আমাদের জীবনে ক্লাসের বইয়ের বাইরে পড়ার বই খুব বেশি ছিল না।
গল্প উপন্যাসের বইয়ের নাম ছিল, আউট বই। আউট বই পড়া অনেক বাড়িতেই খুব ভালো চোখে দেখা হতো না। লুকিয়ে লুকিয়ে পড়ার চল। সেদিক থেকে বাবার কল্যাণে আমাদের ওইসব ঝামেলি ছিল নি। বাবাই তো যাত্রা থিয়েটার সিনেমা দেখাতে নিয়ে যাওয়ার পাণ্ডা। এইসব বিষয়ে ভয় মাকে। মা এমনিতে ছেলেমেয়েদের মারতেন না। বাবার মার আমার বেলায় যখন তখন। মায়ের মার খেয়েছি বলে মনে পড়ছে না। অথচ আমি এই বছর কয়েক আগেও বাবার পক্ষে। এখন বুঝি মা কতখানি সম্পদ। যার মা নেই, তার অনেকখানি ফাঁকা। মাও ছড়া বলতেন বানিয়ে বানিয়ে। সুন্দর হাতের লেখায় চিঠি লিখতেন বোন ও দিদিদের। মায়ের বাপের বাড়ি তো গ্রামে। চিঠি লেখার ঝামেলা নেই। নতুন বিয়ের পর ৫০০ মিটার রাস্তা পালকিতে যেতেন। পরে রাতের বেলায় হেঁটে। আমরা তো জন্ম ইস্তক দেখে আসছি দিনের বেলাতেও যাওয়া। তফাৎ একটাই, মাথায় ঘোমটা। হিন্দু মুসলমান সব মহিলাই বাইরে ঘোমটা দিতেন। ঘোমটায় কোন তফাৎ ছিল না। 'কেয়াপাতার নৌকা' টিভি ধারাবাহিক থেকে মুসলিম মহিলাদের ঘোমটাকে কানের তলায় যে কোন পণ্ডিত ঠেললেন, এখন সব নাটকে, সিনেমায় এই ঘোমটা দেখছি। কিছু মুসলিম মহিলাও এর নকল করছেন।
বইয়ের কথা আগের খণ্ডে কিছু বলেছি। পরে আরও বলতে হবে। বই ছাড়াও বিজ্ঞাপনের কাগজ খুব মিলতো। যাত্রার। সিনেমার। বিভিন্ন পার্টির। এবং সন্তোষী মা ও বাবা তারকেশ্বরের।
সন্তোষী মা তখন সত্তর দশকে আমাদের এলাকায় নতুন নাম। শুক্রবার নিরামিষ খাওয়ার আহ্বান। এবং এই লিফলেট আর ২৫/৫০ টা ছাপিয়ে বিলি করার লোভ ও ভয় দেখানো বক্তব্য দিয়ে শেষ হতো। হলুদ বা সবুজ কাগজে ছাপা হতো। এর নাম ছিল তখন হ্যান্ডবিল।
লিফলেট বা ইস্তেহার এ-সব কথা শুনি বর্ধমানে এসে।
সন্তোষী মা-র হ্যান্ডবিলের শেষে লেখা থাকতো এটা ছেপে বিলি করায় কত টাকা লাভ হয়েছে আর না করলে কী হবে তার ভীতিকর বর্ণনাও।
অনেকেই এর ফলে না পড়েই ফেলে দিতেন। এগুলো পাওয়া যেত বেশি বিডিআর ট্রেনে।
সন্তোষী মা-র ভক্ত হতে গ্রাম বাংলায় কাউকে দেখিনি। তবে পরে কলকাতায় এসে কিছু ডিগ্রি প্রাপ্ত মহিলাকে দেখেছি, যাঁরা সন্তোষী মা-কে মেনে শুক্রবার নিরামিষ খেতেন।
গ্রাম বাংলায় বিশ শতকের সত্তর আশির দশকে আমিষ নিরামিষ বলে আবার কী? যা জোটে তাই খায়।
আমিষ আর কদিন হতো?
খাসি/ পাঁঠার মাংস বছরে একদিন। দুর্গাপূজার নবমীতে। ভাগ করে চাঁদা দিয়ে খাসি/ পাঁঠা খাওয়া। মুরগি আশির দশকের শেষ দিকে গ্রাম বাংলার হিন্দু বাড়িতে প্রবেশাধিকার পায়। রামপাখি হল মুরগি।
পুকুরে মাছ ধরলে বা খেপ জাল ফেললে তবে মাছ। বর্ষাকালের পর অবশ্য প্রায় দিন মাছ। জমির খেতে, ক্যানেলের জলে আড়া বা ঘুষি দিয়ে মাছ ধরা।
ভাদ্র আশ্বিন মাসে মাঠের ধান জমিতে খলবল করতো দাঁড়কে আর পুঁটি মাছ। বাঁশের চোঙ দিয়ে জল বের হতো ঝর্ণার মতো। ঝর্ণায় স্নানের আনন্দে পুঁটি দাঁড়কে মাছ খলবল করে পড়তো পাশে কেটে রাখা গর্তে।
দাঁড়কে মাছ অনেকটা কাঁচকি মাছের মতো। সুস্বাদু।
হিন্দু মুসলমান খাবারেএকটা তফাৎ মনে পড়ছে।
আলু ভর্তায়।
আলু ভর্তার তিনটি নাম ছিল।
আলু মাখা, আলু ভর্তা এবং আলু ছানা।
কলকাতার বিশেষ কিছু অঞ্চলে বিশেষ করে মাড়োয়ারি এলাকায় এর নাম আলু চোখা।
মুসলিমদের আলু ভর্তায় পেঁয়াজ বেরেস্তা করা হতো। শুকনো লঙ্কা ও গোল করে কাটা পেঁয়াজ দিয়ে আলু মাখা।
আর একটা হতো শুকনো লঙ্কা পুড়িয়ে কাঁচা পেঁয়াজ সরষে ইলিশ তেল নুন দিয়ে মেখে।
এছাড়া ডিম সিদ্ধ দিয়ে আলু ভর্তা মাখা।
পরে পোস্ত দানা, গোটা জিরে, রসুন ইত্যাদি দিতে শিখি।।
'হিন্দু' বাড়িতে সাধারণত আলুতে পেঁয়াজ রসুন নয় শুকনো লঙ্কা ভেজে বা একটু ঘি দিয়ে গোল করে পাকিয়ে দেওয়া হতো।
উজ্জ্বল সিনহার লেখা একটা চমৎকার উপন্যাস পড়লাম। সদ্য। উজান গাথা। তাতে দেখি, যৌথ পরিবারের চার ভাইয়ের মেজ ভাই অবিবাহিত। ব্যাঙ্কে কাজ করেন। ঘোর কমিউনিস্ট। দৈনিক একই রঙের পোশাক পরে কাজে যান। তিনি, সূর্যকুমার, এমনিতে খুব ভালো মানুষ।
কিন্তু আলু ভর্তার গোল্লা ঠিক মতো গোল না হলে থালা ছুঁড়ে দেন।
তাই দেখে স্বাধীনতা সংগ্রামী ও কংগ্রেস সমর্থক মা বীণাপাণি বলেন, এরাই আবার কমিউনিস্ট পার্টির কথা বলে!
মায়ের সঙ্গে ছেলের প্রবল মতাদর্শগত অমিল। অথচ এই অবিবাহিত ছেলেকে ঘিরেই মায়ের গোপন আবেগ। ভালোবাসা। ছেলে সূর্যকুমার যখন সংসার ভেঙ্গে ভাগ হয়ে যাচ্ছে, মানতে না পেরে এবং অন্যান্য কারণে আত্মহত্যা করে।
আমাদের ছোটবেলায় অভাবের জ্বালায় সংসার চালাতে না পেরে পুরুষ বা নারীর আত্মহত্যার চেষ্টা দেখেছি। তবে এক 'মুসলিম' তরুণীর প্রেমে এক 'হিন্দু' তরুণের আত্মহত্যা গ্রামে খুব আলোড়ন তোলে।
আরেকজন ছেলেও আত্মহত্যা করে। কেন? আজও রহস্যময়। আমার খুব প্রিয় ছিল। কংগ্রেসি বাবার সিপিএম সমর্থক কিশোর।
আমাকে যে কী ভালোবাসতো! ওঁর বড়দাদা ছিলেন আমার সহপাঠী।
সেজভাইটি আমার এত ন্যাওটা হলো!
আমারও খুব ভালো লাগতো ছেলেটিকে।
কেন যে চলে গেল।
সম্পর্কে ভাইপো হতো।
আমি যেখানে ক... সেখানে।
আমি গ্রাম ছেড়ে শহরে পড়তে চলে এলাম। যোগাযোগ ক্ষীণ হয়ে এল।
আজও মনে পড়লে, এত খারাপ লাগে।
কোন অভিমানে চলে গেল সে।
বলে গেল না।
অকালে চলে যাওয়া মাত্র দুজন মানুষের। আর গেছেন আমার মেজদি ও বড়দি। শ্বশুরবাড়িতে। আর বাবা মা নেই। ঠাকুমা তো কবেই!
বাকিরা তো তবু বেঁচে আছেন।
বেঁচে থাকাই তো ধর্ম জীবনের।