শনিবারের সকাল মানে আমেরিকার রাত। এ-সব বইয়ে পড়েছি। এখন বন্ধু অনুজরা আমেরিকায় থাকে, টুকটাক কথা হয়। তবু মনে থাকে না। আজ সকালে আমেরিকা প্রবাসী সায়নের হোয়া তাগাদা (লেখা কোথায়?) দেখে মনে পড়ল, লেখা তো পাঠাইনি।
আসলে গত শনিবার রাতে মনে মনে লিখে ফেলেছিলাম। একটা লটারির দোকান ছিল আমার থাকার জায়গার উল্টোদিকের মূল রাস্তার ওপর। তারপাশে বাঙ্গালির নতুন আমদানি পোল্ট্রি মুরগির দোকান। এবং আমার ঘরের গায়ে এক সাইকেল সারানোর দোকানের মালিকের কাহিনি। মনে মনে ভেবেছি, তাই লেখাও হয়ে গেছে ভেবে স্বস্তিতে ছিলাম। আসলে ২৮ সেপ্টেম্বর পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ডের বই পার্বণ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে রবীন্দ্র সদনে বাসে যেতে যেতে ভাবছিলাম, বেঁচে থাকলে কাদামাটির হাফলাইফ তথা স্মৃতিকথনের তৃতীয় খণ্ডের নাম দেব-- ফাটা রেকর্ড। ও হরি, কিছু পরেই ফেসবুক খুলে দেখি, ক্যালকাটা রেকর্ডস ডট কমের বিজ্ঞাপন হাজির। ব্যাটারা পণ্য পড়তে পারে, লেখা পারে না ক্যান?
লিখতে বসে দেখি, বাইরে নিম্নচাপের বৃষ্টি, ওদিকে বৃষ্টি মাথায় জেনেও মাধ্যমিক ১৯৮২ ব্যাচের কিছু বন্ধু বান্ধবী বাঁকুড়া মশাগ্রাম ট্রেনে উঠে পড়েছে দীঘা যাবে বলে। আরেকজন এখনো রান্না করছে। ১০-০৫এর কর্ড লোকাল ট্রেন ধরবে। সেই মূল উদ্যোক্তা। ক্লাসের সবচেয়ে চুপচাপ মেয়েদের একজন, শোভা দাস। ডাক্তারের বোন। ওঁর মুখে শুনি, বাবা টিউশন দেননি, ছেলেদের সঙ্গে মিশে যদি বখে যায়। স্কুলে নবম শ্রেণিতে ছিল আলাদা বিভাগ সি সেকশন। ছাত্র ফেডারেশনের হয়ে সদস্য করতে বা ক্লাস ডায়াসিংয়ে গেলে গভীর চোখে তাকাত শোভা। ২৫ পয়সা দিয়ে এসএফআই-য়ের সদস্য পদ নিয়েছিল সবার আগে। সে সময় ২৫ পয়সা অনেক। তিনটে চপ বা পাঁচটা আইসক্রিম হতে পারতো। একটা পাঁউরুটির দাম তখন ১৫ পয়সা। বাপুজী কেক তখন বাজারে আসেনি। আরামবাগের পপুলার বা কোহিনূর কেকের দাম ২০ পয়সা। শোভা এখন ঝাড়া হাত পা। বর অবসরে। বন্ধুদের গ্রুপে কবিতা লেখে আর সবাইকে তাগাদা দেয়, চলো দেখা করি। সে এক্কেবারে তিনদিনের দীঘা ট্যুর ফেঁদেছে। কয়েকজন জুটেও গেছে। প্রসেনজিৎ রায়, সস্ত্রীক নবকুমার, সস্ত্রীক রমেশ, সস্ত্রীক আজম, সস্ত্রীক পীযূষ, নন্দিনী, মালা। প্রসেনজিৎ চুপচাপ ছেলে। পুনর্মিলনে বিরাট ভুমিকা নেয় অনন্তদা, জ্যোতির্ময়, সুবীর রক্ষিতদের সঙ্গে। আছে সস্ত্রীক নবকুমার। সে যে এত রসিকতা জানত বোঝাই যায়নি স্কুলে। এক্কেবারে শান্ত। মন দিয়ে অঙ্ক করতো। হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ, আরেক শান্ত ছেলে অভিজিৎ-এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে, নবকুমার আর শোভা জমিয়ে রাখে। জুবিলার রমেশ আমার বরাবরের ভালো বন্ধু। ভ্রমণে শোভা আমাকেও দলে রেখেছে! এদিকে গিল্ডের বই পার্বণের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের দায়িত্ব, বাড়িতে এবং পাড়ায় দুটি কুকুরের শরীর খারাপও। ওষুধ খাওয়াতে হচ্ছে তিনবেলা। ভোর থেকে রাত। মুখ ধরে গলায় ঢুকিয়ে দিতে হয়। না হলে ফেলে দেবে। ওদিকে এই নিম্নচাপের বৃষ্টির হাতছানিতে জীবনে প্রথমবার বন্ধুবান্ধবীদের সঙ্গে হই হুল্লোড়, আবার ডর্মিটরিতে থেকে, সঙ্গে খিচুড়ি ইলিশ। কী যে করি! ওদিকে সায়ন কর ভৌমিক বউ মেয়েকে পূজার মহলায় নিয়ে গেছে সেতার আর সঙ্গীতে। সঙ্গে তাগাদা। ভয়ে মরছি।
তবে ইলিশ বলতেই মনে পড়ল বাংলাদেশের চাঁদপুরের একখানা ইলিশ শুয়ে আছে ফ্রিজে । খবরের কাগজ মোড়া। ইন্দো বাংলাদেশ প্রেস ক্লাবের ভাইয়েরা ডেকে দিয়েছেন। ভাস্কর, শুভদীপদের ফোন, ২৩ সেপ্টেম্বর কোঠায় তুমি? ইলিশ বসে কান্নাকাটি করছে তোমার কড়াইয়ে চাপবে বলে। ২৩ সেপ্টেম্বর তিনটি কাজ। অবনীন্দ্র সভাঘরে তীর্থদের বিজ্ঞানে সাহিত্য নিয়ে বলা, ওদিকে মিনার্ভা থিয়েটারে মানিকতলা খালপাড়ের শিশুদের নাটক, তার সঙ্গে ইলিশের আহ্বান। আজকাল হোয়াটসঅ্যাপ ঠিক মত দেখা হয় না। পড়ে থাকে একা একা বার্তা। ইলিশের আহ্বানটিও তাই! ইলিশ নিয়ে ফেরার পথে পার্ক সার্কাস। পার্ক সার্কাস বাজার এক অদ্ভুত জায়গা। এখানে গোরু শুয়োর দুই মাংসই মেলে। ইলিশ পড়ে আছে অনন্ত শয়ানে।
আজ ভোর থেকে 'হোয়া' দেখতেই হচ্ছে। বন্ধুরা লোকাল ট্রেনে। হোয়াতেই হাঁক দিচ্ছে। আসছে হাওড়া। আমি ভাবি দুনিয়া কত সুন্দর। আজম, আমার শৈশবের, ন্যাংটোবেলার বন্ধু। সে স্কুলে ছিল চুপচাপ। এখন সবকিছু করছে -- টিকিট কাটা ঘর বুক করা। আরও চুপচাপ শোভা-- সেই অলিখিত চালিকা। বন্ধুদের বউয়েরা আছে বান্ধবীদের বরেরা বাদ এই সফরে। আরেক জন আছে, যাঁকে কত চিঠি লিখতে হয়েছে অন্যের হয়ে, সে শুধু নিত আর বন্ধুটিকে অপেক্ষা করিয়ে রাখতো। আমি ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করতাম, কিছু বললো।
না, শুধু হাত বাড়িয়ে নিল। বলেই তার ব্যাকুল প্রশ্ন, আশা আছে বলো, বড়ভাই।
ছেলেটি এখন মস্ত মৎস্যবিজ্ঞানী। জন্মসূত্রে মুসলিম। প্রেমে পড়েছিল এক মেয়ের। মেয়েটি হিন্দু -- আমাদের মনে একবারও আসেনি।
প্রতি সোমবার টিউশন থেকে বের হয়ে লাল মোরাম রাস্তার ধারে অপেক্ষা করতো ছেলেটি। সোমবার ছিল চিঠি দেওয়ার প্রথম দিন। আমি রবিবার রাতে লিখে রাখতাম। মেয়েটির নামের সঙ্গে মিলিয়ে সোমবার। প্রতি সপ্তাহে দুটি চিঠি।
লিখতে লিখতেই নন্দিনীকে ফোন করলাম। তখন সব মেয়েদের তুমি বলতাম। এখনও তাই বলি। শুধু নন্দিনীকে তুই তোকারি করছি ইদানীং। ও-ও তাই।
জিজ্ঞেস করলাম কীরে, নাম দেবো?
দে।
বর রেগে যাবে না?
আরে ন্না, আমার বরের ওসব নাই।
পৃথিবীটা কত সুন্দর আছে আজও। আমাদের তথাকথিত মফস্বলে। কলকাতায় কেন তবে এত বেশি ভেদ?
বলতে বলতেই আয়ুবকে ফোন। নাম দেবো?
দাও। আয়ুব আজও তুমি বলে। আমি বলতাম, তুই।
বউ কিছু বলবে না?
আরে সে বয়স কী আছে?
আয়ুব খুব যত্ন করে খাম কিনত। অসিতদার দোকান থেকে। ১০ পয়সা দামের। সবচেয়ে দামিটা। খামের এমনি দাম, পাঁচ পয়সা। তাতে মাঝে মাঝে গোলাপের পাপড়ি। বাজেট পারমিশন করলে একটা গোলাপ। নন্দিনী নিত। হেসে। কিন্তু কোনদিন উত্তর দিত না। দেয়ও নি। টানা দু বছর সপ্তাহে দুটো করে চিঠি নিয়ে গেছে। আজ হাওড়ায় দেখা হবে, নন্দিনীর সঙ্গে, জিজ্ঞেস করবো, চিঠিগুলো কেন নিত? আর নিয়ে কী করতো? আমার অইসব সাহিত্য কর্ম। এ বই সে বই পড়ে প্রাণের আবেগে একজনের হয়ে লিখে দিতাম চিঠি। এ-রকম কতজনের হয়ে যে লিখেছি!
এখন লিখছি আর ফোনে কথা বলছি। আয়ুব বন্ধুদের মধ্যে ছিল বড়লোক। কাকা রিজার্ভ ব্যাঙ্কের অফিসার। দৈনিক আট আনা বরাদ্দ। টিফিন খেতো না। পয়সা জমিয়ে খাম কিনতো। আর বন্ধুদের চপ খাওয়াতো।
আরেকজন ছিল আকবর। ধনী ব্যবসায়ীর ছেলে। অতি ভদ্র। পরে ডাকাতরা এসে খুন করে দিয়ে যায় ডাকাতি করতে এসে।
আয়ুবের সঙ্গে কথা হতে কত কথা মনে পড়ল। পরেশবাবুর কথা। বাজারের সবচেয়ে ধনী দোকান দীনবন্ধু পালের বাড়ির ছেলে অজয় পালের কথা। অজয় বাড়ি থেকে খাবার আনতো, দোকান থেকে, লুকিয়ে, আয়ুবকে খাওয়াবে বলে।
বাড়িতে নিয়ে যেত। যাওয়ার আগে প্রথম বার বলে, ঠাকুমাকে আসল নাম বলবি না।
নিয়ে গিয়ে নিজেই নাম বলে দিল, অমিত পাল।
প্রণাম করতেই ঠাকুমার জিজ্ঞাসা, কোন পাল? ছোটলোক না ভদ্রলোক?
ঠাকুমা তো গলে জল, 'ভাই আমার সোনা আমার' বলে যত্ন করে নাতির বন্ধুকে ভাত খাওয়ালেন। পরেও তাই।
আয়ুব বলছিল, এখন, ছোটলোক আর ভদ্রলোক কী আজও বুঝিনি। কিন্তু ঠাকুমাকে কি সত্যি নাম বলা উ্চিত ছিল? অন্যায় করেছি বলো! চুপ করে যায় আয়ুব।
আমি বললাম, বললে অজয় কষ্ট পেত। ওতো তোমাকে ভালবাসতো। ভালবাসার মানুষকে বাড়িতে নিয়ে যেতে সে সময় মানুষ কত আনন্দ পেতো। তাকে খাইয়ে তবে শান্তি। আমি অবশ্য স্বনামে সেহারায় সুবীর রক্ষিত, রাজীব চ্যাটার্জি, সুমনা চ্যাটার্জি, সুবীর ভৌমিকদের বাড়িতে খেয়েছি।
অজয়কে পরে বহু খুঁজেছে আয়ুব, আর পায়নি।
আর এক উচ্চপদস্থ বন্ধুকে ফোন করি-- দীঘা যাবি না ভাই?
যাব কী করে? জেলার দায়িত্বে। কোনও ছুটি নাই। তুমি স্কুলে পড়ার সময় কবিতা লিখেছিলে, ক্রীতদাস স্পার্টাকাস আজ করবেই বিদ্রোহ। আমাদের বিদ্রোহ করার ক্ষমতা নাই। আজ আমরা আধুনিক ক্রীতদাস। চাকুরে। যখন তখন হোয়াটসঅ্যাপে নোটিশ । অনলাইন মিটিং। তখন তুমি স্কুলে নাইনে পড়ার সময় পোস্টার লিখতে রোজ। আমাদের তখন সাদা কাগজ কেনার পয়সা নেই। পুরানো খবরের কাগজে লিখতে। টিউশন পড়ে ফেরার সময় স্কুলের গেটে মেরে দিতাম। কত প্রতিবাদ করেছি তোমার সঙ্গে মিলে ১৪-১৫ বছর বয়সে। আজ ক বছর পর অবসর। পয়সা আছে, কিন্তু আর প্রতিবাদের সে ক্ষমতা নাই গো।