‘মানুষের প্রিয়তম সম্পদ তার জীবন, এটা সে একবারই পায় এবং এই জীবন তাকে এমনভাবে কাটাতে হবে যাতে কেটে যাওয়া বছরগুলি সম্পর্কে যন্ত্রণাদায়ক দুঃখের অনুভুতি না জাগে, অতীতের হীনতা ও তুচ্ছতার লজ্জা যেন তুষের আগুনের মত না পোড়ায়, এমনভাবে বাঁচতে হবে যাতে মরার সময় সে বলতে পারে: আমার গোটা জীবন, আমার সমস্ত শক্তি আমি উৎসর্গ করেছি জগতের মহত্তম লক্ষ্যে– মানবজাতির মুক্তির জন্যে– সংগ্রামের লক্ষ্যে’। নিকোলাই অস্ত্রোভস্কির লেখা এই কথাগুলো 'ইস্পাত' বইয়ের পিছনে লেখা থাকতো।
একজন শ্রমিক হয়ে উঠেছিলেন বিপ্লবী। নিজের জীবন আর কিছুটা কল্পনা দিয়ে লেখা এই বই অনূদিত হয়েছিল ৫২ টি দেশে। দেড় কোটির ওপর বিক্রি। সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বাধিক সংখ্যক ছেলেমেয়ে এক সমীক্ষায় জানিয়েছিল, মহাকাশে গেলে সঙ্গে নিয়ে যাবে 'ইস্পাত'।
আমার মতো অনেকেই পাভেল করচাগিন হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। চীন থেকে প্রকাশিত 'বিপ্লবের গান', রাশিয়া থেকে প্রকাশিত 'ইশকুল', 'জয়া শুরার কথা' হাতে হাতে ঘুরতো।
আর উন্মাদনা ছিল জুলিয়াস ফুচিকের 'ফাঁসির মঞ্চ থেকে' পড়ার। একজন কমিউনিস্ট নেতা কীভাবে দলের ঘনিষ্ঠতম সাহসী কর্মীর ধরা পড়ে যাওয়ার পর একা হয়ে গিয়ে ভীতু বনে তাঁর নাম বলে দেওয়ায় ধরা পড়ে যান পার্টির নেতা।
আর আগ্রহ ছিল 'রোজেনবার্গ পত্রগুচ্ছ'। আমেরিকার এক কমিউনিস্ট দম্পতিকে বিদ্যুৎ চেয়ারে বসিয়ে মেরে ফেলা হয়। অভিযোগ, তাঁরা নাকি সোভিয়েত ইউনিয়নকে পরমাণু বোমা তৈরির ফর্মুলা পাচার করেছেন। মিথ্যা অভিযোগ।
কিন্তু মেরে ফেলা হয়।
আজ জানা যাচ্ছে, ইজরায়েলকে কিন্তু দিয়ে দেওয়া হয়েছিল, পরমাণু বোমা তৈরির ফর্মুলা।
এক মার্কিন রাষ্ট্রপতি বিরোধিতা করেন ইজরায়েলের পরমাণু বোমা কর্মসূচির। তার জন্য নাকি তাঁর প্রাণ যায়। এমন অভিযোগও উঠছে।
পরমাণু বোমার ফর্মুলা পাচার নিয়ে নারায়ণ সান্যালের 'বিশ্বাসঘাতক' আমরা গোগ্রাসে পড়েছি। কী অবিশ্বাস্য টান টান লেখা।
নারায়ণ সান্যাল অবশ্য সব লেখাতেই মুগ্ধ করতেন। মনে পড়ে সপ্তম শ্রেণিতে এক শিক্ষকের কাছে 'প্যারাবোলা স্যার' দেখে টিফিনে না খেয়ে বইটা পড়ে কী হাউ হাউ কান্না। তবে 'বিশ্বাসঘাতক' পড়েননি আমাদের প্রজন্মের এমন ছেলে মেয়ে পাওয়া কঠিন হবে। 'দাদার কীর্তি' সিনেমা আর 'বিশ্বাসঘাতক' দুটোই দুভাবে হিট। একটা প্রেমের আর একটা আদর্শের
পরে এল কলেজ জীবনে দুই বিপরীতমুখী বই। বুদ্ধদেব গুহর 'মাধুকরী' আর সমরেশ মজুমদারের 'কালবেলা'।
কত ছেলে মেয়ে যে অনিমেষ আর মাধুরীলতা হতে চাইতেন! 'সমরেশ মজুমদারের 'কালবেলা' পড়ে।
বুদ্ধদেব গুহ ছিলেন ভীষণ জনপ্রিকাছে 'কোয়েলের কাছে' বইটা পড়তে দেখি কোয়েলদিকে। কলেজ মাঠে । মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ চিত্তরঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের মেয়ে। আমাদের এক ক্লাস জুনিয়র সমুদ্র মুখোপাধ্যায়ের দিদি। কোয়েলদি ছিলেন বনফুলের নাতনি। কোয়েলদি খুব বই পড়তেন। এক রাতের কড়ারে বইটি নিই। কোয়েলদি কোথায় কে জানে! সমুদ্র ডাক্তার। বিলেতে থাকে। মাঝে কৌশিক লাহিড়ীর সঙ্গে ওঁর ছবি দেখলাম।
এভাবেই তখন চলতো বই দেওয়া নেওয়া। কলেজের বন্ধু রুণার খুব প্রিয় চরিত্র ছিল পৃথু। পৃথুর বিরুদ্ধে কিছু বললেই খেপে লাল। রুণা আমাকে একটা চমৎকার বই উপহার দিয়েছিল, ওর সব খুচরো দিয়ে, মাও সেতুং রচনাবলী। পাঁচ খণ্ড ১২৫ টাকা।
১২৫ টাকা তখন অনেক টাকা।
বইগুলো পরে কেউ আত্মসাৎ করেন। কী করা যাবে!
আমাদের বন্ধুদের মধ্যে তখন বইমেলায় বই উপহার দেওয়ার খুব চল ছিল।
লেনিনের আলোকচিত্রময় জীবনী দিয়েছিলাম এক বন্ধুকে। ১৫ টাকা দাম। বন্ধু আশা করেছিল, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের বই। সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের লেখা পড়তে ভালো লাগতো। কিন্তু উপহার দিতাম না আমরা। বুর্জোয়া লেখক! সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় তখন 'বর্তমান' পত্রিকায় সাপ্তাহিক একটি কলম লিখতেন। বন্ধু সেগুলো পড়ে এসে শোনাতো। ওরা জন্মসূত্রে পাঞ্জাবের লোক। কিন্তু বাংলা মাধ্যমেই পড়েছে। বাংলা কাগজ রাখতো বাড়িতে। এইরকম বহু হিন্দিভাষী পরিবার বাংলা মাধ্যমে পড়তো। বাড়িতে বাংলা কাগজ রাখতো। মাড়োয়ারিরাও। এখন সব উল্টো। বাঙালি মধ্যবিত্তের একটা অংশ বাংলা মাধ্যমে ছেলেমেয়েদের পড়ান না।
এখন মজা লাগে।
সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের কথা মনে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুনি। এত ভালো বলেন। বন্ধু লেনিনের আলোকচিত্রময় জীবনী আমাকে দিয়ে দেয়। ভাগ্যিস দেয়। বইটি এখনও আছে। অসাধারণ বই।
এখন ছাপা হলে পাঁচ হাজার টাকা দাম হবে।
মার্কস এঙ্গেলস রচনাবলী কিনেছিলাম পয়সা বাঁচিয়ে। প্রতি খণ্ড তিন টাকা। চল্লিশটি খণ্ডের কিছু আজও আছে।
মার্কসের 'ক্যাপিটাল' তিন খণ্ডে। ১৫ টাকা দাম। ইংরেজি ভাষায়। কিনেছিলাম। কিন্তু বুঝতে পারিনি তখন। পরে বাংলায় পড়েছি। সব বুঝতে পারিনি। কিন্তু বেশ কিছু অংশ উপন্যাসের চেয়ে রোমাঞ্চকর।
অকারণ ভয় দেখানো হতো। এঙ্গেলসের 'অ্যান্টি ডুরিং' বাংলা ইংরেজি দুটোতেই কিনেছি। পড়ার চেষ্টা করেছি। ভালো বুঝিনি। অঙ্ক ভালো না লাগলেও প্রাণপণ শিখেছি, অ্যান্টি ডুরিং বুঝতে।
আসলে আমাদের সামনে তেমন ভালো এবং নিয়মিত পাঠচক্র ছিল না।
কয়েক বছরের ব্যবধানে একটা দুদিন বা তিনদিনের রাজনৈতিক ক্লাস হতো। তাতে বক্তারা মিনিট পনেরো পরই দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ এইসব ছেড়ে সহজ টার্গেট কংগ্রেসে চলে যেতেন। তবে বিনয় কোঙার আধ ঘণ্টা পর্যন্ত বিষয়ে ছিলেন। আর একটা উপকার করেছিলেন, দিগিন বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম করে। পড়ি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা নীললোহিত খুব টানতো। কিন্তু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ভালো লাগে, বলা অন্যায় মনে হতো। নয়ের দশকের শুরুতে সুভাষ চক্রবর্তী টাউন হল ময়দানের এক সমাবেশে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের গদ্যরচনার খুব প্রশংসা করলেন। মনোভাব বদলাল।
সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা ছিল খুবই প্রিয়। যেকোনো প্রতিযোগিতায় তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতা পুরস্কার হিসেবে দেওয়া হতো।
আমি এই বই, শিবনারায়ণ রায়ের বই, একাধিক সংখ্যায় পেয়েছি। যদিও এই দুজন ছিলেন পার্টিতে অপ্রিয়।
শিবনারায়ণ রায়ের লেখা 'সংস্কৃতি ও অবক্ষয়' পড়ে তো চমকে যাই। তিনি ফ্যাসিবাদ ও কমিউনিজম দুটোকেই আক্রমণ করে বলেন, মৌমাছিতন্ত্র।
যাই হোক পার্টির কারও কারও এই উদারতা ছিল।
সুভাষ মুখোপাধ্যায় সিপিআই। তাই রেনিগেড। আর শিবনারায়ণ রায় মানবেন্দ্রনাথ রায়ের অনুগামী। তাই অপছন্দের।
এই প্রসঙ্গে আমার দুজন মানুষের কথা বলতেই হবে।
এক রবীন সেন। দুই এক দাদা। নামটা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না।
রবীন সেন নৌবাহিনীর সদস্য ছিলেন। ১৯৩৯-এ 'দেশ' পত্রিকায় তাঁর গল্প বের হয়। ১৯৪৬-এর নৌবিদ্রোহে সক্রিয় অংশ নেন। প্রসঙ্গত নৌবিদ্রোহের অন্যতম প্রধান নেতা বলাইচাঁদ দত্ত ছিলেন আমাদের পাশের থানা খণ্ডঘোষের মানুষ। আশির দশকে তাঁর সঙ্গে আমার আলাপ হয় নৌবাহিনীর প্রাক্তন সদস্যদের এক সভায়।
রবীন সেন প্রথমে ট্রটস্কিপন্থী, পরে সিপিআই এম।
পড়ালেখা করতেন।
খুব ভালো গদ্য লিখতেন। যদিও আকর্ষণীয় বক্তা ছিলেন না। খুব বড় মনের মানুষ।
তিনি সিপিআই (এম) জেলা সম্পাদক থাকাকালীন একটা চমৎকার গ্রন্থাগার গড়েন। সেখানে 'রাইজ অ্যান্ড ফল অফ থার্ড রাইখ'সহ ভালো বই পড়ি। পাশে অভিধান নিয়ে পড়তে হতো মাঝে মাঝে ।
আর সেখানে আসতো নিউজউইক, টাইমস, দি ইকনমিস্ট পত্রিকা।
একটা আলাদা জগৎ দিয়েছিলেন রবীন সেন। কৃতজ্ঞতা।
পড়ার লোক বেশি ছিল না। ফলে গেলে খুব খুশি হতেন। মুড়ি খাওয়াতেন। রবীন সেন পরে কলকাতায় চলে আসেন। কমিউনে থাকতেন। আমি কলকাতা আসার পরও যোগাযোগ অক্ষুণ্ন ছিল।
আরেকজনের কথা বলি। ন্যাশনাল বুক এজেন্সি তখন বর্ধমান পার্টি অফিসে দোকান খুলেছে। দোকানের পরিচালক শেখর রাজবংশের বই দিতেন। এমনিতে সবসময়ের কর্মীরা ৩০% ছাড় পেতেন। সেটা তো পেতামই, তার সঙ্গে উপরি ছিল, পড়ে ফেরৎ দেওয়া।
এই সুযোগ আমাকে দিয়েছিলেন এক ঘোর কংগ্রেসী। গৌতম তা-ও।
বইয়ের দাম জমা রেখে বই দিতেন।
প্রথম দিন পরীক্ষা নিয়েছিলেন।
আমার প্রাপ্য কুড়ি টাকার বদলে ত্রিশ টাকা দেন। আমি দেখি, ১০ টাকা বেশি। ফেরৎ দিই।
সেটা দেখে গৌতমদা বললেন, সব বই কিনতে হবে না, পড়ে ফেরৎ দিও।
আরও পরে টাকা জমা রাখাও দরকার হতো না। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের বই নোবেল পেল। বইটি দু কপি এল শহরে। একশো টাকা দাম।
যাওয়ার আগেই বিক্রি।
সেই বইও একদিন পর পেয়েছি। সাদাত হাসান মান্টোর লেখা প্রথম পড়ি 'যুগান্তর' শারদ সংখ্যায়। মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুবাদে। ট্রেনে পাঁচ টাকায় তখন পুরনো শারদ সংখ্যা বিক্রি হতো। কিনি। পড়ি মান্টো। পুরো ফিদা।এই লেখকের কথা বললাম, গৌতমদাকে। ইংরেজি বই। আরও পরে সৌমিত্র লাহিড়ী মান্টোর ছোটগল্প সংকলন পড়তে দেন। ইংরেজিতে। আমি দুয়েকটি গল্প অনুবাদও করেছি। সৌমিত্র লাহিড়ী অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে 'যুবমানস' পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। ২৫ পয়সা দাম ছিল পত্রিকার। একাদশ শ্রেণিতে পড়ার সময় আমার একটা চিঠি ছাপা হয়। সেই চিঠি পডে ঘোর বন্ধু হয়ে গেল গলসির সাঁকো গ্রামের চিন্তাহরণ রায়। চিন্তাহরণ তখন সম্পাদক। নবম শ্রেণি থেকেই সে 'সাঁকো' নামে একটা পত্রিকা সম্পাদনা করতো।
চিন্তাহরণ বর্ধমান মিউনিসিপ্যাল স্কুলে একাদশ শ্রেণিতে বিজ্ঞান পড়তে এসে সহপাঠী হল।