গ্রামে মোট তিনটি কাগজ আসতো। দুই কংগ্রেসির বাড়িতে দুটি। আদি কংগ্রেসির বাড়িতে 'আনন্দবাজার' নব কংগ্রেসির বাড়িতে 'যুগান্তর'। ১৯৭৭-র দু'জনের কাগজ বদলে গেল। 'যুগান্তর' বদলে 'আনন্দবাজার। 'আনন্দবাজার' বদলে 'যুগান্তর'।
আমি ক্লাস টু থেকেই খবরের কাগজ পড়ি। কাগজ আসার সময়সীমা নির্দিষ্ট ছিল না।
সেহারাবাজারে কেউ বাজার করতে গেলেই কাগজওয়ালা অশোক ঘোষ নাম লিখে দিয়ে দিতেন। পাশের গ্রাম পলাশনের মানুষ। সবাইকে চিনতেন। সেকালটাই ছিল এমন। আশপাশের পাঁচ দশটা গ্রামের মানুষ সবাই সবাইকে চিনতেন। বাজারেই হোক বা চাষের জমিতে হোক কিংবা বিয়ে শাদি বা মেলা কিংবা খেলার মাঠে দেখা হতোই।
আগেও বলেছি, আর একবার বলা যেতেই পারে, পশ্চিমবঙ্গের গ্রামের বৈশিষ্ট্য।
চারপাশে ছয় আটটা গ্রাম মাঝে গোল করে কয়েক হাজার বিঘা জমি।
আর আমাদের এলাকা দক্ষিণ দামোদর। বর্ধমান শহরের দক্ষিণ দিকে দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশনের এলাকায়।
লোকে বলতো, ডোবানো ভাসানো চোরপোরেশন।
ক্যানাল বা সেচ খাল ছিল। লোকমুখে ছিল কেনেল বা কেঁদেল। সেই ক্যানালের জল আগে পাওয়া বা পরে পাওয়া নিয়ে মাঝে মাঝেই গ্রামে গ্রামে দ্বন্দ্ব বাধতো। ১০/২০ মেইল ডুর থেকে লোক চলে আসতো মাঝরাতেও। কোন গ্রাম বাঁধ দিয়ে ক্যানাল কেটে মাঠে জল পাওয়াচ্ছে। সে-নিয়েও বাবাকে মাঝরাতে দৌড়াতে দেখেছি। সালিশি করতে। সালিশি মানেই খারাপ এ শহুরে ধারণা কবে যে যাবে! গ্রামে আদালতের প্রভাব কম ছিল এই সালিশির কারণে। এমনও হয়েছে, মাথায় টাঙির কোপ পড়েছে, থানা পুলিশ করলে দুজনের জীবন উকিলের কাছে বাঁধা। তাই সালিশি মিটমাটের চেষ্টা।
গ্রামে মেলা পার্বণ বিয়ে শাদির চেয়েও বড় ছিল ধান বোনা ও ধান তোলার ঘটনা। ধান তোলার সময় গ্রামে গ্রামে মাঠ পাহারা হতো। ধানের খড় দিয়ে ঘর বানিয়ে রাতে থাকা। আর টর্চ নিয়ে দেখা কেউ ধান চুরি করছে কিনা।
এই করতে করতেও আশপাশের গ্রামের মিলমিশ মারামারি সব হতো।
আমার গ্রামজীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ আকর্ষণ ছিল এই মাঠপাহারার দায়িত্ব পাওয়া। সপ্তাহে একদিন পালা পড়তো বাড়ি পিছু। মনে হতো রোজ যাই। ধানের খড়ের ঘরে কী উষ্ণতা অকল্পনীয়। আমি যদি নিজে ছবি বানাতে আপ্রি তবে এই দৃশ্য রাখবোই। সবচেয়ে ভয়ের ছিল, বউ মারার মাঠে রাখপাহারা। ভূতের ভয়ে যেতে চাইট না। আমি আর সিরাজ, বছর পাঁচেকের বড়, নাম ধরেই ডাকতাম, গ্রামের প্রথা অনুযায়ী, বেছে নিতাম ওই মাঠ। নুরপুর পলাশনের লোকদের সঙ্গে দেখা হতো। গল্প হতো। ওইটা ছিল আমাদের গ্রামের মির শেষসীমা। খানিকটা ভারত বাংলাদেশ চেকপোস্টের মতো। টর্চ, লাঠি, মুড়ি, বাঁশি ছিল আবশ্যিক । আর বিড়ি। বিড়ি আমি খেতাম না। এরসঙ্গে মজার ছিল, ঘড়ি দিয়ে হাঁক মারা। একজন হই দেবে সেই হইয়ের জবাব দেবে আরেকজন এইভাবে গোতা গ্রামের চারপাশে হাঁক পৌঁছাবে, কোনও চৌকি থেকে হাঁক না এলে পরের চৌকি দেখতে আসবে কিছু হলো কিনা। এখন ভাবতে আশ্চর্য লাগে, পাশের পাঁচ ছটি গ্রামও তো হাঁক বা হই দিত, কীভাবে আলাদা করতেন মানুষ?
এই যে রাতপাহারা, তার বিনিময়ে চাষিকে বিঘে পিছু দু গণ্ডা ধান দিতে হতো। সেই সব ধানের আটি জড়ো করে গোলামহলে ঝাড়া হতো। পাহারাদার গরিব মানুষদের ধান দেওয়া হতো এক বস্তা করে। বাকি ধান নিয়ে তৈরি হতো ক্লাবের ধর্মগোলা। লোকের অভাবে বিয়ে শাদি চিকিৎসা বা রাস্তা উন্নয়নে এই ধান কাজে লাগানো হতো।
ক্লাব আজকাল গালাগাল।
সেকালে ক্লাব ছিল আশির্বাদ।
পার্টি নোয়, ক্লাব ছিল নিরপেক্ষ বিচারের জায়গা। গ্রামের যাবতীয় সমস্যা ১৯৮৩ পর্যন্ত দেখেছি ক্লাব সমাধান করতো। মিলেমিশে।
সবকিছুতেই পার্টি ঢুকে ক্লাবের গ্রামের জনজীবনের খেলার যাত্রার নাটকের সংস্কৃতির সাড়ে সর্বনাশ হয়েছে।
গ্রামে তখন টিভি ছিল না। টিভি আসে ১৯৮৩তে। সেটিও সমবায়িক গ্রামজীবনের টিবি বা যক্ষ্মাস্বরূপ।
আগে ছিল রেডিও। ১৯৭৭এ কসমস ক্লাবের সঙ্গে মোহনবাগানের খেলায় পেলে বেকেনবাওয়াররা আসেন। তখন সাড়ে ছয় কিমি দূরে সেহারাবাজারের মিলমালিক দুর্গাবাবুরা টিভি এনে লায়কাবাজারের বাড়ির দোতলার ছাদে বেঁধে দেন। হাজার হাজার লোক মাঠ থেকে দেখেন। কী দেখেন তারাই জানেন। আম্মো কী ছিলাম!
গ্রামে প্রভাব ছিল রেডিও গুজব আর গ্রুপ মিটিংয়ের। গ্রুপ বৈঠক খুব করত কমিউনিস্ট পার্টী। ৮-১০ জনকে নিয়ে হ্যারিকেনের আলোয়।
এবং ওই খবরের কাগজের।
আমাদের বাড়িতে 'সত্যযুগ' পরে 'বসুমতী' আসতো। জীবনলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পাদনায়। জীবনলাল প্রশান্ত সরকার নিয়ে বড় করে লেখা দরকার। তিন কিমি দূরে গোপীনাথপুর যেতাম 'দর্পণ' বা 'বাংলাদেশ' আনতে। বা না হলে দিয়ে যেত বাদশা চাচার লোক। এবং সাপ্তাহিক 'দেশহিতৈষী'। বিশ্ব রাজনীতির সাপ্তাহিক খবর থাকতো 'দেশহিতৈষী'তে। আমি ছোট থেকে পাকা হয়েছি 'দেশহিতৈষী' পড়ে।
সেই সব পড়া থেকে আমার হিরো হয়ে উঠছিলেন সংঘ পরিবারের নানাজী দেশমুখ, আদবানি, রাজনারায়ণ এবং ফার্ণান্ডেজ।
একটাই কারণ, ওঁরা চরম ইন্দিরা বিরোধী।
আজ বুঝি ইন্দিরা শুধু স্বৈরাচারী ছিলেন না বহু কাজ করছেন দেশের জন্য।
ব্যাংক বীমা রেল খনি শিক্ষা স্বাস্থ্য পরিবহণ সরকারি ব্যবস্থা ন্যায় এনে দেশের প্রভূত উন্নতি করেছে নেহরু ও গান্ধী পরিবার।
একপেশে গাল দেওয়া যে কী খারাপ!