পদি পিসির বর্মি বাক্স নয়, আমাদের ঠাকুমার ছিল এক বিশাল সিন্দুক। ভাদ্র মাসে কিছু জিনিস বের হতো। রোদে দিতে। সিন্দুকটি ছিল বার্মা সেগুনের। পেল্লাই সাইজ। এটি খোলার সময় দরজা বন্ধ করে দিতেন দাদি। আমাকে কেবল ডাকতেন সিন্দুকের ভেতরে ঢুকে মালপত্র বের করার প্রয়োজন হলে। ভেতরের কুঠরিগুলোতেও আলাদা চাবি ছিল। সব চাবি হাতে পাইনি কোনও দিন।
ওই বন্ধ কুঠরিতে মোহর আছে এমন ফিসফাস ছিল। ওই সিন্দুক খোলায় সততার সঙ্গে সাহায্য করায় আমার দুটি প্রাপ্তি হয়। এক কড়ে আঙ্গুলে পড়ার এক তিন পাথর দেওয়া সোনার আঙটি। সেটি মা রেখে দেন। হারিয়ে দিবি বলে।
আরেকটি পুরনো খবরের কাগজের পাতা।
আগে বাক্স বা সিন্দুকে জিনিসপত্র রাখা হতো তলায় গোটা খবরের কাগজের বিছিয়ে। বা আয়তন অনুযায়ী ভাঁজ করে।
আমি একটা গোটা কাগজের পাতা পাই।
১৯৬২ সাধারণ শতকের বাংলা দৈনিক।
তাতে একটা মজার সংবাদ ছিল। সংবাদ নয়, আসলে একটা ব্যঙ্গ নাটক ছাপা হয়েছিল প্রধান সংবাদ হিসেবে।
আমোদ, বিদ্যুৎ এবং আরও কিছু চরিত্র ছিল।
দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়লেও বাড়িতে ও চারপাশে রাজনৈতিক চর্চার কারণে বুঝতে পেরেছিলাম আমোদ মানে প্র মোদ দাশগুপ্ত এবং বিদ্যুৎ জ্যোতি বসু।
চীনকে কমিউনিস্ট পার্টির বামপন্থী অংশ, যাঁরা পরে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী) বলে আলাদা দল করবেন তাঁদের নিয়ে রঙ্গ ব্যঙ্গ ছিল।
কারণ এঁরা চীন ভারত যুদ্ধের সময় চীনকে আগ্রাসনকারী বলতে রাজি ছিলেন না। বলেছিলেন, এটা সীমান্ত সংঘর্ষ।
তখনকার সংবাদপত্র রেডিওতে তারস্বরে দেশপ্রেম প্র চার চলছে। জওহরলাল নেহেরু ব্যাকফুটে। কদিন আগেই চীনা প্রধানমন্ত্রী চৌএনলাইয়ের সঙ্গে মিলে হিন্দি চীনি ভাই ভাই শ্লোগান তুলেছেন। সোভিয়েত ও চীনা মডেলের মিশ্রণে সংসদীয় পথে সমাজতন্ত্র কায়েম নেহরুর স্বপ্ন।
সেই স্বপ্ন বিফলে যাচ্ছে, চীন অরুণাচল প্রদেশ ও আকসাই চীন তাদের এলাকা বলে দখল করে নেওয়ায়। আকসাই চীন নিজেদের কবলে রাখলেও পরে অরুণাচল প্রদেশ থেকে সেনা সরিয়ে নেয় চীন।
এই যুদ্ধ ঘিরে উগ্র জাতীয়তাবাদ তীব্র হয়ে ওঠে।
কমিউনিস্টদের দেশদ্রোহী বলা শুরু হয়। কোথাও কোথাও গায়ে হাত দেওয়া হয়। জেলে পোরা হয়। আর আমাদের গ্রামাঞ্চলে কমিউনিস্ট পার্টি তখনও তত শক্তিশালী নয়, কিন্তু বাবার এলাকায় প্রভাব ছিল প্রচুর। সম্পত্তি, পরোপকার এবং খেলাধুলা যাত্রা ইত্যাদি নানা জনসংযোগের কারণে।
ওই সময় বাবাদেরও চীনা দালাল বলে টিপ্প নি শুনতে হয়। চৌষট্টিতে বলে মাকু। এবং পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে কমিউনিস্ট পার্টি মার্ক্সবাদী -- 'না এক ভাই/ না এক পাই বলে' বলে শ্লোগান তোলে।
তাতে খুব নিন্দা রটে। খবরের কাগজে এবং রেডিওতে তুলোধুনো করা হয় কমিউনিস্টদের।
বেশ কিছু কমিউনিস্ট নয় এমন মুসলিম নেতাকে ১৯৬৫তে কারাবন্দি করা হয়।
প্রখ্যাত বাগ্মী সৈয়দ বদরুদ্দোজাও নিপীড়ন থেকে ছাড় পাননি। তিনি তখন সাংসদ।
আগে কমিউনিস্টদের চীনা দালাল বলা হচ্ছিল এবার বলা হলো মাকু চীনা পাকি।
কুশপুত্তলিকা দাহ হলো বহু জায়গায় জ্যোতি বসুর। ব্রাত্য বসুর 'উইঙ্কল টুইঙ্কল' নাটকে দেবশঙ্কর হালদারের একটা অসাধারণ সংলাপ আছে এই নিয়ে।
বাবার সামনে ছেলে গান্ধীবাদী বাবার নাম ধরে বলছেন, আমি কমিউনিস্ট।
তীব্র সমালোচনা নিন্দা এবং অপপ্রচারের মুখেও কমিউনিস্টদের পিছু হঠতে দেখা যায় নি।
মনোজ বসুর 'চীন দেখে এলাম' বই খুব জনপ্রিয় ছিল । তা পোড়ানো হয়। এবং প্রত্যাহার করতে হয়।
অথচ এর কিছুদিন পরেই ১৯৬৬ তে কমিউনিস্টদের নেতৃত্বেই হাজার হাজার মানুষ পথে নামলেন খাদ্যের দাবিতে, মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে। ১৯৬৭তে তো জাতীয়তাবাদের তীব্র জিগির তোলা কংগ্রেস যুক্তফ্রন্টের কাছে হেরেই গেল।
ছয় ডিসেম্বর ২০২৪ একটা ছবি দেখলাম চলচ্চিত্র উৎসবে। চীন নিয়ে।
ছবিটি ২০২৪ এ চীনে নির্মিত।
১১১ মিনিটের ছবি। নায়িকার মুখে একটাও সংলাপ নেই।
নায়িকা জীবিকা নির্বাহের জন্য নানা কিছু করেন। অপেরায় গান শোনান। অপেরা চলে শ্রমিকদের জন্য নির্মিত এক প্রেক্ষাগৃহে। সেখানে বৃদ্ধ অবসরপ্রাপ্ত খনি শ্রমিকদের ভিড়। পপ নয় অপেরা শুনতে ভালোবাসেন। তাঁরা গান শুনে কিছু পয়সা দেন। কোনও টিকিট নেই। সেই পয়সা থেকে প্রেক্ষাগৃহের পরিচালক কোনও মতে এটার ব্যয় নির্বাহ করেন।
পরিচালকের একটা সাক্ষাৎকার দেখানো হয়। তা থেকে দর্শক এইসব জানেন।
পরিচালক দেখান, মাও সেতুঙের একটা ছবি। যেটা ফেলে দেওয়া হয়েছিল।
একটা অংশ আগুনে পোড়া।
ছবির আসল রঙ ও চেহারা ধরে রাখার জন্য এটা সংস্কার না করার জন্য প্রাক্তন পরিচালক পরামর্শ দেন বর্তমানকে।
এই ছবির পাশাপাশি টিভিতে সম্প্রচারিত হয় চীন আমেরিকার চুক্তি হচ্ছে। আর্থিক সুবিধা হবে বলে। ২০০১-এর ঘটনা।
নায়িকা নানা ধরনের কাজ করে। ম্যাজিক দেখায়। চোখের পাতা দিয়ে দুটো বালতি তোলে। অপেরায় গায়। স্বল্পবসনা হয়ে রাস্তায় ফ্যাশন প্যারেডে নাচে। গুয়াঙডঙের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার প্র চার করে মডেল হয়ে। রাস্তায় খোলা জায়গায়। ঘোষণা হয়, মেলায় কেনাকাটা করলে পুরস্কার। রাস্তা ভাঙাচোরা। সেই রাস্তা দিয়ে মেয়েটি ফেরে। স্বল্পবসনা। রাস্তায় উচ্ছৃঙ্খল যুবকের দল বাইক নিয়ে ঘিরে টিজ করে।
মেয়েটির প্রেমিক বিন শহর ছেড়ে ভালো রোজগারের জন্য অন্য জায়গায় চলে যেতে চায়। মেয়েটি শহর ছাড়তে চায় না। ছেলেটি বারবার তাঁকে ধাক্কা দিয়ে বসিয়ে রাখতে চায় গাড়িতে। মেয়েটি একসময় নেমে যায়।
ছেলেটি কোথায় যাচ্ছে জানিয়ে ছোট মোবাইলে বার্তা পাঠায়, সময় হলে সে নিতে আসবে।
পাঁচ বছর কাটে। ২০০৬।
মেয়েটি নিজের শহর ছেড়ে বন্যার ভ্রূকূটি অগ্রাহ্য করে ছেলেটির শহরে যায়।
মোবাইলে বার্তা পাঠায়।
উত্তর আসে না।
চার্চে যায়। সেখানে স্বামীদের দ্বারা অত্যাচারিত মেয়েদের ভিড়।
তাঁদের প্রার্থনার সময় সে একটা মাংসের গন্ধওলা প্র সেসড নুডলসের প্যাকেট নিয়ে চলে আসে। একটা রেখে আসে।
বারে যায়। জুয়ার আসরে। খুঁজতে। সেখানে ৫০০ ইউয়ান পেয়ে যায়। একজনের ফেলে যাওয়া প্যাকেট।
রাস্তায় তাঁকে ঘিরে টাকাটা ফেরৎ চাইলে সে আত্মরক্ষার জন্য রাখা স্প্রে করে চলে আসে।
বৃষ্টির মাঝে ছাতা নেই। কোট ব্যবহার করে মাথা ঢাকে। অন্যের সাহায্য করার আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে।
ম্যাসাজ পার্লারে পুরুষদের ম্যাসাজ করে।
সেখানেই আসে তাঁর প্রেমিক/ স্বামী।
কিন্তু দেখা হয় না।
সে তখন রিয়েল এস্টেটের সঙ্গে যুক্ত।
প্রশাসনের সাহায্যে টিভিতে নিরুদ্দেশ বিজ্ঞাপন বের হয়। তবু যোগাযোগ করে না ছেলেটি। বিন। বিন তখন পয়সা কড়ি করেছে। সে আরেকটি মেয়েকে বিদেশে পালাতে সাহায্য করে বিমানের টিকিট ও টাকা দিয়ে।
বিরাট বিরাট পুরাতন বাড়ি ভেঙে নতুন ফ্ল্যাট গজাচ্ছে। বিন, মেয়েটির দয়িত সেসব তদারকি করে। কিন্তু দেখা করে না। উত্তর দেয় না
মেয়েটি শেষে হুমকি বার্তা পাঠায়।
ছেলেটি আসে। কথা হয় না। ছেলেটি বার্তা পাঠায়।
আর একসঙ্গে থাকা সম্ভব নয়।
এরপর ২০২২ ।
কোভিড / করোনা কাল। ছেলেটি এখন লোক।
নিজের শহরে ফেরে। রিয়েল এস্টেট ব্যবসা চৌপাট। লোন এজেন্টের কাজ করতো। তাও চলছে না।
একদিন এক শপিং মলে তাঁদের দেখা হয়। লোকটি ক্রেতা। মেয়েটি এখন মহিলা। শপিং মলের কর্মী। দুজন দুজনের করোনা মুখোশ খোলে।
কাজের শেষে দেখা হয়। লোকটি হাঁটতে পারে না ভালো করে। নিজের জুতোর ফিতেও বাঁধতে পারে না।
মহিলা মমতার সঙ্গে জুতোর ফিতে বেঁধে দেয়।
তারপর সন্ধ্যার ম্যারাথন দৌড়ে যোগ দেয়।
ছবিটি দেখতে দেখতে চীনেও এই দারিদ্র্য বেকারত্ব জীবিকার তাগিদ ছেলেদের মস্তানি জুয়া খেলা মাও সেতুঙের ছবির দুর্দশা দেখতে দেখতে ভাবছিলাম, আমাদের বাবারা এই চীনের জন্য এত গালমন্দ শুনেছেন?
সমাজতন্ত্র কি স্বপ্নই?