সাহেবদের খাওয়া?
আমাদের সবকিছুতেই বড়ো আদিখ্যেতা। আহ্লাদে গলে গিয়ে বলি সাহেবরা সন্ধ্যের মধ্যে খেয়ে নেয়। আমাদের কৃষক সমাজও তো সন্ধ্যে সাতটার মধ্যে খেয়ে নিতেন। বিদ্যুৎ না থাকাটা একটা কারণ বটে। অথবা এইটাই ছিল পৃথিবীর বৈশিষ্ট্য। তথাকথিত সভ্যতা এসে মানুষের জীবনের অনেক উন্নতি যেমন করেছে তেমন বদভ্যাসও ডেকে এনেছে। তার একটা বেশি রাত করে ঘুমুতে যাওয়া এবং বেলা পর্যন্ত ঘুমুনো। আর সারাদিন আলস্য গা ম্যাজম্যাজ। সাহেবরা শুনেছি রাতে ফল খান। গ্রামের মানুষ রাতে নয় দিনে ফলপাকুড় ভালোই খেতেন, কিনে নয়, কুড়িয়ে বাড়িয়ে বা গাছ থেকে পেড়ে। আম, জাম, পেয়ারা, আতা,তেঁতুল, । আমাদের এলাকায় কাঁঠাল, তরমুজ,ফুটি,শশা কিনেই খেতে হত। কাঁচা টমেটো নুন দিয়ে বা শুধু খেতে যে কী ভালো স্যালাড শব্দ শেখার আগেই জেনেছি। টমেটো গাছের পাশ দিয়ে গেলে কী সুন্দর গন্ধ ছাড়ত। কুসুম বীজ গাছের গন্ধ, আলু শাকের গন্ধ মাতাল করা। আর গর্ভিনী ধানের গন্ধ বিশেষ করে চাঁদনি রাতে কথনের অতীত।
আমাদের শিক্ষকমশাইরা এক আধজন ছাড়া কেউ বড়লোক ছিলেন না। মধ্যবিত্ত মানুষ। অল্প বেতন। তাও মাস পয়লা বেতন ছিল না। টিউশনি করতে হতো সবাইকেই। এবং নবম দশম শ্রেণির ছেলে মেয়েদের অঙ্ক ইংরেজি দুটোই পড়াতে হতো। বলা যায়, প্রায় সব বিষয়ে টেস্ট পেপার ঘষাতে হতো। আমি পড়তাম প্রথমে জাহ্নবীবাবু, পরে পরেশবাবুর কাছে। মাধ্যমিক পরীক্ষায় যেটুকু অর্জন তা পরেশবাবুর অবদান। আমার মতো রাজনীতি ও সংস্কৃতি পাগল ফাঁকিবাজকে তিনি জব্দ করেছিলেন ইংরেজি ও অঙ্কের টেস্ট পেপার সলভ করে সবাইকে পড়ানোর দায়িত্ব দিয়ে।
জাহ্নবীবাবুর বেতন ছিল ১৫ টাকা। সপ্তাহে ছয় দিন। পরেশবাবুর ২০ টাকা বেতন। সেও সপ্তাহে ছয় দিন।
প্রধান শিক্ষক টিউশন পড়াতেন না। পুজোপাশা, কালী সাধনা নিয়ে থাকতেন। সহকারী প্রধান শিক্ষক সীতেশ দত্ত বিদ্যালয়ের শিক্ষক আবাসনে থাকতেন।
সেখানেই পড়াতেন। তাঁর পড়ানো ওয়ার্ডসওয়ার্থের একটি কবিতা চোখে জল এনে দিত।
উই আর সেভেন।
ওয়ার্ডসওয়ার্থ বা জসিমউদ্দিনের কবিতার সুবাস। জীবনানন্দ দাশকেও যেন খানিকটা শহুরে মনে হয় তখন।
সীতেশবাবু আমাদের পড়াতেন টেনিসন বা ওয়ার্ডসওয়ার্থের কবিতা। গরমকালে আমাদের ছিল সকালে স্কুল। ভোরে উঠে কাঁচা পাকা খেজুর বা আম কুড়িয়ে আমরা দৌড়তাম সাড়ে ছ কিলোমিটার দূরের স্কুলে। শুধু সকালে স্কুলেই আমরা টিফিন খেতাম। দিনের বেলায় স্কুলে কাউকে টিফিন খেতে দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। টিফিনের পর থাকত সীতেশবাবুর ক্লাস । তিনি পড়াতেন, উই আর সেভেন/ হোম দে ব্রট হার ওয়ারিয়র বেড কবিতা।
আমরা তখন রোমান্টিক শব্দ শুনেছি। রোমান্টিকতা মানে যে নিজের মনের বাইরে আরেকটি গুহামন তৈরি-- জানতাম না। রোমান্টিক রিভাইভাল এইসব শব্দবন্ধও শুনিনি। ওয়ার্ডসওয়ার্থ যে ইংল্যান্ড আর ফ্রান্স পরস্পরের শত্রু এটা ভেবে বেঁচে থাকার বিরোধী তাও জানতাম না।
ফ্রান্সের বিপ্লবকে সম্মান জানিয়ে লিখেছেন 'সলিটারি রিপার' কবিতা, তাও অজানা।
পরে জেনেছি, ফ্রান্স আর ইংল্যান্ডের এই তৈরি করা শত্রুতার চরম বিরোধী ওয়ার্ডসওয়ার্থ, এক ফরাসিনীকে বিয়ে করেন। পিকে ছবিতে একটু মিল পাবেন।
শিল্পবিপ্লবের পর টাকার পিছনে ছুটে চলার, যুদ্ধোন্মাদনার, ঘৃণার রাজনীতির বিরুদ্ধে ভালোবাসার কথা, প্রকৃতির কথা বলতে শুরু করলেন সজোরে। উই আর সেভেন-- কবিতাটি যাঁরা পড়েছেন, তাঁরা জানেন, কী গভীর প্রত্যয় আট বছরের এক মেয়ের।
দুজন গেছেন সমুদ্রে, বেঁচে আছেন কিনা জানেন না, দুজন আছেন কনওয়েতে, এক ভাই এক বোন শুয়ে বাড়ির কাছে চার্চের পাশে কবরে, আর মেয়েটি তবু বারবার বলে চলেন, উই আর সেভেন।
মেয়েটি ও তাঁর মা কেবল আছেন।
কিন্তু মেয়েটি দৃঢ়, উই আর সেভেন।
জীবিত না মৃত বড় কথা নয়, বড় কথা সম্পর্ক, বড় কথা বিশ্বাস।
সমুদ্রে যাওয়ারাও কি আছেন? বা কনওয়েতে বাস করারা?
মনে হয় নেই-- আছে একাত্মতা।
মেয়েটির এই প্রত্যয় আমাকে কাঁদিয়ে দিত।
আমাদের মেজদি তার চার বছর আগে শ্বশুরবাড়িতে নিহত। জোর করে নোড়া দিয়ে দাঁত ভেঙে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল, বিষ।
পড়তে ভালোবাসতেন এটা একটা ছিল অপরাধ। আরেকটা পণ।
আমার মেজদির কথা মনে হতো। মেজবুবু আছেন আমাদের সঙ্গে।
পুত্র বা ভাই হারানো মা বা বোনের যন্ত্রণা আমাদের খিদের যন্ত্রণাকেও ভুলিয়ে দিত।
আরেকটি কবিতা টেনিসনের। টেনিসন ভিক্টোরিয়ো যুগের কবি। প্রবল আশাবাদ তাঁর মধ্যে। তিনি লিখেছিলেন
আই ড্রিঙ্ক লাইফ টু দ্য লিজ--জীবনের তলদেশ পর্যন্ত পান করার আকাঙ্খা। সেই কবিকে লিখতে হয়েছে যুদ্ধের মর্মান্তিক ভাষ্য। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরেছে মৃতদেহ। তা দেখতে হচ্ছে স্ত্রীকে। এ দেখায় কোনো যুদ্ধ প্রেমিক রোমান্টিক আবেগ নেই। নিশ্চল পাথরের মতো বসে থাকা। সবাই বলছেন, কাঁদো কাঁদো। তিনি কাঁদছেন না। নীরব। শেষে একজন বৃদ্ধা তাঁর কোলে বসিয়ে দিচ্ছেন সন্তানকে।
কেঁদে উঠছেন। উঠে বলছেন, আই লিভ ফর দি।
ভবিষ্যতের জন্যই তো বাঁচতে হয়।
যুদ্ধের বিরুদ্ধে অনেক গান কবিতা তখন লেখা হতো।
আমরাও সুরে বেসুরে গাইতাম।
বর্ধমান মিউনিসিপ্যাল স্কুলে পড়ার সময় একদিন বাংলার শিক্ষক রাধারমণ মণ্ডল আমাদের সঙ্গেই বেঞ্চে বসে বললেন, তুই আজ যত যুদ্ধবাজ গানটা জানিস? গা তো।
তখন লাজলজ্জা কম ছিল।
গেয়ে দিলাম।
অবশ্য সহপাঠীদের কাছে আবার অত ভণিতা কী?
কলেজ জীবন পর্যন্ত সুরে বেসুরে একলা খুব গাইতাম বা কোরাসে। মিছিলে শ্লোগান ছাড়াও গান হতো। একসঙ্গে গাইতে গাইতে হাঁটা হতো ছয় আগস্ট নয় আগস্ট এবং পয়লা সেপ্টেম্বর।
হিরোশিমা নাগাসাকি ছয় আগস্ট নয় আগস্ট-- বিজ্ঞান ক্লাবগুলো মিছিল করতো শহর জুড়ে। তখন বিজ্ঞান মঞ্চ হয়নি।
যুদ্ধের বিরুদ্ধে গান এবং শ্লোগান খুব হতো। আজ যত যুদ্ধবাজ--ছিল খুবই জনপ্রিয়।
গানটি এখনও মনে আছে।
‘আজ যত যুদ্ধবাজ দেয় হানা হামলাবাজ’
আজ যত যুদ্ধবাজ দেয় হানা হামলাবাজ
আমাদের শান্তি সুখ করতে চায় লুটতরাজ।
আজ যত যুদ্ধবাজ দেয় হানা হামলাবাজ
আমাদের শান্তি সুখ করতে চায় লুটতরাজ।
জোট বাঁধো তৈরী হও যুদ্ধ নয় তোলো আওয়াজ
তোলো আওয়াজ তোলো আওয়াজ
যুদ্ধ নয় যুদ্ধ নয় তোলো আওয়াজ।
তোলো আওয়াজ তোলো আওয়াজ
যুদ্ধ নয় যুদ্ধ নয় তোলো আওয়াজ।
সাজঘরের নীল আলো আজকে হোক বিপ্রতীপ।
উদ্ধত শ্বাস ফেলে হিংস্রতার সরীসৃপ।
সাজঘরের নীল আলো আজকে হোক বিপ্রতীপ।
উদ্ধত শ্বাস ফেলে হিংস্রতার সরীসৃপ।
এই যে বিংশ শতাব্দী গুলিতে ছিন্নভিন্ন আজ।
তোলো আওয়াজ তোলো আওয়াজ
যুদ্ধ নয় যুদ্ধ নয় তোলো আওয়াজ।
তোলো আওয়াজ তোলো আওয়াজ
যুদ্ধ নয় যুদ্ধ নয় তোলো আওয়াজ।
যুদ্ধবাজ জাত যত আজ দেখায় রক্তচোখ
প্রেম প্রীতি আর স্নেহে ভাঙতে চায় শিল্পলোক।
যুদ্ধবাজ জাত যত আজ দেখায় রক্তচোখ
প্রেম প্রীতি আর স্নেহে ভাঙতে চায় শিল্পলোক।
সব শিশুর বাসভূমি এই সবুজ মৃত্তিকা
বিশ্বাসের হাওয়াতে বারুদের বিষ ছড়ায়।
সব শিশুর বাসভূমি এই সবুজ মৃত্তিকা
বিশ্বাসের হাওয়াতে বারুদের বিষ ছড়ায়।
হিংসা নয়, যুদ্ধ নয় ফুল ফোটাও গন্ধরাজ
তোলো আওয়াজ তোলো আওয়াজ
যুদ্ধ নয় যুদ্ধ নয় তোলো আওয়াজ।
তোলো আওয়াজ তোলো আওয়াজ
যুদ্ধ নয় যুদ্ধ নয় তোলো আওয়াজ।
আজ যত যুদ্ধবাজ দেয় হানা হামলাবাজ
আমাদের শান্তি সুখ করতে চায় লুটতরাজ।
আজ যত যুদ্ধবাজ দেয় হানা হামলাবাজ
আমাদের শান্তি সুখ করতে চায় লুটতরাজ।
জোট বাঁধো তৈরী হও যুদ্ধ নয় তোলো আওয়াজ
তোলো আওয়াজ তোলো আওয়াজ
যুদ্ধ নয় যুদ্ধ নয় তোলো আওয়াজ।
তোলো আওয়াজ তোলো আওয়াজ
যুদ্ধ নয় যুদ্ধ নয় তোলো আওয়াজ।
তোলো আওয়াজ তোলো আওয়াজ
যুদ্ধ নয় যুদ্ধ নয় তোলো আওয়াজ।
তোলো আওয়াজ তোলো আওয়াজ
যুদ্ধ নয় যুদ্ধ নয় তোলো আওয়াজ।
পুনশ্চ:
আমাদের ফলমূলের বৈচিত্র্য প্রচুর। ইংরেজরা সে সব জেনে নাকি ভড়কে যায়। সঞ্জীব চক্রবর্তী একটা মজার লেখা লিখেছেন । দিয়ে দেওয়া যাক--
ইংরেজরা বরফের দেশ থেকে আমাদের সুজলা সুফলা উপমহাদেশে এসে কতরকম ফলমূল যে দেখেছে তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু নাম জানা না থাকায় সবকিছুর সাথে সেই অ্যাপল যোগ করে নাম দিয়েছে, ফল বলতে তো একটা অ্যাপেলই ওরা চেনে । যেমন বেলের নাম দিয়েছে উড অ্যাপল, আনারসকে বলে পাইন অ্যাপল, ব জামরুল হয়েছে ওয়াক্স অ্যাপল। এমনকী তালের শাঁসের মধ্যেও আঙুল ঢুকিয়েছে, আইস অ্যাপল।