নিজের সব সম্পত্তি পার্টিকে দান করে দিয়েছেন কমরেড সুন্দরাইয়া -- এই কথাটা মাঝেমাঝেই উচ্চারিত হতো বাড়িতে।
মা বেশ ভয়ে ভয়েই থাকতেন।
এমনিতেই জমি প্রায় প্রতি বছর বিক্রি হতো।
বাবা এমনিতে বইছাড়া কোনো কিছু উপহার কিনে আনতেন না। খাবার দাবার ফল। বছরে দু'একবার প্যাকেট দেখলেই, ভয় লাগতো।
এই বাবা জমি বেচে এলো।
প্যাকেট মানে তাতে কচুরি আলুর দম আর মিষ্টি। খেতে ভালোও লাগতো।
আমাদের এখনকার রাজনীতির দশা হয়েছে তাই। যন্ত্রণা ও আনন্দের।
আমার বাবার মুখে শ্রদ্ধেয় কয়েকজন নেতার নাম উচ্চারিত হতো। মুজফ্ফর আহমেদ, আবদুল হালিম, পি সুন্দরাইয়া, হরেকৃষ্ণ কোঙার এবং নাগি রেড্ডি। পি সুন্দরাইয়া ১৯৭৬-এ পার্টি সংশোধনবাদী হয়ে যাচ্ছে বলে চিঠি লিখে পার্টির সাধারণ সম্পাদক পদ ও পলিটব্যুরো সদস্যপদ ছেড়ে দেওয়ায় কষ্ট পান। জনসঙ্ঘের সঙ্গে হাত মেলানোয় ছিল মূল আপত্তি সুন্দরাইয়ার। বাবা অবশ্য ইন্দিরা জমানার অবসানে প্রাণপণ লড়ে যান।
পি সুন্দরাইয়ার আসল নাম সুন্দরামা পুচাপল্লী রেড্ডি।
আব্দুল হামিদ খান ছিলেন তাঁর রাজনৈতিক গুরু। জাতপাতের ঘৃণা দূর করতে নিজের ব্রাহ্মণ চিহ্ন ও পদবি বিসর্জন দেন। নাম নেন পুচাপল্লী সুন্দরাইয়া। ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন সাজ্জাদ জহির, অমৃতপাদ ডাঙ্গে, ই এম এস নাম্বুদিরিপাদের। বিয়ে করেন লায়লা সৈয়দকে। পার্টির লোকেদের মুখে তাঁর নাম হয়ে দাঁড়ায় লীলা সুন্দরাইয়া। লায়লা ও সুন্দরাইয়া দেশ জাতির জন্য কাজ করবেন বলে সন্তান নেবেন না বলে, সিদ্ধান্ত নেন।
এতে সীমায়িত হয়ে যায় রাজনৈতিক আদর্শ। আপোসকামী হয়ে ওঠে জীবন। বিশ্বাস করতেন হয়তো।
পি সুন্দরাইয়া পার্টিতে আসেন গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনের পথ বেয়ে। কংগ্রেস সোসালিস্ট পার্টি হয়ে। জেলে গিয়ে। তেলেঙ্গানা সশস্ত্র বাহিনী গড়ে লড়াই করেন নিজামের রাজাকার বাহিনীর বিরুদ্ধে। বন্ধুয়া বা ক্রীতদাস মুক্তির আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। বালচন্দ্র ত্র্যম্বক রণদিভে এবং তিনি সশস্ত্র বিপ্লবের পথে ভারতে শ্রমিক কৃষকের ক্ষমতায়নের স্বপ্ন দেখতেন। ১৯৬৪-তে পার্টি ভাগ হলে পি সুন্দরাইয়া সাধারণ সম্পাদক হন। মাঝে জেলে যান। পদত্যাগের আগে পর্যন্ত সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
তিনি একটি চিঠি লেখেন। কেন আমি পার্টির সাধারণ সম্পাদক পদ এবং পলিটব্যুরো থেকে পদত্যাগ করলাম।
তাঁর মূল্যায়ন কতো সঠিক ছিল আজ বুঝি। ১৯৮৫ তে শ্রীকান্ত রাণা, নকশাল ছাত্র রাজনীতি করতো, আমাকে এটি পড়ায়। 'মার্কসিজম টুডে' পত্রিকায় বের হয়েছিল। ১৯৯৪-৯৫ পর্বে শিয়ালদহে মেসে থাকার সময় কেউ এটিতে চক্ষুদান করায় পত্রিকাটি আর পাই না। পরে আরো একজন ১৯৯৮-এ এর বাংলা অনুবাদ দেন।
চিঠির মোদ্দা বক্তব্য ছিল তিনটি।
ক। আমাদের রাজনৈতিক মূল্যায়নে ভুল হচ্ছে।
খ। ইন্দিরা গান্ধী আধা-ফ্যাসিবাদী। আর তাঁর বিরোধিতা করতে গিয়ে যাঁদের হাত ধরা হচ্ছে সেই জনসঙ্ঘ আর এস এস সম্পূর্ণ ফ্যাসিবাদী। দুটো সমান বিপদ নয়।
গ। ইন্দিরা গান্ধীর পতন চেয়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের মদতপুষ্ট জনসঙ্ঘের ও জয়প্রকাশের আন্দোলনে যোগ দেওয়ায় বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনে ভুল বার্তা যাচ্ছে।
আমি এই সিদ্ধান্তের শরিক হতে পারছি না। এটা সংশোধনবাদী চিন্তা। আগামীতে বিপদ ডাকবে দেশের।
আজ যাঁরা বিজেপিকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হাত ধরে এনেছেন বলছেন, তাঁরা মিথ্যাচারণ করছেন। মমতা হাত ধরেছেন ১৯৯৯ এ।
তাঁর ১৪ বছর আগেই হাত ধরেছিল পশ্চিমবঙ্গ সিপিএম আর এস এসের।
শুধু তাই নয়, পয়সা ও প্রভাবের জোরে কেন্দ্রীয় কমিটিকেও বাধ্য করেছিল এই চূড়ান্ত হঠকারী সিদ্ধান্তে শরিক হতে।
বি টি রণদিভে পশ্চিমবঙ্গের পার্টিকে হিন্দুত্ববাদী ও অর্থনৈতিক সুবিধাবাদের শরিক মনে করতেন। সুন্দরাইয়ার মূল্যায়নও ছিল তাই। ব্রাহ্মণ্যবাদী মনে করতেন।
গান্ধী হত্যার পর আর এস এস ছিল অচ্ছুৎ।
তাদের মান্যতা দেন জয়প্রকাশ। এর আগে-
* আর এস এস হিন্দু কোড বিলের বিরোধিতা করেছে।
*মেয়েদের ডিভোর্সের অধিকারের বিরোধিতা করেছে।
* মেয়েদের সম্পত্তি দেওয়ার অধিকারের বিরোধিতা করেছে
* জমিদারি প্রথা বিলোপের বিরোধিতা করেছে। এখন কৃষি আইনের মারফৎ তাকে ঘুরপথে ফেরাচ্ছে।
* খনি ব্যাঙ্ক রেল বীমা তেল সংস্থার জাতীয়করণের বিরোধিতা করেছে। এখন সব বেচে দিচ্ছে।
* তপশিলি জাতি জনজাতির মানুষদের সংরক্ষণ দেওয়ার বিরোধিতা করেছে।
কংগ্রেসের মোরারজি দেশাই গোষ্ঠীর সঙ্গে মিলে। ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ মন থেকে মানতে না চেয়ে মোরারজির পদত্যাগ ইন্দিরা মন্ত্রিসভা থেকে। গুজরাটে গোধরায় জেলাশাসক থাকাকালীন গোধরার দাঙ্গায় মোরারজি দেশাইয়ের ভূমিকা ছিল ন্যক্কারজনক।
সেই মোরারজি দেশাইকে প্রধানমন্ত্রী করতে চেয়ে জনতা দল তৈরি হল।
ইন্দিরা গান্ধীর দোষ ছিল। কিন্তু তাঁর আমলে বিচারক তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্ব কেড়ে নেওয়ার রায় দিতে পেরেছিলেন।
তাঁর চাকরি জরুরি অবস্থাতেও যায় নি।
জয়প্রকাশ নারায়ণ সামরিক বাহিনীকে বিদ্রোহের আহ্বান জানিয়েছিলেন। পরিকল্পনা হয়েছিল, মার্কিন মদতে বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমানের মতো ইন্দিরাকেও হত্যার।
প্রয়াত ঐতিহাসিক হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, ইন্দিরা গান্ধী ২৪ জুন ১৯৭৫ য় সি আই এ র মদতে দক্ষিণপন্থীদের তৈরি করা ৩০০ জনের একটা তালিকা তাঁদের দেখান। খতম তালিকা। তাতে হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়েরও নাম ছিল।
ইন্দোনেশিয়া চিলি বাংলাদেশ তো সেই খতম অভিযানের সাক্ষী।
কোনটা বড়ো বিপদ চেনাটাই আসল কমিউনিস্ট পার্টির কাজ। প্রধান বিপদ আর অপ্রধান বিপদ না বুঝলে দলের দেশের এবং জাতির সর্বনাশ বাঁকা হয়।
ভুল তো একবার হয় নি।
বারেবারে।
মূর্খের মতো অনেকে বলছেন, বিজেপি এতো বড়ো বিপদ আগে বোঝা যায় নি।
মূর্খতা এবং শয়তানি এটা।
গোলওয়ালকর মুঞ্জে সাভারের বালাসাহেব দেওরস তা লিখে গেছেন পড়েন নি।
এরা তো অক্ষরে অক্ষরে তা পালন করছে।
আর এস এসের ইতিহাস জানতেন না। মুসোলিনি ও হিটলারের আদর্শে তৈরি।
দোষ তো আর এস এস বিজেপির নয়, তারা মিত্র চেয়েছে, সিপিএম মিত্র হয়েছে।
দুই জন সাংসদ ১৯১ হলো কাদের জোরে?
একটা ঘৃণিত অচ্ছুৎ দল নাম পাল্টিয়ে জনতা দল হলো।
ফ্যাসিবাদী মতাদর্শ কি ছাড়লো।
১৯৭৯ তে আদবানি বাজপেয়ি পরিষ্কার জানালেন, তাঁরা আর এস এস ছাড়বেন না।
জনতা দল দ্বৈত সদস্যপদ নীতিতে ভেঙে গেল। মোরারজি দেশাই, সকালে গোমূত্র পান করা, মোরারজি দেশাই, পদত্যাগ করলেন।
চরণ সিং প্রধানমন্ত্রী হলেন। যাঁর নাতি জয়ন্ত সিং গতকাল উত্তরপ্রদেশে প্রচণ্ড মার খেয়েছেন।
দশ বছর পর এবার তো সরাসরি বিজেপির হাত ধরা ১৯৮৯ এ।
রাজীব গান্ধীকে এক নম্বর শত্রু চিহ্নিত করে বোফর্স কেলেঙ্কারির নায়ক বলে চোর বলে বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংয়ের মন্ত্রিসভা গঠনের চেয়ার দুটি করে পায়া হলো সিপিএম নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট ও আর এস এস চালিত বিজেপি।
জানতেন না আর এস এসের মূল লক্ষ্য।
ইতিহাস পড়েন নি।
মুসোলিনি বামপন্থী সেজে ফ্যাসিবাদ কায়েম করেন নি।
আর এস এস তার আদর্শ রূপায়ণ করবে বলে লিখিত প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল?
এক বছরে ২ থেকে ৮৯ হলো মদত ছিলো না।
বাজপেয়ি আদবানির সঙ্গে ১৯৮৯ এ সুরজিৎ এবং জ্যোতি বসু বীরেন শাহের ঘরে বৈঠক করেন নি।
নেট দেখুন।
মানবেন না?
১৯৮৭র ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডের জনসভা মনে আছে?
হাত ধরে।
১৯৯৮ তো অনেক পরে।
জাতপাতের অভিশাপ
ভারতে জন্মালে লেনিন এবং স্তালিন বিপ্লবের স্বার্থেই জাতপাতের বিরুদ্ধেও লড়তেন। শ্রেণির সঙ্গে অগ্রাধিকার থাকতো জাতও। আম্বেদকর এ-রকম একটি কথা ভেবেছিলেন। তাঁর চিন্তায় শুধু লেনিন ছিল, আমার সংযোজন, স্তালিন। মুচির ছেলে দেশের প্রধান কল্পনাও করতে পারতো না ভারত। তবে তেলির ছেলেকে মানছে কেন? মানছে, কারণ, লুম্পেন প্রলেতারিয়েতই সামনে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করে, বুর্জোয়ার হয়ে। ভারতে ওবিসি তপশিলি জাতি জনজাতির একটা অংশ লড়ছে মনুবাদ বা ব্রাহ্মণ্যবাদের হয়ে।
এরাই দু:খজনকভাবে অগ্রণী।
এঁদের মধ্যে জাতের চেয়ে ধর্মের পরিচয় বড় হয়ে উঠেছে।
হওয়ার কথা ছিল, শ্রেণির পরিচয়।
কিন্তু ভারতে শ্রেণির কথা বলা ও ভাবার লোক খুব কম।
১৯৯৫ এ মার্চ মাসে ইদের দিনে যাদবপুরে তৎকালীন শাসকদল সিপিআই (এম)এর রাজ্য সম্মেলনে সীতারাম ইয়েচুরি ভাষণ দিতে গিয়ে একটা কথা বলেছিলেন, শ্রেণির সঙ্গে জাতের লড়াইও লড়তে হবে আমাদের।
বলা হল, আমরা সাংবাদিকরা গোপন খবর ফাঁসের মতো করে খুব লিখলাম।
'আজকাল' গুরুত্ব দিয়ে ছাপল।
পার্টি কংগ্রেস হলো। অনেক আশা করে থাকলাম, দিশা মিলবে। একটা প্লেনাম হবে, সালকিয়া ধাঁচে। কিছুই হলো না।
তার কিছুদিন আগে ১৯৯৩-এ ঘুরে এসেছি বেনারস। কোথাও গেলে সিপিএম পার্টি অফিস না গেলে মন ভরতো না। গেলাম। দেবাশিস ভট্টাচার্য বলে পার্টির এক সর্বক্ষণের কর্মীর সঙ্গে দেখা হলো। তাঁর মুখে শুনলাম, হতাশার কথা। বেনারস লোকসভা একসময় কমিউনিস্টরা জিততো। বললেন, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মন্ত্রিসভা ছাড়া ও 'চোরেদের মন্ত্রিসভা' বলা খুব ক্ষতি করেছে।
তাঁর বক্তব্য ছিল, পশ্চিমবঙ্গের পার্টির সরকারে থাকা ও কাজকর্ম দেশের পার্টি বিকাশে অন্তরায়।
খুব তর্ক করলাম। ঠিক নয় বললাম। কিন্তু কথাটা মাথায় রয়ে গেলো।
তারপর ১৯৯৫-এই একদিন আলিমুদ্দিনে বিনয় চৌধুরীর সঙ্গে ঘন্টাখানেক আড্ডা চললো সাংবাদিকদের। অনিল বিশ্বাসের ঘরে। অনিলদা তখন বাইরে। ওবিসি প্রসঙ্গ এল। বিনয় চৌধুরী বললেন, 'পশ্চিমবঙ্গে ওবিসি সেভাবে নেই। আমি তো বহু বছর কৃষক আন্দোলন করছি। রেশন কার্ড করতে গিয়েও দেখছি। আমরা ওবিসি নিয়ে ভাবছি না'।
আনন্দবাজার পত্রিকার সঞ্জয়দা আপত্তি করলেন। কিন্তু বিনয় চৌধুরী মানতে রাজি হলেন না, ওবিসি ফ্যাক্টর।