মাঝেমধ্যে চিকিৎসার কারণে পিজি হাসপাতালে যেতে হয়। আজ যেতে হলো পিজি পেরিয়ে একটা ইউএসজি করাতে। ডাক্তার কিছুতেই পয়সা নেবেন না। স্মৃতিরোমন্থন হলো কিছুটা। রাজনীতি তো অবশ্যই। বললাম, কলেজ হোস্টেল থেকে দেখতাম, হাসপাতাল থেকে মেডিকেল কলেজের দিকে হেঁটে যাচ্ছেন একজন দীর্ঘদেহী সাহেব। ছ ফুট দু ইঞ্চি লম্বা। টকটকে ফর্সা রঙ। পরে আলাপ হলো ছাত্র রাজনীতির সুবাদে।
সেই ডাক্তার তাঁর সংস্থার কর্মীদের বললেন, এ না থাকলে কবে মরেই যেতাম।
আমার এ-কথা বলার। হরিদা, অমিতদা, বিজনদা, উত্তমদা, অনুপদা, অমিতাভদা, জ্যোতিদা, মনোজদা, সুদীপদা, ওমপ্রকাশদা-- এঁরা না থাকলে তো আমিই মরে যেতাম আলসারে। আট বোতল ১০ বোতল রক্ত নেওয়া, টাইফয়েড, জন্ডিস, অ্যাপেন্ডিসাইটিস, সাপের কামড়, কুকুরের কামড়, কলেজ নির্বাচনের মারামারিতে আহত হওয়া-- রোগের কী শেষ আছে?
হাসপাতালে দু মাস ভর্তি স্যালাইন, রক্ত নেওয়া এতো বাঁধা ব্যাপার ছিল ১৯৯১ পর্যন্ত।
বিজনদা বললেন, শোনো ২০০ লোক আমাকে মেরেই ফেলতো। তাঁরা ডিওয়াইএফ আই করে। হাসপাতালে ওয়ার্ডে ঝামেলা। সামাল দিতে গেছি। আমার ওপর আক্রমণ। খবর পেয়ে ইমানুল এসে দলবল নিয়ে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে গেলো। বেঁচে গেলাম।
ভুলেই গিয়েছিলাম।
কতো কথা হারিয়ে যায়।
কতো কথা।
আজ গোখেল রোড দিয়ে ফিরলাম।
কতো কতো ছেলে লাইন দিতো সেনা/ জওয়ান হবে বলে।
আর নিয়োগ নেই।
সে-নিয়ে আলোচনাও নেই।
পিজি হাসপাতালে প্রথম আসি ১৯৮৩-তে।
নিজের জন্য নয়। আমাদের গ্রামের এক শ্রমজীবী কিশোরের জন্য। নাম নেনো। নেনো মালিক। সে ছিল পাশের বাড়ির বাগাল। গরু বাছুর ছাগল দেখতো, গোয়াল কাড়তো , ফাইফরমাশ খাটতো। বছর ১২-১৩ বয়স। অতি ভদ্র ছেলে।
তাকে সাপে কামড়ায়। কেউটে সাপ। বর্ধমান হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আমি প্রতিদিন বিকালে স্কুল শেষে নেনোকে দেখতে যেতাম। সেই বছরই আমি বর্ধমান মিউনিসিপ্যাল স্কুলে পড়াশোনা করার সুবাদে শহরে থাকতে শুরু করেছি।
একদিন ডাক্তার বললেন, এখানে আর হবে না। ওকে ডায়ালিসিস করতে হবে।
কোথায় হবে?
পিজিতে হয়। আর তখন চারটি নামকরা হাসপাতাল ছিল কলকাতায়। বর্ধমানেও চারটি নার্সিং হোম। কিন্তু বর্ধমানে কোথাও ডায়ালিসিস হয় না।
কলকাতার ক্যালকাটা মেডিক্যাল ( সিএমসি), বিড়লা, বেলভিউ, উডল্যান্ড--এই ছিল।
অ্যাপোলো আমরি মণিপালের সম্ভাবনা তৈরি হবে এই ১৯৮৩-তেই।
পাশের বাড়ির লোক করছেন অনেক। কিন্তু এত টাকা কোথায়? অতএব পিজি ভরসা।
কিন্তু সেখানে ভর্তি করা কঠিন।
সিপিএম পার্টি অফিসে গেলাম। পার্টি অফিসে মালেকদা বা গৌরদা চিঠি লিখে দিলে আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে কার্তিকদার কাছে যেতে হবে। সেখান থেকে চিঠি নিয়ে পিজি হাসপাতালের সুপারের কাছে।
সেই মতো আমি ১৭ বছরের এক ছেলে গেলাম। হল না। বলল, সময় লাগবে। সিট নাই। তখন কি গোপাল পল্টু জমানা শুরু হয়েছে? মনে করতে হবে।
ওখানেই দেখা মন্টুদার সঙ্গে। বর্ধমানে তখন দুজন মন্টু বিখ্যাত। একজন বিখ্যাত কৃষক নেতা হরেকৃষ্ণ কোঙারের ছেলে মন্টু কোঙার।
আর একজন শক্তিগড়ের মন্টুদা।
মন্টু খ্যাপা বলে পরিচিত।
বড়লোকের ছেলে । পার্টিকে সব সম্পত্তি দিয়ে দিয়েছিলেন। পার্টির বড় নেতা হননি। কিন্তু ভালোবাসা পেয়েছিলেন মানুষের। তাকে নিয়ে পরে লিখবো। তখন রাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রী রামনারায়ণ গোস্বামী। কৃষক নেতা। দুর্দান্ত লড়াকু গরিব দরদী সৎ নেতা। তাঁর খুব কাছের মানুষ ছিলেন মন্টুদা। সেই সূত্রে বা তাঁর ভালো ব্যবহারের জন্য পিজির সুপার তাঁকে ভালোবাসতেন।
মন্টুদা বলে দিলেন সুপারকে।
পরদিন অ্যাম্বুলেন্স করে নিয়ে এলাম।
সেই কলকাতায় প্রায় ২০ দিন টানা থাকা। পিজির এমার্জেন্সির দক্ষিণ দিকে এম ( মার্টিন) ওয়ার্ডে নেনো ভর্তি হল।
আমি আর আমাদের পাশের বাড়ির একজন রাতদিন ওখানেই থাকলাম। গাছতলায় বহু রোগীর বাড়ির লোক শুতেন। আমরাও শুতাম।
খাওয়া দাওয়া হোটেলে।
একদিন সামনে মাসির হোটেলে খেতে গেলাম।
শুনলাম ডাক্তার ছাড়া খেতে দেওয়া হয় না।
একজন জুনিয়রও এমন চোখে তাকালেন, রাগ হল। কিন্তু চুপ। পেশেন্ট আছে। এখানেই প্রথম রোগীর বদলে পেশেন্ট এবং পেশেন্ট পার্টি শুনি। এটা অবজ্ঞা করে বলা হতো।
আর আমরা গেলেই বলা হতো, ক্যাচ পার্টি এসেছে।
মানে ধরে ভর্তি করানো।
সেসময় জুনিয়র ডাক্তার ধর্মঘট চলছে।
আর আমি সিপিএমের প্রতি খুব বিরক্ত হয়ে গেছি ১৯৮০ থেকেই। মনে হচ্ছিল, ক্ষমতাই লক্ষ্য বিপ্লব নয়।
আজিজুল হকের দলবল রমেশ বাবুর নেতৃত্বে তখন শান্তিপুর এলাকায় বিপ্লবী কাজ চালাচ্ছেন।
আমার ইচ্ছে, ওতে গিয়ে যোগ দেওয়া। নিকোলাই অস্ত্রভস্কির
'ইস্পাত' এবং চিন চিং মাই-এর 'বিপ্লবের গান' পড়ে বিপ্লব করে শহিদ হওয়ার খুব রোমান্টিক ঝোঁক।
জুনিয়র ডাক্তারদের ধর্মঘট চালাচ্ছিল এবিজেডএফ নামের এক সংগঠন। অল বেঙ্গল জুনিয়র ডক্টর্স ফেডারেশন। তখন সিপিএম মানে নামের আগে ওয়েস্ট বেঙ্গল বিরোধী মানে অল বেঙ্গল।
এবিজেডএফ নকশালপন্থী বলে শুনেছি।
আমার সঙ্গে তখন এবং এখনও বই থাকে। লি শাউচির 'সাচ্চা কমিউনিস্ট কী করে হতে হয়' ব্যাগে নিয়ে ঘুরি। রেড বুকের সঙ্গে সদ্য পরিচয় হয়েছে।
আর আছে, ইস্পাত। আজকাল কাগজ কিনি রোজ। ২৫ পয়সা দাম । তাতে ডাক্তার ধর্মঘট ও নকশাল আন্দোলনের খবর খুব থাকে।
জুনিয়র ডাক্তারদের কমরেড বলে ডাকতে গিয়ে সুবিধা হয়নি।
ভেবেছি, সিপিএমের সুপারিশ নিয়ে রোগীর ভর্তি তাই। হাসপাতালে দিনের পর দিন রাত কাটানোর অভিজ্ঞতা যাঁদের আছে তাঁরা জানেন, রোগীর আত্মীয়দের মধ্যে একটা ভাব ভালোবাসা তৈরি হয়ে যায়।
রোগীর বাড়ির লোক কাউকে বলে বাড়ি যান টাকা পয়সা আনতে। ডায়ালিসিসের ওষুধ স্যালাইন ইত্যাদি কিনে দিতে হতো।
নেনোর সঙ্গেই বর্ধমান সদর থানার খেতিয়া গ্রামের এক কৃষক পরিবারের সদস্য ভর্তি ছিলেন। ২৬ বছর বয়স।
সিংহের মতো চেহারা। কোমর সরু। বুক চওড়া। দেখার মতো। তাঁর পরিবারের লোক আমাদের দায়িত্ব দিয়ে বাড়ি গেছেন।
আমরা চারবার করে ওয়ার্ডে যেতাম। বসে বসে বই পড়ার সুবাদে নার্স এবং গার্ড একটু ছাড় দিতেন ।
সেদিন দুপুরে গিয়েছি।
দেখি ওই রোগী ধনুকের ছিলার মতো যন্ত্রণায় বেঁকে উঠছেন। স্যালাইন বন্ধ। ছুটলাম নার্সের ঘরে। বললাম। দেখি দুজন জুনিয়র ডাক্তার বসে হাসি ঠাট্টা করছেন। বললাম, ডাক্তারবাবু একবার চলুন।
এলেন না। উল্টে একজন বললেন, তোরা বর্ধমানের না। যা তোদের স্বাস্থ্য মন্ত্রী রামনারায়ণ গোস্বামীকে ডেকে আন্। স্যালাইন চালিয়ে দেবে।
হাত পা শুধু ধরতে বাকি রেখেছি। রাগও হচ্ছে। কিন্তু নেনো ভর্তি। শামু বলল, কিছু বলিস না। নেনো আছে। ভুল ইঞ্জেকশন দিয়ে যদি মেরে দেয়।
ওয়ার্ডে ছুটে গেলাম।
আমাদের চোখের সামনে মরে গেলেন ছটফট করতে করতে ২৬ বছরের এক তরতাজা যুবক।
নকশালপন্থীদের সম্পর্কে আমার একটু মোহমুক্তি হল।
পরে জ্যোতি বসুর সরকার জুনিয়র ডাক্তার ধর্মঘট ভাঙতে আলাদা সংগঠন গড়েন।
জুনিয়র ডক্টর্স কাউন্সিল অব অ্যাকশন ( জেডিসিএ)। সিনিয়র ডাক্তাররা জুনিয়র ডাক্তার ধর্মঘটে মদত দিচ্ছেন বলে হেলথ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন ভেঙে হেলথ সার্ভিস ডক্টর্স ( এইচ এস ডি) গড়েন।
জুনিয়র ডাক্তারদের মেডিকেল অফিসার হিসেবে দায়িত্ব দিতে অ্যাডহক ভিত্তিতে নিয়োগ দেন।
এবং দুবার ব্যাপক লাঠিচার্জ করেন আলো নিভিয়ে।
জুনিয়র ডাক্তারদের ৫০% মেডিকেল অফিসার হিসেবে নিয়োগ পেতে তিন মাস পর জুনিয়র ডাক্তারদের ধর্মঘট উঠে যায়।
পুনশ্চ : ১৯৮৩-তে জুনিয়র ডাক্তারদের কর্মবিরতি ভাতা বৃদ্ধির দাবিতে শুরু হয়েছিল। সঙ্গে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতির দাবি জুড়ে দেওয়া হয়।
কিন্তু পেছনের কারণ ছিল অন্য।
বামফ্রন্ট সরকারের কিছু জনমুখী কর্মসূচি একটা শক্তিকে ক্ষিপ্ত করে।
বামফ্রন্ট সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী রামনারায়ণ গোস্বামীর লক্ষ্য:
১. খালি পায়ের ডাক্তার তৈরি করতে চেয়েছিলেন।
২. 'হাতুড়ে' ডাক্তার তথা গ্রামীণ চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ দিতে চেয়েছিলেন
৩. তিন বছরের ডাক্তারি পাঠক্রম চালু করেছিলেন কমিউনিটি মেডিকেল সার্ভিস। ডাক্তারদের চাপে বন্ধ করে দিতে হয়
৪. ডাক্তারিতে জেলা ভিত্তিক কোটার কথা উঠেছিল, প্রমোদ দাশগুপ্তর মতানুযায়ী
৫. ওষুধের জেনেরিক নেম লেখার প্রস্তাব দিয়েছিলেন।। ব্রান্ড নেমের পরিবর্তে
৬. হাসপাতালে কর্মরত ডাক্তারদের প্রাইভেট প্র্যাকটিস বন্ধ করতে চেয়েছিলেন
৭. হাসপাতালে বসে মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভদের সঙ্গে সাক্ষাৎ বন্ধ করতে চেয়েছিলেন
৮. রেফার করা বন্ধ করতে চেয়েছিলেন
৯. সিনিয়র ডাক্তারদের ভর্তির দিন ২৪ ঘন্টা অন ডিউটি চেয়েছিলেন
১০. জুনিয়র ডাক্তাররা সপ্তাহে ছয়দিন আসবেন। একদিন বিশ্রাম।
দুদিন ৩৬/৪৮ ঘন্টা ডিউটি করে চলে যাবেন না, এটা
১১. সব ডাক্তারদের প্রথমে গ্রামে দুই বছর কাটাতে হবে।
সপ্তাহে ছয়দিন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে থাকতে হবে।
কম্পাউন্ডার বা নার্সের ভরসায় ছেড়ে দিয়ে এলে চলবে না।
১২. ডাক্তারদের আয়ের হিসাব দিতে হবে।।
১৩. চেম্বারে রোগী দেখলে রসিদ দিতে হবে।
১৪. প্রতিদিনই এক ঘণ্টা করে রোগীর আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা করে জিজ্ঞাসার উত্তর দিতে হবে।
রামনারায়ণ গোস্বামীকে সরে যেতে হয়।