নেই।
কাঠবিড়ালি, পায়রা, কোকিল এবং কাক -- কারও দেখা নেই। বৃষ্টি হচ্ছে। খুব জোরে না হলেও তেজ আছে। সিরো বাবু তো অপ্রতিরোধ্য। বের হবেনই। বেরিয়ে মেজকি, ছোটকা, ভেবলুকে তোলার চেষ্টা করল।
বৃষ্টিতে ওরা গুটিসুটি।
বৃষ্টি থামলে বের হবে।
পাখি এবং কাঠবিড়ালিরাও।
এই বৃষ্টিতে কোথায় লুকোয় ওরা।
কাঠবিড়ালিরা মাঝে মাঝে লোকের এসির বাইরের অংশ কেটে ঢুকে পড়ে।
সে নিয়ে অশান্তি।
তবে কাঠবিড়ালিদের কেন খেতে দিই সে-নিয়ে কোনও আপত্তি শুনিনি।
কুকুরকে খাওয়ানো নিয়েই ঝামেলা।
যত ঘুষখোর এবং মিচকে -- এবং নানাবিধ সোসাইটি গার্লদের কুকুরদের নিয়ে যত আপত্তি।
দু একজন হয়তো এমনিই ভয় পায়।
আপাতত অপেক্ষা।
বৃষ্টি থামলে ওদের খেতে দিতে হবে।
আজ কী দেবো?
ভুট্টা।
বানিয়ে দেবো।
একটা কথা আছে, শিশুরা ফুলের মতো সুন্দর।
অবশ্যই। মিষ্টি হাসি, আধো আধো কথা। প্রিয়জনকে দেখলেই ছুটে আসা।
কিন্তু ছোটদের মধ্যে নিষ্ঠুরতাও থাকে। সময় ও সমাজের প্রভাবে মানবিক হয়ে ওঠে। মানবিক নয়, বলা উচিত প্রাণবিক।
পৃথিবীর সকল প্রাণীর মধ্যে নিষ্ঠুরতা কাদের মধ্যে বেশি?
আমার মাঝে মাঝে মনে হয় মানুষের।
মানুষ কোনও কারণ ছাড়াই হিংসা করে। অনসূয়া নয় প্রায় কেউই। অনসূয়া মানে অসূয়া নেই যার। অন্যের ভালো সইতে বা দেখতে পারে, এমন মানুষ কতজন?
ঈর্ষা ভরপুর জীবন।
আমি জীবনে বিদ্যালয় মহাবিদ্যালয় বিশ্ববিদ্যালয়ে যা শিখেছি, তার চেয়ে বেশি শিখেছি তথাকথিত সাধারণ মানুষের কাছে।
নামে সাধারণরা অধিকাংশই অসাধারণ।
আমাদের গ্রামে বেশ কয়েকজন অতীব সুন্দরী মহিলা ছিলেন। তাঁদের অধিকাংশই দরিদ্র পরিবারের।
এ-রকম ছিলেন তিন বোন।
দুজনের বিয়েই হয় দুই বড়লোকের সঙ্গে। তাঁদের দুজনেরই দ্বিতীয় স্ত্রী ছিলেন এঁরা। বয়সে স্বামীরা বেশ বড়। অভাবের কারণে এই বিয়ে।
এঁদের স্নেহ আমি খুব পেয়েছি। তাঁদের স্বামীদের দাদো বা দাদু বললেও এঁদের বলতাম খালা ( মাসি)। গ্রাম সম্পর্কে তাই হন।
একবার গ্রামে গেছি। ছাদে ধান মেলছিলেন খালা।
নীচে থেকেই জিজ্ঞেস করি, কেমন আছো খালা?
মানুষ কি আর ভালো আছে রে বাপ! এখন বটি কাটারি নয়, হাতে দাঁতে মানুষকে ছিঁড়ে ফেলছে রে বাপ!
দাঁতে মানে কি খালা?
কথায় নয় বাপ, দেঁতো হাসিতে অন্যের সুখ থেঁতো করে দিচ্ছে লোকে।
আমি আর কথা বাড়াইনি।
তখন রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সময়। ২০০৯।
আমার বাবা চিরকাল উল্টো স্রোতের মানুষ।
দরকার নেই, কথা বাড়িয়ে।
ছোটবেলায় দেখেছি, এখনও দেখি। কিছু শিশু অকারণ নিষ্ঠুরতা করে। কুকুরের গায়ে ঢিল ছোঁড়ে। গায়ে বাজি/ বোম ছুঁড়ে দেয়। পিচকারি দিয়ে জল রঙ মারে।
গ্রামে দেখতাম, ফড়িংয়ের ডানা ছিঁড়ে দিত অকারণ। সুতো দিয়ে বেঁধে রাখতাম অবশ্য আমিও।
লাল রঙের ফড়িংয়ের প্রতি সবার খুব আকর্ষণ ছিল।
চড়ুই পাখি ধরে মেরে ফিস্ট করা ছিল ছোটদের প্রিয় দস্তুর।
আরেকটি নিষ্ঠুরতা এখন মনে পড়লে খারাপ লাগে।
ছোটদের গিরগিটি মারা।
কে বা কারা ভুলভাল শিখিয়েছিল, গিরগিটি নাকি হজরত হোসেন (রা) কে এজিদের কাছে ধরিয়ে দিয়েছিল।
গিরগিটি মানে অন্য অর্থ না বুঝে আসল অর্থ বুঝে বহু গিরগিটির প্রাণ গেছে।
গিরগিটিকে বলা হতো, কাবেল।
আর ছিল নানা নাম ধরে খেপানো।
এটা বড়রাই শেখাতেন।
টিজিং যাকে বলে।
কী মনোকষ্ট যে হতো ছোটদের। কে বুঝবেন?
তা বলে ছোটবেলায় আনন্দ কম ছিল না। একসঙ্গে খেলা, সাঁতার কাটা, দৌড়াদৌড়ি, লুকোচুরি, ঝালঝাপটা, গাদি/ নুনচিক/ বুড়ি বসন্তী, মার্বেল, ভাটা, লুডো, গুলি ডাং, ফুটবল, ভলি, ক্রিকেট।
আর ছিল রঙ মিলান্তি।
সঙ্গে ছিল নানা বিষয়ে ছড়া কাটা।
এলাটিং বেলাটিং সইলো তো সবাই জানেন, ক্লাস নিয়ে একটা ছড়া ছিল।
মনে আছো কারও?
অঞ্চল ভেদে বদলে যেতে পারে।
স্মৃতি থেকে লেখা।
ক্লাস ওয়ান খায় জোয়ান
ক্লাস টু খায় গু
ক্লাস থ্রি খায় বিড়ি / পায়খানা মিস্ত্রি
ক্লাস ফোর জুতো চোর।
ক্লাস ফাইভ পোঁদে পাইপ/ লর্ড ক্লাইভ
ক্লাস সিক্স সবকিছু ফিক্স/ ভেরি নাইস
ক্লাস সেভেন বুকে পেন/ হেভেন হেভেন
ক্লাস এইট হেব্বি টাইট
ক্লাস নাইন সুপার ফাইন
ক্লাস টেন মারাকাটারি সুচিত্রা সেন।
ক্লাস সেভেন বুকে পেন (কলম) বলতে মনে পড়ে গেল, পঞ্চম ষষ্ঠ শ্রেণিতে বুক পকেটে কলম গোঁজা অসভ্যতা বলে গণ্য হতো।
যেমন নবম শ্রেণির আগে চা দোকানে ছোটদের চা খাওয়াও অশিষ্ট বিষয় বলে গণ্য হতো।
ক্লাস সিক্সে একজন বুটজুতো পরে আসায় তার কী হেনস্থা হয়েছিল, ভাবা যায় না।
আমরা খালি পায়েই স্কুল যেতাম প্রাথমিকে। দশম শ্রেণি পর্যন্ত নব্বই ভাগ ছেলে মেয়ে অজন্তা হাওয়াই চটি পরতেন।