সব দলের দেওয়াল লিখনের তলায় ইংরেজি তথা রোমান হরফে নাম লেখার একটা প্রথা ছিল।
বিশেষ করে দেওয়াল দখলে ইংরেজি 'মাস্ট'।
অল ওয়াল ফর সিপিআই (এম) বা অল ওয়াল ফর কং... হামেশাই দেখা যেত।
অনেক সময় এ ডব্লিউ এফ লিখে দলের নাম লেখা হতো।
এবং একটা সময় দেওয়া থাকতো।
১৯৮০-৮৫ বা ৯০ তক দৌড়। ২০০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তখন ভাবতোই না। তখন ফি বছর হয় নির্বাচন নয় সম্মেলন নয় সমাবেশ কিংবা রাজনৈতিক দাবি দাওয়ার লিখন।
ফ্লেক্স তখন মানুষের কল্পনাতেও ছিল না।
কাপড়ে লেখা কিছু ব্যানার নারকেল দড়ি দিয়ে মাথার ওপরে টাঙানো হতো।
সংখ্যায় খুব কম।
সম্মেলন উপলক্ষে অভ্যর্থনা সমিতি গঠিত হতো। পরে এগুলোর নাম হয় রিসেপশন কমিটি।
সম্মেলনের দায়িত্ব সামলানোর জন্য নানা উপসমিতি হতো। খাদ্য, আবাসন, অর্থ, স্মরণিকা, সাংস্কৃতিক। পরিবহণ উপসমিতি প্রথম দিকে দেখিনি। পরে এসব উপসর্গ জোটে।
পেটের খাদ্য আর মনের খাদ্য এই দুইয়ে ছিল জোর বেশি। সম্মেলন উপলক্ষে ভালো নাটক গান কবিতার আসর বসতো। মানুষকে শিক্ষিত করার অনেক চেষ্টা থাকতো।
সেহারাবাজার স্কুলে পার্টির এক সম্মেলন উপলক্ষে শৌভনিক সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর মা নাটক দেখি। ১৯৮০ র প্রথম দিকে
গৌতম মুখোপাধ্যায় মা চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করেন।
আজও চোখে লেগে আছে।
আর একটা কথা, তখন সাইকেল ছেড়ে নেতারা মোটর সাইকেল চড়লে বা বিড়ি ছেড়ে সিগারেট খেলে সম্মেলনে সমালোচনা হতো। পরে আর হতো না। তবে এখনকার মতো ছোট অতি ছোটদের চার চাকা গাড়ি বা বৈভব অকল্পনীয় বিষয় ছিল। এখনকার শাসকদলের সম্মেলনে এসব নিয়ে কি কোনও সমালোচনা হয়? জানি না।
সত্তর দশকের মাঝামাঝি শোনা গেল সবুজ বিপ্লবের কথা। আগে শুধু লোকে অ্যামোনিয়া আর ইউরিয়া দিতেন চাষের সময়। এবার এল পটাশ, গ্রোমোর, ইফকো কোম্পানির নানা সার। তাঁদের প্রতিনিধিরা চাষিদের নিয়ে বৈঠক করতে লাগলেন। বড় চাষির জমিতে বিনা পয়সায় সার দিয়ে দেখিয়ে দিল, ধান কত বেশি হচ্ছে।
কেউ কেউ বললেন, সার দিয়ে দিয়ে জমির পোঙা মেরে দিচ্ছে। ছিবড়ে করে দিচ্ছে। কিন্তু সে কথা উন্নয়ন হাওয়ায় উড়ে গেল।
একে একে এরপর নতুন ধান এল। বেশি ফলনের লক্ষ্যে। পাঞ্জাব খাস, আই আর এইট, মিনিকিট, বসুমতী, মশুরি এবং চীনা ধান তাই চুং।
বিঘেতে ২৮ থেকে ৩০ মণ ধান দেখে লোকের তাক লেগে গেল। ছয় থেকে ১২ মণ ধান হলেই বিঘা পিছু লোকে বলতো খুব হয়েছে, সেখানে ২৮-৩০ মণ।
এই ধান কি জল খাচ্ছে বেশি? চাপা পড়ে গেল উন্নয়ন আওয়াজে।
সিপিএমের বদলের কথা লিখেছি ৪৮ পর্বে। এবার আত্মত্যাগের কথাও বলা জরুরি। কত কত মানুষ দেখেছি নিজের জীবন বিপন্ন করে রাতের আঁধারে মিটিং করতে বা শুনতে আসতেন।
অশোক ভট্টাচার্যের কথা বেশি করে মনে পড়ছে। পার্টি ক্ষমতায় আসার পর বড় নেতা হতে পারেন নি। ডিওয়াইএফ করতেন। সৎ আন্তরিক মানুষ। তখন ছাত্র ফ্রন্টের লোকরা বেশি গুরুত্ব পেতো আর কৃষক নেতারা। বাকিরা আছে থাকবে মিছিল মিটিং করবে এই আর কি! শিল্পাঞ্চলে ছিল শ্রমিক ও ছাত্র নেতাদের গুরুত্ব।
কৃষি এলাকায় ছাত্র নেতারাই কৃষক নেতা হতে শুরু করলেন। পার্টির ইচ্ছেতেই। আর শিল্পাঞ্চলে ছাত্র নেতাদের হতে হলো শ্রমিক নেতা। সেটাই সর্ব নাশের শুরু।
এঁরা তো কোনও কায়িক শ্রম করেন না। ফলে বাইরে থেকে দেখা।
এবং দায়িত্ব পেয়ে নিজের নেতৃত্ব কায়েম করতে গ্রুপ বাজি করা। ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। মৃণাল দাস, গৌরাঙ্গ চট্টোপাধ্যায়, জিয়াউরদা।
অশোক ভট্টাচার্য খুব ভালো বাগ্মী নন। কিন্তু দারুণ সহজ করে শোষণের বিরুদ্ধে বক্তব্য পেশ করতেন। ধনপতির দল কীভাবে মুনাফা করছে তার মুখেই শোনা। ১৯৭৪-৭৫র কোনও এক সময়ে। রাতের অন্ধকারে আসতেন ভোরে চলে যেতেন।
হেঁটে আসা হেঁটে যাওয়া।
আমাদের বৈঠকখানায় আলো নিভিয়ে বৈঠক হতো। গভীর রাতে। এক এক করে লুকিয়ে লুকিয়ে আসতেন সব। তিন খানা গ্রাম থেকে।
আমাদের বাড়ি থেকে মাত্র ১০০ মিটার দূরে কংগ্রেসের দুই নেতার বাড়ি।
খবর পেলেই মুশকিল।
এখন অবাক লাগে, কীভাবে রাতের অন্ধকারে সব কিছু গোপন রেখে চাপা স্বরে একজন বলে যেতেন বাকিরা মন দিয়ে শুনতেন।
কেউ কেউ টুকটাক প্রশ্ন করতেন।
আর আসতেন অমল হালদার। সোভিয়েত ইউনিয়নের কথা বলেছিলেন। সেখানে কেউ বেকার নেই। সবাই কাজ পায়। খেতে পায়। আমি তো বেশ ছোট। চুপ করে শুনতাম। অমলদা একবার থেকে গেলেন। আমি সাহস করে বললাম, আমি স্তালিনের কথা জানি।
বল তো, স্তালিনের ডাক নাম কী?
সোশো বইটি সদ্য পড়া।
বলে দিলাম গড়গড় করে অনেক কথা।
অমলদা বহুদিন আমাকে সোশো বলে ডাকতেন।
প্রশান্ত কাকুর কথা প্রথম খণ্ডে লিখেছি। তিনি কোনও সভা করতেন না। ছানিশালে শুতেন। বৈঠকখানায় অমলদা অশোকদা শুতেন। দাদার স্কুলের বড় দাদা বলে চালিয়ে দেওয়া যেতো। কংগ্রেসের নেতারা এঁদের চিনতেন না। কিন্তু প্রশান্ত কোলে বহু পরিচিত।
আগে এসেছেন। থেকেছেন। আর তাঁর বিশাল বড় গোঁফ দেখলেই চেনা যেত। কৃষক নেতা।
ষাটের দশক থেকে পার্টি করা।
আর একজন মানুষ ঘর থেকে উৎখাত হয়ে থাকতে এলেন। বাঁকুড়া জেলার ইন্দাস থানার পাহাড়পুর গ্রামের ডা. ইউনুস। তিনি হোমিওপ্যাথিক ও ইউনানি ডাক্তার হিসেবে খুব নাম করেছিলেন।
আমাদের বাড়িতে থাকতেন অনেক মানুষ। কেউ সন্দেহ করেননি। কিন্তু কংগ্রেসের এক নেতা আসতে শুরু করলেন। আমার বৈঠকখানায় বসে হোমিওপ্যাথি ওষুধ দিতেন লোককে।
একদিন একজনকে একটা ওষুধের নাম বলতে ইউনুস সাহেব বলে ফেলেন ওই ওষুধটা কি ঠিক হবে? এই রোগে এই ওষুধ দিলে ভালো হয়।
শুরু হয়ে গেল ঘোর সমস্যা।