আমাদের গ্রামে দোল নয়, হোলিই বলা হতো। আর দোল এবং হোলি যে আলাদা সেটা জানলাম বর্ধমান শহরে এসে। বর্ধমানের রাজারা ছিলেন পাঞ্জাবের মানুষ।
বর্ধমানে দোলের পরদিন হোলি উৎসব হতো।
গ্রামে তো রঙ দিয়ে শুরু হয়ে ধান সেদ্ধ করার কড়াইয়ের কালি এবং শেষে পুকুরের পাঁক দিয়ে শেষ হতো। হিন্দু মুসলমান হিসেবে হোলিকে দেখানোর 'আচ্ছে দিন' তখনও অনাগত, ফলে উভয় ধর্মের কিশোররাই রঙ খেলতেন।
কারও বাড়ি গিয়ে রঙ দেওয়ার ইচ্ছে এবং সাহস কোনওটাই তখন ছিল না।
এগুলো সত্তর ও আশির দশকের কথা।
বর্ধমানে থাকতে উচ্চমাধ্যমিক পড়ার সময় দোল/ হোলির দিন একটা নিছক ছুটির দিন। খুব মাতামাতি দেখিনি।
অন্তত আমি যে পাড়ায় থাকতাম।
ওগুলো চ্যাংড়াদের কাজ হিসেবেই গণ্য হতো।
আশির দশকের শেষ দিকে কৃষ্ণসায়রকে সাজিয়ে তোলা হলো, ফুলে ফলে। বোটিং চালু করে। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে। অনিমেষ নাথ নামে একজন বিপুল পরিশ্রম করেন।
প্রবেশমূল্য চালু হয়। যতদূর মনে পড়ছে দুই টাকা।
১৯৮৯ (!) নাগাদ সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু হল। প্রথম বছরে এসেছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা ও সুবিখ্যাত নৃত্যশিল্পী ড. অমিতা দত্ত।
বর্ধমান শহরে পাঁচটি বড় দিঘি ছিল। এগুলোকে সায়র বলা হতো।
রাণীসায়র, শ্যামসায়র, কৃষ্ণসায়র ইত্যাদি।
১৯৮৭তে বর্ধমান শহরের বিধায়ক হলেন নিরুপম সেন। তাঁর পরিকল্পনায় বর্ধমান শহর সাজানোর কাজে হাতে দেয় পুরসভা ও বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়। বর্ধমান পুরসভা তখন চালান সুরেন মণ্ডল ও আইনুল হক।
সায়রগুলো সুন্দর করে সাজিয়ে তোলা হলো।
আমাদের কলেজের সামনেই ছিল শ্যামসায়র। পানাপুকুরে ভর্তি।
একবার এক মহিলা সেখানে ঝাঁপ দেন। আমি কলেজে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম, লোকের চিৎকার শুনে গিয়ে তাঁকে জল থেকে তুলে আনি।
রাজ কলেজের কথাই যখন উঠল, দোলের কথাও বলা যাক।
১৯৮৫ রাজ কলেজ ফজলুল হক ছাত্রাবাসে থাকি। রাজ কলেজের তিনটি ছাত্রাবাস। এন আর বা নলিনীরঞ্জন ছাত্রাবাস, এনসি হোস্টেল ও ফজলুল হক হোস্টেল।
সংক্ষেপে এফ এইচ হোস্টেল। ফজলুল হক হোস্টেল একসময় শুধু মুসলিম ছাত্রদের জন্য ছিল। এখন ও আমাদের সময় সবার জন্য। কিন্তু আমাদের সময় মুসলিম সম্প্রদায়ে জন্মানো ছাত্র কেবল একজন। জাহাঙ্গির। তাও সে গেস্ট তখন। কানপুর নিবাসী সোমনাথ রায়ের। সাত নম্বর ঘরে আমিও ঢুকি সোমনাথ রায়ের অতিথি হিসেবে। এক ঘরে একে একে সবমিলিয়ে সাতজন। রাজ্যে তখন বামফ্রন্ট। কলেজে এসএফআইয়ের ছাত্র সংসদ। কিন্তু হোস্টেল চলে ছাত্র পরিষদ ও নকশালপন্থীদের কথায়। দু একজন এস এফ আই সমর্থক থাকলেও তাঁদের চেয়ে সিপি বা ছাত্র পরিষদ এবং নকশালপন্থীদের কথাই চলতো।
আমার যাওয়ার কিছু দিন পর, আমরা দলে ভারি হই। সাত থেকে সতেরো। পরে ষাট জনের অধিকাংশই আমাদের সমর্থক। এই সমর্থন জোটাতে আমাদের নানা কাজ করতে হয়। এক, হোস্টেলে মদ বন্ধ। রাতে বাইরে থেকে লোক এনে অসামাজিক কিছু কাজ চলতো-- তা বন্ধ করা।
মদ গাঁজা সিদ্ধি বন্ধ করা খুব কঠিন। বিশেষ করে দোলের সময়। বিকল্প কিছু দিতে হবে।
ঠিক করলাম, এবার দোলের দিন আমরা শহর পরিক্রমা করবো।
প্রদীপ মুখোপাধ্যায় ছিলেন প্রিফেক্ট। ভালো গান গাইতেন। তাঁর ঘরে একটা ঢোল ছিল। তাঁর ঘরে গানের মহলা হল কদিন।
জোর।
বর্ধমানে দোলের দিন নয় হোলির দিন রঙ খেলা।
আমরা ঢোল নিয়ে এবং কাঁসির বদলে থালা নিয়ে বের হয়ে পড়লাম।
লক্ষ্য অধ্যাপকদের বাড়ি যাওয়া। কোনও বান্ধবীর বাড়ি যাওয়া যাবে না, ঠিক করা হয়েছে। যদিও মনে মনে অনেকেরই ইচ্ছে, বান্ধবীদের বাড়ি যাওয়া।
আমরা শহরে বেশ কয়েক কিলোমিটার হেঁটে প্রায় ত্রিশ জন অধ্যাপকের বাড়ি ঘুরে ফেললাম।
হিসাব ছিল, মিষ্টি খাওয়া যাবে না।
খেলে তো আর পয়সা দেবেন না।
সবশেষে হিসাব করে দেখা গেল ১৮০০ টাকা চাঁদা উঠেছে।
কী খাওয়া হবে?
বিরিয়ানি।
শহরে তখন একটা মাত্র বিরিয়ানির দোকান।
আড়াই কিলোমিটার দূরে কার্জন গেটের কাছে প্রান্তিক।
তাও সবদিন করতো না। শনিবার ও রবিবার।
আমরা চলে গেলাম। অর্ডার দিলাম ৫০ প্লেট বিরিয়ানি।
ত্রিশ টাকা করে মাথাপিছু।
তখন মুরগির মাংস ১৫ টাকা কেজি। খাসির মাংস ৩০ -৩৫ টাকা কেজি।
এত দাম?
রাগ হয়ে গেল।
কিন্তু কিছু করার নেই। বিরিয়ানি সিদ্ধান্ত হয়েছে। বিরিয়ানি খাওয়া তখন সুবিশাল ব্যাপার।
কলকাতার রয়াল হোটেলে লোকে খুব শখ হলে বিরিয়ানি খেতে যায় বা নিউ মার্কেটে আমিনিয়ায়।
রয়াল হোটেল তখন খুব নামী। সেখানে ত্রিশ টাকা প্লেট খাসির বিরিয়ানি।
লোকে মাটন বিরিয়ানি বলতো না। চিকেন তখনও মুরগি ছিল।
কথায় কথায় এত ইংরেজিয়ানা ছিল না।
আমরা পরিকল্পনা করলাম, ত্রিশ টাকা দাম নিচ্ছে!
হোস্টেলে তখন মিল চার্জ এক টাকা আশি পয়সা হলেই ধুন্ধুমার বেধে যায়। অডিট হয়।
এত কী করে হলো?
দেড় থেকে দু টাকায় মাছ ভাত খুব ভালো করে খাওয়া যায় হোটেলে।
মাংস ভাত পাঁচ টাকা। আটটা রুটি তরকারি দিয়ে দু টাকা। রসগোল্লা চার আনা আর আট আনা। কচুরি চার আনা।
আট আনায় ডিম টোস্ট সর টোস্ট।
পরোটা চল্লিশ পয়সা তরকারি দিয়ে।
ঠিক হল, ব্যাটাদের জব্দ করতে হবে। খাইয়ে লোক কারা কারা? সে তো সবাই।
কিন্তু ব্যাপক খেতে পারে কারা? জাহাঙ্গির খেতে পারতো মোটা মোটা ৪২ টা রুটি। রাজ্যের ম্যারাথনে তৃতীয় জেলায় প্রথম তারক ৩০-৩৫টা মেরে দিত। মইনুল ২৫-৩০ টা।
এইরকম ১০জনকে ঠিক করা হল, তাঁরা প্রথম ব্যাচে যাবে। খাবে। পেট চুক্তি তো।
প্রথম ১০ জনেই সব খাবার শেষ।
আমরা গিয়ে শুনি খাবার নেই!
চিল্লাচিল্লি শুরু। যাঁরা খেয়েছে তাঁরা বললে, বিরিয়ানি নাকি ওটা। ঝোল ভাত হয়েছে।
আবার রাতে রান্না চাপল। বিরিয়ানি হলো না। মাংস ভাত জুটলো। দোকান গুলিয়ে মুরগির মাংস কিনে এনে রান্না। ভাত প্রায় ফ্যান মাখা। সে এক ঐতিহাসিক বিরিয়ানি অভিযান।
এদিকে টাকা তো দেওয়া হয়ে গেছে!
কী হবে?