কলকাতা বইমেলা শেষ হয়েছে। আর আজ আমাদের গ্রামে ১৯ মাঘ ওলাইচণ্ডী পূজার মেলা। এই মেলাতেই হিন্দু মুসলমান সব সম্প্রদায়ের মানুষ বাড়ি ফেরেন। ইদ বকরিদ বা পূজা অনুষ্ঠানে না ফিরলেও মেলায় ফেরা চাই।
বহু মানুষ এভাবেই ঘরে ফেরেন।
আমিও।
মাঝে বহুবার ফেরা হয়নি।
অনেকবার বইমেলার কারণে। ২০২১ এ কলকাতা বইমেলা হয়নি। এসেছিলাম।
আমার স্বভাব ছিল গ্রামে প্যান্ট জুতো ঘড়ি খুলে গেরুয়া লুঙ্গি আর গেরুয়া পাঞ্জাবি পরে খালি পায়ে গ্রামের সব বাড়ি ঘোরা। আগে ছিল ৬৫ টি বাড়ি। এখন প্রায় ৪০০। সব বাড়ি ঘুরতে ঘুরতে কোথাও একটা খাওয়া জুটে যায়। আদিবাসী পাড়ায় তো খেতেই হবে। এবং যেতেও। প্রথমে যাই বেনেপাড়া ও বামুনপাড়ায়। বেনে পাড়া ও বামুনপাড়ার মাঝে বারোয়ারি তলায় শিবমন্দির ও ওলাইচণ্ডী পূজা হয়।
আমি ২০২১ এ গিয়ে করোনা এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে সব বাড়ির ভেতরে যেতে অস্বস্তি বোধ করছিলাম।
রামমামার বাড়িতে অবশ্য অবশ্য যেতে হবেই। আমার দিদিমার সই অন্নপূর্ণা দত্ত। গেলেই ঠোঁটে হাত দিয়ে মাথায় চুমু খাবেন। এখন ৯৬ বছর বয়স। ওদের বাড়িতে কোনোদিন ছোঁয়াছুঁয়ি দেখিনি। দুধ বা শরবত খেতেই হবে।
২০২৩-এ গিয়েছিলাম অন্য একবার দেখা হয়নি। আজ, ২০২৪ এ হল। বন্ধু সাংবাদিক ঋজু বসু সঙ্গে ছিলেন। বারোয়ারি মন্দির তলায় ওলাইচণ্ডী পূজা চলছিল। সেখানেই ছিলেন বসে। উঠলেন দেবু মালিকের সাহায্যে।
বয়স হয়েছে তাই আমি নিজের পরিচয় দিলাম।
গ্রামে আমার পরিচয় এনামের ছেলে। তবে এই অভিজ্ঞতা হল ঋজুরও। আনন্দবাজারের সাংবাদিক বলে লোকে চিনছে, কিন্তু জগন্নাথ বসু ঊর্মিমালা বসুর ছেলে বললেই লোকে বলছেন, আরে ব্বাস।
এবং ছেলেকে বাবা মায়ের গুণগান শুনতে হল সবজায়গাতেই। সত্যি কথা বলতে কি রেডিও শুনতেন সব মানুষ। এবং ঊর্মিমালা বসু জগন্নাথ বসু কার্যত শ্রুতিনাটককে জনপ্রিয় করেন।
আমিও গ্রামে বাবার ছেলে।
গতবার অন্নপূর্ণা দিদিমাকে এনামের ছেলে বলায় তিনি বলেন, আমি যদি বলি জাহানারার ছেলে।
এবার বললেন, যদি বলি আমার নাতি।
রামমামার মায়ের নাতি তো বটেই।
এই তো আমাদের ভারত।
গতবারের অভিজ্ঞতা লিখি আগে। ২০২১এ এসেছি। করোনা কাল একটু কেটেছে। ঘুরতে ঘুরতে গিয়েছি এক বাড়ি।
আয়। ঘরের ভিতরে আয়।
অস্বস্তি বোধ করি। মানসিকতা কতো পাল্টে গেছে মানুষের। মনের মধ্যে বিদ্বেষ উঁকি ঝুঁকি মারে। এঁরা তো বামুন। শোওয়ার ঘরে যাওয়া ঠিক হবে? আগে ভাবতাম না। এখন দেখে শুনে দ্বিধা জাগে।
আয় ভাই। বোস।
দেখি ঝুনু দিদি । বোন রাণু নিয়ে যায় ঘরে। চেয়ারে আসন পাতা। বসি। ঝুনু দিদি, বোন রাণু, আমাদের গ্রামের মানুষ। পাশের গ্রামের পলাশন উচ্চ-মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের গণিত শিক্ষক শান্তি চক্রবর্তীর বড়ো মেয়ে। মা মেয়ে দুজনেরই দুধে আলতা রং। লক্ষীপ্রতিমা মনে হতো মা মেয়েকে।
দিদিরা কলকাতায় থাকে। তিন বোন এক ভাই। সবাই এখন কলকাতা বা হাওড়ার বাসিন্দা। ওলাইচণ্ডী পূজা উপলক্ষে মেলায় এসেছে। যে মেলা উৎসবে হিন্দুদের চেয়ে মুসলমানদের উৎসাহ এক চুলও কম নয়। বরং বেশি। অ্যামেচার যাত্রার মূল উদ্যোক্তা তারাই।
শান্তিবাবুর নাম ছিল অঙ্কে। সাতে পাঁচে না থাকা মানুষ।
বন্ধু তাপসের বাবা। তাপস আর নুরুল ক্রিকেট খেলা ভালো ভাবে শুরু করে গ্রামে বিডি মহাজনের ব্যাট প্যাড গ্লাভস কিনে এনে।
পরে শ্যামল দত্ত মামার কাছে শুনেছি, গোপী সরকার কলকাতায় থাকতেন। বড়দিনের ছুটিতে ধান ঝাড়াতে আসতেন। দুই ছেলেকে নিয়ে। ছেলেরা নাকি ক্রিকেট খেলতো। সে আমার মনে নেই।
তাপস ঘুমোচ্ছিল। দিদি আর বোন মিলে তাপসকে তোলে।
তাপস বলে, তোকে টিভিতে দেখি। কী ভালো লাগে। দেখলেই লোককে বলি, আমার বন্ধু। একসঙ্গে খেলেছি।
কথায় কথায় গ্রামের পুরাতন দিনের কথা ওঠে। মাটির দোতলা বাড়ি ছিল তাপসদের। বারান্দায় ছিল কাঠের শৌখিন রেলিং।
সে বাড়ি গেছে কালের নিয়মে। কেউ থাকেন না।
সবাই কলকাতা হাওড়ায়।
পুরাতন গ্রামের কথা ওঠে।
বলে, আমাদের গ্রামের মতো গ্রাম হবে না। হিন্দু মুসলমান ভেদ নাই।
এই জন্য মেলায় আসি।
একটা ঘর করেছি তাই।
সবার সঙ্গে দেখা হয়।
সাধন কাকাদের সঙ্গে বড়ো প্রাণের সম্পর্ক ছিল শান্তিবাবুদের। নিজের ছেলের মতো ভালবাসতেন। সাধন কাকাও রাণুদিদিদের সঙ্গে গ্রাম ছাড়েন।
এখন হোমিওপ্যাথি ডাক্তার।
ঝুনুদিদি বলল, তোর লেখা দেখলে লোকদের বলি আমার ভাইয়ের লেখা।
'আমার ভাই'!
গ্রামের ছেলে নয়, আমার ভাই।
চোখ ভরে আসে জলে।
'পথের পাঁচালী'র রাণুদিদি যেন উঠে আসে অপুর কাছে।
সাধনকাকা বললে, গর্ব হয় তোর জন্য। টিভিতে যখন বলিস।
সাধন কাকা তোমরাও আমাদের গর্ব গো। কী সুন্দর আঁকতে আর লিখতে। কেউ নেই। তবু ভিটেটা রেখেছো।
সাধন কাকাকে বলায় উত্তর এলো, দৈন্যের দায়ে বেচিব সে মায়ে এমনি লক্ষ্মীছাড়া।
সাধন কাকা দীন নয়। স্বচ্ছল মধ্যবিত্ত।
কথায় আছে, গাঁয়ে মায়ে সমান গো।
সমান।
গ্রামের পুরাতন আত্মা যেন বেঁচে থাকে। রাজনীতি আর অপ-ধর্ম যেন বাধা হয়ে না দাঁড়ায়।
মাটির দোতলা বাড়ি কীভাবে তৈরি হয়?
সিঁড়িও মাটি দিয়েই তৈরি হতো। আমাদের বাড়ির সিঁড়ি এবং বারান্দা অবশ্য পাকা। বাড়ি তৈরিতে লাগে বিশেষ ধরনের মাটি-- আমরা বলি লাল মাটি। একটু বালি মেশানো থাকে। তাতে খড়ের কুটি বা পাটকুচি ইত্যাদি দিয়ে পচানো হয়। পা দিয়ে ছানতে/ মাখতে হয় দিন পাঁচেক। আঠালো হলে দেওয়াল ধরানো। এক একটা পাট দিতে হয়।
আমাদের বাড়ির দেওয়ালের পাট প্রতিটা এক ফুট উঁচু। আর প্রায় দু ফুট চওড়া।
ঘরের ছাউনি আগে হতো খড় দিয়ে। এখন অ্যাসবেস্টস টিন।
আর ছাত মানে দোতলার মেঝেতে কড়ি বরগা করা হয় সারালো তাল গাছ কেটে তাকে মাসখানেক জলে ডুবিয়ে রেখে। মেঝেতে দেওয়া হয় বাঁশ।
বাঁশও পুকুরে ডোবানো থাকে মাসখানেক।