এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে আসি।
আমাদের গ্রামে মুসলমানরা ৬৫ শতাংশ। হিন্দুদের ৩৫ % এর মধ্যে পঁচানব্বই শতাংশ তথাকথিত 'নিম্ন'বর্গের।
নিম্ন এবং উচ্চ এই দুটি শব্দেই আমার আপত্তি আছে।
কে উঁচু করে নীচু ঠিক করার মালিক কে বা কারা?
আমার বাবার নিবিড় যোগ ছিল সুবিধাবঞ্চিত গরিবদের সঙ্গে। তপশিলি জাতি জনজাতির বেশিরভাগ মানুষ গরিব। তাঁদের সঙ্গেই সখ্য বেশি। ওঠাবসা যাতায়াতও।
১৯৭৮-এ পঞ্চায়েত নির্বাচনে দুজন জিতলেন। একজন আমার বাবা আরেকজন তপশিলি জাতির মানুষ। ওই আসন সংরক্ষিত। তা ওই কাকা জেতার আনন্দে একদিন নিমন্ত্রণ করলেন। বাবার অবশ্য সঙ্গী আমি।
যাওয়ার আগে আমার ঠাকুমা বললেন, ভাই, তোর বাপ তো কিছুই মানে না। কাঁসার থালায় খায়। তুই চললি ভাই, মনে রাখিস, চাঁড়ালের ভাত হজম হয় না।
আমার বাবা কাঁসার থালা গ্লাসে খেতেন। লালু কাকা আদিবাসী। আমাদের সারা বছরের কৃষাণ। তাঁরও বরাদ্দ কাঁসার থালা। গ্লাস।
এনামেলের বাসন তাঁর জন্য নয়। কাঁসার থালা।
প্রতিবাদে বাবাও বোধহয় কাঁসার থালাতেই খেতেন।
'হিন্দু' বাড়িতে কাঁসার থালা সম্মানসূচক হলেও আমাদের বাড়িতে যতদিন ঠাকুমার শাসন ছিল, কাঁসার থালা ছিল সংরক্ষিত।
গেলাম। খেলাম। কাঁসার থালায় চুড়ো করে ভাত। পাশে আলু ভাজা, একটা সব্জি, ডাল আর হাঁসের মাংস। হাঁসের মাংস ততো মশলাদার নয়।
খেলাম তো বটে, মনে মনে খচখচ করতে লাগল, ভাতটা কি পাথর হয়ে পেটে থেকে যাবে।
রাত কাটলে, দিব্যি সব, পায়খানা হয়ে বেরিয়ে গেল।
তা অনেকেই বোধহয়, এখনো আমার ঠাকুমার মতো হয়ে আছেন।
মুসলমানরা যে জুতোয় সোজা এবং তাঁদের থালায় খেতে নেই একথাও ছিল। তবে বাড়াবাড়ি ছিল না।
আগে জেলেরা মাছ ধরতে এলে ঘরের বারান্দায় মুড়ি গুড় চা খেতো।
এখন শুনি, মুড়িও নিচ্ছে না কেউ।
দলিতদের এ-দেশে এখনও মানুষ হিসেবে দেখা হয় না। আড়ালে আবডালে 'সোনার চাঁদ সোনার থালা' নিয়ে কত ব্যঙ্গ শুনি।
২০০১-এ প্রেসিডেন্সি কলেজের ভর্তির সময় তপশিলি জাতির ছেলেমেয়েদের জেনারেলে নাম রাখায় আপত্তি উঠল। কোটায় থাকবে। আমি বললাম, আইন তা নয়। জেনারেলে সুযোগ পেলে জেনারেলেই দিতে হবে।
কাজ না হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় ছুটলাম। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের যুগ্ম নিবন্ধক নীতীশ বিশ্বাসের কাছ থেকে সার্কুলার এনে দিলাম।
চন্দননগর কলেজে এক বাংলার অধ্যাপিকা বিরাট উত্তেজিত। আমি যতদূর জানতাম, ও নিজে তপশিলি। বামুন বাড়ির বৌ। বক্তব্য, আরে এক এস সি জেনারেলে এক নম্বরে এসে যাচ্ছিল। অনেক অঙ্ক কষলাম। দু নম্বর হয়ে গেল। .২ কম।
সেবার ক্লাসের সেরা ছাত্রী ছিল এক তপশিলি জাতির কন্যা। বিজয়লক্ষ্মী বর্মণ। আসতো ১৬ কিমি দূর থেকে চালিয়ে। তেভাগাখ্যাত, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'ছোটবকুলপুরের যাত্রী'র আধার বড়াকমলাপুর থেকে।
কোটার ডাক্তার -- তো কত শুনি।
কোটায় পাস।
তা কেউ বলেন না মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক দুটোতেই প্রথম হয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গে প্রথম যে-জন, অরূপ দাস, আমাদের সংগঠন ভাষা ও চেতনা সমিতির একনিষ্ঠ ভক্ত শেফালি/ শুভ্রাদির ছেলে। শেফালি/ শুভ্রাদি চাকদহ থেকে প্রতিদিন আসতেন রবীন্দ্র সদন চত্বরে। সংস্কৃতির স্বাদ নিতে।
দলিতদের জীবনের কতটুকু আমরা জানি।
অপমান অবমাননা লাঞ্ছনার কথা। পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানরাও তো দলিত।
তাঁদের কথাও গৌরকিশোর ঘোষের 'প্রেম নেই' ছাড়া প্রায় প্রেমহীন।
উপন্যাস এবং ঔপন্যাসিকের কথা উঠলেই আমরা বঙ্কিমচন্দ্র রবীন্দ্রনাথ শরৎচন্দ্র, অন্নদাশঙ্কর রায় কথিত তিন বন্দ্যোপাধ্যায়, সতীনাথ ভাদুড়ী, সমরেশ বসু, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদারের কথা বলি।
অদ্বৈত মল্লবর্মণের কথা আসে না, আসে নি বন্ধনীতে।
'তিতাস একটি নদীর নাম' -এর মতো শক্তিশালী উপন্যাস বাংলা কেন বিশ্বসাহিত্যেও কম লেখা হয়েছে।
আজ পর্যন্ত কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্যের ইতিহাসে অদ্বৈত মল্লবর্মণ প্রশ্নপত্রে আসেন নি। উপন্যাস হিসেবে কোথাও কোথাও পাঠ্য যদিও।
আদিবাসী দলিত সাহিত্য লইয়া শোরগোল তো হইবেই।
এলিট-চিন্তা-হীন ছদ্ম-এলিটিজমে ঘা পড়িয়াছে যে।
'আবার একটা নতুন হৌল' বলিয়া।
ইদ আসার আগে আসতো রমজান।
রমজান তো এখন বলি। বলা হতো, রোজা আসছে। আমাদের তিনখানা গ্রাম মিলিয়ে ষাট সত্তর দশকে হাজার খানেক মানুষ। ষাটের দশকে গ্রামে কোনও মসজিদ নাই। দুর্গামন্দিরও নাই। দুর্গাপূজাও হতো না।
ছিল শিবমন্দির আর ওলাইচণ্ডীর থান।
খান পাঁচেক পীরতলা ছিল। কিন্তু তাঁদের মাহাত্ম্য তেমন ছিল না। লোকে পীরস্তান বলতে আড়াই কিলোমিটার দূরে পশ্চিমপাড়ার পুকুর ধারে যেত। সেখানে সংখ্যায় বেশি যেতেন হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ।
১৯৭৭-এর পর বাংলা তথা ভারতের রাজনীতিতে শুধু পরিবর্তন আসেনি ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়িও বাড়তে থাকে।
সংঘ পরিবারের শাখা সংগঠন জনসংঘের লোকরা কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভায় খুব গুরুত্বপূর্ণ পদ পান।
বিদেশমন্ত্রী হন অটলবিহারী বাজপেয়ী। ফলে বিদেশি রাষ্ট্র, বিদেশি দূতাবাস এবং বিদেশি সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে প্রভূত যোগাযোগ বাড়ে। আমেরিকাসহ নানা দেশে সংঘ পরিবারের শাখার উদ্যোগ বাড়ে। ইস্কন ভারত সেবাশ্রম ইত্যাদি সংগঠন শক্তিশালী হয়।
লালকৃষ্ণ আদবানি ইন্দিরা গান্ধির বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি মুখর মানুষদের একজন। রাজনারায়ণ, জর্জ ফার্নান্ডেজ এবং আর এস এস নেতা নানাজি দেশমুখকে নানাভাবে প্রচারমাধ্যম প্রচার দিতে থাকে। সাভারকরের বন্দনা শুরু হয় প্রচারমাধ্যমে। বলতে খারাপ লাগলেও সত্যি, গান্ধি নেহরু ও ইন্দিরা এবং সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের বিরুদ্ধে বলাই ছিল তখন বামপন্থীদের একমাত্র কাজ। কংগ্রেস যে একটাও ভালো কাজ করেছে তা কোনওদিন শুনিনি।