লোক থাকতো। বিশেষ করে সিপিএমের নেটওয়ার্ক ছিল ভালো।
ওখান থেকে রণপায়ে করে দুজন এসে হাজির। আজ রাতেই অভিযান হবে। ডাক্তার ইউনুসকে ধরার জন্য।
বড়রা ঠিক করলেন, একটু অন্ধকার নামলেই ইউনুসকে আরও নিরাপদ আশ্রয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। ভিন এলাকার মানুষ রাতের আঁধারে আল পথ বেয়ে যাবেন কী করে মাইল ছয়েক রাস্তা?
দুজন বিশ্বস্ত সঙ্গী চাই।
আমি তখন ছোট। আমার দিদিও ছোট। পাশের গাঁয়ে কেরোসিন আনার নাম করে আজফার চাচাকে চিরকুট দিয়ে আসার দায়িত্ব পড়ল আমাদের ওপর। রাস্তায় দেখা এক বয়স্ক মানুষের সঙ্গে। কংগ্রেস করেন। ধুরন্ধর লোক। বললেন, সাঁঝ হতে চললো, দুজনে চললি কোথায়?
কেরাসিন আনতে।
আমাদের গাঁয়ে মিলল না।
যদি না পাই। বুদ্ধি করে উত্তর দিল দিদি।
ওখানে গেলে বেশি পাবো।
তখন পয়সা দিলেও সবসময় বেশি কেরোসিন পাওয়া কঠিন ছিল।
রাতের অন্ধকারে আজফার চাচা একজনকে নিয়ে বৈঠারী পৌঁছে দিয়ে এলেন ডাক্তার ইউনুসকে। ফেরার সময় পড়লেন পুলিশের মুখে।
ক্যানেলের জলে ঝাঁপ দিয়ে পালালেন।
এদিকে আজফার চাচার খোঁজে আরও পুলিশ ঢুকেছে। গ্রাম ঘিরে ফেলেছে। রটে গেল, পেলেই গুলি করে মারবে।
রাতের অন্ধকারে আরো ছয় ক্রোশ হেঁটে হাজির হলেন রায়নায়।
সেখানে এক ভদ্রলোক থাকতেন। কংগ্রেস করতেন। মামলা করতে ছিলেন দুরন্ত।
তিনি আশ্রয় দিলেন।
এরপর তিনি গিয়ে ধরলেন তখনকার কংগ্রেসের দুর্দান্ত যুবনেতা সৈয়দ নুরুল ইসলামকে। তোমাদের দলে কিছু সাহসী সিপিএম যোগ দেবে। নাও।
তো, পলাতক কিছু সিপিএম কর্মী একদিন রাতের আঁধারে আমাদের বাড়ি হাজির। দেওয়াল টপকে ঘরে ঢুকতেই বাবা ও দাদা ভেবেছেন চোর।
তাঁরা বললেন, না ভাই, আমরা সব সিপিএম আছি। থাকবো। জান বাঁচাতে আর যে আমাদের তাড়িয়েছে তাঁকে জব্দ করতে কংগ্রেসে যোগ দিচ্ছি। রাগ করো না আমাদের ওপর।
তো একদিন ছত্রি করা সাজানো গোরুর গাড়িতে তাঁরা ঢুকলেন। স্কুলের মাঠে নুরুল ইসলাম দারুণ মিটিং করে গেলেন।
এরপর এই কর্মীদের দাপটে আগের কংগ্রেসি নেতাকে বসে যেতে হল।
গ্রামেও শান্তি ফিরে এল।
এইসময় দলমত নির্বিশেষে তরুণদের মধ্যে ছিল দারুণ একতা।
তাঁরা ঠিক করলেন, রাজনীতির ফলে ঐক্য নষ্ট হচ্ছে। গ্রামের সবাইকে এক করতে ক্লাব দরকার।
তৈরি হল আউশাড়া ব্রাদার্স ক্লাব। বা এবিসি।
ফুটবল নাটক যাত্রা সমাজসেবা মেয়েদের বিয়ে দেওয়া হাসপাতালে রোগী নিয়ে যাওয়া বৌ পেটানো বন্ধ করা --সবেতেই এই ক্লাবের ছেলেরা অগ্রণী ভূমিকা নিলেন।
আমাদের গ্রাম অল্পদিনের মধ্যেই ফুটবল খেলায় তাক লাগানো সাফল্য অর্জন করলো।
রামবাটি, ধারান, আনগুনা, বাঁশা-- কাছে দূরের সব মাঠের ফুটবল প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে লাগল।
সত্তরের দশকে ফুটবল ঘিরে গ্রাম বাংলায় যে উন্মাদনা ছিল তা আজ কল্পনাই করা যায় না।
ফুটবল খেলা মানে কয়েক হাজার দর্শক।
আমাদের গ্রামের খেলা থাকলে বাচ্চা বুড়ো সবাই গ্রাম ফাঁকা করে ফুটবল ম্যাচ দেখতে ছুটতো।
কেউ বিশ্বাস করবেন কি না জানি না, ১০ কিলোমিটার দূরে পর্যন্ত হেঁটে যেত লোকে ফুটবল দেখতে।
রাজনীতি ছিল তার পাশাপাশি ছিল ফুটবল ও যাত্রা ঘিরে মানুষের অসম্ভব আবেগ।
সেই আবেগ কি আর ফিরবে না?