আজকাল কত সহজেই মানুষ সম্পর্ক ভেঙে দেয়।
ফেসবুকে হোয়াটসঅ্যাপে ঝগড়া করে। যাদের পক্ষ নিয়ে লড়ে বা পরস্পরকে অমুকের দালাল বা চটিচাটা/ বুটচাটা/ ধুতি চাটা/ গোবর চাটা বলে গাল দেয়, তারা কিন্তু গোপনে ভালোই সম্পর্ক রাখে। মিটিং মিছিল টিভিতে গাল দেয়। পরে দেখা হলে হেসে বলে, আরে রাজনীতিতে ওরকম বলতে হয়।
এবং পরস্পরের বিপদের সময় পাশে থাকে।
গ্রামে আড্ডা হতো মাটিতে বসে। দাওয়ায় বৈঠকখানা/ দলিজ/ খানকা ঘরে। বড়জোর সেখানে একটা তালাই বা আসন বিছানো থাকতো।
চেয়ার টেবিলের বালাই ছিল না।
চেয়ার টেবিল ছিল স্কুলে। কন্ট্রোলে। মানে, সমবায় সমিতিতে। আমরা বলতাম, কন্ট্রোল বা কন্টোল। কন্টোল বলার লোক বেশি।
যুক্তাক্ষর ব্যবহার এলিট প্রবণতা।
একজন দেখি গরমেন্ট বলার জন্য গালি খান।
একজন নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত লেখক তো সব জায়গায় গরমেন্ট লিখে গেছেন।
লোকে কি স্কুল কলেজের বই আর দু চারটি জনপ্রিয় লেখা ছাড়া পড়েন না?
কারো বাড়িতেই চেয়ার টেবিলে খাওয়া ছিল না। তবে ড্রেসিং টেবিল বা পড়ার টেবিল ছিল কিছু বাড়িতে। আমাদের বাড়িতে একটা বড় মেহগনি কাঠের ড্রেসিং টেবিল কাম পড়ার টেবিল ছিল। আয়নাটা ঘোরানো যেত। ড্রয়ার ছিল। তাতে বহু কিছু থাকতো। খোপ খোপ ছিল।
আগেকার মানুষরা লেখার জন্য ডেস্ক বা চৌকি গোছের একটা ব্যবহার করতেন। এখনো কিছু কাপড়ের গদিতে দেখা মেলে। ডেস্কের ভেতরে হরেক খোপের মেলা।
ওপরে গোল করে কালির দোয়াত রাখার জায়গা।
হরেক খোপে পয়সা কড়ি রাখা বা জিনিস রাখার জন্য ব্যবহৃত হতো।
একটি আমার সংগ্রহে আছে। ১৫০ বছরের পুরানো।
আমাদের গ্রামে আড্ডা দেওয়ার জন্য বাঁশের মাচা বা বেঞ্চি বানানো হতো।
এগুলো দোকানে থাকতো, পাড়ার মোড়ে থাকতো।
আমরা একটা বানাই সবাই মিলে বারোয়ারি তলায়। এটাই ছিল আমাদের আড্ডাখানা।
কালভার্টে কিছু লোক আড্ডা দিতেন।
আমাদের জুনিয়র হাইস্কুলের একটা চৌবাচ্চা ছিল। আমরা বলতাম, হাউজ, তাতে বসেও গুলতানি চলতো।
এছাড়া দোকানে বা কারো বৈঠকখানায় এমনি বসে, তালাইয়ে বসে, শতরঞ্জি বা চটে বসে, মাদুরে বসে, আড্ডা চলতোই।
বর্ষাকাল আর শীতকালে -- এই তো মাসখানেক টানা চাষের কাজ।
বাকি ছুটকো ছাটকা।
ফলে আড্ডার সময়ের অভাব ছিল না।
মানসিকতারও।
স্কুল কলেজে পড়ুয়াদের তো বন্ধুত্ব ছিলই তবে খেটে খাওয়া মানুষদের বন্ধুত্বও ছিল দেখার ও বলার মতো। হরিহর আত্মা।
দুগোদার দোকানে দুজন এসে বসতেন। দুজনের এক নাম। একজন ব্রাহ্মণ একজন তপশিলি জাতির। দুজনে মুখোমুখি বসে থাকতেন। একটা কথাও হতো না। দু ঘন্টা তিন ঘন্টা একসঙ্গে বসে থাকাটাই ছিল তাঁদের হৃদয়ের আন্তরিক বিনিময়। ঝড় জল বৃষ্টি কাদা দুজন আসবেনই। বসবেন। এবং কোনো কথা না বলে উঠে যাবেন।
আর দুজন ছিল টগরভাই ও ভাদুভাই। প্রতিদিন দেখা হওয়া চাই।
আমাদের বাড়িতে বসতেন। মা ও বাবার সঙ্গে গল্প করে চলে যেতেন।
আমার মায়ের সঙ্গে সই পাতিয়েছিলেন পাশের বাড়ির সই মা।
যতদিন বেঁচে ছিলেন, একবার ঠিক আসতেন।
কই গো কোথায় তুমি? বলে হাঁক দিতেন। পরস্পরের মাঝে মাঝে তরকারি বিনিময় হতো।
আমার সেজো মাসির সঙ্গে দত্ত বাড়ির নতুন বৌ শঙ্করী লাল গামছা সই পাতান ৬৫ বছর আগে।
আমার পিসি ময়না ফুফুর সই ছিলেন আশালতা। আশালতা মালিক। সেকালের কথায় চাঁড়াল বাড়ির মেয়ে।
ফুফু বলেন, ভাত খেতাম ঘরে কুল্লি করতাম আশালতার বাকুলে।
এখন এদের দেখা হয় না।
কিন্তু খোঁজ রাখেন দুজন দুজনের।
খোঁজ রাখাটাই তো সম্পর্ক।
কথার বিনিময় তো নয়।